জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহবানে সাড়া দিতে গিয়ে ২৬ মার্চ, ১৯৭১-এর বেতারের খবরে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। নিজেই বাহিনী তৈরি করেন এবং উর্ধ্বতনদের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে ৪ এপ্রিল ‘৭১ খুলনার গল্লামারী রেডিও সেন্টার আক্রমণ করেন। তিনি নিজেই ছিলেন এ যুদ্ধের ফিল্ড কমান্ডার। শত বাধা যে বীর সেনানীর গতিরোধ করতে পারেনি, যে রেডিও সেন্টার স্বাধীন করতে গিয়ে তিনি প্রথমে গাজী হন এবং পরে শহীদ হন, সেই রেডিও সেন্টার আজ স্বাধীন এবং সেই রেডিও সেন্টারের স্থানটিতেই আজ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে শহীদের কোনো নাম নিশানা খুঁজে পাওয়া যায় না। এটি কি শহীদের প্রতি অবমাননা নয়?
কথাগুলো এস এম ফজলে আমীনের। ১৯৯৯ সালে সাপ্তাহিক মুক্তিবার্তা পত্রিকায় ‘শহীদ জয়নুল আবেদীন-একজন যোদ্ধার চালচিত্র’ শীর্ষক রচনায় প্রবল আক্ষেপের সাথে কথাগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন তিনি।
এরপর অবশ্য আরো বিশটি বছর কেটে গেছে। খুলনার নিরালা সিটি কলেজ ছাত্রাবাস চত্বরে রয়েছে শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়ার মাজার। সোনাডাঙ্গায় রয়েছে তার নামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাছাড়া যুদ্ধস্থল স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে তার নাম।
কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, আসলেই কতজন মানুষ জানে মুক্তিযুদ্ধের এই মহান শহীদের কথা? সংখ্যাটা কিন্তু আসলেই অনেক কমে আসবে। স্বয়ং শহীদ জয়নুল আবেদীনের পুত্র, ভাই, আত্মীয়সহ তার জন্মস্থান চিতলমারীর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন, বর্তমান প্রজন্মের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ জানেন না যুদ্ধকালীন তার সাহসী অবদান সম্পর্কে।
কীভাবেই বা জানবে! এই মহান মুক্তিযোদ্ধার সাহসিকতার গল্প ছড়িয়ে দিতে কোনো উদ্যোগ তো নেয়া হয়ইনি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে; বরং ইতঃপূর্বে বিদ্যালয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইগুলোতে তার গল্প থাকলেও, বিএনপি সরকারের আমলে বাদ দেয়া হয় তা। বর্তমানে শহীদ জয়নুল আবেদীনের বসতবাড়ি পড়ে আছে জীর্ণদশায়, সেখানে নেই কোনো স্মৃতিফলকও।
কে এই জয়নুল আবেদীন?
বেনজির আহম্মদ টিপু রচিত ‘চিতলমারীর ইতিহাস’ বই থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর শহীদ জয়নুল আবেদীনের জন্ম ১৯২৮ সালে, বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার আড়ুয়াবর্নী গ্রামে। তার পিতা শেখ লেহাজ উদ্দিন, আর মাতা মাজুবিবি। জয়নুল আবেদীন পড়াশোনা করতেন বাগেরহাট পিসি কলেজে। আর তখনই উপমহাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল ইংরেজদের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য। এমতাবস্থায় তরুণ জয়নুল আবেদীন যোগদান করেন ভারতবর্ষের সেনাবাহিনীতে। বীরত্ব ও কৃতিত্বের জন্য পরবর্তীতে বহু সম্মাননা ও উপাধিতেও ভূষিত হন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদান
চিতলমারীতে দীর্ঘদিন যাবত সাংবাদিকতা করে চলা মোঃ একরামুল হক মুন্সীর বিবরণী থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রেডিওতে স্বাধীনতার খবর পাওয়ার পর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা জয়নুল আবেদীন। তার ঘরে ছিল দোনলা একটি আগ্নেয়াস্ত্র (বন্দুক) এবং কিছু কার্তুজ। সেগুলো নিয়েই তিনি যুদ্ধাভিমুখে অগ্রসর হতে উদ্যত হন।
তখন তাকে বাধা প্রদান করেন গর্ভবতী স্ত্রী হাজেরা মানিক। স্থানীয় মুরব্বিদেরও দ্বারস্থ হন তিনি, যেন তারা জয়নুল আবেদীনকে আটকান। কিন্তু হাজেরা মানিকের সকল প্রচেষ্টা বিফল হয়। মুক্তিযুদ্ধে যেতে জয়নুল আবেদীন ছিলেন বদ্ধপরিকর, তাই তিনি সকল পিছুটানকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যান।
সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীনের মুক্তিসংগ্রামের সূচনা হয় চিতলমারী উপকণ্ঠে সমবেত জনতার উপস্থিতিতে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়ির করবার লক্ষ্যে এক জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদানের মাধ্যমে। তার সেই ভাষণের কথা মনে পড়লে আজো গা শিউরে ওঠে সেদিন উপস্থিত অনেকের।
জয়নুল আবেদীনের ভাষণ বেশ কাজে দিয়েছিল। তার ভাষণ থেকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকজন ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিলেন তার সাথে। তাদের সবাইকে সাথে নিয়ে তিনি প্রথমে বাগেরহাটে যান, এবং সেখান থেকে আরো লোক জোগাড় করে চলে যান খুলনায়।
তার মূল লক্ষ্য ছিল খুলনার গল্লামারীতে অবস্থিত বেতার কেন্দ্র এলাকাকে পাক সেনাদের কবল থেকে মুক্ত করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপন। এজন্য প্রথমে তার প্রয়োজন ছিল পাক সেনাদের অবস্থান দেখা, এবং সে অনুযায়ী যুদ্ধের নকশা করা। কিন্তু রেকি (লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ ও আক্রমণপূর্ব পর্যবেক্ষণ) করতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন, আবার বুদ্ধি খাটিয়ে পালিয়েও আসেন। এজন্যই বলা হয়ে থাকে যে, তিনি প্রথমে গাজী হয়েছিলেন।
খুলনা বেতার কেন্দ্র
১৯৭১ সালে খুলনা বেতার কেন্দ্র ছিল একটি সদ্যজাত প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর মাত্র কিছুকাল পূর্বে এ কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ সালে শুরু হয়েছিল নির্মাণ কাজ। প্রচার ভবন ব্যতিরেকেই শহরের মূল কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণে গল্লামারী নামক স্থানে এর ট্রান্সমিটার ভবন স্থাপন করা হয়। আর আনুষ্ঠানিকভাবে বেতার কেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হয় ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর।
১৯৭১ সালের মার্চ মাস সারা দেশের সকল বেতার কেন্দ্রের জন্যই ছিল একটি ঘটনাবহুল মাস। ব্যতিক্রম ছিল না খুলনার বেতার কেন্দ্রটিও। দেশের আর সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মতো খুলনা বেতারের কর্মীরাও একাত্ম হয়েছিলেন বাঙালির প্রাণের সংগ্রামে। তাই তারাও নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাঙালির স্বার্থ রক্ষার যাবতীর কার্যক্রম পরিচালনা করে যেতে থাকেন।
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটি ৮ মার্চ সকালে প্রচার করেন খুলনা বেতারের কর্মীরা। এরপর থেকে খুলনা বেতার কেন্দ্রকে ‘রেডিও পাকিস্তান’ বলাও বন্ধ করে দেয়া হয়, এবং নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তারা জনগণকে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জ্বীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট থাকেন।
২৫ মার্চের পর দেশব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলে খুলনা বেতারের সকল কর্মী নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। তবে কেন্দ্র ত্যাগ করার আগে বেতার কেন্দ্রের প্রকৌশলীরা সব যন্ত্রপাতি এমনভাবে বন্ধ করে দেন যেন তারা ছাড়া আর কেউ সেগুলোকে চালু করতে না পারে।
পাক বাহিনীর খুলনা দখল
খুলনাই ছিল বাংলাদেশের সর্বশেষ বড় শহর, যেটি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়। খুলনা দখলে এত সময় লাগার পেছনে বড় অবদান ছিল খুলনার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বৃহত্তর খুলনার মুজিব বাহিনীর কমান্ডার শেখ কামরুজ্জামান টুকু বলেন,
ঢাকায় পাকিস্তান আর্মি ক্র্যাকডাউন করার পর আমরা ছাত্র, শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষদের প্রতি আহবান জানাই গাছের গুঁড়ি, ইট ও পাথর দিয়ে ঢাকা-খুলনা হাইওয়ে, রেইলওয়ে লাইনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে, যেন হানাদার বাহিনীর আগ্রাসন দমন করা যায়।
এরপরও ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ ২১৬ কনভয়ে করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী খুলনায় প্রবেশ করে, বিভিন্ন স্থানে তাদের ক্যাম্প করে, এবং খুলনা বেতার কেন্দ্রটি দখল করে নেয়।
বেতার কেন্দ্র যুদ্ধের পরিকল্পনা
কামরুজ্জামান টুকু খুলনা শহরে বেশ কিছু প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ পরিচালনা করার পর আর যখন টিকতে পারেননি, তখন রূপসা নদীর ওপারে চলে যান। সেখানে রূপসা রেল স্টেশনের কাছে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। পরে খুলনা শহর থেকে রূপসা পারের দিকে পাক বাহিনী একটানা শেল নিক্ষেপ করতে থাকলে, সেখান থেকে আরো কিছুটা সরে এসে নৈহাটি স্কুলে অবস্থান নেন।
এই নৈহাটি স্কুলেই কামরুজ্জামান টুকুর সাথে যোগ দেন চিতলমারী থেকে আসা জয়নুল আবেদীন। এরপর বাগেরহাটের এমপি এবং বাগেরহাট সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আব্দুর রহমানের মাধ্যমে কামরুজ্জামান টুকুর সাথে যোগাযোগ হয় মেজর এম এ জলিলের (সেক্টর কমান্ডার-৯)। খুলনা বেতার কেন্দ্র আক্রমণের পরিকল্পনাও তৈরি হতে থাকে সেখানে বসেই।
খুলনা বেতার কেন্দ্র আক্রমণের পরিকল্পনাটি ৩১ মার্চ সম্পন্ন হয় মূলত তিনজন ব্যক্তির যৌথ প্রয়াসে। তারা হলেন: মেজর জলিল, খুলনা বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান টুকু এবং সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন।
রেডিও ভবন আক্রমণ করার আগে বাহিরদিয়ার মানসের বাহিনীর সাথেও যোগাযোগ করা হয়। মানস ঘোষ ছিলেন খুলনার একজন বহু আলোচিত বামপন্থী বিপ্লবী নেতা, যিনি ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সাথে জড়িত ছিলেন। তাকে বেতার কেন্দ্র আক্রমণের যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি এ অভিযানে সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন।
স্মরণীয় সেই বেতার কেন্দ্র যুদ্ধ
খুলনা বেতার কেন্দ্র দখলের নিমিত্তে বিখ্যাত সেই যুদ্ধটি হয়েছিল ৪ এপ্রিল। এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ যোদ্ধা, যদিও তাদের প্রায় সকলেরই নাম অজানা। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, চিতলমারী, মোল্লাহাট প্রভৃতি এলাকা থেকে এসে দলছুট পুলিশ, ইপিআর, মুজাহিদ, আনসারসহ বহু সশস্ত্র ও নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী যুবক যোগ দিয়েছিলেন এই যুদ্ধে।
কোনো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রই ছিল না মুক্তিবাহিনীর কাছে। অস্ত্র বলতে ছিল কেবল ২০০ থেকে ২৫০টির মতো থ্রি নট থ্রি রাইফেল এবং কিছু দেশী বন্দুক ও বোমা। নৈহাটি স্কুল থেকে ৩ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে রওনা হয়েছিলেন তারা। কিন্তু শুরুতেই ঘটে যায় এক বিপত্তি। রূপসা নদী পার হওয়ার সময় এক আনসারের রাইফেল থেকে হঠাৎ বের হয়ে যাওয়া একটি গুলির আঘাতে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটে এক মাঝির।
যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনজন। তারা হলেন সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন, কামরুজ্জামান টুকু এবং নায়েক সিদ্দিক। মেজর জলিল এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেননি।
জয়নুল আবেদীন ছিলেন যুদ্ধের কমাণ্ডার। তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন কাটআউট পয়েন্টের দায়িত্ব। এছাড়া সমন্বয়কারী হিসেবে থাকেন কামরুজ্জামান টুকু, এবং অ্যাটাকিং ফোর্সের দায়িত্ব ছিল নায়েক সিদ্দিকের।
যুদ্ধের পরিকল্পনা ছিল এমন: আক্রমণ চালানো হবে বেতার কেন্দ্রের দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে, উত্তর দিক থাকবে ফাঁকা। নায়েক সিদ্দিককে নিয়ে কামরুজ্জামান টুকু দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করবেন। পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করবে আরেকটি দল। এ দলের নেতৃত্বে থাকবেন ডাঃ আসিফ। আর জয়নুল আবেদীন অবস্থান নেবেন হাজীবাড়ী ও বর্তমান জাহিদুর রহমান সড়কের দিকে, যাতে খুলনা থেকে কোনো সৈন্য বেতার কেন্দ্রের দিকে আসতে না পারে।
যুদ্ধ হলো শুরু…
৪ এপ্রিল রাত ১২টা ১ মিনিটে শুরু হয় অভিযান। প্রথম দিকে অনেকটা বিনা বাধাতেই বেতার কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। খুব তাড়াতাড়িই তারা পৌঁছেও যান বেতার কেন্দ্রের প্রাচীরের কাছে। তবে এবার একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। সীমানা প্রাচীর অতিক্রম করা হবে কীভাবে? বেতার কেন্দ্র ভবনের প্রধান দরজা ছিল একটিই, যেখানে পাক সেনাদের দুর্ভেদ্য প্রহরা। অন্য কোনো স্থান থেকে ঢুকতে হলে প্রাচীর ভাঙতে হবে, অথচ প্রাচীর ভাঙার কোনো যন্ত্রপাতিই ছিল না মুক্তিবাহিনীর সাথে।
এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব টের পেয়ে গেছে পাকবাহিনী। তারা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিবর্ষণ করে চলেছে। শিপইয়ার্ড সার্কিট হাউস এবং রূপসা নদীতে অবস্থানকারী গানবোট থেকেও অনবরত উড়ো ফায়ার করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থা হয়ে পড়ে বেগতিক।
মুক্তিবাহিনীর কাছে না ছিল কোনো বাঙ্কার, না ছিল কোনো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র। তাছাড়া অধিকাংশেরই নেই পূর্বে এমন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। কোনো রকম প্রশিক্ষণও নেয়া হয়নি অনেকেরই। ফলে খুব দ্রুতই ক্লান্ত হয়ে পড়েন তারা, এবং চারদিকের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ডিঙিয়ে বেতার কেন্দ্রের ভেতর ঢোকাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এদিকে সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন কিন্তু বীর বিক্রমে তার নিজের কাজটি ঠিকই করে চলেছিলেন। খুলনা শহর থেকে সাহায্য করতে আসা পাক সেনাদেরকে ঠেকিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কয়েকটি দলকে তো তিনি গুলির মুখে ফিরে যেতেও বাধ্য করেন তিনি।
বেতার কেন্দ্র থেকে হানাদার বাহিনী অনবরত ওয়্যারলেসে সাহায্য চেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু জয়নুল আবেদীনের বীরত্বে কোনো নতুন জনবল ও অস্ত্রশস্ত্র প্রবেশ করতে পারছে না বেতার কেন্দ্র এলাকায়। মূলত এই একজন মানুষের কারণেই পাকবাহিনীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়, তারা বিপদের আশঙ্কায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
মুক্তিবাহিনীর প্রধান দলটিও ততক্ষণে প্রাথমিক ছন্নছাড়া অবস্থা কাটিয়ে উঠে পৌঁছে গেছে বেতার কেন্দ্রের প্রধান দরজার একেবারে কাছে। হানাদার সৈন্যরা প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে দরজা আগলে রাখার। কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে আর বেশিক্ষণ প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে পারবে না তারা। আর একবার দরজা দিয়ে মুক্তিবাহিনী ঢুকে পড়তে পারলেই রক্ষা নেই ভেতরে অবস্থানকারী সেনাদের।
মুক্তিবাহিনীও উপলব্ধি করে ফেলেছে, এই সকল প্রচেষ্টাই বৃথা যাবে, যদি শেষ পর্যন্ত বেতার কেন্দ্রের ভিতরে ঢোকা না যায়। হয়তো এই উপলব্ধির কারণেই, চরম দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন করে বসেন কামরুজ্জামান টুকু বাহিনীর অন্যতম বীর সদস্য হাবিব। তিনি ছিলেন স্থানীয় দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির কর্মী। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে তিনি বোমা হাতে লাফ দিয়ে মেইন গেট টপকে ভিতরে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা চালান। যদি কাজটিতে সফল হতেন, তাহলে নিজ দলের বিজয় অনেকটাই ত্বরান্বিত করা যেত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ব্যর্থ হন হাবিব। পাক সেনাদের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। তার দেখাদেখি আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেমও দরজার ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হন তিনিও। দরজায় প্রহরারত পাক সেনাদের গুলিতে ইহলীলা সাঙ্গ হয় তারও।
জয়নুল আবেদীনের একক লড়াই
দীর্ঘক্ষণ ধরে একা একাই বেতার কেন্দ্রে যাবার পথ আগলে চলেছিলেন জয়নুল আবেদীন। এক পর্যায়ে ক্লান্তি গ্রাস করে তাকেও। তার সহযোদ্ধা যারা ছিলেন, পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝতে পেরে একে একে সরে পড়তে শুরু করেছিলেন সকলেই।
কিন্তু জয়নুল আবেদীনের পক্ষে হাল ছেড়ে দেয়া সম্ভব ছিল না। কেননা ভিতরে কী হচ্ছে তা তো আর তিনি জানেন না। এমন অবস্থায় নিজে সরে যাওয়া মানে বাকি সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর পথ প্রশস্ত করে দেয়া। তাই দাঁতে দাঁত চেপে নিজের কর্তব্য পালন করে যেতে থাকেন তিনি।
এভাবেই রাত কেটে সকাল হয়ে যায়। জয়নুল আবেদীনের সাথে থাকা গুলিও ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। তিনি এখন সম্পূর্ণ একা। তার প্রতিরোধ যখন কমে এসেছে, ঠিক তার বিপরীতে শত্রুপক্ষও যেন আগের চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। তাই শেষ মরণ কামড়টি দেন তিনি। কয়েকটা ট্রাক অকেজো করে দিয়ে বেশ কিছু পাক সেনাকে হতাহত করেন তিনি। এরপর পাক সেনারা আরো বেপরোয়াভাবে গুলি চালাতে শুরু করলে, ক্রলিং করে তিনি অন্য এক সুবিধাজনক স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা আর করতে পারেননি তিনি। শত্রুপক্ষের ব্রাশ ফায়ারে তার বুক, মাথা এবং শরীরের বিভিন্ন স্থান ঝাঁঝরা হয়ে যায়। জীবনাবসান ঘটে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার।
শেষ কথা
বেতার কেন্দ্র দখল করতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে পুরোপুরি ব্যর্থও কি বলা যাবে? মোটেই না। হাবিব ও মোসলেমের মতো যুবকেরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, দেশপ্রেমের চেয়ে বড় আর কিছুই হতে পারে না, স্বাধীনতার জন্য বাঙালি আত্মবিসর্জনেও ভয় পায় না।
আর সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন যা করেছিলেন, তার তো কোনো তুলনাই হয় না। দেশপ্রেম তো বটেই, সেই সাথে কর্তব্যবোধের যে অসামান্য নজির তিনি স্থাপন করেছিলেন, তা আজকের দিনে বিরল। একাই তিনি ৭৪ জন পাক সেনাকে খতম করে দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন হানাদার বাহিনীর আত্মবিশ্বাসের ভিত। একই সমান্তরালে হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধের যাকে বলে একদম প্রথম প্রহর, তখনই জয়নুল আবেদীনের এমন আত্মত্যাগ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যুগিয়েছে, উদ্বুদ্ধ করেছে।
স্বামীর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না জয়নুল আবেদীনের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী হাজেরা মানিক। যখন শুনতে পান তার স্বামী আর নেই, প্রবল শোকে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। আর কখনো জ্ঞান ফেরেনি তার। তাই শহীদের স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনিও।
বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি আমরা যে এই জয়নুল আবেদীন, হাজেরা মানিক কিংবা হাবিব-মোসলেমদেরকে চিনি না, এই লজ্জা আমরা কোথায় লুকাই?