কামো নদীর উৎপত্তিস্থল প্রায় তিন হাজার ফুট উচ্চতার মাউন্ট সাজিকিগাতাকে, যার বর্তমান অবস্থান কিয়োটো শহরের উপকন্ঠ কিতাকুতে। জাপানী ভাষায় ‘কামো’ অর্থ ‘বুনোহাঁস’। কামো নদীর পাশেই অবস্থিত ইজুমো-তাইশা, যা জাপানের সবচেয়ে পুরনো শিন্তো মঠগুলোর একটি। পেশায় লৌহকার নাকামুরা সানেমন ও তার পূর্বপ্রজন্ম ইজুমো তাইশা মঠের পরিচারক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। নাকামুরা সানেমনের কন্যা ইজুমো নো ওকুনি ছোটবেলা থেকেই ইজুমো তাইশা মঠে মিকো বা মঠ পরিচারিক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। মিকো হলো পরিপূরক পুরোহিত যারা মঠের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার সহায়ক হিসেবে থাকে। তারা মঠের জন্য পবিত্র নৃত্যও পরিবেশন করত।
ইজুমো নো ওকুনি খুব অল্প বয়সেই অভিনয় ও নৃত্যে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। শিন্তো মঠের আচার-অনুষ্ঠানে তার অভিনয়-নৃত্যগুণ এবং সৌন্দর্যের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুত। অভিনয়-নৃত্যগুণ এবং জনপ্রিয়তার কল্যাণে কিয়োটোর বাইরেও তার ভ্রমণের সুযোগ হয়। মঠ থেকে ওকুনিকে কিয়োটো পাঠানো হতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নৃত্য প্রদর্শনের জন্য। এমনই এক অনুষ্ঠানে ওকুনি দশম শতাব্দীর লোকনৃত্য নেমবুতসু ওদোরি (আমিদা বুদ্ধকে উৎসর্গকৃত নাচ) প্রদর্শন করে আলোচনায় আসেন। প্রচলিত ধর্মীয় নৃত্যের লেবাস ছেড়ে ওকুনি গল্প বাঁধেন একজন পুরুষ এবং পতিতার রসাত্মক কথোপকথোন কেন্দ্র করে, যা দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেললেও মঠের পুরোহিতরা ছিলেন নাখোশ। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নৃত্যে যৌনোদ্দীপক গল্প, অভিনয় এবং সমাজের সাধারণ মানুষের গল্প ছিল অভূতপূর্ব। এ ঘটনার পর পুরোহিতরা ওকুনিকে ডেকে কারণ দর্শাতে বললেও মঠে তিনি আর ফিরে যাননি।
১৬০৩ সালে শুষ্ক কামো নদীর তীরে ওকুনি শুরু করেন তার নিজস্ব থিয়েটার। সেই সাথে শুরু করেন রাজদরবারের নারী মহলে অভিনয়। তার নাট্যদলে সুযোগ পায় কিয়োটোর সুবিধাবঞ্চিত ও তৎকালীন নিম্নশ্রেণীর (বিশেষত পতিতা) নারীরা। ওকুনি তাদের অভিনয়, নৃত্য এবং সঙ্গীত বিষয়ক সকল দীক্ষা দেন। দীক্ষিত সেসব নারীই প্রথম কাবুকি থিয়েটারের সদস্য হয়। কাবুকি শব্দের প্রাথমিক অর্থ ‘যারা অদ্ভুত পোশাকে সদম্ভ চলে’। কাবুকির বিশেষ দুটি বৈশিষ্টের মধ্যে এর অতিরঞ্জিত সজ্জা ও পোশাকের বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। রংচঙা পোশাক, অতিরঞ্জিত সাজসজ্জা এবং বিষণ্ন আবহ সঙ্গীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় একেকটি গল্প। কাবুকি থিয়েটারে বিয়োগাত্মক গল্পের প্রাধান্য বেশি। ধারণা করা হয়, ওকুনি যখন ইজুমি তাইশা মঠে মিকো হিসেবে ছিলেন, তখন থেকেই কাবুকি নৃত্য ও অভিনয়ের কাঠামোগত গঠন শুরু।
এদো পিরিয়ডের শুরুর দিকে কাবুকির জন্ম। এদো পিরিয়ডের সময় ১৬০৩ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত। তকুগাওয়া লেমিতসুর শাসনামলে জাপান বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত থাকার জন্য স্বেচ্ছায় সকল পশ্চিমা দেশের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে। তবে পরবর্তীতে কিছু বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুধুমাত্র নাগাসাকি বন্দরের মাধ্যমে হয়।
১৬৩৩-১৮৫৩ সাল পর্যন্ত জাপানে এ নীতি চালু ছিল। দু’শ বছরেরও অধিক সময় ধরে চলা বৈদেশিক প্রভাব বর্জনের এ নীতি জাপানকে আর্থিকভাবে ঠিক কতটা সাহায্য করেছিল তা বলা মুশকিল হলেও কলা, শিল্প ও সামাজিক প্রথার স্বকীয়তা রক্ষায় যে তা ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল তা বলা একেবারেই সহজ। কাবুকি ঠিক সে সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ফিরে আসি দীক্ষিত সেই নারীদের কথায়। ওকুনির দলে ছিল বিভিন্ন গোত্রের শিল্পী। তাদের বেশিরভাগই পথশিল্পী বা স্ট্রিট-আর্টিস্ট। ওকুনির সেই দলে কোনো পুরুষ শিল্পী ছিল না। নাট্যাংশের পুরুষ চরিত্রগুলোতেও শিল্পী ছিলেন নারীরা। কাবুকির কাঠামোগত গঠন যে সময়ে হতে থাকে, সে সময় ওকুনি কাবুকি থিয়েটারের মাধ্যমে দিন দিন জনপ্রিয় হতে থাকেন। সাধারণ মানুষের কাছে কাবুকি থিয়েটার এক বিস্ময়রূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ তৎকালীন জাপানের প্রচলিত লোক থিয়েটারে শুধুমাত্র ধর্মীয় গাঁথা, কাহিনী এবং কল্পকাহিনীর আধিক্য ছিল। এদিকে কাবুকি থিয়েটারের বিষয় ছিল মানবপ্রেম, যুদ্ধ ও সমসাময়িক ঘটনার হাস্যরসাত্মক নাটকীয় রুপান্তর। ওকুনির কাবুকি গল্পে ফুটে ওঠে ভালোবাসা, যোদ্ধার বীরত্ব এবং পতিতালয়ের নারীদের গল্প। তৎকালীন দর্শকদের মধ্যে তা বিস্ময়ের উদ্ভব ঘটায়। রংচঙা পোশাক, অতিরঞ্জিত সজ্জা, অদ্ভুত বাচনভঙ্গি এবং বিষণ্ন আবহসঙ্গীতের মূর্ছনায় মুগ্ধ হয় দর্শক। ছড়িয়ে পড়ে ওকুনির সুনাম।
কাবুকির মূল কাহিনী ইতিহাস কেন্দ্র করে। পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার নাটকীয় রুপান্তরই কাবুকির প্রধান বৈশিষ্ট্য। বলিষ্ঠ সংলাপ, অদ্ভুত বাচনভঙ্গি ও মর্মস্পর্শী অভিব্যক্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় সেসব ঘটনা। ওকুনি তার গল্পে তুলে আনেন তৎকালীন জাপানী কৃষ্টি ও প্রথার অসঙ্গতি। ওকুনির মঞ্চস্থ নৃত্যাভিনয়ের গল্পগুলো ছিল সেসময়ের জন্য নতুন, কিন্তু সময়োপযোগী। ওকুনি পরবর্তী সময়ে এ গল্পগুলো পরিমার্জিত করা হয়। রাজতন্ত্র ও সামাজিক প্রথাবিরোধী ঘটনাপ্রবাহ মঞ্চস্থ করা পরবর্তীতে সেন্সরশিপ আইনের মাধ্যমে বাতিল হয়।
ধারণা করা হয়, নাগোইয়া সানসোবুরো ছিলেন ইজুমো নো ওকুনির আর্থিক সহযোগী। শুরুর দিককার কাবুকি থিয়েটার পরিচালনার আর্থিক সহায়তা সানসোবুরো দিয়েছিলেন। সানসোবুরো ছিলেন একজন সামুরাই যিনি ১৬০৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ওকুনির বিখ্যাত কাবুকি প্লে-র মধ্যে একটি এই সানসোবুরোকে নিয়েই। সেখানে দেখানো হয়- সানসোবুরো মৃত্যুর পর আবার মর্ত্যে ফিরে আসেন ওকুনির সাথে নাচার জন্য।
১৬১০ সালে ইজুমো নো ওকুনি অবসর গ্রহণ করেন। তার সম্বন্ধে এরপর আর বেশি কিছু জানা যায় না। ধারণা করা হয়, তিনি ১৬১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কাবুকি প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি যে জনপ্রিয়তার স্বাদ পেয়েছিলেন তা ছিল তার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য। তৎকালীন জাপান সমাজে নারীদের আর্থ-সামাজিক অংশগ্রহণ খুবই কম থাকা সত্ত্বেও ইজুমো নো ওকুনি নিজ প্রচেষ্টায় এক মঞ্চশিল্পের গোড়াপত্তন করেন। ওকুনির অবদান পরবর্তীতে এদো পিরিয়ডের কলা ও শিল্পের স্বকীয়তা রাখে। সময়ের পরিক্রমায় আজ কাবুকি বিশ্বনন্দিত ‘ফর্ম অব আর্ট’ এ রুপান্তরিত হয়েছে।
১৬২৯ সালে অশ্লীলতা প্রচার এবং কাবুকি অভিনেত্রীদের প্রতি পুরুষদের অধিক আকৃষ্টতার দরুণ তকুগাওয়া লেমিতসু নারীদের কাবুকি থিয়েটারে অভিনয় করা থেকে বিরত থাকতে বলেন। এর ফলে সকল কাবুকি থিয়েটারে শুধুমাত্র পুরুষদের অভিনয় শুরু হয়, যে প্রথা আজও বহাল আছে।