Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দিনের বেলা পেশাদার রেসলার, রাতের অন্ধকারে ‘ওল্ড লেডি কিলার’!

মেক্সিকোতে বিনোদনের বেশ জনপ্রিয় একটি মাধ্যম প্রো-রেসলিং বা পেশাদার রেসলিং। তবে সাধারণত আমরা রেসলিং বলতে যা বুঝি, মেক্সিকোতে রেসলিংয়ের ফর্মটা তার চেয়ে কিছুটা আলাদা। টেলিভিশনে বসে মারামারি দেখে উত্তেজনায় খাটের উপর লাফিয়ে ওঠার চেয়ে ঢের বেশি আড়ম্বর আর উত্তেজনাপূর্ণ হয় ও দেশের রেসলিং। রেসলার বা লুচাডোররা রঙিন সব মুখোশ পরে, প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে ভয়ঙ্কর অঙ্গভঙ্গি করে, মঞ্চের দড়ি ছিঁড়ে যেন একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। অদ্ভুতদর্শন তো বটেই, গোটা ব্যাপারটা বেশ ভালোই ইন্টারেস্টিংও বলা যায়। তবে জুয়ানা বারাজার জন্য এই রেসলিং রিংয়ের বাইরের দুনিয়াটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। অন্ধকার সে দুনিয়ার সন্ধান পাওয়া সাধারণ কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না।

দিনের বেলা জুয়ানার পেশা ছিল পপকর্ন বিক্রি করা। আর যেদিন খেলা থাকতো, সেদিন মেক্সিকো সিটির বিখ্যাত কোনো রেসলিং ভেন্যুতে লড়াকু সাজে দেখা যেত তাকে। শক্তপোক্ত আর বীর যোদ্ধা জুয়ানাকে রিংয়ের সবাই ‘দ্য লেডি অফ সাইলেন্স’ নামে চিনতো। অপেশাদার সার্কিটে খেলা এই নারীর জন্য রেসলিংয়ের ক্ষেত্রে নামটা যতটা মানানসই ছিল, রেসলিংয়ের দুনিয়ার বাইরে তা ঠিক ততটাই বেমানান। মুদ্রার ওপিঠের নামটি ছিল মাতাভিয়েজিতাস বা ‘লিটল ওল্ড লেডি কিলার’, খাঁটি বাংলায় যাকে বৃদ্ধ নারীদের খুনি বলা যায়। সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি ভিন্ন সত্ত্বার অধিকারী জুয়ানাকে খুঁজে বের করতে তিন বছর ধরে বেশ বেগ পেতে হয় মেক্সিকোর পুলিশদের।

রেসলিংয়ের কস্টিউমে জুয়ানা; Image Source: wrestlingforum.com

২০০৩ সালের শুরুর দিকের কথা। পেশা হিসেবে পপকর্ন বিক্রিকে বেছে নেয়ায় বেশ অনেকের সাথে পরিচয় ছিল জুয়ানার। সেই সুবাদে বয়স্ক নারীদের ঘরে ঢুকে তাদের সাহায্য করার ভণিতা করবার সুযোগ পেয়ে যেত সে। অনেক সময় সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সেবা দিতে এসেছে, এমন কথা বলেও তাদের ঘরে ঢুকে পড়ত জুয়ানা। ঘরে ঢুকে কোনো একটা অস্ত্র বেছে নিত সে। ঘরের কোণায় পড়ে থাকা দড়ি বা টেলিফোনের তার খুলে নিয়ে গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করত তাদের। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এভাবে খুন করা হয় প্রায় ১১ জন বৃদ্ধ নারীকে।

ভিক্টিম বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে আর দশজন সিরিয়াল কিলারের মতো সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুযায়ী না চলে একটু ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করত জুয়ানা। সরকারের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে নারীদের তালিকা সংগ্রহ করত সে। তারপর প্রথমে খুঁজে বের করত তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক নারীদের নাম। তাদের ভেতরে যারা একা থাকতো, তারাই ছিল জুয়ানার প্রথম পছন্দ। সরকারি সেসব সংস্থার কাগজ চুরি করে বা নকল করে নিজেকে নার্স দাবি করে তাদের ঘরে ঢুকতো সে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিশ্চিত করতো ভদ্রমহিলার রক্তচাপ ০/০ আছে কিনা।

এহেন অদ্ভুত পন্থার সাথে যে মোটেই পরিচিত ছিল না মেক্সিকান পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, তা আর আলাদা করে বলাই বাহুল্য। তাদের ধারণা ছিল, বিকৃত যৌন রুচির কোনো পুরুষের কাজ এটি। কাজেই দীর্ঘদিনযাবত নির্বিঘ্নে সবার সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াতে পেরেছে জুয়ানা। ভিক্টিমের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সাথে করে কোনো না কোনো স্মারকচিহ্ন নিয়ে যেত সে। আর্থিক কোনো লাভের জন্য খুন সে করতো না, এটুকু তো খুনের ধরন দেখে নিশ্চিত করে বলা যায়। তবে ভিক্টিমের ব্যবহার্য ছোটখাট কোনো নিশানা অথবা তার বাড়িতে থাকা ধর্মীয় কোনো ছবি বা তাবিজ জাতীয় কিছু নিজের সংগ্রহে রাখতো সে। ছোট্ট এই মেমেন্টোটি যেন তার বিজয়ের স্মৃতি বহন করতো।

জুয়ানা বারাজা; Image Source: crimescenedb.com

প্রতিটি কেস অনুসরণ করে পাগলের মতো হন্যে হয়ে খুনিকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো পুলিশ। ছেলেটা কেন এমন কাজ করছে বুঝতেই পারছিল না তারা। অপরাধবিজ্ঞানীরাই তাকে ‘কনফিউজড সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি’ সমৃদ্ধ এক খুনী পুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাদের মতে, শৈশবে কোনো বয়স্ক আত্মীয়ের দ্বারা শারীরিক বা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই এই রাস্তা বেছে নিয়েছে সে। অপমানবোধ আর অসন্তোষ থেকে জন্ম নেয়া প্রতিহিংসাকে চরিতার্থ করতে একের পর এক খুন করে চলেছে সে। নির্দোষ এই ভিক্টিমরা খুব সম্ভবত শৈশবে যে তার উপর নিপীড়ন চালিয়েছে, তার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিল। পরস্পর সম্পর্কহীন এই সিরিয়াল কিলিংয়ের পেছনে এর চেয়ে ভালো ব্যাখ্যা তারা দাঁড় করাতে পারেননি।

পরবর্তীতে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে অপরাধবিজ্ঞানীদের এই ধারণা। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, খুন হওয়া এক নারীর ঘর থেকে সন্দেহভাজন যে ব্যক্তিকে সে বেরিয়ে যেতে দেখেছে, তার শারীরিক গঠন, আকার-আকৃতি পুরুষালি হলেও পরনে ছিল নারীদের পোশাক। কাজেই পুলিশ এবার তদন্তের জন্য জোরেসোরে খোঁজ করতে লাগলো তৃতীয় লিঙ্গের যৌনকর্মী বা এ ধরনের গড়নের কোনো অপরাধীকে।

সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে ধাবিত হওয়া পুলিশকে ঘোল খাইয়ে বেশ ভালোই দিন কাটছিল জুয়ানার। তার টিকির হদিস পাওয়াও যে পুলিশের পক্ষে সম্ভব না, দিব্যি বুঝে গিয়েছিল সে। পরবর্তী কয়েক বছর তাই নিশ্চিন্ত মনে খুনলীলা চালিয়ে যায় সে। সরকারি হিসেব মতে নিহত নারীদের সংখ্যা ১১ হলেও, প্রকৃতপক্ষে তা ৫০ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়। বিষয়টি এমন মহামারী আকার ধারণ করায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই খুব দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করতে আসল অপরাধীকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

২০০৬ সালে ৮২ বছর বয়সী এক নারীকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করে জুয়ানা। ক্রাইম সিন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় খুনীর সাথে দেখা হয়ে যায় ঐ বৃদ্ধার পেয়িং গেস্টের। কাজ সেরে বাড়িতে ঢুকে বাড়িওয়ালীর মৃতদেহ চোখে পড়ে তার। সাথে সাথে পুলিশকে ফোন করে সে। ততক্ষণে অবশ্য বাড়ি থেকে সটকে পড়েছে খুনি, নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদেই হয়তো এই মেয়েটিকেও খুন করার কথা মাথায় আসেনি তার। প্রত্যক্ষদর্শীর সহায়তায় জুয়ানা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে আটক করে পুলিশ।

কারাগারে বন্দি জুয়ানা; Image Source: elpais.com

জিজ্ঞাসাবাদের সময় জুয়ানা কেবল ঐ ৮২ বছরের বৃদ্ধাকে খুন করার কথাই স্বীকার করে। রাগের বশবর্তী হয়ে খুনটি করে সে। বয়স্ক নারীদের প্রতিই তার একধরনের চরম বিতৃষ্ণা রয়েছে বলে জানায় সে। তার এই ঘৃণার উৎপত্তি হয় নিজের মায়ের প্রতি বিরূপ ধারণা থেকে। নেশাগ্রস্ত মা মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরত মাঝরাতে। মেয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিল তার দ্বিতীয় স্বামীর উপরে। সৎ বাবার কাছে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া জুয়ানার সবটা ক্ষোভ এসে জমা হয় মায়ের প্রতি। মাত্র ১২ বছর বয়সে জীবনের নোংরা দিকগুলো দেখতে পেয়ে পেশা হিসেবে সে বেছে নেয় রেসলিংয়ের মতো লড়াকু খেলাকে, নেশা হিসেবে বেছে নেয় রাতের অন্ধকারে বয়স্ক নারীদের খুন করাকে।

জুয়ানার মতে, এতগুলো খুনের পেছনে সে একা দায়ী না। গণমাধ্যমের সামনে তাকে হাজির করার পর সবাদ সম্মেলনে সে খোলাখুলি জানায়, “কর্তৃপক্ষের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, আমি একা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত না। আমার মতো আরও অনেকেই এমন অন্যায় জুলুম আর খুনের সাথে যুক্ত। পুলিশ কেন তাদেরকেও গ্রেপ্তার করছে না?” তবে পুলিশের হিসাব আলাদা। তাদের মতে, গোটা সিরিয়াল কিলিং জুয়ানা একাই করেছে। বেশ কয়েকটি অপরাধ সংঘটনের স্থান থেকে তার হাতের ছাপের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। কাজেই এখানে জুয়ানার ভূমিকা নিয়ে সন্দেহের আর কোনো অবকাশই থাকে না।

পুলিশের সংগৃহীত প্রমাণাদি অনুযায়ী, জুয়ানার বিরুদ্ধে অন্তত ১৬টি খুনের অভিযোগ প্রমাণ করা যেত। আর কেবলমাত্র অভিযোগের দিক থেকে তো তা ৫০ এর কাছাকাছি বলে কথিত আছে। একটি খুনের কথা স্বীকার করলেও, জুয়ানার বিরুদ্ধে থাকা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে ৭৫৯ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। জুয়ানা বলে, “আমি জানি, আমি যা করেছি তা নিঃসন্দেহে একটি অপরাধ। যা করেছি, তার জন্য শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু অন্যের অপরাধের সাজাও কেন আমাকে দেয়া হচ্ছে, বুঝলাম না”

মেক্সিকোর প্রধান প্রসিকিউটর বার্নান্দো বাটিজ সিরিয়াল কিলিংয়ের সাথে জুয়ানার সম্পৃক্ততার কথা নিশ্চিত করেছেন। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মকর্তার বরাতে জানানো হয়, শৈশবে সৎ বাবার কাছে ধর্ষণের শিকার হয়ে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে জুয়ানা। জুয়ানার সাথে নিষিদ্ধ মাদক পাচারকারী সংঘ ‘সান্তা মুয়ের্তে’র যোগসাজশ থাকতে পারে বলে ধারণা করছে মেক্সিকোর পুলিশ।

ফিচার ইমেজ- crimefeed.com

Related Articles