৮ আগস্ট ১৯৬৩। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। গ্লাসগো থেকে ইউস্টনগামী মেইল ট্রেনের কর্মীরা চলন্ত ট্রেনেই নিজেদের কাজ গোছাতে ব্যস্ত। লন্ডনে পৌঁছানোর আগেই ট্রেনে থাকা চিঠিপত্র আর পার্সেল সব গুছিয়ে রাখছে তারা।
ট্রেনের লম্বা কামরার সারির সবগুলোতেই সমান তালে কাজ চলছে। তবে এর মাঝে সামনে থেকে দ্বিতীয় বগিতে আছে বেশিরভাগ মূল্যবান জিনিসপত্র। রেজিস্ট্রি করা মূল্যবান পার্সেল আর চিঠিগুলো সাধারণত পরিবহণ করা হয় এই বগিতে। প্রতি যাত্রায় সাধারণত লাখ তিনেক পাউন্ডের মতো অর্থ সেখানে পরিবহণ করা হয়। কিন্তু সেবারে সাধারণ সময়ের তুলনায় ঢের বেশি অর্থ ছিল সেখানে। স্কটল্যান্ডে ব্যাংকের বিশেষ ছুটির দিন থাকার কারণ প্রায় তেইশ লাখ পাউন্ড নিয়ে যাচ্ছিল ডিজেলচালিত ট্রেনটি।
ভোর তিনটার দিকে লেইটন বুজার্ড অতিক্রম করে গেলো তারা। সামান্য একটু এগোতেই সিয়ারস ক্রসিং নামের এক জায়গায় ট্রেনচালক জ্যাক মিলস দেখতে পেলেন, রেলের লাল বাতি জ্বলে আছে। দক্ষ চালক সেই লাল বাতি দেখে ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা করলেন দ্রুত হাতে। আসলে সিগনালটি তৈরি করা হয়েছিল তাকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে। মূল সিগন্যাল বাতির সবুজ আলো হাতের দস্তানা দিয়ে ঢেকে দিয়ে, ছয় ভোল্টের একটি ব্যাটারির সাহায্যে লাল বাতিটি জ্বালিয়ে রাখা হয়েছিল।
ট্রেন থেমে যেতেই সহকারী চালক ডেভিড হুইটবি ইঞ্জিন রুম থেকে নেমে এলেন। সামনের লাইনে কী সমস্যা হয়েছে, তা জানার জন্য সিগন্যালম্যানের সাথে ফোনে যোগাযোগ করবে বলে। রেল লাইনের পাশে বসানো টেলিফোনের তার কাটা অবস্থায় দেখতে পেয়ে ঘটনা কিছুটা আঁচ করতে পারলেন হুইটবি। দ্রুত ট্রেনের দিকে ফিরে যাবার জন্য রওনা হন তিনি। কিন্তু সেখানে আগে থেকেই ওঁত পেতে ছিল এত কিছু করে ট্রেন থামানো ট্রেন ডাকাত দলের এক সদস্য। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করে সেই ডাকাত। শুধু আক্রমণ নয়, খাড়া রেলবাঁধ থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলা হয় তাকে।
অন্যদিকে মুখোশ পরা অন্য এক ডাকাত ট্রেনের ইঞ্জিন রুমে উঠে আসে। বিপদ সম্পর্কে অসচেতন জ্যাক মিলসকে মাথায় বাড়ি মেরে সহজেই অজ্ঞান করে ফেলে সে। ট্রেন দখলের কাজ শেষ করে পরবর্তী কাজে লেগে পড়ল তারা। ১৫ সদস্যের ডাকাত দল। সংখ্যায় কেবল ভারি নয়, একেবারে গোছানো পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে তারা। সিয়ারস ক্রসিং জায়গাটা খাড়া আর সঙ্কীর্ণ। এখান থেকে সরাসরি লুটের অর্থ নিয়ে সটকে পড়া সম্ভব নয়। তবে সে ব্যাপারেও আছে তাদের পরিকল্পনা।
ট্রেনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলো যে প্রথম দুই বগিতে রাখা হয়, তা তারা আগেই খোঁজ নিয়ে রেখেছিল। তাই চুপিসারে ইঞ্জিন আর প্রথম দুটি বগি ট্রেনের বাকি কামরাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সামনের এই দুই বগিতে থাকা পোস্ট অফিস কর্মীদেরকে ডাকাত দলের কয়েকজন সদস্য আটকে রাখে। বিচ্ছিন্ন করে দেয়া পেছনের ১০টি বগির কর্মীরা কিছু জানতেও পারেনি যে কী নাটক চলছে ট্রেনের সামনের অংশে!
ডাকাতদের ইচ্ছা, সিয়ারস ক্রসিং থেকে মাইলখানেক সামনে ব্রাইডগো ব্রিজের কাছে তারা ট্রেনটি নিজেরাই চালিয়ে নিয়ে যাবে। তারপর সেখান আগে থেকে তৈরি থাকা গাড়িতে করে লুটের অর্থ নিয়ে পালাবে। এতক্ষণ পর্যন্ত সব পরিকল্পনামাফিক চললেও এবার প্রথমবারের মতো ঝামেলায় পড়লো ডাকাত দল। পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী, দলের এক সদস্য বিগত কয়েক মাস ধরে রেল কর্মীদের সাথে সখ্য গড়ে তুলেছিল এই বলে যে, সে ট্রেন চালানোর ব্যাপারে আগ্রহী। সে কারণে বহুবার সে বিভিন্ন লোকাল ট্রেনের ইঞ্জিন রুমে ভ্রমণ করতে পেরেছে; আর বারকয়েক ট্রেন চালানোর সুযোগও পেয়েছে। এই ডাকাত সদস্যের কাজই ছিল চালককে অজ্ঞান করার পর ট্রেনটিকে চালিয়ে ব্রাইডগো ব্রিজ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া।
কিন্তু, ইঞ্জিন রুমে প্রবেশ করেই সে বুঝতে পারল, এ ট্রেন তার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। কারণ এতদিন সে যে লোকাল ট্রেন চালানো দেখেছে বা চালিয়েছে, তার সাথে এই বিশাল ডিজেল ইঞ্জিনের খুব একটা মিল নেই। এই ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা অনেক জটিল। কিন্তু এত সূক্ষ্ম পরিকল্পনা আর এতদিনের অপেক্ষা কিছুতেই মাঠে মারা যেতে দিতে রাজি নয় অন্য সদস্যরা। দলের অন্যতম প্রধান রনি বিগস তাই অজ্ঞান ট্রেন চালক জ্যাক মিলসকে সজাগ করে। তারপর তাকে বাধ্য করে, ট্রেন চালিয়ে তাদের কথামতো নির্দিষ্ট যায়গায় নিয়ে যেতে।
ব্রাইডগো ব্রিজে পৌঁছে ডাকাতরা ১২০টি বস্তাভর্তি প্রায় আড়াই টন ওজনের অর্থ নামিয়ে নেয়। পরিকল্পনাতে কোনো ফাঁক রাখতে নারাজ তারা। সব কাজ শেষ করে তারা পোস্ট অফিস কর্মীদের শাসিয়ে রেখে যায়, যাতে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে পুলিশের সাথে কেউ যোগাযোগের চেষ্টা না করে। কিন্তু একথার মধ্যেই তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র রেখে দিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে এই ত্রিশ মিনিটের ব্যাপারটা থেকেই তদন্তকারীরা বুঝে নেয় যে, ডাকাতদের লুকোনোর জায়গা লুটের জায়গা থেকে আনুমানিক ত্রিশ মিনিটের পথের মাঝেই হবার সম্ভাবনা বেশি।
আসলে তা-ই করেছিল ডাকাতরা। ওকলে বাকিংহামশায়ারের জীর্ণ এক ফার্ম তারা ভাড়া করেছিল লুকিয়ে থেকে অর্থ ভাগ করে নিয়ে, যে যার মতো পালিয়ে যাবার জন্যে। পরবর্তী সময়ে প্রমাণ পাওয়া যায়, সেখানে অর্থ ভাগ করা ছাড়াও সত্যিকারের অর্থ ব্যবহার করে মনোপলিও খেলেছে তারা!
এত বড় মাপের ট্রেন ডাকাতির ঘটনা পুরো দেশ জুড়ে আলোড়ন তৈরি করে। বড় আকারের তদন্ত দল গঠন করা হয় এই রহস্য সমাধানের জন্যে। সেই দল পরিচালনার দায়িত্বে রাখা হয় বিখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর বাকিংহামশায়ার পুলিশের অভিজ্ঞ গোয়েন্দাদের। মূল দায়িত্ব অর্পণ করা হয় চিফ সুপারিনটেনডেন্ট জ্যাক স্লিপারের হাতে। ব্রিটিশ পরিবহন পুলিশকেও কাজে লাগানো হয় ছোটখাট কাজ, যেমন- সন্দেভাজনের তালিকা তৈরি, স্টাফদের তালিকা তৈরি আর অনুসন্ধান ইত্যাদি কাজে।
ওদিকে ফার্মে বসে বেশ চিন্তায় পড়ে যায় ডাকাতেরা। এর একটি কারণ, তাদের ধারণার চাইতে অনেক বেশি অর্থ সেই ট্রেনে ছিল, আর সেগুলো উদ্ধারের জন্যে সরকার পক্ষ কোনো ত্রুটি রাখবে না তা বেশ ভালোই বুঝতে পারে তারা। তার উপর ফার্মে বসে তারা দেখতে পায়, একেবারে নিচ দিয়ে কিছু প্লেন বারবার উড়ে যাচ্ছে। যদিও পুলিশের তদন্তের সাথে এই প্লেনগুলোর কোনো সম্পর্ক ছিল না। সেগুলো নিছক ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্যে ওড়ানো হচ্ছিল। কিন্তু ডাকাতরা তো আর সে খবর জানত না।
এ মানসিক চাপের মাঝেই তাদের ভাগাভাগির কাজ শেষ হয়। এক আর পাঁচ পাউন্ডের নোটগুলো থেকে নিজেদের অংশ আলাদা করে নেয় তারা। আগের পরিকল্পনা ছিল, তারা সবাই এই ফার্ম হাউজে কয়েক সপ্তাহ গা ঢাকা দিয়ে থেকে এরপর যে যার মতো চলে যাবে। কিন্তু বিগস অপেক্ষা করতে নারাজ। সে তার প্রাপ্য এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার পাউন্ড নিয়ে সেখান থেকে তখনই চলে যায়। বাকিরাও ধীরে ধীরে চলে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
এতগুলো অপরিচিত মানুষের সন্দেহজনক চলাচলের কারণে ফার্মের কাছাকাছি বাস করা এক প্রতিবেশীর মনে সন্দেহ হয়। সে পুলিশের কাছে ব্যাপারটা জানায়। সংবাদ পেয়ে পুলিশ সেই ফার্ম হাউজে অভিযান চালায়। কিন্তু যতক্ষণে সেখানে পুলিশ গিয়ে পৌঁছায়, ততক্ষণে ডাকাতরা সেখান থেকে চলে গেছে। জন ওলির নেতৃত্বে চালানো সে অভিযানে পুলিশদল ডাকাতদের ধরতে ব্যর্থ হলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র তারা খুঁজে পায়। যার মাঝে ছিল ফেলে যাওয়া খাদ্য রসদ, সেলার আর উপরের ঘরে ঘুমানোর বিছানাপত্র। পোস্ট অফিসের বস্তা, টাকার বাণ্ডিলের মোড়ক আর রেজিস্ট্রি করা খালি খাম।
ডাকাত দলের সদস্যরা ঘটনার সময় মুখ ঢাকা অবস্থায় ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা তখন কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি। সে কারণে এতদিন পর্যন্ত কারা এই ডাকাতির সাথে জড়িত, সে ব্যাপারে অন্ধকারেই ছিল তদন্তকারী দলের সদস্যরা। তবে ফার্মে ফেলে যাওয়া নানা জিনিস থেকে আঙুলের ছাপ উদ্ধার করে এবার প্রায় সবার পরিচয় জানতে সক্ষম হয় তারা। বিশেষ করে ফেলে যাওয়া মনোপলি বোর্ড আর কেচাপের বোতল থেকে ছাপগুলো সংগ্রহ করা হয়। শনাক্ত হয়ে যাওয়ার পর গ্রেফতারি পরোয়ানা আসতে দেরি হয়নি। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে একে একে গ্রেফতার হতে শুরু করে ডাকাতেরা।
এ ডাকাতির পেছনের মূল হোতা ব্রুস রেইনল্ডসকে খুঁজে পেতে পুলিশ দলের সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ বছর। তাকে দশ বছরের সাজা দেওয়া হয়। ডাকাত দলের অন্যতম সদস্য রনি বিগসকে সাজা দেওয়া হয় ত্রিশ বছরের। কিন্তু পনেরো মাসের মাথায় ওয়ান্ডসওয়ার্থ জেল থেকে পালায় সে। স্পেন আর অস্ট্রেলিয়া হয়ে সে ব্রাজিলে পৌঁছায়, আর সেখানেই গা ঢাকা দিয়ে নিজের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ২০০১ সালের মে মাসে সে আবারও যুক্তরাজ্যে ফিরে আসে এবং তখন তাকে গ্রেফতার করা হয়।
এই ট্রেন ডাকাতির সাথে জড়িত সব সদস্যের কারাভোগের সাজার সময় যোগ করলে দাঁড়ায় ৩০৭ বছর। এত টাকা চুরি করার পরও এদের কারো জীবনে শান্তি মেলেনি। বাস্টার এডওয়ার্ডস নামের এক সদস্যের শেষ জীবন কাটে ওয়াটার লু স্টেশনে ফুল বিক্রি করে। যদিও সে আলোচনায় আসে ১৯৮৮ সালে ফিল কলিন্সের ‘বাস্টার’ সিনেমায় অভিনয় করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে সে আত্মহত্যা করে। জেমস হাসি এবং টমাস উইসবি নামের অপর দুই সদস্য মাদক চোরাচালানের দায়ে আবারও দোষী সাব্যস্ত হয়। চার্লস উইলসন নামের অন্য এক ডাকাত স্পেনে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়।
ডাকাতির পরিকল্পনা থেকে করে দেখানোর কাজটি তারা করেছিল অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। যেখানে ট্রেনচালক আর সহকারীকে আক্রমণ করা বাদে আর কোনো সংঘাতের খবর পাওয়া যায় না। এমনকি এত বড় ডাকাতিতে কোনো রকমের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কথাও জানা যায় না। ইতিহাসের পাতায় ‘দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি’ স্থান করে নিতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু নিজেদের নিয়তিকে এই ডাকাতরা কোনোভাবেই ঠেকাতে পারেনি।