‘হানি ট্র্যাপ’ শব্দ যুগলকে দেখে ভ্রু কুঁচকানোর দরকার নেই। শিরোনামের বাকি অংশ দেখে আপনি যা ভাবছেন ঠিক তা-ই আসলে বোঝাচ্ছে এই শব্দ দুটি। কিন্তু এই ট্র্যাপ তথা ফাঁদ সাধারণ কোনো উদ্দেশ্য কিংবা নিছকই মজা করার উদ্দেশ্যে পাতা হয় না। বরঞ্চ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে, যিনি হতে পারেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, গোয়েন্দাসহ যে কেউ, মূল্যবান কোনো তথ্য কিংবা অর্থ হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যেই এমন চাতুর্যপূর্ণ ফাঁদ পাতা হয়ে থাকে।
বর্তমান দুনিয়ার হালচাল সম্পর্কে অবগত থাকলে এমন ঘটনা আপনার কাছে নতুন কিছু হবার কথা না। তবে আজ যে ঘটনাগুলো জানাতে এই লেখার অবতারণা, সেগুলো স্বল্প পরিচিতই বলা চলে। দেরি না করে তাই চলুন গোয়েন্দাগিরির সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু হানি ট্র্যাপের কথাই জেনে আসা যাক।
১
গোয়েন্দাগিরির কথা আসবে অথচ ইসরায়েলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কথা আসবে না সেটা আবার হয় নাকি! এজন্য এই লেখার শুরুর কাহিনীটা মোসাদ সংক্রান্তই।
মরদেচাই ভানুনু নামে এক ইসরায়েলী টেকনিশিয়ান কাজ করতো দেশটির দিমোনা নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটিতে। ১৯৮৬ সালে সে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের কাছে গিয়ে দাবি করে বসলো, ইসরায়েলের কাছে নাকি পারমাণবিক বোমা আছে!
এমন কথা শুনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের তো মাথা নষ্ট হবার দশা। ওদিকে ভানুনুর পেশাগত অবস্থান দাবিটাকে একেবারে অযৌক্তিকও বলার সুযোগও দিচ্ছিল না। সানডে টাইমস এ সময়টায় তাকে লন্ডনেরই এক জায়গায় লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে নিজেরাই তার দাবির সত্যতা যাচাইয়ে নেমে পড়েছিল।
কিন্তু ভানুনুর এই বন্দী জীবন একেবারেই ভাল লাগছিল না। লন্ডনের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘোরার সময় এক সুন্দরী নারীর সাথে দেখা হয়েছিল তার। তারা দুজন আবার দেখা করার পরিকল্পনা করেছিল। তবে সেটা লন্ডনে না, রোমে। একজনের এমন প্রেমযাত্রায় বাধা দেয়াটা ভাল দেখায় না দেখে সানডে টাইমস কর্তৃপক্ষও আর তাকে থাকবার ব্যাপারে জোরাজুরি করল না। এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল।
মনের মানুষের সাথে রোমে ভানুনু পৌঁছেছিল ঠিকই, কিন্তু এরপরই মোসাদ এজেন্টদের হাতে আটক হয় সে। জোর করে তার দেহে নেশাজাত দ্রব্য প্রয়োগ করে ইতালি থেকে জাহাজে করে সোজা ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়।
দেড় যুগ জেলে কাটাবার পর ২০০৪ সালে মুক্তি মেলে ভানুনুর। তবে সেটাকে পুরোপুরি মুক্তি বলারও উপায় নেই। অনেক রকম বিধিনিষেধের মাঝেই জেল-পরবর্তী দিনগুলো কাটছে তার। এর মাঝে বিদেশী কারও সাথে কোনো রকম কথা না বলা এবং কারও সাথে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি না করার নির্দেশও ছিল।
ও হ্যাঁ, যে নারীর প্রেমে ভানুনু পাগল হয়ে গিয়েছিল, সে কিন্তু একজন মোসাদ এজেন্ট, নাম চেরিল বেন টভ, ছদ্মনাম ‘সিন্ডি’। সিন্ডি ওরফে চেরিল আগে থেকেই আরেকজনের সাথে মন দেওয়া-নেওয়া সেরে রেখেছিল। ইসরায়েলী সিকিউরিটি সার্ভিসে কর্মরত এক অফিসারের সাথেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল সে।
হায় ভানুনু, যদি তুমি বুঝতে!
২
একইরকম অভিযোগ ছিল মাতা হারির বিপক্ষেও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের সাথে কাজের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি ছিল, খ্যাতনামা ফরাসি রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের প্রলুব্ধকরণের মাধ্যমে সে এই কাজটি করছিল।
বিচারের সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে মাতা হারি। কিন্তু কাজ হয়নি। ১৯১৭ সালের ১৫ অক্টোবর ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
যুদ্ধের পর ফরাসি কর্তৃপক্ষ অবশ্য স্বীকার করে যে, তাদের কাছে মাতা হারির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ব্যাপারে তেমন কোনো প্রমাণই ছিল না। ইতিহাসবিদদের মতে, মাতা হারিকে আসলে হানি ট্র্যাপিংয়ের অভিযোগে শাস্তি পেতে হয়নি, বরং কোনো নারীই যেন সেই পথে যাবার দুঃসাহস না দেখায় সেজন্য তাকে হত্যার মাধ্যমে একটি উদাহরণ তৈরি করেছিল ফরাসি কর্তৃপক্ষ।
৩
লন্ডন, ইসরায়েল, ইতালি, ফ্রান্স ঘুরে এবার একটু সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়া যাক। গত শতকের ষাটের দশকের শুরুর দিকে লন্ডনে সোভিয়েত অ্যাটাশি হিসেবে কাজ করতেন ইয়েভগেনি ইভানভ। সুদর্শন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই কর্মকর্তা ব্রিটিশ কূটনীতিক ও সামাজিক নানা কাজকর্মে বেশ জনপ্রিয় এক মুখ ছিলেন। ব্রিটিশ অস্টিওপ্যাথ এবং আর্টিস্ট স্টিফেন ওয়ার্ডের পার্টিতেও নিয়মিত মুখ ছিলেন ইভানভ।
ওয়ার্ডের সেসব পার্টিতে আবার আসতো লন্ডনের সুন্দরী সব নারীরা। এমনই এক পার্টিতে ইভানভের সাথে পরিচয় হয় ক্রিস্টিন কীলার নামক এক নারীর। একসময় তাদের এই পরিচয় প্রণয়ে রুপ নেয়। কিন্তু, ওদিকে কীলার ছিলেন একইসাথে ব্রিটিশ এমপি এবং সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ওয়্যার জন প্রফুমোরও প্রেমিকা! ভাগ্য আরও খারাপ হলো এদিক দিয়ে যে, সেসময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জার্মানিতে ক্রুজ মিসাইল স্থাপন নিয়ে কাজ করছিলেন।
১৯৬৩ সালে প্রফুমোর সাথে কীলারের সম্পর্কের কথা মিডিয়ায় আসে প্রথমবারের মতো। সাথে সাথেই ব্রিটিশ মিডিয়া এই বিষয়টিকে ইভানভের হানি ট্র্যাপ হিসেবে দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বেচারা প্রফুমো, হাউজ অফ কমন্সের কাছে এই সম্পর্কের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলায় তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। স্ত্রীর কাছ থেকে ক্ষমা পেলেও বেচারার ক্যারিয়ার ঠিকই শেষ হয়ে গিয়েছিল এই হানি ট্র্যাপিংয়ের অভিযোগের ফলে।
পরবর্তীতে ইভানভও চলে আসেন মস্কোতে। পুরো বিষয়টায় বেশ মজা পেয়েছিলেন তিনি। এটা নিয়ে মজা করে বলতেন, “ব্যাপারটা ভাবতেও হাসি পায় যে এক রাতে বিছানায় শুয়ে ক্রিস্টিন কীলার প্রফুমোকে বলছে, ‘আচ্ছা ডার্লিং, ক্রুজ মিসাইলগুলো জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছাবে কবে?’”
৪
এতক্ষণ যেসব হানি ট্র্যাপিংয়ের কাহিনী শোনানো হলো, সবই তো হেটারোসেক্সুয়াল। এবার তাহলে একটা হোমোসেক্সুয়াল ফাঁদের গল্প শোনানো যাক।
ষাটের দশকে ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিনিধি হিসেবে মস্কোতে কাজ করছিলেন জেরেমি ওলফেন্ডেন। তিনি একদিকে যেমন রাশিয়ান ভাষা জানতেন, অন্যদিকে ছিলেন সমকামী। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় কেজিবি। ওলফেন্ডেনকে প্রলুব্ধ করতে তারা বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাপিতকে কাজে লাগায়। তাকে বলে দেয় যেন আগে থেকেই ওলফেন্ডেনের ক্লোজেটে ক্যামেরাসহ কাউকে লুকিয়ে রাখা হয় যে কি না তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিগুলো তুলে রাখতে পারবে।
পরিকল্পনা মতো ছবি তোলা হয়ে গেলে সেগুলো দিয়ে ওলফেন্ডেনকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে কেজিবি। বলে, “হয় মস্কোতে থাকা পশ্চিমা কমিউনিটির উপর গোয়েন্দাগিরি কর, নাহয় তোমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চলে যাবে ছবিগুলো!”
ওলফেন্ডেন এত কিছু না আমলে নিয়ে সোজা নিজ দেশের দূতাবাসে বিষয়টি জানিয়ে দিলেন। এতেই পড়ে গেলেন মহা ফাঁপরে। কারণ, এরপর যখন তিনি লন্ডনে গেলেন, তখন তার ডাক পড়লো সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস (এসআইএস) থেকে। তারা তাকে প্রস্তাব দিল ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করার, অর্থাৎ কেজিবির সামনে তিনি তাদের হয়ে কাজ করার ভানই করবেন, কিন্তু বাস্তবে কেজিবির তথ্যই পাচার করবেন এসআইএস এর কাছে।
এত চাপ আর নিতে পারছিলেন না ওলফেন্ডেন। ধীরে ধীরে অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ছিলেন তিনি। শেষে গোয়েন্দার এই জীবন থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। মস্কোতে দেখা হওয়া এক ব্রিটিশ নারীকে বিয়ে করে চলে গেলেন ডেইলি টেলিগ্রাফের ওয়াশিংটন ব্যুরোতে।
কিন্তু গোয়েন্দা সত্তাটিই যেন তার পিছু ছাড়তে চাচ্ছিল না। ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশ অ্যাম্বাসির এক পার্টিতে তার সাবেক এসআইএস হ্যান্ডলারের সাথে দেখা হয়ে যায়। তাকে আবারও ইচ্ছার বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগান হয়। এবার এই চাপ আর নিতে পারলেন না তিনি। বিষণ্ন থাকতেন সবসময়। অবশেষে সেই বছরেরই ২৮ ডিসেম্বর মাত্র ৩১ বছর বয়সে বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাতের ফলে মৃত্যু হয় তার। তবে তার বন্ধুদের ভাষ্যমতে, সেদিন আসলে ওলফেন্ডেনের দেহটারই মৃত্যু হয়েছিল। কেজিবি আর এসআইএস মানসিকভাবে আরও আগেই তাকে শেষ করে দিয়েছিল।
যে গোয়েন্দা সত্তা ওলফেন্ডেনকে শেষ করে দিয়েছিল, সেখানে তিনি কেমন ছিলেন? সত্যি বলতে, ডাবল এজেন্ট হিসেবে আহামরি কিছুই করতে পারেননি তিনি। সহকর্মীরা তার সাথে তেমন একটা তথ্য শেয়ার করত না, কারণ তাদেরকে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল যে তিনি কেজিবির সাথে যোগাযোগ রাখেন। ওদিকে সোভিয়েতরাও তার সাথে বলতে গেলে তেমন কিছুই শেয়ার করত না। মাঝে দিয়ে এই হানি ট্র্যাপিংয়ের ফাঁদে পড়ে অল্প বয়সেই ঝরে গেল একটি প্রাণ।
৫
শেষ করব আরেকজন সাংবাদিকের কাহিনী দিয়ে। তবে ওলফেন্ডেনের মতো তিনি ফাঁদে পড়েননি, বরং নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগিয়ে রক্ষা পেয়েছিলেন।
বলা হচ্ছে বিবিসির ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স বিভাগের জনপ্রিয় সম্পাদক জন সিম্পসনের কথা। চেকোস্লোভাকিয়ান ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস থেকে আশির দশকের শুরুতে তাকেও একই ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।
যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে, এর অল্প কিছুদিন আগেই বিবাহবিচ্ছেদ হয় সিম্পসনের। ফলে মানসিকভাবে এমনিতেই বিপর্যস্ত ছিলেন তিনি। এরই মাঝে হুট করে অ্যানা নামে চেকোস্লোভাকিয়ান এক নারীর কাছ থেকে তিনি রোমান্টিক ও সান্ত্বনামূলক চিঠি পেতে শুরু করেন। এক ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সের মাধ্যমেই পরিচয় হয়েছিল দুজনের। সেই কনফারেন্সের সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে যে হোটেলে তিনি ছিলেন, সেখানেই হোটেল রিসিপশনিস্ট হিসেবে কাজ করতেন অ্যানা। দেখতে তিনি বেশ সুন্দরীই ছিলেন।
দিন যত যেতে থাকল, সিম্পসনের কাছে চিঠি আসার পরিমাণও ততই বাড়তে থাকল। এমনকি একটা সময়ে গিয়ে আসতে থাকল অ্যানার ছবিও, যেখানে তিনি লিখে দিতেন, “স্যরি, ছবিগুলো খুব একটা সুন্দর করে তুলতে পারিনি… এগুলো আমি ঘরে বসেই তুলেছি।”
বিষয়টা খুব একটা সুবিধার ঠেকেনি সিম্পসনের কাছে। বিশেষ করে একটা ছবিতে ফটোগ্রাফারের দেহাবয়ব দেখতে পেয়ে তার সন্দেহ আরও দৃঢ় হলো। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে জানালেন বিবিসি কর্তৃপক্ষকে। তারা পরামর্শ দিল এমআই-ফাইভ এর সাথে যোগাযোগের।
যথাসময়ে এমআই-ফাইভের একজন কর্মকর্তা এসে দেখা করেন সিম্পসনের সাথে। তিনি সিম্পসনের বুদ্ধির প্রশংসাই করেন। কারণ, যদি তিনি অ্যানার পরামর্শ মোতাবেক আসলেই কোনো হাঙ্গেরিয়ান হোটেলে তার সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে যেতেন, তাহলে তাকেও হয়তো ওলফেন্ডেনের পরিণতিই বরং করতে হতো!
এই পাঁচটি ঘটনা দিয়ে হানি ট্র্যাপিংয়ের ইতি টানছি এখানেই। নভেল করোনাভাইরাসের দিনগুলোতে নিজে সুস্থ থাকুন, অন্যকেও সুস্থ থাকার সুযোগ করে দিন।
এমনই আরও অবিশ্বাস্য কিছু সত্য গোয়েন্দা কাহিনী নিয়ে বই পড়তে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিঙ্কে:
১) স্পাই স্টোরিজ : এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনী