প্রাচীন পৃথিবীর অমানবিক যত শাস্তি

আইন বলে- অপরাধী যে-ই হোক না কেন, তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। আর অপরাধের মাত্রার উপর ভিত্তি করে শাস্তির মাত্রারও রয়েছে ভিন্নতা। আবার যুগের পালাবদলের সাথে সাথে পাল্টে যায় শাস্তির ধরনও। ফলে আজকে যে শাস্তিকে আপনার কাছে যথাযোগ্য বলে মনে হচ্ছে, আজ থেকে শতবর্ষ পরে আপনার বংশধরের কাছেই হয়তো তা অমানবিক ঠেকবে। একই কথা বলা যায় উল্টো দিক থেকেও। অর্থাৎ ইতিহাসে শত শত বছর আগে প্রচলিত নানা শাস্তির কথা শুনে এখন আমাদেরও সেগুলোকে অমানবিক লাগতে পারে।

সে যা-ই হোক, সেই শাস্তিগুলো বাস্তবায়নের উপায় জানলে বিস্মিত না হয়ে থাকার উপায় নেই। প্রাচীন পৃথিবীর এমনই কিছু শাস্তি, যা প্রাণ হরণকারী নয়, সেগুলো নিয়েই চলুন জেনে নেয়া যাক আজ।

মাতালের জোব্বা

একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ মদ্যপানকে কখনোই সমর্থন করবে না। আর মাতালদের মাতলামি যে কখনো কখনো কতটা খারাপ পর্যায়ে যেতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষভাবে অনেকেই দেখেছেন কিংবা পরোক্ষভাবে শুনেছেন অন্যের কাছে। মাতালদের শাস্তি দিতে, আরো ভালো করে বলতে গেলে লজ্জা দিয়ে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে একটি পদ্ধতির প্রচলন ছিলো। মূলত জনসমক্ষে মাতলামি করা ব্যক্তিরাই এর শিকার হতেন।

মাতালের জোব্বা; Source: Wikimedia Commons

মাতালকে শাস্তি দিতে বানানো এ জোব্বাটি ছিলো আসলে একটি ব্যারেল। এর মধ্য দিয়ে তার হাত, পা ও মাথা বের করে রাখার ব্যবস্থা ছিলো। এই ব্যারেলের মধ্যে থাকলে সে শারীরিকভাবে কোনোপ্রকার আঘাত পেত না। কিন্তু শহরজুড়ে এভাবে একটা ব্যারেল গায়ে জড়িয়ে হাঁটা যে কোনো সুখকর অনুভূতি না, তা তো বলাই বাহুল্য। সেই সাথে লোকটিকে দরিদ্রদের পাঁচ শিলিং দানও করতে হতো।

আস্তে আস্তে পুরো ইংল্যান্ডেই মাতালদের শাস্তি দেয়ার এ অভিনব পদ্ধতিটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একসময় তা ছড়াতে শুরু করে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও।

ট্রেডমিল

ট্রেডমিল; Source: cybexintl.com

ঘরের ভেতরে হাঁটা কিংবা দৌড়ের মাধ্যমে শরীরচর্চার যন্ত্র ট্রেডমিল আমাদের অনেকেরই পরিচিত। মজার ব্যাপার হলো এর শুরুটা কিন্তু শরীরচর্চার উদ্দেশ্যে হয় নি, বরং হয়েছিলো জেলে বন্দী থাকা সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত অপরাধীদের কাজ করার যন্ত্র হিসেবে। ঊনিশ শতকে ব্রিটেনে এর প্রচলন হয়। আজকের দিনের ট্রেডমিলগুলো যেখানে চলন্ত মেঝের মতো লাগে, সেখানে শুরুর দিককার জেলখানার সেই ট্রেডমিলগুলো দেখতে ছিলো অনেকটা ওয়াটার হুইলের মতো।

মানবচালিত ট্রেডমিল; Source: Wikimedia Commons

তবে বন্দীরা সেখানে শরীরচর্চার জন্য দৌড়াতো না। এটা ছিলো তাদের শাস্তির অংশ। দৈনিক আট ঘণ্টা তাদেরকে এর উপর হাঁটাচলা করতে হতো। অবশ্য মাঝে মাঝে বিরতির ব্যবস্থাও ছিলো। এমন গাধার মতো খাটানোর উদ্দেশ্য ছিলো একটাই- তাদেরকে অপরাধ থেকে নিরুৎসাহিত করা। অনেক জায়গায় আবার এগুলো কোনো যন্ত্রের সাথেও যুক্ত থাকতো। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় বেডফোর্ড কারাগারের কথা। এর ট্রেডমিলগুলো একটি ময়দা তৈরির মেশিনের সাথে যুক্ত ছিলো। ফলে বন্দীরা এর উপর দিয়ে হাঁটলে অপর প্রান্তে লাগানো মেশিন থেকে প্রস্তুত হতো ময়দা। এভাবে ময়দা প্রস্তুতিতে অবদান রাখায় ময়দা বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ বন্দীদেরও দেয়া হতো।

ক্যাঙ্গু

সতের শতকে চীনে ক্যাঙ্গু নামের এক শাস্তিদানের পদ্ধতির প্রচলন ঘটে। এর বিভিন্ন রুপ ছিলো। তবে সবগুলোর মূলনীতি ছিলো মোটামুটি একই। একজন অপরাধীর গলা একটি কাঠের ফ্রেমে এমনভাবে আটকে রাখা হতো যেন দেহের বাকি অংশ থাকে ফ্রেমের অপর পাশে। বড়সড় কাঠের ফ্রেমটি পেরিয়ে একজন অপরাধীর হাত তার মুখ পর্যন্ত পৌঁছাত না। ফলে নিজে নিজে খাবার খেতে পারতো না সে। খাবার খাওয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের আরো বিভিন্ন কাজের জন্য সমাজের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো তাকে।

ক্যাঙ্গু; Source: pilloryhistory.com

অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী ক্যাঙ্গুর ভরেরও পরিবর্তন হতো। কিছু কিছু ফ্রেম নব্বই কেজি ভর পর্যন্ত ছিলো বলে শোনা যায়। মাঝে মাঝেই এই অতিরিক্ত ভর সইতে না পেরে মারা যেত সেই অপরাধী। ১৯১২ সাল পর্যন্ত চীনে এটি ব্যবহৃত হয়েছে।

উত্তপ্ত লোহার ছ্যাঁক দেয়া

অপরাধের শাস্তি হিসেবে উত্তপ্ত, গনগনে লাল লোহার ছ্যাঁক দেয়ার চর্চা চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে। এর ফলে একদিকে যেমন অপরাধী শারীরিক শাস্তি পেত, তেমনি ছ্যাঁক খাওয়া জায়গাটি সবাই দেখতে পেত বলে মানসিকভাবেও সমাজের কাছে আজীবন ছোট ও অপমানিত হতো সে।

ছ্যাঁক দেয়ার জন্য ব্যবহৃত লৌহদন্ড; Source: londonist.com

চোর এবং পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের ধরতে পারলে তাদের এভাবে ছ্যাঁক দেয়ার নিয়ম ছিলো প্রাচীন রোমে। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীর শরীরে বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন ছ্যাঁক দিয়ে চিরস্থায়ীভাবে বসিয়ে দেয়া হতো। যাযাবর গোত্রীয় কেউ অপরাধে লিপ্ত হলে তার গায়ে V (Vagrant), পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস ধরা পড়লে তার গায়ে S (Slave), ধর্ম সম্পর্কে কটুক্তিকারীদের গায়ে B (Blaspheme) এবং দাঙ্গা সৃষ্টিকারীদের গায়ে F (Fraymaker) বর্ণের ছাপ বসিয়ে দেয়া হতো।

১৮২৯ সালে ব্রিটেনে শাস্তির এই অমানবিক প্রথাটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের কোনো দেশে এটি ব্যবহারের কথা আর শোনা যায় না।

পিকেট

মধ্যযুগে ইউরোপে এ শাস্তির প্রচলন ছিলো। এক্ষেত্রে একটি লাঠি প্রথমে মাটিতে পুঁতে রাখা হতো। এরপর মাটির উপরে থাকা প্রান্তটি ছুরি দিয়ে কেটে ধারালো করা হতো। এবার অপরাধীকে সেই ধারালো প্রান্তের উপর হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো ছবির মতো করে।

পিকেট; Source: Wikimedia Commons

অপরাধীকে এমন উচ্চতায় ঝোলানো হতো যেন সে ব্যথায় লাঠির উপর পা রাখতে বাধ্য হয়। রাখা যেত মাত্র একটি পা। কিন্তু রাখার সাথে সাথেই ব্যথায় কুঁকড়ে যেত সে, কারণ লাঠির মাটির উপরের প্রান্তটি যে সূক্ষ্ম প্রান্তবিশিষ্ট! তবে এতে যেন তার পা কেটে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা হতো। যতক্ষণ না অপরাধী সহ্যের প্রান্তসীমায় উপস্থিত হচ্ছে, ততক্ষণ তাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখা হতো।

পিচক্যাপ

মর্মান্তিক এই শাস্তির দেখা মিলেছিলো ১৭৯৮ সালে। তখন আইরিশ বিদ্রোহের সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের এই শাস্তির মুখোমুখি করা হতো।

পিচক্যাপ; Source: listverse.com

এজন্য প্রথমে হাতের কাছে পাওয়া সুবিধাজনক কিছু, যেমন- শক্ত পাট দিয়ে চোঙাকৃতির টুপি বানিয়ে তা অপরাধীকে পরিয়ে দেয়া হতো। এরপর সেই টুপির উপর ঢেলে দেয়া হতো গরম আলকাতরা! তখন যে বিদ্রোহীর অবস্থা কেমন হতে পারে তা তো সহজেই অনুমেয়। এরপর আবার তার মাথা থেকে টুপিটি খুলে নেয়া হতো। তখন মাথা থেকে একেবারে চুল, এমনকি খুলির চামড়া পর্যন্ত উঠে আসতো। কখনো কখনো আলকাতরার জায়গায় ব্যবহার করা হতো গানপাউডার। টুপিতে গানপাউডার রেখে এরপর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হতো।

স্রষ্টার বিচার

এতক্ষণ ধরে যে শাস্তিগুলোর কথা আলোচনা করা হলো, সেগুলোর সাথে মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে যুক্ত করে নি। মানুষ নিজেই বিচার করেছে, শাস্তিদানের পদ্ধতি ঠিক করেছে, নিজেই অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছে। কিন্তু এবারের পদ্ধতিটি আলাদা। যেসব অপরাধের বেলায় প্রকৃত অপরাধী খুঁজে বের করতে মানুষ ব্যর্থ হতো, সেসব অপরাধের সমাধান খুঁজতে এককালে তারা দ্বারস্থ হতো স্রষ্টার কাছে

এজন্য বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অপরাধের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কেউ যদি সেই পরীক্ষায় পাস করে যেত, তার মানে হলো স্রষ্টা তাকে রক্ষা করেছেন, সে নির্দোষ। কিন্তু যদি কোনো কারণে কেউ সেই পরীক্ষায় ফেল করতো, তাহলে ধরে নেয়া হতো লোকটি অপরাধী, এজন্যই সৃষ্টিকর্তা তাকে ধরিয়ে দিয়েছেন।

ইতিহাসে এর বিভিন্ন রকম নমুনাই খুঁজে পাওয়া যায়। কখনো একজন ব্যক্তি দোষী নাকি নির্দোষ তা বোঝার জন্য তাকে অন্য কারো সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হতে হতো। যদি জিতে যেত, তাহলে সে নির্দোষ, নাহলে দোষী। গরম পানিতে হাত চুবিয়ে একটি পাথর তুলে আনার পরীক্ষা ছিলো। হাত চুবানো লোকটির হাতে যদি তিন দিন পরেও ক্ষত না সারতো, তাহলে ধরা হতো সে অপরাধী।

ব্যাভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হবার পর গনগনে লাল লাঙলের ফলার উপর দিয়ে হেঁটে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করছেন কুনিগুন্ড অফ লুক্সেমবার্গ; Source: Wikimedia Commons

আরেক পরীক্ষায় বাদী-বিবাদী দুজনকেই ক্রুশের সামনে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। যার হাত আগে পড়ে যেত, তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হতো। খুনের অপরাধী নির্ণয়ের জন্য সন্দেহভাজন খুনীকে খুন হওয়া ব্যক্তির লাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। তখন যদি লাশ থেকে কোনো কারণে রক্তপাত হতো, তাহলে লোকটিকে দোষী বলে ধরে নেয়া হতো। আরেক পরীক্ষায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে শুকনো রুটি ও পনির খেতে দেয়া হতো। যদি রুটি তার গলায় আটকে তার দমবন্ধ হবার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, তাহলে ধরে নেয়া হতো সে দোষী।

ফিচার ইমেজঃ torturemag.org

Related Articles

Exit mobile version