হুইসেল ব্লোয়ারদের কথা উঠলেই আমাদের মনে পড়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং এনএসএর হ্যাকার এডওয়ার্ড স্নোডেন কিংবা উইকিলিক্সের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কথা, কিংবা বড়জোর পেন্টাগন পেপারস ফাঁসের পেছনে জড়িত ড্যানিয়েল এলসবার্গের কথা। সন্দেহ নেই, তাদের প্রত্যেকের কাজই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু তারা মার্কিন সরকারের টপ সিক্রেট তথ্যগুলো প্রকাশ করেছিলেন বা করতে পেরেছিলেন সময়ের অনেক পরে।
সেই তুলনায় ক্যাথরিন গান এক ব্যতিক্রমী হুইসেল ব্লোয়ার। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি যখন জানতে পারেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য মিলে অন্যায়ভাবে ইরাক আক্রমণের জন্য জাতিসংঘের ভোট জালিয়াতি করতে যাচ্ছে, তখন তিনি সেটা ফাঁস করে দিয়েছিলেন সময়ের অনেক আগেই। তিনি চেয়েছিলেন সময় থাকতেই অন্যায় একটা যুদ্ধ থামিয়ে দিতে। বলাই বাহুল্য, তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু সন্দেহ নেই বিশ্বের সামনে তিনি সৃষ্টি করে গেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
ক্যাথরিন গান ছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা GCHQ তথা গভর্নমেন্ট কম্যুনিকেশনস হেড কোয়ার্টার্সের একজন কর্মচারী। গোয়েন্দা-সংস্থায় চাকরি করার কোনো পরিকল্পনা ক্যাথরিনের কখনো ছিল না। তার ইচ্ছে ছিল আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই শিক্ষকতা করে কিংবা অনুবাদের চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে। কিন্তু অনেকটা ভাগ্যক্রমেই তিনি চাকরি পেয়ে যান ব্রিটেনের সবচেয়ে গুরুত্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি, GCHQ-তে।
জন্ম লন্ডনে হলেও বাবার চাকরির সুবাদে ক্যাথরিন গান বেড়ে উঠেছিলেন তাইওয়ানে। সেখানে থাকতেই তিনি শিখেছিলেন চাইনিজ ম্যান্দারিন এবং জাপানিজ ভাষা। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে কয়েক বছর জাপানে শিক্ষকতা করার পর তিনি যখন ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন, তখন প্রথম প্রথম পছন্দমতো কোনো চাকরি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এসময়ই একদিন তার চোখে পড়ে GCHQ-এর একটি বিজ্ঞাপন; তাদের চীনা ভাষায় পারদর্শী একজন অনুবাদক দরকার। সাথে সাথেই যোগাযোগ করেন ক্যাথরিন। কিন্তু GCHQ যে একটি গোয়েন্দা সংস্থা, সে তথ্যও তখনও তিনি জানতেন না।
এই সংস্থাটির কাজ হচ্ছে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শত্রু রাষ্ট্রগুলোর উপর গোয়েন্দাগিরি করা, তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর আড়িপাতা। সেখানে ক্যাথরিনের কাজ ছিল আড়িপেতে সংগ্রহ করা চীনা এবং জাপানি গোপন বার্তাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করা। রুটিন মাফিক দিনগুলো ভালোই কাটছিল তার। কিন্তু ২০০২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন ইরাক যুদ্ধের তোড়জোড় শুরু হতে থাকে, তখনই তার বিবেক তাতে বাধা দিতে থাকে। তার মনে পড়তে থাকে টিভির পর্দায় দেখা প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকার বিমান হামলায় নিহত ইরাকি যোদ্ধাদের ছিন্নভিন্ন শরীরের দৃশ্যগুলোর কথা, আমেরিকার অবরোধের কারণে অপুষ্টিজনিত কারণে লক্ষ লক্ষ ইরাকি শিশুর মৃত্যুর সংবাদের কথা।
ক্যাথরিন গানের অস্বস্তি ক্ষোভে রূপ নিতে শুরু করে, যখন তিনি দেখতে পান- কীভাবে জাতিসংঘকে ব্যবহার করে একের পর এক ইরাক আক্রমণ করার অজুহাত খুঁজে চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সেইসাথে তার নিজের দেশ যুক্তরাজ্য। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই দুই দেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নতুন একটি রেজোল্যুশন পাশের প্রস্তাব তোলে, যা পাশ হলে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনকে তার কথিত পারমাণবিক কর্মসূচী বাতিলের জন্য মাত্র একমাস সময় বেঁধে দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু, ফ্রান্স এবং রাশিয়া ঐ প্রস্তাবে ভেটো দেবে বুঝতে পেরে তারা পিছিয়ে যায় এবং বিকল্প পথ খুঁজতে শুরু করে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ইরাক আক্রমণের পরিকল্পনার প্রধান অংশীদার ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। কিন্তু ব্লেয়ারের এ অবস্থানে সায় ছিল না দেশটির ভেতরে অনেকেরই। ব্রিটেনের বিরোধী দলীয় লেবার পার্টি এর তীব্র বিরোধিতা করছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, এমনকি সরকার দলীয় আইনজীবীদের অনেকেও এর বিরোধিতা করছিল এই যুক্তিতে যে, এই যুদ্ধ হয়তো আইনগতভাবে অবৈধ বলে প্রমাণিত হতে পারে এবং এতে ভবিষ্যতে ব্রিটিশ সেনাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। কিন্তু বুশ এবং ব্লেয়ার ছিলেন যুদ্ধ বাঁধানোর জন্য মরিয়া। হাল না ছেড়ে তারা নিরাপত্তা পরিষদে দ্বিতীয়বার ভোটাভুটির আয়োজন করে যেতে থাকেন।
এরকম পরিস্থিতিতে, ২০০৩ সালের ৩১ জানুয়ারি, অনেকটা ভাগ্যক্রমেই ক্যাথরিনের গানের হাতে এমন একটি ডকুমেন্ট এসে পড়ে, যা তার জীবনকে পাল্টে দেয় চিরকালের জন্য। সেদিন সকালে অফিসে গিয়ে রুটিন মাফিক সংস্থার অভ্যন্তরীণ ই-মেইল চেক করতে গিয়ে তিনি দেখতে পান, সেখানে একটি ইমেইল এসেছে মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থা NSA (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি)-এর কাছ থেকে। ইমেইলের বিষয়বস্তু পড়ে রাগে, ঘৃণায় ক্যাথরিনের শরীর কাঁপতে থেকে। তিনি কখনো ভাবতেও পারেননি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এতটা নোংরা কাজ করতে পারে।
ফ্রান্স এবং রাশিয়ার ভেটোকে রুখে দেওয়ার জন্য সে সময় আমেরিকা এবং ব্রিটেন নতুন পরিকল্পনা করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যদের মধ্যে যত বেশি সম্ভব সদস্যকে তারা নিজেদের পক্ষে ভোট দেওয়ানোর ব্যবস্থা করবে, যেন চাপে পড়ে স্থায়ী সদস্যরা ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। ক্যাথরিন গান NSA‘র ইমেইলে দেখতে পান- NSA, GCHQকে ঠিক সেই পরামর্শই দিচ্ছে- কীভাবে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য অ্যাঙ্গোলা, বুলগেরিয়া, চিলি, মেক্সিকো, গিনি এবং পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের উপর গোয়েন্দাগিরি করে তাদের সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ করে এরপর তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করে ভোট দিতে রাজি করাতে হবে!
ক্যাথরিনের বুঝতে দেরি হয়নি, এই চিঠির তাৎপর্য কত বেশি। এক অন্যায় যুদ্ধ শুরু করার জন্য বিশ্বের দুই পরাশক্তি মিলে জঘন্য এক পরিকল্পনা করছে, আর সেই যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার, বা অন্তত থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার সুবর্ণ সুযোগ আছে তার সামনে। কিন্তু এতে যে বিপদের সম্ভাবনাও আছে! ব্রিটেনের ‘অফিশিয়াল সিক্রেট’ আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় গোপন কোনো তথ্য ফাঁস করলে নিশ্চিত দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড। কী করবেন তিনি? নিজের ক্যারিয়ারের স্বার্থে এত বড় অন্যায় দেখেও চেপে যাবেন? নাকি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তা ফাঁস করে দেবেন বিশ্ব মানবতার স্বার্থে?
বিকেলবেলা ঘরে ফিরে গেলেন ক্যাথরিন। পরের দু’দিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। পুরো দুই দিন ধরে তিনি নিজের সাথে বোঝাপড়া করলেন। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, তাকে অবস্থান নিতে হবে ন্যায়ের পক্ষেই। তাতে তার চাকরি গেলেও যাক, দেশদ্রোহিতার অভিযোগ মাথায় নিতে হলেও হোক! সোমবারে সকালে অফিসে গিয়ে সবার অলক্ষ্যে তিনি ইমেইলটি প্রিন্ট করে ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে নেন। এরপর অফিস থেকে বেরিয়ে ছুটে যান তার পূর্ব পরিচিত এক যুদ্ধবিরোধী কর্মীর কাছে। তার মাধ্যমে সেটা পৌঁছে দেন ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য অবজার্ভারের এক সাংবাদিকের কাছে।
সে সময় অবজার্ভারের নীতিগত অবস্থান ছিল যুদ্ধের পক্ষে। কিন্তু এটি ছিল পত্রিকার প্রকাশক এবং রাজনৈতিক সম্পাদকের অবস্থান। এর বাইরে অধিকাংশ সংবাদকর্মীই ছিলেন যুদ্ধের বিপক্ষে। তাদেরই একজন ছিলেন সাংবাদিক মার্টিন ব্রাইট। প্রথমে রাজি না হলেও মার্টিন ব্রাইটের এবং তার এক সহকর্মীর চাপে শেষ পর্যন্ত অবজার্ভার এ সংবাদ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা শিরোনাম করে,
Revealed: US dirty tricks to win vote on Iraq war
পুরো ইমেইলটিই তারা তুলে দেয় তাদের ফ্রন্টপেজে।
ক্যাথরিন গানের নাম তখনও কেউ জানত না। তিনি বিশ্ববাসীর সামনে হিরো হওয়ার জন্য গোপন তথ্য ফাঁস করেননি। তিনি চেয়েছিলেন একটা অন্যায় যুদ্ধ থামিয়ে দিতে। গ্রেপ্তারের ভয়ে নিজের নাম-পরিচয় গোপন রেখে তাই তিনি শুধু মেমোটাই লিক করেছিলেন। কিন্তু জিসিএইচকিউ যখন তাদের প্রতিটি কর্মচারীকে এক এক করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে, লাই ডিটেক্টরে বসাতে শুরু করে, তখন নিজের সহকর্মীদেরকে হয়রানির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি সামনে এগিয়ে আসেন এবং নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন।
তাৎক্ষণিকভাবে ক্যাথরিন গানকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিন পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত আটক রাখা হয়। সে সময় ব্রিটিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চের এক অফিসার যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন, ব্রিটিশ সরকারের একজন কর্মচারী হয়েও কেন তিনি সরকারের গোপন তথ্য ফাঁস করেছেন, তখন তিনি উত্তর দেন-
“না, আমি ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করি না। আমি চাকরি করি ব্রিটিশ জনগণের জন্য। আমার সংগ্রহ করা গোপন তথ্য দিয়ে সরকার জনগণের সাথে প্রতারণা করবে- এটা আমি হতে দিতে পারি না।”
জামিন পাওয়ার পরেও ব্রিটিশ গোয়েন্দারা ক্যাথরিনের উপর চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি অব্যাহত রাখে। দীর্ঘ আটমাস এভাবে চলার পর অবশেষে তার মামলা আদালতে তোলা হয়। কিন্তু তার আইনজীবী যখন তাকে নির্দোষ প্রমাণের লক্ষ্যে পাল্টা ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্তকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেন এবং আরো গোপন ডকুমেন্ট প্রকাশ করার দাবি জানান, তখন রাষ্ট্রপক্ষ পিছিয়ে পড়ে। তারা ক্যাথরিনের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নেয়।
কোনো প্রকার শাস্তি ভোগ না করেই মুক্তি পান ক্যাথরিন গান। কিন্তু ততদিনে তার জীবনের উপর দিয়ে প্রচুর ধকল বয়ে গেছে। আদালতে শাস্তি না হলেও GCHQ-তে কিংবা অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বাতিল হয়ে গেছে। কিছুদিন এদিক-সেদিক চাকরি খুঁজে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে তিনি তার কুর্দি স্বামীর সাথে ইংল্যান্ড ছেড়ে তুরস্কে পাড়ি জমান। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন।
২০০৮ সালে ক্যাথরিন গানের জীবনী নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়, যার নাম দ্য স্পাই হু ট্রাইড টু স্টপ অ্যা ওয়ার। এই বই অবলম্বনে ২০১৯ সালে মুক্তি পায় মার্কিন-ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অফিশিয়াল সিক্রেটস। সিনেমাতে ক্যাথরিনের চরিত্রে অভিনয় করেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী কিরা নাইটলি। সিনেমার শ্যুটিংয়ের আগে অভিনেত্রী কিরা নাইটলি গিয়েছিলেন আসল ক্যাথরিন গানের সাথে সাক্ষাৎ করতে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি যে নিজের দেশের আইন ভঙ্গ করেছেন, এত বছর পর এখন আপনার মনোভাব কী? ক্যাথারিন উত্তর দিয়েছেন, আমার যা করা উচিত ছিল, সেটাই করেছি। আমাকে যদি আবারও এই কাজ করতে হয়, তাহলে আবারও করব।
এই আর্টিকেলটি ভালো লাগলে পড়তে পারেন বাস্তব জীবনের সত্যিকার স্পাইদের কাহিনি নিয়ে এই লেখকের লেখা বই “স্পাই স্টোরিজ: এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি“।
বইটি সংগ্রহ করতে পারেন এখান থেকে: roar.cm/spy-stories