আজকের দিনে একটি বাচ্চা জন্ম নিলে তার খাবারদাবার নিয়ে এতটা চিন্তাভাবনার দরকার পড়ে না। বাচ্চার জন্য সবার প্রথমেই আসবে মায়ের বুকের দুধের কথা। এরপর সময়মতো অন্যান্য খাবারের জন্য কেবল আশেপাশের মুদি দোকান কিংবা সুপারশপগুলোতে ঢুঁ মারলেই কাজ হয়ে যায়। কিন্তু আজ থেকে শত শত বছর পূর্বের পরিস্থিতি মোটেও এমনটা ছিলো না। তখন বাচ্চার জন্য মায়ের বুকের দুধই ছিলো প্রধান ভরসা। কোনো কারণে সেটা না মিললে লোকজন দ্বারস্থ হতো ওয়েট নার্সের। ফিডারে দুধ পান করানো আজকের দিনে মামুলি বিষয় হলেও এককালে এর সাথে জড়িয়ে থাকতো মৃত্যুর আশঙ্কাও।
সন্তানকে স্তন্যদানের ইতিহাসের নানা দিক তুলে ধরতেই রোর বাংলার পাঠকদের জন্য আমাদের এই আয়োজন।
১
ওয়েট নার্স (অপরের সন্তানকে স্তন্যদানের কাজে নিযুক্ত ধাত্রী) পেশার সর্বপ্রথম নজির দেখা যায় আজ থেকে প্রায় ২ হাজার বছর আগে। আর এটি চলেছিল প্রায় বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত। দীর্ঘ এ সময়কালে একজন মা ওয়েট নার্স নিয়োগ দেবেন কি না এটা তার ইচ্ছা কিংবা পরিস্থিতি দুটোর উপরই নির্ভর করতো।
কিছু কিছু মায়ের দেহে সন্তানের জন্য পর্যাপ্ত দুধ উৎপন্ন না হওয়ায় তাদের জন্য ওয়েট নার্সদের নিযুক্ত করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকতো না। অবশ্য নিযুক্ত হবার সময় তাদেরও বেশ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলার ব্যাপারে একমত হতে হতো। উনিশ শতকে শিশুদের দুধ খাওয়ানোর বোতলের আগমনের সাথে সাথে ওয়েট নার্সিং পেশারও বিলুপ্তির পথ সুগম হয়ে যায়।
আনুমানিক ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইসরায়েলে সন্তানকে স্তন্যদানের এই বিষয়টি স্রষ্টার পক্ষ থেকে একপ্রকার আশীর্বাদ হিসেবেই দেখা হতো।
২
আনুমানিক ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে গ্রিসের উচ্চ বংশীয় নারীরাও ওয়েট নার্সদেরই নিয়োগ দিতেন। কালে কালে সেসব পরিবারে সেই ওয়েট নার্সদের প্রভাব বাড়তে থাকতো এবং কখনও কখনও তাদেরকে সেই পরিবারে নিযুক্ত অন্যান্য কর্মচারীদের চেয়েও বেশি ক্ষমতা দেয়া হতো। বাচ্চাদের বয়স ৩ বছর হওয়ার আগপর্যন্ত তারা স্তন্যদান করে থাকতেন।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে শুরু করে ৪০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যে পরিত্যক্ত শিশু, বিশেষত মেয়ে শিশুদের, দেখাশোনার জন্য ওয়েট নার্সদের সাথে লিখিত চুক্তি করা হতো। কারণ পরবর্তীকালে এই বাচ্চা মেয়েদেরই ধনী পরিবারগুলো ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে নিত।
৩
এই যে এতক্ষণ ওয়েট নার্সদের নিয়ে কথা বলা হলো, তাদের জন্য তো কিছু নীতিমালা এবং পরামর্শও থাকা দরকার, যাতে করে তারা তাদের কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারেন। ত্রয়োদশ শতকে ফ্রান্সিস্কান (১২০৯ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট ফ্রান্সিস অফ আসিসি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ধর্ম সংঘের সদস্য) ফ্রায়ার বার্থোলোমিউ অ্যাংলিকাস এমনই একটি উপদেশমালা প্রকাশ করেছিলেন।
সন্তানের জন্য মায়ের বুকের দুধের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা না থাকলেও তৎকালে মানুষজন অন্তত এটা বিশ্বাস করতো যে, এতে বাচ্চার জন্য জাদুকরী কিছু উপাদান আছে, যা তাকে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে। মানুষজন মনে করতো, একজন মায়ের শারীরিক ও মানসিক নানা বৈশিষ্ট্য এই বুকের দুধের মাধ্যমেই সন্তানের মাঝে সঞ্চারিত হয়। তাই মায়েদেরও নিজ নিজ সন্তানকে স্তন্যদানে উৎসাহিত করা হতো।
রেনেসাঁর সময়ে মায়েরা মনে করতেন, তাদের সন্তানকে যদি কোনো ওয়েট নার্সের কাছে স্তন্যদানের জন্য দেয়া হয়, তবে তারা সেই নারীকেই তাদের মা বলে মনে করবে। এজন্য নিজ সন্তানের স্তন্যদানের দায়িত্ব নিজেদের কাছে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তারা।
৪
ওয়েট নার্সিং পেশাটি এভাবে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে উনিশ শতক পর্যন্ত, যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ বলা যায় সমাজের ধনীদের। কারণ, তারা আপন সন্তানকে স্তন্যদানের এই বিষয়টিকে বেশ ‘আনফ্যাশনেবল’ হিসেবে দেখার পাশাপাশি ভয় পেতেন এটা ভেবে যে, এটা বোধহয় তাদের ‘ফিগার’ নষ্ট করে দেবে! তখন ধনী নারীদের পোশাকপরিচ্ছদও বাচ্চাকে স্তন্যদানের জন্য সহায়ক ছিলো না।
তবে শুধু যে অভিজাত সমাজের লোকেরাই এমনটা করতেন সেটা বলার জো নেই। ডাক্তার, আইনজীবী ও বণিকদের স্ত্রীরাও ঠিক একই কাজ করতেন। যেহেতু একজন ওয়েট নার্সের মাসিক বেতন স্বামীর ব্যবসার কর্মচারী কিংবা বাসার একজন কাজের লোকের চেয়ে কম ছিলো, তাই এটা তাদের গায়ে খুব একটা লাগতো না।
শিল্প বিপ্লবের সময় অনেক পরিবারই গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। ফলে শহরাঞ্চলে কৃষক শ্রেণীর ওয়েট নার্সদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
৫
সপ্তদশ শতকে অবশ্য বেশ মজার একটি ঘটনা ঘটেছিল। ১৬১২ সালে ফরাসি সার্জন ও ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ জ্যাক গিলেম্যু তার ‘দ্য নার্সিং অফ চিলড্রেন’ বইয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন লাল চুলের নারীদেরকে কেউ ওয়েট নার্স হিসেবে নিয়োগ না দেয়। এর পেছনে তার যুক্তি ছিলো, লাল চুলের নারীরা বেশ রাগী স্বভাবের হয়ে থাকে। আর তাদের বুকের দুধ পান করলে ভবিষ্যতে সেই বাচ্চাও একই মানসিকতার হয়ে যাবে! একজন ওয়েট নার্সের মাঝে কী কী গুণাবলী থাকা উচিত সেই সম্পর্কেও পরামর্শ দিতে ভোলেননি তিনি। তার মতে, একজন ওয়েট নার্সের শান্ত, নম্র-ভদ্র, কৃতজ্ঞ, ধৈর্যশীল, সংযমী, ঝগড়া না করা, অহংকারী না হওয়া, লোভমুক্ত থাকা, বোকার মতো কোনোকিছু না বলা ইত্যাদি নানাবিধ গুণ থাকা উচিত।
৬
এতক্ষণ তো কথা হলো কেবল স্তন্যদান নিয়ে। এবার বোতলের মাধ্যমে সন্তানকে দুধ পানের দিকেও নজর দেয়া যাক।
উনিশ শতক থেকেই পেশা হিসেবে বিলুপ্তির দিকে যেতে শুরু করে ওয়েট নার্সিং। কারণ, ততদিনে বাচ্চাদেরকে বিভিন্ন প্রাণীর দুধ এবং বোতলে করে দুধ পান করানো বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করছিলো। অবশ্য এর আগে যে বাচ্চাদের বোতলে করে দুধ পান করানো হতো না বিষয়টি কিন্তু তা না। বরঞ্চ বাচ্চাদের দুধ পান করানোর এমন বোতলও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো হাজার হাজার বছরের পুরনো। আনুমানিক ৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ব্যবহৃত গ্রেসিয়ান টেরাকোটার একটি ফিডার পাওয়া গিয়েছে, যাতে করে বাচ্চাদের ওয়াইন ও মধুর মিশ্রণ পান করানো হতো। প্রাচীনকালের অনেক কন্টেইনারেই দুগ্ধজাত দ্রব্যের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ধারণা করছেন যে, প্রাণীর দুধ কিংবা এর বিকল্প অন্য কিছু সেই প্রস্তর যুগ থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বিভিন্ন লেখনী থেকে জানা যায়, রোমান, মধ্যযুগীয় এবং রেনেসাঁর সময়কালে এই বোতল পরিষ্কার করা ছিল বেশ ঝামেলার বিষয়। তবে শিল্প বিপ্লব এই সমস্যা দূরীভূত করে বাচ্চাদের জন্য জীবাণুমুক্ত, নিরাপদ দুগ্ধপানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে দেয়।
৭
আজকের দিনে বাচ্চাদের ফিডারের মোটামুটি একটি আকৃতির সাথে আমরা পরিচিত। কিন্তু একটা সময় পরিস্থিতি এমন ছিলো না। বেশ কিছু ফিডার সিরামিক বা কাঠ দিয়ে বানানো হতো। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো গরুর সিং দিয়ে বানানো ফিডারগুলো। সপ্তদশ শতকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতো পিউটার (টিন ও সীসা মিশ্রিত ধূসর পদার্থ) ও ইস্পাত। তখনকার সময়ে ইউরোপে বেশ জনপ্রিয় ছিলো ইংরেজ চিকিৎসক হিউ স্মিথের উদ্ভাবিত বাবি পট। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পাত্রটি পরিষ্কার করা ছিলো দুঃসাধ্য। ফলে প্রায়সময়ই শিশুরা অসুখে পড়তো, যা অনেকক্ষেত্রে ডেকে আনতো মৃত্যুও।
৮
উনিশ শতকের মধ্যভাগে আগমন ঘটে কাচের তৈরি ফিডারের, বিদায় নেয় এদের পূর্বপুরুষ পোর্সেলিনের ফিডার। পরবর্তীতে বিভিন্ন ডিজাইনের ফিডারই এসেছিল, যেগুলোকে উপহাস করে বলা হতো ‘খুনে বোতল’, কারণ এই বোতলগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা যেত না বলে ব্যাকটেরিয়ার জন্য তারা একপ্রকার পেট্রি ডিশ হিসেবেই কাজ করতো।
এমনই নানা গবেষণার একপর্যায়ে একটি কৃত্রিম স্তনও উদ্ভাবন করেছিলেন এক ব্যক্তি। এর ভেতরে তরল দুধ ভরে একজন মা সেটি গায়ে জড়িয়ে রাখতে পারতেন। পরবর্তীতে সুবিধামতো সন্তানকে সেখান থেকেই দুধ পান করাতে পারতেন তিনি।