Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লা নোচে ত্রিস্তে: অ্যাজটেকদের হাতে স্প্যানিশ দখলদারদের ধরাশায়ী হওয়ার রাত

অ্যাজটেক সভ্যতা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল দুর্ভিক্ষের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা একদল মানুষের হাতে। একশো বছরের মধ্যে তারা একেবারে বসবাসের অনুপযোগী এক অঞ্চলকে নিজেদের মতো করে গড়ে নেয়, যাতায়াত ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতিসাধন করে। নিজেদের সভ্যতাকে তারা এমন পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয় যে মেক্সিকোর অন্যান্য অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর কাছে অ্যাজটেকদের কর্তৃত্ব না মেনে উপায় ছিল না। বর্তমান মেক্সিকোর তেনোখতিতলান নামের একটি শহর ছিল অ্যাজটেক সভ্যতার রাজধানী, যাকে তৎকালীন পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর একটি হিসেবে গণ্য করা হতো। অ্যাজটেকরা যে জাতি হিসেবে যথেষ্ট পরিশ্রমী ছিল, তাদের রাজধানীর শান-শওকত, সৌন্দর্য, সম্পদের প্রাচুর্য দেখেই সেটা প্রমাণিত হয়ে যায়।

ইতিহাসের একটি সত্য এই যে, শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সেনাপতিরা যখন টানা বেশ কয়েকটি রাজ্য জয় করেন, তখন তাদের ঘাড়ে আরও বেশি রাজ্য জয় করার ভূত চেপে বসে। পর্তুগিজ সেনাপতি হার্নান কোর্তেসকে এই নেশাই পেয়ে বসেছিল। কিউবা কিংবা হিস্পানিওলাসহ ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে পর্তুগিজ রাজার পক্ষে সফলভাবে নৌ-অভিযান পরিচালনার পর তার ঘাড়ে আরও রাজ্যজয়ের ভূত চেপে যায়। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকায় পা রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পর স্পেনও আমেরিকার দিকে নতুন করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। একই সাথে রাজার কাছে নিজেকে আলাদা করে চেনানো, দিগ্বিজয়ী সেনাপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা কিংবা অ্যাজটেকদের বহুমূল্য সম্পদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ক্যাপ্টেন জেনারেল হার্নান কোর্তেস কিউবার গভর্নরের নির্দেশ অমান্য করেও অ্যাজটেকদের আক্রমণ করে বসেছিলেন, যার কড়া মূূল্য দিতে হয়েছিল।

ঋহনয়াহাহা
অ্যাজটেকদের সম্পদের লোভে কোর্তেস আক্রমণ করে বসেছিলেন আগপিছ  না ভেবেই; image source: elsoldemexico.com.mx

অ্যাজটেক সভ্যতা সময়ের সাথে সাথে বিস্তৃতি লাভ করলেও মেক্সিকোর অন্যান্য জাতিসত্ত্বার মানুষদের সাথে অ্যাজটেকরা মিশে যেতে পারেনি বা তাদেরকে আত্তীকরণ করে নিতে পারেনি। অ্যাজটেকরা সামরিকভাবে মেসো-আমেরিকান অঞ্চলে একেবারে অদ্বিতীয় ছিল। তাদের সামরিক বাহিনীর উৎকর্ষতা সেসময় মেক্সিকোর অন্যান্য জাতিসত্ত্বার মানুষের কাছে অজানা ছিল না। তাই তারা অ্যাজটেকদের সাথে সামরিক সংঘাত এড়িয়ে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করত। একে কাজে লাগিয়েই অ্যাজটেকরা অন্য জাতির মানুষদের নিজেদের হুকুম পালনে বাধ্য করত। মেক্সিকোর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর কাছে তারা ‘বাইরে থেকে আসা স্বাধীনতা হরণকারী’র চেয়ে বেশি কিছু ছিল না।

হার্নান কোর্তেস পাঁচশো সৈন্য, একশো নাবিক ও ষোলটি ঘোড়াসহ কিউবা থেকে ১৫১৯ সালে মেক্সিকান উপকূলে এসে পৌঁছান। উপকূলীয় অঞ্চলে থাকা মেক্সিকান নৃগোষ্ঠীগুলোকে কোর্তেসের পক্ষ থেকে অভয় দেয়া হলো। তিনি তাদেরকে বোঝালেন যে তার মূল লক্ষ্য শুধু অ্যাজটেকদের ধ্বংস করা, অন্য কেউ নয়। যেহেতু অ্যাজটেকদের শাসনে স্থানীয় নৃৃৃৃগোষ্ঠীগুলো সন্তুষ্ট ছিল না, তাই তারা পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন কোর্তেসের কথায় খুশি হয়ে যায় এবং একজন দাসী উপহারস্বরূপ পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে কোর্তেস এই দাসীকেই বিয়ে করেন ও তাদের সন্তান জন্মলাভ করে। সেই নারী (পরবর্তীতে কোর্তেসের স্ত্রী) দোভাষীর ভূমিকা পালন করতো। স্থানীয়রা কোর্তেসকে যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্য দিয়েও সহায়তা করে। তারা ভেবেছিল আধিপত্যবাদী অ্যাজটেকদের যদি কোর্তেসের মাধ্যমে একটু শায়েস্তা করা যায়, তাহলে মন্দ কী?

Hcydgx
স্প্যানিশ ক্যাপ্টেন হার্নান কোর্তেসের একটি চিত্রকর্ম; image source: biography.com

স্থানীয়দের সহযোগিতা লাভের পর উপকূল ছেড়ে ধীরে ধীরে কোর্তেস ও তার সেনাবাহিনী অ্যাজটেকদের রাজধানীর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। অ্যাজটেকদের ধর্মে কুয়েটজালকোল নামের একজন দেবতা সম্পর্কে এরকম ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে, তিনি একসময় অ্যাজটেকদের রাজধানীতে সশরীরে আগমন করবেন। এই কারণে যখন কোর্তেস তার সেনাবাহিনীসহ যখন অ্যাজটেকদের রাজধানীতে পা রাখেন, তখন অ্যাজটেক রাজা দ্বিতীয় মন্টেজুমা ভেবেছিলেন কোর্তেসই বোধহয় ধর্মীয় শাস্ত্রে উল্লেখ করা সেই কুয়েটজালকোল দেবতার দূত। সেনাবাহিনীসহ কোর্তেসকে রাজকীয় সম্মানের মাধ্যমে রাজধানীতে বরণ করে নেয়া হয়। এই ঘটনায় কোর্তেস একেবারে অবাক হয়ে যান, কারণ তারা অ্যাজটেকদের কাছ থেকে তীব্র প্রতিরোধ আশা করেছিল।

নসনহসনসমস
অ্যাজটেকদের ধর্মে একজন দেবতার আগমন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল; image source: mexicolore.co.uk

হার্নান কোর্তেস ও তার সেনাবাহিনী যখন অ্যাজটেক রাজধানীতে পা রাখে, তখন বিস্ময়ে তাদের চোখ কপালে উঠে যায়। তারা চিন্তাও করতে পারেনি যে মেক্সিকোয় একটি সভ্যতা সবদিক থেকে এত বেশি উন্নত হতে পারে। অ্যাজটেক নগরীর বিশাল বিশাল পিরামিড, বিলাসবহুল প্রাসাদ কিংবা সেচব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করে কোর্তেসের বিস্ময়ের সীমা ছিল না। তার সেনাবাহিনীর সদস্য বার্নাল ডিয়াজের ভাষ্যমতে, “(অ্যাজটেকদের নগরীর) এত চমৎকার দৃশ্য অবলোকন করে আমরা একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

হার্নান কোর্তেস রাজা দ্বিতীয় মন্টেজুমাকে অপহরণ করে আড়াল থেকে নিজে অ্যাজটেকদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন;
image source: britannica.com

ক্যাপ্টেন কোর্তেস কিউবার গভর্নরের আদেশ অমান্য করে মেক্সিকোতে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। যেহেতু গভর্নরের অনুমতি ছিল না, তাই কোর্তেসের অভিযানের আইনগত বৈধতাও ছিল না। কিউবার গভর্নর ভেলাজকুয়েজ, কোর্তেসের অবৈধ অভিযানের সঙ্গী হিসেবে থাকা স্প্যানিশ সৈন্যদের ফিরিয়ে আনতে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন, যারা ১৫২০ সালে মেক্সিকান উপকূলে জাহাজ নোঙর করে। কোর্তেস তার সেনাবাহিনীর কিছু অংশ অ্যাজটেকদের রাজধানীতে রেখে এসে বাকিদের নিয়ে গভর্নর ভেলাজকুয়েজের বাহিনীকে প্রতিহত করতে রওনা দেন। গভর্নরের সেনাবাহিনী পুরোপুরি পরাজিত হয়, কোর্তেস বিজয়ীর বেশে অ্যাজটেকদের রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন।

কিউবার গভর্নরের বাহিনীকে পরাজিত করার আগেই কোর্তেস অ্যাজটেকদের রাজা দ্বিতীয় মন্টেজুমাকে অপহরণ করে এনে আটকে রাখনে এবং আড়াল থেকে নিজে অ্যাজটেকদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এটা অ্যাজটেকরা ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারেনি, কারণ কোর্তেসকে তখন তারা দেবদূত হিসেবে সম্মান করত। কিন্তু যখন গভর্নরের বাহিনীর সাথে কোর্তেস যুদ্ধ করতে যান, তখন স্প্যানিশ সৈন্যদের সাথে অ্যাজটেকদের ঝামেলা শুরু হয়। পেদ্রো দে আলভারেদো, যাকে কোর্তেস তার অবর্তমানে সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সে অ্যাজটেক রাজধানীতে একটি উৎসবে অতর্কিত হামলা চালায় এবং শত শত অ্যাজটেককে হত্যা করে। এটা অ্যাজটেকরা মোটেও ভালোভাবে নেয়নি। তারা কোর্তেসের সৈন্যদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার উদ্দেশ্যে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। গভর্নরের বাহিনীকে পরাজিত করার পর কোর্তেস এসেও তার সেনাবাহিনী বনাম অ্যাজটেকদের বিশৃঙ্খলা থামাতে পারেননি।

১৫২০ সালের ১ জুলাই দিবাগত রাতে অ্যাজটেকরা স্প্যানিশদের পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করার অংশ হিসেবে সকল সেতু ধ্বংস করে ফেলে। কোর্তেস এরপর একটি ভ্রাম্যমাণ অস্থায়ী সেতু নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং রাতের আঁধারে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ১ জুলাই দিবাগত রাতে ভ্রাম্যমাণ সেতু দিয়ে পার হতে গিয়ে অসংখ্য সেন্য টেক্সকোকা হ্রদে ডুবে মারা যায়। অ্যাজটেক সেনাবাহিনীর বিখ্যাত ‘জাগুয়ার ওয়ারিয়ার্স’ এবং ‘ঈগল ওয়ারিয়র্স’দের মতো অভিজাত বাহিনীর হাতে অনেক সৈন্য বেঘোরে প্রাণ হারায়।

কোর্তেসের সৈন্যরা নিজেদের সাথে প্রচুর সোনা-দানা নিয়ে আসতে চেয়েছিল। তাদের সেই স্বপ্নের কবর রচনা করে অ্যাজটেকরা। বিশৃঙ্খলার মধ্যে অ্যাজটেক রাজা দ্বিতীয় মন্টেজুমার মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তবে তার হত্যাকারী কারা ছিল, এ নিয়ে মতবিভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, অ্যাজটেকরা বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে তাকে হত্যা করে, কেউ বলেন অ্যাজটেকদের পাল্টা আক্রমণের জবাবে কোর্তেসের সৈন্যরাই তাকে হত্যা করে। কোর্তেসও কোনোমতে সেই রাতে নিজের প্রাণ বাঁচান। ইতিহাসে ১৫২০ সালের ১ জুলাইয়ের দিবাগত এই রাতটিই ‘লা নোচে ত্রিস্তে’ বা ‘বেদনাবিধুর রাত’ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।

জআহতহচআহ
শেষপর্যন্ত হার্নান কোর্তেস কোনমতে প্রাণ বাঁচিয়ে স্পেনে ফেরত আসেন। তার সেনাবাহিনীর প্রায় সবাই অ্যাজটেকদের হাতে মারা পড়ে; image source: infobae.com

ক্যাপ্টেন কোর্তেস ছিল রাজ্যজয়ের স্বপ্নে বিভোর। এমনকি আমেরিকার উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনার জন্য গভর্নরের অনুমতি নেয়ারও তোয়াক্কা করেননি তিনি। কিন্তু অ্যাজটেকদের পরাজিত করা মোটেও সহজ ছিল না, কারণ তারা সেই সময়ে সবদিক থেকেই নিজেদের সেরা হিসেবে তৈরি করেছিল। অ্যাজটেক রাজার সরলতার সুযোগ নিতে চেয়েছিল স্প্যানিশ দখলদারেরা। লাগামহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিণাম যে ভয়াবহ হয়, এই সত্যটি ‘লা নোচে ত্রিস্তে’র ইতিহাস আমাদেরকে আরেকবার মনে করিয়ে দেয়।

Related Articles