আপনি কি কখনো পত্রিকার পাতা নিয়ে ‘ক্রস-ওয়ার্ড পাজল’ বা শব্দধাঁধা সমাধান করার খেলা খেলেছেন? আমাদের অনেকের মধ্যেই এই অভ্যাসটি রয়েছে। পত্রিকা হাতে পেলেই শব্দের খেলার পাতা খুঁজে বের করা অনেকের দৈনন্দিন অভ্যাস। ইংরেজিতে খেলাটি ‘ক্রস-ওয়ার্ড’ নামে পরিচিত হলেও বাংলাতে এটি ‘শব্দজব্দ’, ‘শব্দজট’, ‘শব্দসন্ধান’, ‘শব্দচতুষ্ক’ বা ‘শব্দছক’ ইত্যাদি নামে অধিক পরিচিত।
বর্তমানের ক্রসওয়ার্ড পাজল বা শব্দজটের যে খেলাটি প্রচলিত আছে, পূর্বে কিন্তু তেমনটি ছিল না। নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে খেলাটি আজকের অবস্থানে এসেছে। কীভাবে খেলাটির আবির্ভাব ঘটলো এবং সাধারণের মাঝেও তা ছড়িয়ে পড়লো, তা নিয়েই আজকের এই লেখা।
শব্দছক বা ক্রসওয়ার্ড দেখতে অনেকটা আয়তাকার বা বর্গাকার বড় একটা চৌকো ঘরের মতো। এর মধ্যে অনেকগুলো ছোট-ছোট সাদা বা সাদা-কালো বর্গাকৃতির খোপ থাকে। সাদা ঘরগুলোয় শব্দ লিখে ছকপূরণ করতে হয়। শব্দের একেকটি অক্ষরের জন্য একটি ঘর নির্দিষ্ট করা থাকে। এক বা একাধিক অক্ষর থেকে একের পর এক নতুন শব্দ তৈরি করার মধ্যে দিয়ে খেলা এগোতে থাকে, যতক্ষণ না পর্যন্ত সকল খালি ঘর সঠিক অক্ষর দিয়ে পূরণ করা হয়।
শব্দজট খেলার উৎপত্তির কথা বলতে হলে উল্লেখ করতে হয় ১৯১৩ সালের দিকের একটি ঘটনার। সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’-এর কমিক্স বিভাগ ‘ফান’-এর দায়িত্বে ছিলেন ইংল্যান্ডের লিভারপুলের সাংবাদিক আর্থার উইনি। অনেকদিন ধরেই ধাঁধার পাতায় ছাপা হতো ওয়ার্ডস্কোর, হিডেন ওয়ার্ড, অ্যানাগ্রামের মতো শব্দের খেলা। সে বছর আসন্ন বড়দিনে ভক্তদের জন্য বিশেষ উপহার হিসেবে তিনি আনলেন এক নতুন শব্দছকের খেলা। আর্থার তার এই শব্দছকের নাম দিলেন ‘ওয়ার্ড-ক্রস’।
সেদিন তিনি কাজটি যে অনেক ভেবে চিন্তে করেছিলেন, তা কিন্তু নয়। অনেকটা চিরাচরিত শব্দ ধাঁধার একঘেয়েমি কাটানোর জন্য খেলায় কিছু পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি যে, নিজের অজান্তেই তিনি তৈরি করে ফেলেছেন ব্যতিক্রমী এই খেলা।
তবে আর্থারের এই শব্দছকের ধারণাটি বেশ পুরনো। প্রাচীনকালে পম্পেই নগরীতে ল্যাটিন ভাষায় এমন একটি খেলার প্রচলন ছিল। যে বর্গাকৃতির ছকে খেলাটি হতো, তাকে বলা হতো ‘ম্যাজিক স্কোয়ার’। এই ম্যাজিক স্কোয়ারে খেলোয়াড়কে একগুচ্ছ শব্দ দেয়া হতো। সেই শব্দগুলোকে উপরে নিজে সাজিয়ে অর্থবোধক অর্থ তৈরি করতে হতো। আর্থারের শব্দ ছকের ধারণাটি এখান থেকেই সৃষ্ট। আর্থারের বানানো শব্দছকটি দেখতে অনেকটা হীরাকৃতির ছিল। একেবারে উপরের তিনটি বর্গাকার খোপে তিনি লিখেছিলেন FUN। বাকি খোপগুলো ফাঁকা ছিল সূত্রানুযায়ী পূরণ করার জন্য।
প্রথমবার প্রকাশের পরপরই রাতারাতি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় আর্থারের এই ওয়ার্ড-ক্রস। সমগ্র মার্কিন সমাজের ছোট-বড় সবাই ওয়ার্ড-ক্রসে মেতে উঠল। পত্রিকার পাঠকেরা অধীর আগ্রহে পরবর্তী শব্দছক প্রকাশের অপেক্ষায় থাকতেন। সপ্তাহখানেক পরই আর্থার নিজেই খেলার নামটি উল্টে দিলেন। তখন থেকে আর ‘ওয়ার্ড-ক্রস’ নয়, হয়ে গেলো তা ‘ক্রস-ওয়ার্ড’। মাঝের হাইফেন বিদায় নিতে আরও বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। সে সময় শব্দছকটির আকৃতি নিয়ে চলেছিল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
একবার আর্থার পত্রিকায় বৃত্তাকার শব্দছকও ছেপেছিলেন। শেষমেষ তিনি থিতু হন এর আয়তাকার চেহারায়। এর জনপ্রিয়তা লক্ষ করে আরেকটি সংবাদপত্র ‘বস্টন গ্লোব’-এ নিয়মিতভাবে এই ক্রসওয়ার্ড প্রকাশিত হতে শুরু করে।
নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় ক্রসওয়ার্ড পাজল জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকেই অনেক ভক্ত পত্রিকা অফিসে তাদের নিজস্ব বানানো শব্দছক পাঠাতে শুরু করেন। ১৯১৪ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে আর্থার এর মধ্য থেকে বাছাই করা কিছু ক্রসওয়ার্ড ছাপতেও শুরু করেন পত্রিকার পাতায়।
এদিকে অন্য এক বিপত্তি দেখা দিল তখন। শব্দছকের খেলা মুদ্রণের সময় এর টাইপ সেট করতে গিয়ে মুদ্রণকর্মীদের নানা সমস্যা হচ্ছিল। ফলে প্রায় সময় শব্দছকে মুদ্রণজনিত নানা ভুল হতে লাগলো। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে পত্রিকার কর্তৃপক্ষ শব্দছক বিভাগটিই তুলে দিলেন।
সাথে সাথে সারা মার্কিন সমাজে প্রতিবাদের ঢেউ উঠলো। ক্রসওয়ার্ড ছাপার দাবি জানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হতে লাগলো। অসংখ্য প্রতিবাদী চিঠি আসতে লাগলো পত্রিকার দপ্তরে। তাই অনেকটা নিরুপায় হয়ে পত্রিকার কর্তৃপক্ষ বিভাগটি পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯১৭ সালে আরও বেশি খবরের কাগজে চালু হতে লাগলো ক্রসওয়ার্ড পাজল। ১৯২০-২১ সালে সাধারণ মানুষ শব্দসন্ধানের নেশায় এতটাই মেতে উঠলো যে অভিধান ও বিশ্বকোষের জন্য স্থানীয় গ্রন্থাগারগুলোতে ভিড় করতে লাগলো। ফলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গ্রন্থাগারে এসে তাদের প্রয়োজনীয় পড়াশোনা করতে না পারায় নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে এসে সমবেত অভিযোগ জানায়।
তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, জনপ্রিয় এই শব্দছকের খেলা ছিল পুরোটাই নিউইয়র্ক কেন্দ্রিক। নিউইয়র্ক ছাড়া আর কোথাও প্রকাশিত হতো না এই ক্রসওয়ার্ড পাজল। ১৯২৪ সাল থেকে এই ধারার অনেকটাই পরিবর্তন আসতে শুরু করে। কলম্বিয়া স্কুল অফ জার্নালিজম থেকে পাশ করা দুই তরুণ স্নাতক ডিক সাইমন ও লিঙ্কন শুস্টার নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় বাছাই করা শব্দসন্ধান নিয়ে প্রকাশ করলেন ক্রসওয়ার্ড পাজলের এক চমৎকার সংকলন। পাঠকদের উৎসাহিত করার জন্য বইটির সাথে জুড়ে দেয়া হলো একটি পেন্সিলও। আমেরিকার ক্রসওয়ার্ড পাজলপ্রেমীদের মধ্যে আলোড়ন ফেলে দিল বইটি। সে বছর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বইটি বহুল বিক্রিত বইয়ের সম্মান পায়।
ধীরে ধীরে ক্রসওয়ার্ডের জনপ্রিয়তা ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংল্যান্ডের এক জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘পিয়ারসন’-এ প্রথম ক্রসওয়ার্ড পাজল প্রকাশিত হয়। তবে গার্ডিয়ান পত্রিকার তথ্যানুসারে, ১৯২৫ সালে ‘সানডে এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় প্রথম ইংল্যান্ডের প্রথম ক্রসওয়ার্ড প্রকাশিত হয়।
খুব কম সময়ের মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকায় ক্রসওয়ার্ড পাজলের জনপ্রিয়তা এতই বৃদ্ধি পেল যে, কিছু লোক শব্দছক নিয়ে ‘প্রাইজ-পাজল’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে শুরু করে। অল্প কিছু প্রবেশমূল্য দিলেই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা যেতো। আর ঠিকঠাক সমাধান করতে পারলে নগদ হাজার পাউন্ডের পুরস্কার। লক্ষাধিক মানুষের পাঠানো প্রবেশমূল্য দিয়ে মোটা টাকা সহজে কামিয়ে নিতে থাকলো উদ্যোক্তারা।
শব্দছকের জনপ্রিয়তা সাহিত্যিকদেরকেও আকর্ষণ করেছিল, তা বলাই বাহুল্য। অনেক গোয়েন্দা ও রহস্য ঔপন্যাসিক শব্দছককে আশ্রয় করে লিখেছেন অনেক গল্প ও উপন্যাস।
শব্দছক নিয়ে রোমাঞ্চকর কাহিনীরও কোনো অভাব নেই। ১৯২৬ সালে বুদাপেস্টে ঘটে এক অদ্ভুত আত্মহত্যা। তদন্তে নেমে পুলিশের কর্মকর্তারা একটা ‘সুইসাইড নোট’ পায়, যাতে রয়েছে একটা ক্রসওয়ার্ড। তদন্তকারী কর্মকর্তারা বুঝতে পারলেন ওই ক্রসওয়ার্ড থেকেই জানা যাবে মৃত্যুর কারণ। শুরু হলো সেই ক্রসওয়ার্ড পাজলের সমাধানের চেষ্টা। বাঘা-বাঘা পুলিশ কর্তারা যখন ফেল, তখন জনসাধারণের সাহায্যে মেলে এর সঠিক সমাধান।
১৯৩০ সালে ২৩ জানুয়ারি থেকে লন্ডনের বিখ্যাত ‘টাইমস’ পত্রিকা ছাপতে শুরু করে ‘দ্য টাইমস ক্রসওয়ার্ড’। ধীরে ধীরে এটিও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। তবে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত শব্দসন্ধানের সঙ্গেই একসময় বিখ্যাত গুপ্তচর জর্জ ব্লেকের জেল থেকে পালানোর সম্পর্ক খুঁজে পান ব্রিটিশ গোয়েন্দারা।
প্রথম ও দ্বিতীয় দুই বিশ্বযুদ্ধেই এই শব্দছক হয়ে উঠেছিল গুপ্তচরবৃত্তির এক অন্যতম মাধ্যম। গুপ্তচর সংস্থাগুলো পরস্পরের সাথে তথ্য আদান-প্রদানে এই শব্দছকের আশ্রয় নিতো। অনেকসময় কোনো নির্দোষ ক্রসওয়ার্ডকেও সন্দেহের বশে বিপজ্জনক সাংকেতিক তথ্য হিসেবে ভেবে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সব শেষে জানাব শব্দছক নিয়ে এক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কথা। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অফ ইক্সেটার এবং কিংস কলেজের বিজ্ঞানীরা এক পরীক্ষা করে দেখেন যে, যারা নিয়মিত ক্রসওয়ার্ড পাজল সলভ করেন, তাদের মস্তিষ্ক নাকি অন্যদের চেয়ে অনেক সক্রিয় থাকে। তাইতো আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও ক্রসওয়ার্ড পাজলের জনপ্রিয়তা আজও অমলিন।
ফিচার ইমেজ- dreamstime.com