সম্প্রতি জার্মান সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্ডারট্রান্সপোর্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে জীবিতদেরকে এককালীন ক্ষতিপূরণ প্রদানের। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমেই ৮০ বছর পূর্বে নাৎসি জার্মানি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড ও তৎকালীন ফ্রি সিটি অব দানজিগ (বর্তমান পোল্যান্ডের জডানস্ক) থেকে প্রায় এক হাজার শিশু ও টিনেজারকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল ইহুদি।
আশি বছর পূর্বে ব্রিটেনে পালিয়ে আসা সেই শিশু ও টিনেজাররা আজ বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। অনেকে ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণও করেছেন। তাদের অপেক্ষার প্রহরটি যে অনেক বেশি প্রলম্বিত হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও আশার কথা, আগামী ১ জানুয়ারি থেকে তারা প্রত্যেকে ২,৫০০ ইউরো (২,৮০০ মার্কিন ডলার) ক্ষতিপূরণ লাভ করবে।
অবশ্য এই ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে যে আট দশক পূর্বে নিজেদের মাতৃভূমি, মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে একদম অপরিচিত একটি দেশে এসে বাস করার যন্ত্রণা বিন্দুমাত্র লাঘব হবে না, সে কথাও বলাই বাহুল্য।
কিন্ডারট্রান্সপোর্ট কী?
জার্মান ভাষার এই শব্দটির বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘শিশুদের পরিবহন’। এটি ছিল একটি সংঘটিত উদ্ধার অভিযান, যার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর নয় মাস পূর্বে নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের উপর আক্রমণ চালানো হলে দশ হাজারেরও বেশি শিশু ও টিনেজারকে নিরাপদে ব্রিটেনে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। উদ্ধারকৃত শিশুরা প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন ব্রিটিশ ফস্টার হোম, হোস্টেল, স্কুল ও ফার্মে থাকতে শুরু করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই উদ্ধারকৃতরাই ছিল হলোকাস্টের প্রকোপ থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া তাদের পরিবারের একমাত্র সদস্য।
পেছনের ইতিহাস
১৯৩৮ সালের ৯-১০ নভেম্বর নাৎসি কর্তৃপক্ষ জার্মানিতে অবস্থানরত ইহুদিদের উপর এক বর্বরতম সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চালায়, যা ক্রিস্টালনাখট বা ভাঙা কাঁচের রাত (Night of Broken Glass) নামে ইতিহাসের পাতায় পরিচিত হয়ে আছে। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বিশেষ কিছু শ্রেণীর ইহুদিদের উপর থেকে অভিবাসন বিধিনিষেধ শিথিল করে। তারা অনির্দিষ্ট সংখ্যক অনূর্ধ্ব-১৭ বছরের ইহুদি শিশুকে জার্মানি ও জার্মান-অধিকৃত দেশসমূহ থেকে গ্রেট ব্রিটেনে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করে। এ সময়ে ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ এ সিদ্ধান্তকে ব্যাপক সমর্থন জানিয়েছিল, এবং ব্রিটিশ সরকার শরণার্থী ত্রাণ কমিটির কাছ থেকেও প্রচুর সাহায্য লাভ করেছিল।
তবে এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার একটি শর্ত আরোপ করে দেয়। দেশের সাধারণ নাগরিক কিংবা দাতব্য সংস্থাগুলোকে প্রতিটি শিশুর পরিচর্যা, শিক্ষা এবং অভিবাসনের যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে। কেবল তার বিনিময়েই ব্রিটিশ সরকার সঙ্গীহীন ইহুদি শরণার্থী শিশুদেরকে তাদের দেশে প্রবেশের সাময়িক ভ্রমণ-ভিসা দেয়।
তখন ধারণা করা হয়েছিল, সংকটের অবসান ঘটলেই এই শিশুদেরকে তাদের বাবা-মা বা অভিভাবকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু এ যাত্রায় কোনো বাবা-মাই তাদের সন্তানের সাথে আসতে পারেনি। যেসব শিশু একেবারেই অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল, যাত্রাকালীন সময়ে তাদের দায়িত্ব অন্যান্য শিশুদেরকে নিতে হয়েছিল।
ট্রান্সপোর্ট
প্রথম কিন্ডারট্রান্সপোর্ট গ্রেট ব্রিটেনের হারউইচে এসে পৌঁছায় ১৯৩৮ সালের ২ ডিসেম্বর। এতে করে বার্লিনের একটি ইহুদি এতিমখানা থেকে দুইশোর মতো শিশুকে নিয়ে আসা হয়। তাদের এতিমখানাটি ক্রিস্টালনাখটের কবলে পড়ে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
বেশিরভাগ ট্রান্সপোর্টই ট্রেনের মাধ্যমে এসেছিল বার্লিন, ভিয়েনা, প্রাগ এবং সেন্ট্রাল ইউরোপের বড় বড় শহর থেকে। ছোট শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিশুরা এসব কালেকশন পয়েন্টে এসে জড়ো হয়ে পরবর্তীতে কিন্ডারট্রান্সপোর্টে চড়েছিল।
এসব ট্রান্সপোর্টের পরিকল্পনা করেছিল গ্রেটার জার্মান রাইখের অভ্যন্তরীণ ইহুদি সংস্থাগুলো। সংস্থাগুলো সাধারণত সেসব শিশুকেই অভিবাসনের ক্ষেত্রে পছন্দ করেছিল, যাদের অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন, যাদের বাবা-মাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বা যাদের বাবা-মা ঐ মুহূর্তে আর তাদের সাহায্য করবার মতো অবস্থায় ছিল না। তারা গৃহ ও পিতৃ-মাতৃহীন শিশুদেরও বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছিল।
শিশুদের নিয়ে ট্রান্সপোর্টগুলো ট্রেনে করে বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডের বন্দরে যায়, এবং সেখান থেকে জাহাজে করে তারা হারউইচে এসে পৌঁছায়। তবে প্রথমদিকে ছেড়ে আসা ট্রান্সপোর্টগুলোর মধ্যে অন্তত একটি জার্মানির হামবুর্গ বন্দর থেকে ছেড়ে এসেছিল। এছাড়া চেকোস্লোভাকিয়া থেকে কিছু শিশুকে সরাসরি প্লেনে করে ব্রিটেনে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। সর্বশেষ ট্রান্সপোর্টটি জার্মানি ত্যাগ করে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর, ঠিক যখন আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে। আর নেদারল্যান্ড থেকে শেষ ট্রান্সপোর্টটি ছেড়ে আসে ১৯৪০ সালের ১৪ মে। ঐদিনই ডাচ সেনাবাহিনী জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণ করে।
হারউইচে আগমন
হারউইচে এসে পৌঁছানোর পর, যেসব শিশু ইতিমধ্যেই তাদের পৃষ্ঠপোষক পেয়ে গিয়েছিল, তারা সরাসরি লন্ডনে রওনা দেয় তাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী পরিবারের সাথে যোগ দিতে। আর যেসব শিশু পৃষ্ঠপোষক পায়নি, তাদের রাখা হয়েছিল ডেভারকোর্ট বে’র একটি সামার ক্যাম্পে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের জন্য অন্য কোনো রক্ষণাবেক্ষণকারী পরিবার বা হোস্টেলের ব্যবস্থা করা না যায়, ততক্ষণ তাদেরকে ঐ সামার ক্যাম্পেই রাখা হয়।
অনেক সংস্থা ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিই যোগ দিয়েছিল এই উদ্ধার অভিযানে। ব্রিটেনে মুভমেন্ট ফর দ্য কেয়ার অব দ্য চিলড্রেন ফ্রম জার্মানি বেশ কিছু উদ্ধার অভিযানের তত্ত্বাবধানে ছিল। ব্রিটেনের ইহুদি, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছিল এই উদ্ধার অভিযানে। প্রায় অর্ধেকের মতো শিশুই তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পরিবার খুঁজে পেয়েছিল। বাকি অর্ধেক শিশুকে গ্রেট ব্রিটেন জুড়ে বিভিন্ন হোস্টেল, স্কুল ও ফার্মে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সবমিলিয়ে যে দশ হাজারের মতো শিশুকে জীবিত উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়, তাদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ বা সাড়ে সাত হাজারের মতো শিশুই ছিল ইহুদি।
এনিমি এলিয়েন্স
আন্তর্জাতিক আইনানুসারে, যুদ্ধ চলাকালীন শত্রু দেশ থেকে পালিয়ে আসা অভিবাসীদেরকে এনিমি এলিয়েন্স হিসেবে অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর জার্মানি যেহেতু সরাসরি গ্রেট ব্রিটেনের শত্রু-রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তাই কিন্ডারট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে আসা শিশুদেরকেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এনিমি এলিয়েন্স হিসেবে গণ্য করা শুরু করে। তাদের মধ্যে অনেককেই আইল অব ম্যান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার অন্তরীণ শিবিরে সাময়িকভাবে আটক রাখা হয়। তবে তা সত্ত্বেও কিন্ডারট্রান্সপোর্টের অনেক টিনেজারই পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়, এবং জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়ে।
যুদ্ধের পর কী হয়?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে কিন্ডারট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে আসা অনেক শিশুকেই গ্রেট ব্রিটেনের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। আর অন্যান্য শিশুদেরকে অভিবাসী হিসেবে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। বেশিরভাগ শিশুই আর কোনোদিন তাদের বাবা-মায়ের মুখ দেখেনি, কারণ তাদেরকে হলোকাস্টের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল।
কিন্ডারট্রান্সপোর্টের অন্তর্নিহিত গুরুত্ব
এই উদ্ধার অভিযানকে অন্য সব উদ্ধার অভিযানের সাথে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে। কারণ একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, জীবিত শিশুগুলোর অনেকেই সরাসরি তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে ট্রান্সপোর্টে যোগ দিয়েছিল, এবং পরবর্তীতে হলোকাস্টে তাদের বাবা-মা খুন হয়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, ঐসব বাবা-মা নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে, সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ থেকে তাদেরকে কিন্ডারট্রান্সপোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যে বাবা-মা কখনোই সন্তানকে কাছ ছাড়া করতে চান না, সন্তানকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য সেই তারাই আবার কতখানি আত্মত্যাগ করতে পারেন, কিন্ডারট্রান্সপোর্ট তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বর্তমানে ৯৩ বছর বয়সী বব কার্ক এমন একজন, যিনি কিন্ডারট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে প্রাণে বেঁচেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি হারিয়েছিলেন তার বাবা-মা সহ পরিবারের বিশ সদস্যকে। স্রেফ তার বাবা-মা সঠিক সময়ে তাকে কিন্ডারট্রান্সপোর্টে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই রক্ষা পেয়েছিল তার জীবন। এজন্য কার্ক আজীবন তার বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ।
বেঁচে আছি বলে কখনোই অপরাধবোধে ভুগিনি। বরং বাবা-মায়ের জন্য মনের মধ্যে প্রচন্ড কৃতজ্ঞতা অনুভব করি। তাদের সাহসিকতার কারণেই তো বেঁচে আছি। সকল বাবা-মাই, যারা তাদেরকে সন্তানদেরকে ট্রান্সপোর্টে পাঠিয়েছিলেন, তারা অসাধারণ মনের জোর দেখিয়েছিলেন।
সত্যিই, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসা ঠিক কতখানি তীব্র, তা অনুধাবনে কিন্ডারট্রান্সপোর্ট হতে পারে একটি অসাধারণ উদাহরণ।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/