১৯৪২ সালের ১৭-১৮ আগস্ট প্রশান্ত মহাসাগরের কিরিবাতি দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত ম্যাকিন দ্বীপে (বর্তমান নাম বুটারিটারি ) ইউএস মেরিন কর্পসের রেইডার ব্যাটালিয়ন একটি অবিশ্বাস্য মিশন পরিচালনা করে। ১২১ জন জন মেরিন সেনা রাতের অন্ধকারে দুটো সাবমেরিনে করে দ্বীপে অবতরণ করে ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মির উপর আচমকা হামলা শুরু করে।
তাদের লক্ষ্য ছিল দ্বীপে থাকা জাপানি স্থাপনার যত সম্ভব ক্ষয়ক্ষতি করা, উল্লেখযোগ্য জাপানি সেনা বন্দি করা। পাশ্ববর্তী গিলবার্ট দ্বীপের জাপানি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা। তবে এই অপারেশনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল গুয়াডালক্যানাল ও তুলাগি আইল্যান্ডে মিত্রবাহিনীর আসন্ন সেনা অবতরণের কাজ সহজে সম্পন্ন করতে জাপানিজ রিএনফোর্সমেন্ট ধোঁকা দিয়ে ম্যাকিন আইল্যান্ডে নিয়ে আসা। এই অপারেশন মেরিন রেইডারদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও এদের কৌশল কতটা কার্যকরী সেটির পরীক্ষা হয়ে যায়।
একটি বিষয় বলে রাখা আবশ্যক, মেরিনদের বলা হয় ‘নেভাল ইনফেন্ট্রি’, এরা জলপথে গিয়ে স্থলে যুদ্ধ করার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। আর্মি ও মেরিন সম্পূর্ণ আলাদা বাহিনী। ক্ষেত্রবিশেষে মেরিনদের প্রশিক্ষণ আর্মিদের থেকে তুলনামুলক বেশি কঠিন হয়ে থাকে। কারণ এরা অপ্রচলিত কৌশলে যুদ্ধ করে থাকে। যেমন- ম্যাকিন আইল্যান্ড আক্রমনের শিকার হওয়ার সময় জাপানিরা কল্পনাও করেনি যে এভাবে সাবমেরিনে করে কেউ সেনাদল পাঠাতে পারে।
এই অপারেশন হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরিচালিত প্রথম আমেরিকান গ্রাউন্ড অফেন্সিভ অপারেশন। এই মিশনের জন্য দায়িত্ব পায় ইউএস মেরিনের সেকেন্ড রেইডার ব্যাটালিয়ন। সেখান থেকে মিশনের জন্য সদস্যদের নির্বাচিত করার পর দেখা গেলো সাবমেরিনে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় প্রতিটি কোম্পানি তাদের নিজস্ব রাইফেল সেকশন থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এজন্য ছয়টি রাইফেল কোম্পানিকে বাড়তি সেনা সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়। ফলে সাবমেরিন ইউএসএস আর্গোনাউটে A কোম্পানি সবাই ও B কোম্পানির ১৮ জন নিয়ে মোট ১২১ জন মেরিন সৈনিক উঠানো হয়। বাকি ৯০ জন ওঠেন অপর সাবমেরিন ইউএসএস নটিলাসে।
অপরদিকে ম্যাকিন আইল্যান্ডে ১৯৪২ সালের শুরু থেকেই একটি জাপানি গ্যারিসন ও সি-প্লেন বেজ ছিল। ইম্পেরিয়াল জাপানিজ ল্যান্ডিং ফোর্সের ওয়ারেন্ট অফিসার কায়ুজাবুরো কানেমিতসু্র নেতৃত্বে দুই প্লাটুনের মতো (৭১ জন) সৈনিক সেখানে ঘাঁটি গেড়েছিল। তবে তাদের কাছে দ্বীপ প্রতিরক্ষার উপযোগী ভারী অস্ত্র ছিল না। এই তথ্য আবার যুক্তরাষ্ট্রের জানা ছিল না। তারা ভেবেছে ম্যাকিনে জাপানিরা শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। দ্বীপে কানেমিতসু্র সৈনিক বাদে সি-প্লেন পাইলট, ক্রু, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ইউনিটের কয়েকজন সেনা ও দ্বীপবাসিদের সাথে যোগাযোগের জন্য কয়েকজন দোভাষী থাকায় ম্যাকিন আইল্যান্ডে জাপানিদের সংখ্যা কিছুটা বেশিই ছিল বটে। উল্লেখ্য, প্লাটুন, কোম্পানি, ব্যাটালিয়ন ইত্যাদি শব্দ দ্বারা সেনাদলের আকার কত বড় সেটি বোঝায়।
সাবমেরিনে করে উপকূলে গিয়ে সেনা নামানো সম্ভব নয়। তাই মেরিন রেইডারগণ বাতাস দিয়ে ফোলান যায় এমন রাবারের বোট সঙ্গে করে দিয়ে এসেছিলেন। এতে ছয় হর্সপাওয়ারের আউটবোর্ড ইঞ্জিন লাগানো হয়েছিল যা বোটের তুলনায় কম শক্তিশালী।
১৭ আগস্ট ঠিক রাত বারোটার সময় লে.কর্নেল ইভান কার্লসনের নেতৃত্বে দুটো সাবমেরিন থেকে রেইডারগণ রওনা দেয়। কিন্তু তখন সাগরে ছিল প্রচুর স্রোত এবং বাতাস। তার উপর দুর্বল আউটবোর্ড ইঞ্জিন বারবার বিকল হয়ে যাচ্ছিল। এসব কারণে তারা রাত সোয়া পাঁচটার সময় দ্বীপে ল্যান্ড করে। প্রশান্ত মহাসাগরে তখনও ভোর হতে অনেক সময় বাকি। কিন্তু লে. কর্নেল ইভান কার্লসন শেষ মুহূর্তে প্ল্যান চেঞ্জ করে সকল রেইডারকে একটি বিচে ল্যান্ড করার নির্দেশ দিয়েছিলেন যা আগের প্ল্যান অনুযায়ী দ্বীপের দুই দিকের বিচে ল্যান্ড করার কথা ছিল। কিন্তু কোনো কারণে লেফটেন্যান্ট অস্কার পেট্রোসের ১২ সদস্যের স্কোয়াড নির্দেশ শুনতে না পেয়ে আগের বিচেই ল্যান্ড করে আক্রমণ শুরু করে দেয়। ইতিহাসবিদরা একে ‘ভাগ্যবান ভুল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা তার হামলা ঠেকাতে কায়ুজাবুরো কানেমিতসু্ নিজে একটি দল নিয়ে চলে আসেন। বেশিরভাগ জাপানি যখন দক্ষিণ দিকে অস্কার পেট্রোসের দলের বিরুদ্ধে গোলাগুলিতে ব্যস্ত, তখন পূর্বদিকে মোতায়েন স্নাইপারগণ আরো বড় দলের হামলার খবর দেয়। লে. কর্নেল কার্লসনের স্কোয়াড জাপানিজ মেশিনগানগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন।
সেগুলোর পতন হতেই কানেমিতসু্ আরো সেনা পাঠান এবং প্রয়োজনে হাতাহাতি লড়াই করে হলেও প্রতিরক্ষা অবস্থান ধরে রাখতে নির্দেশ দেন। ফলে জাপানিরা দুইবার বেয়নেট, গ্রেনেড নিয়ে আত্মঘাতি হামলা (banzai charges) করে। কিন্তু কার্লসনের টিম সেটি ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়। তাকে বাধা দিতে বাধ্য হয়েই কানেমিতসু্ বাদবাকি সৈনিকদের নতুনভাবে মোতায়েন করেন।
ফলে লেফটেন্যান্ট অস্কার পেট্রোসের টিম সামনে গিয়ে কার্লসনের সাথে যোগ দিতে পারছিলেন না। তার দলের তিনজন ইতিমধ্যে মারা গেছে, আহত হয়েছে দুজন। বাকিদের নিয়ে তিনি ঘুরপথে গিয়ে কানেমিতসু্র টিমের পিছন দিয়ে হাজির হন। তার নতুন কৌশলে দুই-তিন দিক দিয়ে গুলি ছোড়ায় লে. কর্নেল কার্লসনের টিম এবার কিছুটা কোণঠাসা হয়ে গেছে। লেফটেন্যান্ট পেট্রোস পিছন থেকে আচমকা হামলা করে কানেমিতসু্সহ আট জাপানিকে হত্যা করেন। সকাল নয়টার মধ্যেই দ্বীপটির উল্লেখযোগ্য অংশ মেরিন রেইডারদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তাদের উপর স্বল্প সময়ের জন্য দ্বীপ দখলে রাখার নির্দেশ ছিল। তাই বাদবাকি জাপানিদের খুঁজে বের করার দরকার হয়নি।
মেরিনরা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে না করতেই বেলা দেড়টার সময় রিএনফোর্সমেন্ট হিসেবে আসা ২টি জাপানি ফ্লাইং বোট (সেনাভর্তি সি-প্লেন) সহ বারোটি বিমান ম্যাকিন আইল্যান্ডের আকাশে উড়ে আসে। ফ্লাইং বোটগুলো দ্বীপের ভিতরের হ্রদে অবতরণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু মেরিনরা এবার দখলকৃত জাপানি মেশিনগান দিয়ে তাদের উপর গুলি চালায়। এছাড়াও তারা এন্টি ট্যাংক রাইফেল এনেছিল। সেগুলোর গোলা হজম করে একটি বিমান ক্রাশ করে, আরেকটি আকাশেই বিস্ফোরিত হয়। বাকি বিমানগুলো ফিরে যেতে বাধ্য হয়। জাপানি রিএনফোর্স টিম ব্যর্থ হতেই মেরিনরা সাবমেরিনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কেননা লে. কর্নেল কার্লসনের ধারণা ছিল এবার জাপানিরা আরো বড় পরিসরে হামলা করবে। এটাই ছিল মার্কিনিদের আসল উদ্দেশ্য। ম্যাকিনে সেনা পাঠাতে হলে গুয়াডালক্যানাল, গিলবার্ট ও তুলাগি আইল্যান্ড থেকেই পাঠাতে হবে যা মার্কিনীদের আসন্ন অপারেশনকে সহজ করে দেবে।
সাড়ে সাতটায় ১৮টি রাবার বোটে করে মেরিনরা দ্বীপ ত্যাগ করতে শুরু করে। এসব বোটের অনেকগুলোরই তখন ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে। প্রচুর স্রোত পাড়ি দিয়ে সাতটি বোটে করে বেশ কয়েকজন মেরিন সাবমেরিনে ফিরে যায়। রাতের জোয়ারে আর সাবমেরিনে ফিরে যাওয়া সম্ভব না বিধায় পরদিন সকালে বাকি ৭২ জন ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে।
শক্তিশালী স্রোতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ১১টি বোট ডুবে যায়। এ সময় মেরিনরা তাদের অস্ত্রশস্ত্রসহ অন্যান্য ইকুপমেন্ট হারায়। দ্বীপে তখন মাত্র তিনটি বোট ও ২০ জন সশস্ত্র মেরিন কার্লসনের টিমকে নিরাপত্তা দিতে রয়ে গিয়েছিল। ব্যর্থ ও ক্লান্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইভান কার্লসন সাবমেরিনে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় ভেবে তখন একজন জাপানিকে দিয়ে বাদবাকি জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ বার্তা পাঠান। কিন্তু দ্বীপে থাকা সেই ২০ জন কার্লসনের সিদ্ধান্ত জানতেন না। তারা উক্ত সংবাদবাহককে মেরে ফেলেন!
১৮ আগস্ট সকাল নয়টার সময় সাবমেরিন থেকে রেসকিউ বোট পাঠানো হয় যেন বাদবাকি বোটগুলো দড়ি দিয়ে টেনে সাবমেরিনে ফিরিয়ে নেয়া যায়। সেটি তার কাজ শুরু করেছে, তখনই জাপানি যুদ্ধবিমানের আগমন ঘটে। বিমান হামলায় রেসকিউ বোট ডুবে যায়, সাবমেরিনগুলো পানির তলায় ডুব দিতে বাধ্য হয়। এটি সারাদিনেও আর পানির উপরে উঠে আসতে পারেনি। রাত এগারোটার সময় কার্লসনের দলের লেফটেন্যান্ট চার্লি ল্যাম্ব সাবমেরিনকে আলোর সাহায্যে সিগন্যাল দিয়ে ম্যাকিন দ্বীপের লেগুনের মুখে আসতে সাবমেরিনকে সিগন্যাল দেন। এ সময় তিনি বাদবাকি তিনটি বোট ও দ্বীপবাসীদের ছোট দুটি নৌকা একসাথে জোড়া দিয়ে দুটো সচল আউটবোর্ড ইঞ্জিনের সাহায্যে চার মাইল পাড়ি দিয়ে সাবমেরিনে পৌঁছাতে সক্ষম হয় বাদবাকি ৭২ জন মেরিন।
মেরিনদের মধ্যে ১৮ জন মারা যান। তাদেরকে ম্যাকিন আইল্যান্ডেই কবর দেয়া হয়। ১২ জনকে নিখোঁজ হিসেবে ঘোষণা করা হয় যাদের একজনকে পরবর্তীতে স্থানীয় আদিবাসীরা অন্যদের সাথে কবর দিয়েছিল। ২০০০ সালে এই ১৯ জনের কবর ম্যাকিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা হয়। ৬ জনকে পারিবারিক কবরস্থানে পুনরায় সমাহিত করা হয়। পরে জানা যে নিখোঁজদের ৯ জন রাতের বেলা সাবমেরিনে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টার সময় ব্যর্থ হয়ে দ্বীপে ফিরে ধরা পড়েছিল এবং ‘কোশো আবে‘ নামক এক জাপানির হাতে খুন হয়। যুদ্ধবন্দী হত্যার অভিযোগে তাকে মেরিনরা মৃত্যুদন্ড দেয়।
লে. কর্নেল কার্লসন রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, তিনি নিজে ৮৩ জন জাপানি সেনার লাশ গুনেছেন। ম্যাকিন দ্বীপের অধিবাসীদের ভাষ্য অনুযায়ী ১৬০ জন জাপানি মারা গেছে। ইতিহাসবিদ স্যামুয়েল মরিসন দাবি করেছেন, ফ্লাইং বোট ধ্বংসের কারণে ৬০ জন জাপানি মারা গিয়েছে। তবে জাপানি সূত্র থেকে ৪৬ জন মারা যাওয়ার কথা জানা যায়। এই তথ্যটি বিশ্বাসযোগ্য হবার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ জাপানি নথি মোতাবেক দ্বীপে তখন ২৭ জন সেনা বেঁচে ছিল। এই তথ্যটি পরদিন আসা আরেকটি জাপানি রিএনফোর্সমেন্ট টিম হেডকোয়ার্টারকে অবহিত করে।
এই অপারেশনটি আপাতদৃষ্টিতে সফল হলেও প্রকৃতভাবে দ্বিগুণ ব্যর্থ একটি অপারেশন। কেননা কোনো জাপানি অফিসারকে বন্দী করা সম্ভব হয়নি বা অন্য কোনোভাবে পাশ্ববর্তী গিলবার্ট দ্বীপের জাপানি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি। একইসাথে এই দ্বীপ রক্ষায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রিএনফোর্সমেন্ট ম্যাকিন আইল্যান্ডের জন্য আসেনি। বরং ম্যাকিন দ্বীপ ও সলোমন আইল্যান্ডের আশেপাশের জাপানি দ্বীপসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমস্ত জাপান দখলকৃত দ্বীপগুলোতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কয়েকগুণ শক্তিশালী করা হয়। ফলে পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালে ম্যাকিন দ্বীপ আবার দখল করতে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনামূলক বেশি রক্ত দিতে হয়েছিল। ম্যাকিন আইল্যান্ডের পরপরই গিলবার্ট ও মার্শাল আইল্যান্ডের যুদ্ধে মার্কিনীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিখ্যাত ভিডিও গেম সিরিজ কল অফ ডিউটি – ওয়ার্ল্ড অ্যাট ওয়্যার ও মেডেল অফ অনার – প্যাসিফিক অ্যাসল্ট গেমে এই অপারেশনের আদলে মিশন বানানো হয়েছে। এছাড়া এই ঘটনা নিয়ে ১৯৪৩ সালে লে. কর্নেল কার্লসনের তত্ত্বাবধানে Gung Ho! নামে একটি মুভি বানানো হয়।