যেভাবে পোষ মানল ঘোড়া, বদলে দিল সভ্যতার ইতিহাস

মানবসভ্যতা উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে আজ যে অবস্থানে এসে পৌঁছেছে, তাতে কেবল মানুষেরই অবদান ছিল, এমনটা দাবি করলে সেইসব অবলা জীবজন্তুদের প্রতি ভীষণ অবিচার করা হবে, যাদের অবদান মোটেই ফেলনা ছিল না। সেই বন্য কুকুর-বিড়াল থেকে শুরু করে গরু, ছাগল, ভেড়া, কিংবা উট, গাধা, মোষ, সকল প্রজাতির পশুই নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রেখে গেছে।

কিন্তু যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, পৃথিবীর ইতিহাসে যত পশু আছে বা ছিল, তার মধ্যে মানবসভ্যতার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান কোন পশুটির, একটু কি থতমত খেয়ে যাবেন না? নিশ্চয়ই যাবেন। কিন্তু সামলে নিয়ে যে নামটি আওড়াবেন, শতকরা নব্বই ভাগ সম্ভাবনা সেটি হবে ঘোড়া। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে ভার বহন, দূরত্বকে জয় কিংবা যুদ্ধ বিগ্রহে অগ্রণী ভূমিকা পালন, কোথায় নেই ঘোড়ার অবদান! একটু গভীরে চিন্তা করে দেখলে বোঝা যাবে, মানুষকে সত্যিকারের মানুষ করে তুলতে ঘোড়া চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি।

এখন আপনার কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ঠিক কবে থেকে মানুষের সাথে ঘোড়ার এমন সখ্যতা? কবে থেকে ঘোড়া বন ছেড়ে মনুষ্য সৃষ্ট আস্তাবলে রাত কাটাতে শুরু করল? আর কীভাবেই বা মানবসভ্যতার উন্নয়নের সূচক টেনে উপরে তুলতে ঘোড়া অবদান রাখল? এই লেখার মাধ্যমে আমরা সেইসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজব।

ঘোড়ার পোষ মানা মানবসভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম বড় ঘটনা; Image Source: War Horse

কবে পোষ মানল ঘোড়া?

পৃথিবীতে ঘোড়ার আগমন সেই ইয়োসিন-ইপক যুগে, অর্থাৎ ৫৫.৮ থেকে ৩৩.৯ মিলিয়ন বছর আগে। তখন উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে ৪.২ থেকে ৫ হাত (১.৪ থেকে ১.৭ ফুট) পর্যন্ত লম্বা এক ধরনের জন্তু দেখা যেত, যাকে ঘোড়ার আদি পুরুষ হিসেবে ধরা হয়। তবে মানুষের সাথে ঘোড়ার যোগসূত্রের প্রথম হদিস পাওয়া যায় অনেক পরে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০,০০০ অব্দে। প্রাচীন প্রস্তরযুগের আদিমানবদের গুহাচিত্রে ঘোড়ার ছবি আবিষ্কৃত হয়। তখনও অবশ্য মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয়নি ঘোড়ার। বনে-জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়াত তারা, আর মানুষ মাঝেসাঝে তাদের শিকার করত মাংসের লোভে।

প্রথম মানুষের কাছে ঘোড়ার পোষ মানার নিদর্শন আমরা খুঁজে পাই ইউরেশিয়ার স্তেপ অঞ্চলের ইতিহাসে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩,৫০০ অব্দের দিকে বর্তমান কাজাখাস্তানের আকমোলা প্রদেশের প্রাচীন বোটাই সভ্যতায় পালন শুরু হয় ঘোড়া। সেই সভ্যতার মানুষ ঘোড়া দিয়ে ঠিক কী কী করত সে সম্পর্কে বিশদে জানা না গেলেও, ধারণা করা হয়, ঘোড়ার দুধ ও মাংসই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য।

ঘোড়াকে দিয়ে কাজ করানোর শুরু সম্ভবত মেসোপটেমিয়ায়। এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব ২,০০০ অব্দ সময়কালের টেরাকোটায় ঘোড়া দিয়ে রথ টানানোর দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া খ্রিস্টপূর্ব ২,০০০-১,৮০০ অব্দে ওই অঞ্চলে সরাসরি ঘোড়ার পিঠে চড়ারও সূচনা হয়। আর মিশরে খ্রিস্টপূর্ব ১,৬০০-১,৪০০ অব্দের কবরের উপর আঁকা চিত্রকর্ম থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, সেখানেও তখনকার মানুষ ঘোড়ার পিঠে চড়তে আরম্ভ করেছিল।

ঘোড়া সম্বন্ধীয় প্রথম লিখিত নমুনার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১,৪০০ অব্দে। সেখানে রথ টানার উপযোগী ঘোড়াকে কীভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে এ ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এছাড়া খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০ অব্দের দিকে এথেন্সের গ্রিক দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, সৈন্য জেনোফোন, যিনি ছিলেন সক্রেটিসের একজন ছাত্রও বটে, রচনা করেন ঘোড়া নিয়ে বিখ্যাত বই ‘দ্য আর্ট অব হর্সম্যানশিপ’। এমনকি আজকের দিনেও বইটি খুবই প্রাসঙ্গিক, যেখানে ঘোড়ায় চড়ার নানাবিধ কৌশল থেকে শুরু করে ঘোড়ার মনস্তত্ত্ব এবং কীভাবে ঘোড়ার পরিচর্চা করতে হবে, এই সকল বিষয়েই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

কীভাবে মানবসভ্যতার ইতিহাস বদলে দিল ঘোড়া?

ঘোড়াকে পোষ মানানোর আগ পর্যন্ত যেকোনো জাতির বিচরণের ক্ষেত্রই খুব সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষিকাজে যতই উন্নতি হোক না কেন, আর তার মাধ্যমে সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটুক না কেন, মানুষ কোনো লম্বা পথ অতিক্রমের সাহস দেখানো তো দূরে থাক, এমনকি স্বপ্ন দেখতেও ভয় পেত। কেননা মানুষের পক্ষে পায়ে হেঁটে কতদূরেই বা যাওয়া সম্ভব! কিন্তু যখন মানুষ ঘোড়ার সাথে সখ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হলো, তখন থেকেই মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সীমা ছাড়িয়ে গেল।

ঘোড়ার ক্ষীপ্র গতি আর অভাবনীয় শক্তির উপর ভর করে মানুষ দূরকে জয়ের পথে পা বাড়াল। বদলে গেল মানুষের পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও। দূরত্ব জয় তো ছিলই, এর পাশাপাশি কৃষিকাজ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ব্যবসা, ক্রীড়াক্ষেত্র সবখানেই ঘোড়া হয়ে উঠল মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু ও সহচর।

১৮৮০ সালে কলকাতায় ঘোড়াচালিত ট্রাম; Image Source: Culture Bowl

কৃষিকাজ ও পরিবহন

ঘোড়ার আগমনের পূর্বেও মানুষ গরু দিয়ে ফসলী জমিতে লাঙল চালাতো। কিন্তু সেটি ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ কাজ। গরু অত্যন্ত ধীরগতির প্রাণী। পাশাপাশি গরু প্রচন্ড আলসেও। একটানা বেশিক্ষণ কাজ করতে পারতো না। অল্পতেই হাঁপিয়ে যেত, নয়তো একটু পর পর খাওয়াতে হতো। তখন তাকে খাওয়া-দাওয়া করে শরীরে শক্তি ফিরিয়ে আনতে হতো। কিন্তু খাওয়ার সাথে সাথেই আবার সে কাজে ফিরতে পারত না। খাওয়ার পর আবার কিছুক্ষণ তাকে বিশ্রাম নিতে হতো। ঘোড়ার বেলায় এমন কোনো ঝক্কি ছিল না। খাওয়ার পরই সে আবার কাজ শুরু করে দিত প্রচন্ড দ্রুতগতিতে। ফলে সময়ের কাজ সময়ে শেষ করা নিয়ে মানুষকে আর চিন্তায় থাকতে হতো না।

তাছাড়া জমির কাজ শেষে উৎপন্ন ফসল বহন করা এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্যও ঘোড়াকে ব্যবহার করা যেত। ঘোড়া কাজে লাগত অন্যান্য মালামাল পরিবহনের কাজেও। ধরুন, একজন গড়পড়তা মানুষ হয়তো একবারে ৫০ পাউন্ড বোঝা বহন করতে পারত। একটি ঘোড়া সেখানে পারত ২০০ পাউন্ড। আর বুদ্ধি করে যদি ঘোড়াকে কোনো চাকাওয়ালা বাহনের সাথে জুড়ে দেয়া হতো, তাহলেই কেল্লাফতে! এবার সেই ঘোড়া বহন করতে পারত ১,০০০ থেকে ২,০০০ পাউন্ড বোঝাও!

ঘোড়ার আগমনে উপকৃত কেবল কৃষক ও ব্যবসায়ীরাই হয়নি, হয়েছিল রাখাল বালকরাও। তাদের জীবনে অভূতপূর্ব স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে এনেছিল ঘোড়া। ছোট্ট একটি উদাহরণের মাধ্যমেই বিষয়টিকে পরিষ্কার করা যাবে। একজন রাখাল ও একটি কুকুর যেখানে মাত্র ২০০টি ভেড়া চড়াতে পারতো, সেখানে একজন রাখাল, একটি কুকুরের সাথে একটি ঘোড়া যোগ করলেই ৫০০টি ভেড়া চরানো যেত।

দূরত্ব জয় এবং সভ্যতা ও বাণিজ্যের বিস্তার

মানুষের স্বাভাবিক হাঁটার গতি ছিল ঘণ্টায় ৪ মাইল করে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা হেঁটেই মানুষের শক্তি শেষ হয়ে যেত, আর আগে বাড়তে পারত না। অন্যদিকে ঘোড়াও স্বাভাবিকভাবে এই গতিতেই হাঁটত, তবে অনেক লম্বা সময় পর্যন্ত। আবার গতি একটু বাড়ালেই ঘণ্টায় ৮ মাইল পর্যন্ত যেতে পারত। আর যদি দূরত্ব খুব বেশি না হয়, তাহলে ঘোড়া দৌড়ে ঘন্টায় ৩৫ মাইলও চলে যেতে পারত। সবমিলিয়ে স্বাভাবিক গতিতে দিনে ৮ ঘণ্টা হেঁটে ঘোড়া ৩২ মাইল এবং দৌড়ে ১০০ মাইল পর্যন্ত অতিক্রম করতে পারত।

প্রাচীনকালে গুহার দেয়ালে আঁকা ঘোড়ার রথ টানার দৃশ্য; Image Source: Early Church History

তাহলে বুঝতেই পারছেন, ঘোড়াকে পোষ মানানোর ফলে বাস্তবিকই দূরত্ব জয় করা কত সহজ হয়ে গিয়েছিল মানুষের জন্য। দৈনিক একটানা হেঁটে যে মানুষটি ২০ মাইলও অতিক্রম করতে পারত না, ঘোড়ায় চড়ে সেও ১০০ মাইল অতিক্রম করা শুরু করলো। ফলে মানুষকে এখন আর নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হলো না। তারা বেরিয়ে পড়তে শুরু করল অজানাকে জানার উদ্দেশ্য এবং তা করতে গিয়ে তারা দেখা গেলো, তাদের বাসস্থানের কিছু দূরেই একইরকম জাতীয়তার আরও বিভিন্ন গোষ্ঠীর বাস। এতদিন তারা ছাড়া ছাড়া ভাবে থেকেছে। এবার যখন তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয়েই গিয়েছে, গোষ্ঠীগুলো আর ছন্নছাড়া না হয়ে একত্রে বাস করতে শুরু করলো। এর মাধ্যমে সভ্যতা আরও শক্তিশালী হলো, সভ্যতার ভিতও মজবুত হলো।

আবার ঘোড়ার সুবাদেই কিছু কিছু দুঃসাহসী মানুষ কেবল নিজ অঞ্চলের আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েই সন্তুষ্ট থাকল না, তারা চলে যেতে থাকল আরও দূর থেকে দূরে। এভাবে তারা পৌঁছাতে থাকল এমন অজানা কোনো দেশে, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্বসূরীরা কেউ হয়তো অবগতই ছিল না। কিংবা সেদেশের ভাষা হয়তো একেবারেই ভিন্ন। প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ সেসব ভাষা শিখে নিল, তাদেরকেও নিজের মুখের বুলি শিখিয়ে দিল। এভাবে আদান-প্রদান ঘটল ভাষা ও সংস্কৃতির।

ভাষাগত অভিন্নতা চলে এলে বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হলো। তখন এক দেশের সাথে অন্য দেশের ব্যবসায়িক বিনিময় ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সৃষ্টিরও পথ সুগম হলো। এক দেশ হয়তো মসলার জোগান দিল, বিনিময়ে নিজেরা নিল রবিশস্য। এভাবেই সব দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল। একটি তথ্য জেনে অনেকেই অবাক হবেন, ১৮৮০ সালে কলকাতার ট্রামগাড়িকে বয়ে নিয়ে যেতো এই ঘোড়ারাই। সেখানেই শেষ নয়। সম্রাট শের শাহের আমলে চিঠিপত্র বিলি করা হতো এই ঘোড়ার পিঠে চেপেই!

যুদ্ধক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন

যখন থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়া হয়ে উঠল মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী, তখন থেকেই মানবসভ্যতায় এলো এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। খ্রিস্টপূর্ব ৪,০০০ থেকে ২,০০০ অব্দের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে প্রথম ইউরেশিয়া অঞ্চলের যুদ্ধে ঘোড়ার ব্যবহার শুরু হয়। এরপর থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য যুদ্ধেই ঘোড়া রেখেছে বিশাল ভূমিকা। ঘোড়ার সবচেয়ে বড় দুইটি গুণ হলো এর ভার বহনের ক্ষমতা আর এর দ্রুতগতি। একদিকে একটি সাধারণ ঘোড়াও নিজের ওজনের ৩০% বেশি ভার বহন করতে পারে, যা যুদ্ধ-বিগ্রহে খুবই কাজে লাগত। আর ঘোড়ার দ্রুতগতির কারণে শত্রুপক্ষের উপর আকস্মিক আক্রমণে, কিংবা শত্রুপক্ষের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে ঘোড়ার কোনো জুড়ি নেই।

তাছাড়া ঘোড়া হলো শক্তি ও আভিজাত্যের প্রতীক। তাই ঘোড়ার উপর কেবল যুদ্ধের ফলাফলই নির্ভর করত না, কোন দলের কত বেশি ঘোড়া আছে তা দিয়ে পরিমাপ করা হতো সেই দলের নেতা বা রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদাও। পরবর্তীতে যখন দেখা গেল, বুদ্ধি ও পরাক্রমে মানুষের চেয়ে ঘোড়া কোনো অংশে কম না, তখন থেকে ঘোড়াকে সরাসরি শিখিয়ে পড়িয়ে নামিয়ে দেয়া শুরু হলো যুদ্ধক্ষেত্রে। এলো ঘোড়ার পিঠে চড়া বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য। মধ্যযুগে ইউরোপে বিশেষ যুদ্ধঘোড়া ব্যবহৃত হতো। যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়ার ব্যবহারে পিছিয়ে ছিল না আরব মুসলিমরাও। এমনকি আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ফলেও বিশেষ অবদান ছিল ঘোড়ার। আধুনিক সমরাস্ত্রের আগমনের পূর্বে যুদ্ধ জয়ে ঘোড়ার কোনো বিকল্পই ছিল না।

একসময় যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়া ছিল অপরিহার্য; Image Source: Tablet Mag

ক্রীড়াক্ষেত্রে 

শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, মানুষের বিনোদনের উদ্দেশে সৃষ্ট খেলাধুলাতেও ঘোড়ার সংস্লিষ্টতার ইতিহাস বহু পুরনো। এবং তা অব্যাহত রয়েছে আজও। রেসিং, জাম্পিং, রোডিও, পোলো ইত্যাদি জনপ্রিয় খেলার জন্ম ঘোড়াকে কেন্দ্র করেই। অনেকেই হয়তো জানেন না, বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সাথেও যোগসূত্র রয়েছে ঘোড়ার। কীভাবে? ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেখানে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, সেটির পূর্ব নাম ছিল রমনা রেসকোর্স। ব্রিটিশ আমলে প্রতি রবিবার সেখানে বসতো বৈধ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন।

সাহিত্য ও উপকথায় ঘোড়ার উপস্থিতি

সাহিত্যের আঙ্গিনায়ও বারবার ঘুরেফিরে এসেছে ঘোড়ার কথা। ঘোড়া সংক্রান্ত প্রচলিত কিংবদন্তী নিয়েও চর্চা কম হয়নি। ঠাকুরমার ঝুলি পড়েননি, এমন শিক্ষিত বাঙালি হয়তো হাজারে একজনও পাওয়া যাবে না। সেই ঠাকুরমার ঝুলিতে বারবার উঠে এসেছে পঙ্খীরাজ ঘোড়ার কথা। ভিনদেশী সাহিত্যেও রয়েছে ঘোড়ার ব্যাপক প্রাধান্য। অ্যানা সিউলের ‘ব্ল্যাক বিউটি’ উপন্যাস তার অনন্য উদাহরণ। এছাড়াও ঘোড়া নিয়ে রয়েছে অসংখ্য বাস্তব, অবাস্তব ও অমীমাংসিত আখ্যান। চলুন জেনে আসি সেরকমই কয়েকটির ব্যাপারে।

সেন্টর

সেন্টর নামক প্রাণীটির উল্লেখ আমরা গল্প-উপন্যাসে অজস্রবার পেয়েছি। চলচ্চিত্রের পর্দায়ও নেহায়েত কম দেখিনি। কী এই সেন্টর? কিংবদন্তী অনুযায়ী, এটি এমন একটি প্রাণী যার সামনের অংশ মানুষের মতো আর পিছনের অংশ ঘোড়ার মতো। কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এমন অত্যাশ্চর্য একটি প্রাণীর কথা মানুষের উর্বর মস্তিষ্কে কীভাবে জন্ম নিল? আসল রহস্যটি জানলে চমৎকৃত হবেন অনেকেই। মূল ঘটনা হলো, প্রাচীন আমলে যখন মানুষ প্রথম ঘোড়ায় চড়া শিখল, অনেক উপজাতি সম্প্রদায়ই ঘোড়ায় চড়া মানুষ দেখে ভয় পেয়ে যেতো। তারা ভাবত, এ নির্ঘাত নতুন কোনো অবতার।

সেই অবতারের কথাই লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আসল রহস্যের উদ্ঘাটন হলেও, কিংবদন্তী রূপে প্রাণীটির কথা রয়েই যায়। আর তাই এই ২০১৮ সালে এসেও অনেককেই বলতে শুনি সেন্টরের কথা।

ট্রোজান যুদ্ধ

মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’র কথা শুনে থাকবেন নিশ্চয়ই। গ্রিসের মহাকবি হোমারের অমর সৃষ্টি এ দুইটি, যেখানে ছিল গ্রিকদের সাথে ট্রোজানদের যুদ্ধের বিবরণ। বহু বছর ধরেই ট্রোজানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও জয়ের দেখা পাচ্ছিল না গ্রিকরা। পারছিল না ট্রয় দখল করে নিতে। কেননা ট্রয়নগরী বেষ্টিত ছিল বিশাল পাঁচিল দিয়ে, যা অতিক্রম করার সাধ্য সেইসময়কার গ্রিকদের ছিল না।

শেষ পর্যন্ত আজব এক ফন্দি এঁটে বসলেন গ্রিক বীর ওডিসিউস। তার কথা মতো তৈরী হলো বিরাট এক কাঠের ঘোড়া। সেই ঘোড়ার পেটের জায়গাটি ছিল ফাঁপা, যেখানে ঢুকে লুকিয়ে পড়েন ওডিসিউসসহ বেশ কয়েকজন গ্রিক যোদ্ধা। বাকি সবাই ঘোড়াটি রেখে জাহাজে করে চলে যায়। ট্রোজানরা যখন যুদ্ধ করতে এলো, গ্রিকদের জাহাজ না দেখে তারা তো অবাক। ভাবলো, গ্রিকরা বোধহয় হার মেনে পালিয়ে গেছে। আর যাওয়ার আগে ফেলে গেছে মস্ত বড় এই ঘোড়াটি। সেটিকে নিয়ে শহরে ফিরে এলো তারা। হলো বিজয় আনন্দে মশগুল। গোটা শহর জুড়ে উৎসবের আমেজ।

এদিকে রাতের আঁধারে নিঃশব্দে ঘোড়ার পেট থেকে বেরিয়ে এসে গ্রিক যোদ্ধারা খুলে দিলো ট্রয় শহরের প্রধান ফটক।। ততক্ষণে ফিরে এসেছে গ্রিকদের জাহাজ। ফটক খোলা পেয়ে বানের জলের মতো ট্রয় নগরীতে ঢুকে পড়ল তারা। ধ্বংস করে দিলো নগরী।

আলেকজান্ডার ও বুসেফেলাস; Image Source: Wikipedia

বুসেফেলাস

গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের কথা তো সবাই জানেন। কিন্তু এই কাহিনীর যখন সূত্রপাত, তখন আলেকজান্ডার সবে ১২ বছরের বালক। এক ঘোড়া ব্যবসায়ী খুব তেজী একটি ঘোড়া নিয়ে উপস্থিত হলেন রাজদরবারে। কিন্তু চঞ্চলমতি সেই ঘোড়া এতই অস্থির যে, সেটিকে বশ মানানোর সাধ্য কারও ছিল না। তাই আলেকজান্ডারের বাবা ফিলিপ ঠিক করলেন, কিনবেন না ওই ঘোড়া। ঘোড়া ব্যবসায়ীকে যেই না ‘না’ করে দিতে উদ্যত হলেন তিনি, কিশোর আলেকজান্ডার তার কাছে এসে বলল, “আমাকে একটিবার চেষ্টা করার সুযোগ দিন।”

বড় বড় বীর পালোয়ানরাই যেখানে ওই ঘোড়া সামলাতে গিয়ে নাজেহাল, সেখানে এইটুকু পুঁচকে ছোঁড়া নাকি চেষ্টা করে দেখতে চায়! সবাই তো হেসে কুটিকুটি। কিন্তু সবার উপহাস-তাচ্ছিল্যে দমবার পাত্র নয় আলেকজান্ডার। তবে তার এমন আত্মবিশ্বাস দেখে অভিভূত হলেন রাজা। তিনি অনুমতি দিলেন ছেলেকে। ঘোড়ার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ সেটিকে পর্যবেক্ষণ করেই আলেকজান্ডার সেটির সমস্যা বুঝে ফেললেন। নিজের ছায়াকে ভয় পাচ্ছে সেটি! তাই শুরুতেই ঘোড়াটির কাছে গিয়ে সেটিকে রোদের দিকে মুখ করে দাঁড় করালেন। ফলে ছায়া সরে গেল ঘোড়াটির পিছনে। সুতরাং ভয় পাওয়ারও আর কিছু থাকল না।

বীর বিক্রমে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলো আলেকজান্ডার। ঘোড়াটি বিন্দুমাত্র আপত্তি জানাল না। ছোট্ট মনিবকে মেনে নিল। সবাই তো ছোট্ট আলেকজান্ডারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ওদিকে আলেকজান্ডারের বেজায় পছন্দ হয়ে গেছে ঘোড়াটিকে। সে সিদ্ধান্ত নিল এখন থেকে এটিই হবে তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। এই ঘোড়াটিই হলো আলেকজান্ডারের সবচেয়ে প্রিয় ঘোড়া বুসেফেলাস, যা সাক্ষী থেকেছে আলেকজান্ডারের অসংখ্য জয়ের, অসংখ্য বীরত্বের।

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is about the domestication of horse, and how it shaped human civilization. Information sources are hyperlinked inside the article.

Featured Image © Getty Images

Related Articles

Exit mobile version