বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় সবজির একটি হলো আলু। সকল রূপেই যার মোহনীয় স্বাদের কারণে সব বয়সী মানুষের প্রিয় নাস্তার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানে আলুর সবচেয়ে পরিচিত ও সমাদৃত রূপ আলুর চিপস। এক হিসাবে দেখা দেখা গেছে, প্রতিবছর শুধু আমেরিকানরাই ১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড আলুর চিপস সাবাড় করে। বাংলাদেশেও আলুর চিপসের জনপ্রিয়তা দিনদিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদশের আলুর চিপস।
জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠা এই খাবারের ইতিহাস কিন্তু খুব বেশী পুরোনো নয়। প্রায় দেড়শ বছর আগে প্রচলন শুরু হয় আলুর চিপসের। চলুন তবে দেখি আসি কেমন ছিলো এই তারকা খাবারের ঐতিহাসিক পথচলা।
প্রচলিত মিথ
আলুর চিপসের জন্ম নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত যে গল্পটি সেটি আসলে মিথ। সে গল্প অনুযায়ী নিউইয়র্কের ছোট শহর সারাটোগার এক রিসোর্টের বাবুর্চি জর্জ ক্রাম অপ্রত্যাশিতভাবেই উদ্ভাবন করেছিলেন আলুর চিপসের। ১৮৫৩ সালের গ্রীষ্মের ঘটনা এটি। তৎকালীন ধনকুবের কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট রিসোর্টে এসে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অর্ডার করেছিলেন। তার সামনে পরিবেশনকৃত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই মোটা বলে ক্ষুব্ধ হয়ে ফেরত পাঠান বাবুর্চির কাছে।
বাবুর্চি ক্রাম ভ্যান্ডারবিল্টের সমালোচনা সহজভাবে নিলেন না। বিরক্ত হয়ে এরপর আলু অনেক পাতলা করে কেটে ভেজে পরিবেশন করলেন তিনি। আর নতুন ধরনের এই আলু ভাজার স্বাদে মুগ্ধ হয়েছিলেন ভ্যান্ডারবিল্ট। সেই থেকেই ক্রামের এই আলুর চিপসের প্রচলন শুরু হয়। সে সময় ‘সারাটোগা চিপস’ হিসেবেই পরিচিতি পায় এটি।
মিথের উৎপত্তি
‘জেএসটিওআর ডেইলি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্রামের চিপস উদ্ভাবন মিথ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ১৮৫৩ সালের সেই গ্রীষ্মে কর্নেলিয়াস ভেন্ডারবিল্ট যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন না। আবার ১৮৫৩ সারাটোগায় এই আলু ভাজা একদম নতুন বস্তুও ছিলো না। ১৮৪৯ সালের জুলাই মাসের ‘নিউইয়র্ক হেরাল্ড’ এর প্রতিবেদনে সারাটোগার এলিজা নামের এক বাবুর্চির বিখ্যাত পদ ‘আলু ভাজা’র প্রশংসা করা হয়েছিলো। এদিকে ক্রামের বিখ্যাত সেই গল্পটির প্রচলন শুরু হয় ১৮৮৫ সালে। এরও একশো বছর পর এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই গল্পে যুক্ত হন ভ্যান্ডারবিল্ট।
তবে জর্জ ক্রামের চিপস উদ্ভাবনের গল্পটি মিথ হলেও আলুর চিপসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে এই আমেরিকান বাবুর্চির অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৬০ সালে ক্রাম তার নিজের রেস্টুরেন্ট খোলার পর সেখানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু ছিলো ‘সারাটোগা চিপস’ এর ঝুড়ি।
প্রকৃত উদ্ভাবন ইতিহাস
ধারণা করা হয় শুরুর দিক আলুর চিপসের উদ্ভাবন হয়েছিলো একটি স্বাস্থ্যরক্ষা খাদ্য হিসেবে। সে সময় একে ক্রিস্প নামে ডাকা হত। ১৮১৭ সালে প্রকাশিত বৃটিশ ডাক্তার উইলিয়াম কিচিনারের বই “দ্য কুক’স ওরাকল” ছিলো যুক্তরাজ্যের বেস্টসেলার বইগুলোর একটি। ১৮২২ সালে এর নতুন সংস্করণে ফালি ফালি করে কাটা আলু ভাজার রেসিপি পাওয়া যায়। সেই রেসিপি অনুযায়ী আলুর খোসা ছাড়িয়ে কোয়ার্টার ইঞ্চি পুরুত্বে কেটে শুকর অথবা গরুর চর্বিতে ভাজতে হতো। আলু ভাজার পর ঠান্ডা হলে তা লবণ দিয়ে পরিবেশন করতে হতো।
ডাক্তার কিচিনারের মূল লক্ষ্য ছিলো সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রচলন। সে সময়ে অধিকাংশ মানুষ নিজের খাদ্যাভ্যাসের চেয়ে তাদের পশুর খাদ্য নিয়ে সচেতন ছিলো বেশী। তাই তাদের খাদ্যাভ্যাসে সচেতনতা সৃষ্টি করতে তিনি বইটি লিখেছিলেন। ভাবতে অবাক লাগলেও ভিক্টোরিয়ান যুগের সেই স্বাস্থ্যরক্ষা খাদ্যই বিপুল মানুষের মন জয় করে আজকের দিনের বিশ্বজয়ী জলখাবার আলুর চিপসে রূপান্তরিত হয়েছে।
নামকরণ
জায়গাভেদে আলুর চিপসের বিভিন্ন নাম প্রচলিত রয়েছে। আমেরিকান ও কানাডিয়ান ইংরেজিতে এই খাবারকে ‘চিপস’ বলেই অভিহিত করা হয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে পটেটো চিপস হিসেবেই পরিচিত এটি।
যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে স্বাভাবিক তাপমাত্রার আলুর চিপসকে ‘ক্রিস্প’ বলা হয়। ওসব অঞ্চলে ‘চিপস’ বলতে বোঝানো হয় গরম ফ্রেঞ্চ ফ্রাই জাতীয় খাবারকে। উত্তর নিউজিল্যান্ডে ঘরোয়াভাবে ‘চিপিস’ নামে পরিচিত হলেও বাণিজ্যিকভাবে সারাদেশে ‘চিপস’ হিসেবেই প্রচলিত এই খাবার।
বাংলাদেশে এটি সাধারণত ‘চিপ’, ‘চিপস’ নামে পরিচিত, তবে আঞ্চলিকভাবে একে ‘আলু ভাজা’ নামেও ডাকা হয়।
প্রথম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড
হারমান লে নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কর্মী হিসেবে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন দোকানে চিপস বিক্রয় শুরু করে ১৯২০ সালে। অল্প সময়ের মধ্যেই তার তৈরি চিপস জনপ্রিয়তা পায় মানুষের মাঝে এবং লে’জ ( Lay’s) চিপস হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
প্রথম দেশব্যাপী সফল বাণিজ্যিক ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে ওঠে লে এর কোম্পানি। ১৯৬১ লে তার কোম্পানিকে সালে ডলাস-বেইজড নাস্তা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রিটোর সাথে যুক্ত করেন। ফলে এই চিপসের প্রচলন আরোও বৃদ্ধি পায়। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় আলুর চিপসের ব্র্যান্ড লে’জ।
চিপস ব্যাগের প্রচলন
প্রচলন শুরুর কয়েক দশক ধরে ঝুড়ি, টিন বা কাচের বয়ামে পরিবেশিত হতো আলুর চিপস। এতে বেশী দিন টাটকা থাকতো না চিপস। অল্পদিনেই বাসি ও নরম হয়ে ভেঙ্গে যেত। এ সমস্যার সমাধান ঘটে চিপস ব্যাগের প্রচলনের পর।
লরা ক্লাফ স্কুডা ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরি পার্কের চিপস ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্য। তার কোম্পানির প্রধান সচেতনতা ছিলো উদপাদিত চিপস সতেজ ও টাটকা রাখা। এই লক্ষ্যে ১৯২৬ সালে স্কুডা তার কর্মীদের দ্বারা ওয়াক্স পেপার ইস্ত্রি করে ব্যাগের আকৃতি তৈরি করেন। এই ব্যাগের ভেতর চিপস সংরক্ষন করে ব্যাগের মুখ ইস্ত্রি করে বন্ধ করে দেয়া হয়। এর ফলে চিপস অনেকদিন টাটকা থাকে এবং ভেঙ্গে যাওয়াও রোধ করা যায়।
চিপস ব্যাগে সংরক্ষণের তারিখ লেখার প্রচলনও শুরু করেন লরা স্কুডা। স্কুডার এই ব্যাগ তৈরির চিন্তা ও সে সময় সেলোফেনের আবিষ্কার চিপস বাণিজ্যকরণে নতুন যুগের সূচনা করে। বর্তমানে প্লাস্টিকের ব্যাগে নাইট্রোজেন গ্যাসসহ চিপস সংরক্ষণ করা হয়।
ফ্লেভারযুক্ত চিপস তৈরি
বর্তমানে আমরা যেসব চিপস খাই তা বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় স্বাদে পরিবেশিত হয়। চিংড়ি, মুরগির মাংস, চকলেট,চিজ ইত্যাদি নানাধরণের বিচিত্র ফ্লেভারের আলুর চিপসে অভ্যস্ত বিশ্ববাসী। এখন যদি আমাদের বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের সেই আদি চিপস খেতে দেয়া হয়, তবে তা নিশ্চয়ই বিস্বাদ ও ম্যাড়ম্যাড়ে লাগবে সবার কাছেই। সেক্ষেত্রে আমাদের সবার উচিত জো ‘স্পাড’ মারফি নামক ব্যক্তিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা। কারণ তার উদ্যোগেই যে প্রথম চিপসে বিভিন্ন ফ্লেভার যোগ করা শুরু হয়!
১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত আলুর চিপস ছিলো নিতান্তই সাদামাটা মশলাহীন এক খাবার। চিপসের প্যাকেটে এমনকি লবণও দেওয়া থাকত না। ১৯৫৪ সালে আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী মারফি প্রতিষ্ঠা করেন তার চিপস কোম্পানি টেটো। মারফি প্রচলিত সাদামাটা চিপস একেবারেই পছন্দ করতেন না। তাই চিপসের স্বাদের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়ে তিনি চিপসে যোগ করেন নানাধরনের মশলা। টেটো কোম্পানির চিপসে যুক্ত প্রথম ফ্লেভার ছিলো পেয়াজ ও চিজ এর ফ্লেভার। লবণ ও ভিনেগার তাদের আরেকটি জনপ্রিয় ফ্লেভার। উভয় ফ্লেভারই বর্তমান সময়েও বিপুল জনপ্রিয়।
আমেরিকায় প্রচলিত প্রথম চিপসের ফ্লেভার হলো টক ক্রিম ও পেয়াজ এবং বারবিকিউ ফ্লেভার। ফ্লেভারযুক্তকরণ আলুর চিপসের ইতিহাসে আরেক নতুন অধ্যায়ের শুরু করে।
বর্তমানে প্রচলিত আলুর চিপসের রেসিপি
প্রচলন ও আধুনিকরণের ইতিহাস যতটা লম্বা আলুর চিপস তৈরির প্রক্রিয়া কিন্তু ততো লম্বা নয়। অল্প সময়ে ঘরেই তৈরি করা যায় আলুর চিপস। তবে চলুন জেনে নেই জনপ্রিয় এই জলখাবার তৈরির রেসিপি।
উপকরণ –
- খোসা ছাড়ানো আলু
- তেল
- লবণ
- প্রয়োজনীয় স্বাদের মশলা
বানানোর পদ্ধতি-
- প্রথমে আলু পাতলা করে কেটে ধুয়ে পানি ঝড়িয়ে নিতে হবে। চিপস কাটার জন্য বিভিন্ন আকৃতির স্লাইসারও ব্যবহার করা যায়।
- কড়াইয়ে গরম ডুবো তেলে আলুর স্লাইস গুলো সোনালী করে ভাজতে হবে।
- তেল থেকে নামিয়ে ঠান্ডা হলে চিপসের উপর লবণ ও ইচ্ছামতো স্বাদের মশলা ছড়িয়ে দিলেই তৈরি হয়ে যাবে মজাদার স্বাদের আলুর চিপস।
- তেলে ভাজা ছাড়াও ওভেন বেকড আলুর চিপস বানানো হয়।
আলু নিয়ে আরও জানতে আজই পড়ুন এই বইগুলো
৩) বাংলাদেশে আলু টমেটো ও বেগুনের চাষ
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/