ফারাওয়ের মিসরের ওপর যে অভিশাপ বা গজবগুলো নেমে এসেছিল সেগুলোকে ইহুদীরা হিব্রুতে বলে থাকে ‘মাকৌৎ মিৎস্রায়ীম’ (מכות מצרים)। ইংরেজিত যা কিনা মিসরের প্লেগ (Plagues of Egypt) নামে পরিচিত। ইহুদীদের তাওরাত অনুযায়ী মোট দশটি গজব নেমে এসেছিল মিসরের ওপর, যার শেষে ফারাও তার দাসবন্দী ইসরাইলিদের (হিব্রুদের) মিসর ত্যাগের অনুমতি দেন।
ফারাওয়ের যে প্রশ্নের ফলে গজব নাজিল শুরু হয় সেটি ছিল, “কে এই মাবুদ যে, আমি তার কথা শুনে ইসরাইলকে ছেড়ে দেব? আমি মাবুদকে জানি না, ইসরাইলকেও ছেড়ে দেব না।” (তাওরাত, হিজরত, ৫:২) দশটি প্লেগ না পাঠিয়ে একবারেই ফারাওকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারতেন আল্লাহ, কিন্তু তা করেননি কেন? এর উত্তর ইহুদী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ বলেছিলেন, “কেননা এত দিনে আমি মহামারী দ্বারা তোমাকে (ফারাও) ও তোমার লোকদেরকে আঘাত করতে পারতাম; তা করলে তুমি দুনিয়া থেকে উচ্ছিন্ন হতে। কিন্তু বাস্তবিক আমি এজন্যই তোমাকে স্থাপন করেছি যেন আমার ক্ষমতা তোমাকে দেখাই ও সারা দুনিয়াতে আমার নাম কীর্তিত হয়।” (তাওরাত, হিজরত, ৯:১৫-১৬)
মুসা (আ) এর কাছে অপমানিত ফারাওয়ের রাগকে যেন তার সভাসদেরা আরও বাড়িয়ে দিল। প্রতিশোধ কত প্রকার আর কী কী তা ফারাও দেখিয়ে দেবেন মুসা (আ) এর জাতিকে। কিন্তু তার জন্য যে কতগুলো অভিশাপ অপেক্ষা করছিল তা তার কল্পনাতেই ছিল না। গজবগুলো পুরো মিসরকেই আক্রান্ত করেছিল, কিন্তু হিব্রুরা বেঁচে গিয়েছিল।
ইসলামের সাথে ইহুদী ধর্মে বর্ণিত মুসা (আ) এর এ ঘটনাগুলো প্রায় হুবহুই মিলে যায়, কেবল কিছু জায়গা বাদে, সেই জায়গাগুলোতে ইসলামে ঠিক কী ঘটনা টেনে ইহুদীদের বর্ণনার সেই নির্দিষ্ট অংশকে অস্বীকার করা হয়েছে, সেটি যথাসময়ে উল্লেখ করা হবে। তবে এ পর্যায়ে বলতে হয়, ইহুদী ও খ্রিস্টানরা যেখানে দশটি গজবে বিশ্বাস করে, ইসলামে কুরআন ও হাদিসে সেখানে দশম গজবটি সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। তবে এখন একে একে সেই গজবগুলোর কথায় আসা যাক।
প্রথম গজব: নদীর পানি রক্তে পরিণত হওয়া (דָם)
আল্লাহর আদেশ আসে, “তুমি তোমার লাঠি নিয়ে মিসরের পানির উপরে, দেশের নদী, খাল, বিল ও সমস্ত জলাশয়ের উপরে তোমার হাত বাড়িয়ে দাও; তাতে সেসব পানি রক্ত হয়ে যাবে এবং মিসর দেশের সর্বত্র কাঠ ও পাথরের পাত্রের পানিও রক্ত হয়ে যাবে।” (তাওরাত, হিজরত, ৭:১৯)
মুসা (আ) ও হারুন (আ) লাঠি নিয়ে মিসরের পানির ওপরে হাত বাড়িয়ে দেন। ফারাও ও সভাসদদের সামনেই তারা দুজন লাঠি তুলে নদীর পানিতে আঘাত করলেন। সাথে সাথে সমস্ত পানি রক্তে পরিণত হলো। নদীর মাছ মারা গেল, মিসরীয়রা পানি পান করতে পারলো না।
পরে ফারাওকে তুষ্ট করতে জাদুকরেরা তার সামনেই পানিকে রক্তে পরিণত করে দেখালো। এতে ফারাও স্বস্তি অনুভব করলেন এবং নিজ কক্ষে ফিরে গেলেন। কিন্তু মিসরীয়রা নদীর পানি পান করতে না পেরে পানির জন্য নদীর আশপাশে খনন করতে লাগলো।
দ্বিতীয় গজব: ব্যাঙের উৎপাত (צְּפַרְדֵּעַ)
প্রথম গজবের সাত দিন গত হবার পর দ্বিতীয় গজবের পালা। আল্লাহর আদেশ এলো, “আমার সেবা করার জন্য আমার লোকদেরকে ছেড়ে দাও। যদি ছেড়ে দিতে অসম্মত হও, তবে দেখ, আমি ব্যাঙ দ্বারা তোমার সমস্ত প্রদেশকে আঘাত করবো। নদী ব্যাঙে পরিপূর্ণ হবে; সেসব ব্যাঙ উঠে তোমার বাড়িতে, শয়নাগারে ও বিছানায় এবং তোমার কর্মকর্তাদের বাড়িতে, তোমার লোকদের মধ্যে… প্রবেশ করবে; আর তোমার, তোমার লোকদের ও তোমার সমস্ত কর্মকর্তাদের উপরে ব্যাঙ উঠবে।” (তাওরাত, হিজরত, ৮:১-৪)
হারুন (আ) গিয়ে মিসরের সমস্ত পানির উপরে তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। নদী থেকে ব্যাঙেরা উঠে এসে মিসর ছেয়ে ফেলল। অবশ্য জাদুকরেরাও তখন একই কাজ করে দেখালো, অর্থাৎ নদী থেকে ব্যাঙ উঠিয়ে আনা। তবে এতে ফারাওয়ের চিন্তা গেল না, কারণ, দেশের আসলেই ক্ষতি হচ্ছিল। তিনি মুসা (আ) ও হারুন (আ)-কে ডেকে বললেন, “তোমাদের মাবুদের কাছে ফরিয়াদ কর, যেন তিনি আমার কাছ থেকে ও আমার লোকদের কাছ থেকে এসব ব্যাঙ দূর করে দেন।” (হিজরত, ৮:৮) এতে ফারাও হিব্রু দাসদের চলে যেতে দেবেন এই কথা দিলেন। মুসা (আ) পরদিন প্রার্থনা করলেন ব্যাঙের বিষয়ে। ফলে তখনই বাড়িতে বা মাঠেঘাটের সব জায়গায় অজস্র ব্যাঙ মারা গেল। বেশ দুর্গন্ধও ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু ব্যাঙের আপদ তো গেল- এই ভেবে ফারাও আর মুসা (আ)-কে পাত্তা দিলেন না। ফলে তৃতীয় গজবের পালা এলো।
তৃতীয় গজব: উঁকুনের আক্রমণ (כִּנִּים)
আল্লাহ আদেশ করলেন, “তুমি তোমার লাঠি তুলে ভূমির ধূলিতে প্রহার কর, তাতে সেই ধূলি উঁকুনে পরিণত হয়ে সারা মিসর দেশ ছেয়ে ফেলবে।” (তাওরাত, হিজরত, ৮:১৬)
মুসা (আ) আর হারুন (আ) তা-ই করলেন। ফলে মিসরের সমস্ত ধুলি উঁকুনে পরিণত হলো। মানুষ আর পশুর উপর উঁকুনের উৎপাত প্রকটাকার ধারণ করলো। কিন্তু ফারাওয়ের মন গললো না এতটুকুও।
হিব্রু শব্দ কিনিম (כִּנִּים) এর অর্থ উঁকুন ছাড়াও মশাও হতে পারে, এমন অনুবাদও দেখা যায়।
চতুর্থ গজব: দংশকের আক্রমণ (עָרוֹב)
আল্লাহর বাণী এলো ফারাওয়ের উদ্দেশ্যে, “আমি তোমার উপর, তোমার কর্মকর্তাদের উপর, লোকদের ও সমস্ত বাড়ি-ঘরের উপর ডাঁশ মাছির ঝাঁক প্রেরণ করবো; মিসরীয়দের বাড়ি-ঘরগুলো, এমনকি তাদের বাসভূমিও ডাঁশ মাছিতে পরিপূর্ণ হবে।” (তাওরাত, হিজরত, ৮:২১)
মিসর দেশ ছেয়ে গেল একপ্রকারের কামড়ানো মাছির ঝাঁকে, তবে হিব্রুরা যে গোশেন এলাকায় থাকতো সেখানে পোকাগুলো যায়নি। হিব্রু শব্দ আরৌভ (עָרוֹב) দিয়ে এ পোকার ঝাঁক বোঝানো হয়। যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ফারাও অনুরোধ করলেন মুসা (আ)-কে যেন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, এবার তিনি যেতে দেবেন হিব্রুদের। মুসা (আ) প্রার্থনা করলে পরে পোকাগুলো সব চলে গেল, একটিও থাকলো না। এবারও ফারাও তার কথার বরখেলাপ করলেন।
পঞ্চম গজব: পশুর মৃত্যু (דֶּבֶר)
ফারাওকে মুসা (আ) এবার জানালেন আল্লাহর পক্ষ থেকে, “তোমার ক্ষেতে যেসব পশু রয়েছে, অর্থাৎ তোমার ঘোড়া, গাধা, উট, গরুর পাল ও ভেড়ার পালের উপর মাবুদের হাত রয়েছে; কঠিন মহামারী হবে।” (তাওরাত, হিজরত, ৯:৩)
পরদিন মিসরের সমস্ত ঘোড়া, গাধা, উট, গরুর পাল ও ভেড়ার পাল মারা গেল। তবে হিব্রুদের এলাকার কোনো পশু মরেনি। এ গজবের পর অবশ্য ফারাওয়ের মন একটুও টলেনি।
ষষ্ঠ গজব: বিষফোঁড়া (שְׁחִין)
আল্লাহ মুসা (আ) ও হারুন (আ)-কে বললেন, “তোমরা মুষ্টি পূর্ণ করে উনুনের ছাই নাও এবং মুসা ফারাওয়ের সামনে তা আসমানের দিকে ছড়িয়ে দিক। তা সমস্ত মিসর দেশব্যাপী সূক্ষ্ম ধূলি হয়ে সেই দেশের সর্বত্র মানুষ ও পশুদের শরীরে বিষফোঁড়া জন্মাবে।” (তাওরাত, হিজরত, ৯:৮-৯)
এটা করবার পর অবশ্য এবার জাদুকরেরাও কিছু করতে পারলো না, কারণ তারাও বিষফোঁড়ার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। কষ্ট হলেও ফারাও মুসা (আ) এর কথায় কান দিলেন না।
সপ্তম গজব: শিলাবৃষ্টি (בָּרָד)
“মিসরের পত্তন থেকে আজ পর্যন্ত যেরকম কখনও হয়নি, সেরকম প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি আমি আগামীকাল এই সময়ে বর্ষাবো। অতএব তুমি এখন লোক পাঠিয়ে ক্ষেতে তোমার পশু ও আর যা কিছু আছে সেই সমস্ত তাড়াতাড়ি আনাও; যে মানুষ ও পশু বাড়ির বাইরে ক্ষেতে থাকবে তাদের ওপরে শিলাবৃষ্টি হবে আর তাতে তারা মারা যাবে।” (তাওরাত, হিজরত, ৯:১৮-১৯)
প্রচণ্ড রকমের শিলাবৃষ্টি হলো মিসরে। মানুষ-পশু নির্বিশেষে প্রায় সবাই আহত হলো, ক্ষেতের ফসল নষ্ট হলো। খাবারের অভাবে দুর্ভিক্ষই লেগে গেল (অন্যান্য কিছু গজবের ফলেও এটা হয়েছিল)। কেবল গোশেন এলাকায় শিলাবৃষ্টি হলো না। ফারাও মুসা (আ) এর কাছে লোক পাঠিয়ে মাবুদের কাছে ফরিয়াদ করতে বললেন এ বৃষ্টি আর বজ্র থামাতে। মুসা (আ) নগরের বাইরে গিয়ে দোয়া করলেন। বৃষ্টি থেমে গেল, মেঘ সরে গেল। কিন্তু ফারাও কথা রাখলেন না। বনি ইসরাইল দাসই রয়ে গেল।
অষ্টম গজব: পঙ্গপাল (אַרְבֶּה)
“ইবরানীদের (হিব্রুদের) মাবুদ আল্লাহ্ এই কথা বলেন, তুমি আমার সম্মুখে নম্র হতে কতকাল অসম্মত থাকবে? আমার সেবা করার জন্য আমার লোকদেরকে ছেড়ে দাও। কিন্তু যদি আমার লোকদেরকে ছেড়ে দিতে অসম্মত হও, তবে দেখ, আমি আগামীকাল তোমার সীমাতে পঙ্গপাল নিয়ে আসবো।” (তাওরাত, হিজরত, ১০:৩-৪)
এবার সভাসদেরা ফারাওকে বললেন, এই আপদকে দেশ থেকে বিদায় হতে দিন অনুগ্রহ করে। এখানে থেকে এরা আমাদের ক্ষতির কারণই হচ্ছে কেবল। কিন্তু ফারাও শোনেন কার কথা!
যথাসময়ে পূর্ব দিক থেকে বয়ে যাওয়া বাতাসের সাথে এসে হাজির হলো পঙ্গপাল। এরকম অবস্থা মিসর আগে কখনও দেখেনি। পঙ্গপাল সমস্ত জায়গা আচ্ছন্ন করে ফেলল, মাটির যে সবুজ লতা ও গাছপালার যে ফল শিলাবৃষ্টি থেকে রক্ষা পেয়েছিল, সেসব পঙ্গপাল খেয়ে ফেললো; সমস্ত মিসর দেশে গাছ বা ক্ষেতের সমস্ত সবুজ লতাপাতা কিছুই রইলো না বাকি।
এবারও ফারাও একইভাবে মাবুদের কাছে ফরিয়াদ করতে বললেন মুসা (আ)-কে। মুসা (আ) এর দোয়ার পর পশ্চিম থেকে বাতাস এসে পঙ্গপাল তাড়িয়ে নিয়ে গেল। কিন্তু ফারাও যেতে দিলেন না বনি ইসরাইলকে।
নবম গজব: আঁধার (חוֹשֶך)
“তুমি (মুসা) আসমানের দিকে হাত বাড়িয়ে দাও; তাতে মিসর দেশ অন্ধকার হবে, যে অন্ধকার মানুষ খুব করে অনুভব করতে পারবে।” (তাওরাত, হিজরত, ১০ঃ২১)
তিন দিন পর্যন্ত সমস্ত মিসর দেশ গাঢ় অন্ধকারে ডুবে থাকলো। তিন দিন পর্যন্ত কেউ কারো মুখ দেখতে পেল না প্রাকৃতিক আলোতে। কিন্তু বনি ইসরাইলদের জন্য ছিল ব্যতিক্রম। এবার ফারাও ডেকে আনলেন মুসা (আ)-কে। বললেন, এবার তোমাদের ছেড়ে দেব। কিন্তু তোমাদের গবাদিপশু সব রেখে দিতে হবে।
বলা বাহুল্য, মিসরের সব পশু মারা গিয়েছিল, বনি ইসরাইলেরগুলো বাদে। কিন্তু মুসা (আ) রাজি হলেন না একদম। ফারাও রেগে গিয়ে বললেন, “আমার সামনে থেকে দূর হও, সাবধান, আর কখনও আমার মুখ দর্শন করো না; কেননা যেদিন আমার মুখ দেখবে, সেই দিনই তোমার মরণ হবে।”
মুসা (আ) বললেন, “ভালই বলেছেন, আমি আপনার মুখ আর কখনও দেখবো না।”
দশম গজব: প্রথম সন্তানের মৃত্যু (מַכַּת בְּכוֹרוֹת)
এ গজবের কথা ইহুদীরা বিশ্বাস করে থাকে, কারণ ইহুদীদের তাওরাত এ কথা বলছে। কিন্তু ইসলামে এ গজবের কথা উল্লেখ নেই, বাকিগুলো নিয়ে সমস্যা না থাকলেও। কারণ এ গজবটি একমাত্র গজব যেখানে মানুষের প্রাণ যাবে, এর আগেরগুলোতে কোনো মানুষ মারা যায়নি।
গজব সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, “তারপর আমি পাকড়াও করেছি- ফেরাউনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং ফল ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে যাতে করে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।” (কুরআন, সুরা আরাফ, ৭:১৩০) “আমি তাদের উপর পাঠিয়ে দিলাম তুফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত প্রভৃতি বহুবিধ নিদর্শন একের পর এক। তারপরেও তারা গর্ব করতে থাকল। বস্তুতঃ তারা ছিল অপরাধপ্রবণ। আর তাদের উপর যখন কোনো আযাব পড়ে তখন বলে, হে মূসা আমাদের জন্য তোমার পরওয়ারদেগারের নিকট সেই বিষয়ে দোয়া করো যা তিনি তোমার সাথে ওয়াদা করে রেখেছেন। যদি তুমি আমাদের উপর থেকে এ আযাব সরিয়ে দাও, তবে অবশ্যই আমরা ঈমান আনব তোমার উপর এবং তোমার সাথে বনী ইসরাঈলদেরকে যেতে দেব। অতঃপর যখন আমি তাদের উপর থেকে আযাব তুলে নিতাম নির্ধারিত একটি সময় পর্যন্ত, যেখান পর্যন্ত তাদেরকে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য ছিল, তখন তড়িঘড়ি তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করত।” (কুরআন, সুরা আরাফ, ৭:১৩৩-১৩৫)
মোট নিদর্শনের সংখ্যা হিসেবে কুরআনে বলা হয়েছে, “আমি মূসাকে নয়টি প্রকাশ্য নিদর্শন দান করেছি।” (কুরআন, সুরা বনি ইসরাইল, ১৭:১) অবশ্য, কোথাও কোথাও এর মাঝে লাঠি থেকে সাপ হয়ে যাওয়া, এবং বগল থেকে শ্বেতশুভ্র হাত বের করাকেও অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়েছে।
যা-ই হোক, ইসলামে না থাকলেও ইহুদী ও খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, দশম গজব ছিল মিসরের সকল পরিবারের প্রথম সন্তানের মৃত্যু, এমনকি পশুরও। তবে অবশ্যই বনী ইসরাইলের কারও না। তবে মধ্যরাতে মৃত্যুর ফেরেশতা মিসরের রাস্তায় নেমে এলে কেবল যে বাড়ির দরজায় ভেড়ার বাচ্চার রক্ত দিয়ে ছাপ দেখবেন, সে বাড়িকে রেহাই দেবেন। তাই মুসা (আ) বনী ইসরাইলিদের এ কাজটা করতে বললেন- বাড়ির দরজায় রক্তের ছাপ দেয়া। এই রেহাই দেওয়া, বা সেই বাড়িকে পাস (pass) করে যাওয়া থেকেই আসলে ইহুদীদের উৎসব পাসওভার (passover) এর সূচনা। ভেড়ার বাচ্চা হিব্রুতে ফেসাখ (פֶּסַח) নামে পরিচিত, তাই এ খুশিকে ইহুদীরা ‘ঈদুল ফেসাখ’ হিসেবে উদযাপন করে।
সেই রাতে ফারাওয়ের নিজের প্রথম সন্তান থেকে শুরু করে কারাগারের বন্দীর প্রথম সন্তান পর্যন্ত সবাই মারা গেল, এমনকি পশুদের ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। মাঝরাতে মিসরের সব ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেল, কারণ সব ঘরেই যে কেউ না কেউ মারা গেছে! সন্তান হারাবার রাগে-কষ্টে ফারাও রাতেই মুসা (আ) আর হারুন (আ)-কে ডাকলেন, বললেন, “তোমরা ওঠ, বনি-ইসরাইলকে নিয়ে আমার লোকদের মধ্য থেকে বের হয়ে যাও; তোমরা যাও, তোমরা গিয়ে তোমাদের কথা অনুসারে মাবুদের এবাদত কর। ভেড়ার পাল ও গরুর সমস্ত পাল সঙ্গে নিয়ে চলে যাও, যেমনটা চেয়েছিলে এবং আমাকেও দোয়া করো।” (তাওরাত, হিজরত, ১২:৩১)
সেদিন রাতেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে বনি ইসরাইল রাজি হয়ে যায় বের হয়ে যাবার জন্য মিসর থেকে। কিন্তু সবচেয়ে বড় অলৌকিকতা তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল সামনেই।
ইসলামে এ ‘দশম’ গজবের কোনো কথা নেই, তাছাড়া একজনের পাপের ভার অন্য মানুষ বহন করে না- এটাই ইসলামে প্রচলিত। তবে ফারাও কী কারণে অন্য গজবে রাজি না হলেও এবার রাজি হয়ে যান সে ব্যাপারে কিছু পাওয়া যায় না ইসলামে।
ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থে এ গজবগুলোর ঘটনা উল্লেখ থাকায় তারা এতে বিশ্বাস রাখেন বটে, কিন্তু ইতিহাসবিদরা বরাবরের মতোই সন্দিহান এ ব্যাপারে- আদৌ এগুলো হয়েছিল কি না। কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ মনে করেন, ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের শহর পি-রামেসিসে এ প্লেগগুলো এসেছিল। উইলিয়াম অলব্রাইটের মতো প্রত্নতত্ত্ববিদগণ অবশ্য এ দশ প্লেগের ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে বলেই মনে করেন। মিসরের উত্তর সিনাই এর আল-আরিশ (العريش) শহরে পাওয়া গেছে এক প্রাচীন পানি-আধার। সেখানে হায়ারোগ্লিফিকে লেখা প্রাচীন মিসরের সেই অন্ধকার ছেয়ে যাবার ঘটনা, এবং বিস্তারিতভাবেই!
মিসরের দ্বাদশ সাম্রাজ্যের সময় লেখা ইপুয়ের (Ipuwer) প্যাপিরাস বলছে, “নদীর পানি রক্ত হয়ে গেল।” অবশ্য এ প্যাপিরাসের সব কথা ধর্মগ্রন্থের কাহিনীর সাথে মেলে না।
মিসর ছেড়ে যাবার জন্য বেশ কিছু দূর চলে যাবার পরই ফারাও এর মনে জেগে ওঠে প্রতিশোধের আগুন। এবং এরপর তিনি তার বাহিনী নিয়ে পিছু নেন তাদের, সেখানে এমন কিছু ঘটনাও উল্লেখ আছে ইহুদী গ্রন্থে যার বিস্তারিত বিবরণ সাধারণত ইসলামি গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত নেই, অবশ্য অস্বীকারও করা নেই।
দশম পর্ব: দ্বিখণ্ডিত লোহিত সাগর, এক্সোডাসের সূচনা
এ সিরিজের পর্বগুলো হলো:
প্রথম পর্ব: ইহুদী জাতির ইতিহাস: সূচনা পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব: মিশরে যাবার আগে কেমন ছিল বনি ইসরাইল?
তৃতীয় পর্ব: হযরত ইউসুফ (আ): দাসবালক থেকে মিসরের উজির- ইহুদী জাতির ইতিহাস
চতুর্থ পর্ব: ইউসুফ-জুলেখার কাহিনীর জানা অজানা অধ্যায়
পঞ্চম পর্ব: মসজিদুল আকসা আর বাইতুল মুকাদ্দাসের ইতিবৃত্ত
ষষ্ঠ পর্ব: দাসবন্দী বনী ইসরাইল এবং হযরত মুসা (আ:) এর জন্ম
সপ্তম পর্ব: মিসরের রাজপ্রাসাদ থেকে সিনাই পর্বত
অষ্টম পর্ব: সিনাই পর্বত থেকে ফারাওয়ের রাজদরবার
নবম পর্ব: মিসরের অভিশাপ
দশম পর্ব: দ্বিখণ্ডিত লোহিত সাগর, এক্সোডাসের সূচনা
একাদশ পর্ব: মরিস বুকাইলি আর ফিরাউনের সেই মমি
দ্বাদশ পর্ব: তূর পর্বতে ঐশ্বরিক সঙ্গ এবং তাওরাত লাভ
ত্রয়োদশ পর্ব: ইসরাইলের বাছুর পূজা এবং একজন সামেরির ইতিবৃত্ত
চতুর্দশ পর্ব: জীবন সায়াহ্নে দুই নবী
পঞ্চদশ পর্ব: রাহাব ও দুই গুপ্তচরের কাহিনী
ষোড়শ পর্ব: জেরিকোর পতন এবং স্যামসনের অলৌকিকতা
সপ্তদশ পর্ব: এক নতুন যুগের সূচনা
বোনাস প্রাসঙ্গিক আর্টিকেল:
দ্য ফার্স্ট মুসলিম: একজন ইহুদীর চোখে মহানুভব হযরত মুহাম্মাদ (সা)