ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে চলুন ঘুরে আসা যাক আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী আগেকার পৃথিবী থেকে। ১৯০৫ সালের ১৬ আগস্ট ছিলো সেদিন। ইউক্রেনের খেরসন এলাকার দক্ষিণে এবং রাশিয়ার কুবান এলাকার পশ্চিমে অবস্থিত ক্রিমিয়ার এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম নেয় ছোট্ট একটি মেয়ে। মেয়ে ছোট হলে কী হবে, তার নামটি কিন্তু ছিলো বেশ বড় এবং দাঁতভাঙা- মারিয়া ভাসিল্য়েভ্না অক্টিয়াব্রিস্কায়া!
দশ ভাই-বোন আর বাবা-মাকে নিয়ে গড়া সংসারে সুখেই কেটে যাচ্ছিলো ছোট্ট মারিয়ার দিনগুলো। আস্তে আস্তে একসময় শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পা রাখে সে। তারপর পরিবারের চাহিদা মেটাতে প্রথমে এক ফ্যাক্টরিতে ক্যানের ভেতর খাদ্য সংরক্ষণের চাকরি নেয় মারিয়া। তারপর এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে আরেকটু ভালো জীবিকার আশায় সে বেছে নেয় টেলিফোন অপারেটরের চাকরি। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো তার রঙিন স্বপ্নের ঘুড়ি ওড়ানো দিনগুলো।
বিশ বছর বয়সে ১৯২৫ সালে এক সোভিয়েত আর্মি অফিসারের সাথে বিয়ে হয় মারিয়ার। এ বিয়েটাই যেন মারিয়ার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর থেকেই সামরিক নানা ব্যাপারে আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে তরুণী মারিয়ার মনে। এরই অংশ হিসেবে কিছুদিন পরে তিনি যোগদান করেন সামরিক বাহিনীর সদস্যদের স্ত্রীদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিলে। এরপর তিনি সামরিক বাহিনীর জন্য নার্সের ট্রেনিংটাও সেরে ফেলেন। অল্প কিছুদিন পরে আগ্রহের বশে শিখে নেন বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র ও সাঁজোয়া যান চালানোর কৌশলও! তিনি বলতেন- “সামরিক বাহিনীর কাউকে বিয়ে করো এবং তুমি নিজেও আর্মিতে কাজ করো। একজন অফিসারের স্ত্রী হতে পারা কেবল গর্বেরই নয়, বরং দায়িত্বেরও প্রতীক।”
তবে মারিয়ার জীবনের এমন খুশির দিনগুলো খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। আস্তে আস্তে পৃথিবীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে থাকে। ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে যায় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্ববাসী আবারো হতবাক হয়ে কিছু ক্ষমতালোভী মানুষের ধ্বংসলীলার মাঝে আবিষ্কার করে নিজেদের। ১৯৪১ সালের ২২ জুন থেকে শুরু হয় ‘দ্য গ্রেট প্যাট্রিয়টিক ওয়্যার’। এ যুদ্ধটি একেক পক্ষের কাছে একেক নামে পরিচিত। অতীতের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আধুনিক কালের রাশিয়ার কাছে যুদ্ধটি এ নামেই পরিচিত। অন্যদিকে জার্মানরা একে বলে থাকে ‘ইস্টার্ন ফ্রন্ট’। অপরদিকে তৃতীয় পক্ষগুলোর কাছে এ যুদ্ধটি ‘ইস্টার্ন ক্যাম্পেইন’, ‘রাশিয়ান ক্যাম্পেইন’, ‘জার্মান-সোভিয়েত যুদ্ধ’ ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত।
প্রায় চার বছর ধরে চলা এ যুদ্ধটি বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনীর সমাবেশ দেখেছে। হিংস্রতা, ধ্বংস, নির্যাতন ও নির্বাসন মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। যুদ্ধের ভয়াবহতায়, অনাহারে-অর্ধাহারে, নানা রোগে ভুগে, নির্বিচারে চালানো গণহত্যায় মারা গিয়েছিলো লাখ লাখ মানুষ। ধারণা করা হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারা যাওয়া প্রায় ৭ কোটি মানুষের মাঝে ৩ কোটির মতো মারা গিয়েছিলো শুধু এ ইস্টার্ন ফ্রন্টেই!
৩ বছর ১০ মাস ২ সপ্তাহ ৩ দিন পর ১৯৪৫ সালের ৯ মে শেষ হয় এ যুদ্ধ। যুদ্ধে ১৯৪১, ১৯৪৩ এবং ১৯৪৫ সালে নাৎসি বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিলো যথাক্রমে ৩৭,৬৭,০০০, ৩৯,৩৩,০০০ এবং ১৯,৬০,০০০। অপরদিকে একই বছরগুলোতে মিত্রবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিলো যথাক্রমে ২৬,৮০,০০০, ৬৭,২৪,০০০ এবং ৬৪,১০,০০০। এ যুদ্ধে বিজয় লাভ করে মিত্রপক্ষ, ইউরোপে শেষ হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ, পতন ঘটে নাৎসি বাহিনীর এবং শেষ হয় অ্যাডল্ফ হিটলার নামক এক অধ্যায়ের।
আবারো মারিয়ার গল্পে ফিরে আসা যাক। দ্য গ্রেট প্যাট্রিয়টিক ওয়্যার শুরু হলে মারিয়াকে সরিয়ে নেয়া হয় সাইবেরিয়ার শহর টম্স্কে। সেখানে থাকাকালেই একসময় মারিয়া জানতে পারেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধে মারা গেছেন তার স্বামী। মারিয়ার স্বামী আসলে মারা গিয়েছিলেন ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসেই। কিন্তু যুদ্ধের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এ খবরটি তার কাছে এসে পৌঁছায় ১৯৪৩ সালে, অর্থাৎ প্রায় দু’বছর পর! স্বামীকে হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়লেন না তিনি। বরং জার্মান বাহিনীর কোমর ভেঙে দিতে দাঁতে দাঁত চেপে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলেন মারিয়া। তার মনের মাঝে দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো প্রতিশোধের আগুন।
এরপর এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন মারিয়া, সরাসরি চিঠি লিখে বসলেন সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের কাছে।
“মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছেন আমার স্বামী। স্বামীর মৃত্যুর জন্য এবং সোভিয়েত জনগণের মৃত্যুর জন্য আমি এসব ফ্যাসিস্ট বর্বরগুলোর উপর প্রতিশোধ নিতে চাই। এজন্য আমি আমার কাছে থাকা সকল অর্থ, ৫০,০০০ রুবল, ন্যাশনাল ব্যাংকে জমা রেখেছি যাতে করে একটি ট্যাঙ্ক বানানো যায়। আমি অনুরোধ করছি যেন এ ট্যাঙ্কটির নাম রাখা হয় ‘ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড’ এবং ফ্রন্ট লাইনে এ ট্যাঙ্কের ড্রাইভার হিসেবে আমাকে পাঠানো হয়।”
স্টেট ডিফেন্স কমিটি সবকিছু বিবেচনা করে মারিয়ার এ আবেদন অনুমোদন করে। তারা অবশ্য মারিয়ার যুদ্ধে যোগ দেয়াটাকে কেবলই প্রচারের জন্য ব্যবহারের চিন্তা করেছিলো। আফসোস! তারা আসলে তখনো মারিয়ার ভেতরে জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপটা টের পায় নি। মারিয়ার জন্য একটি টি-৩৪ মডেলের ট্যাঙ্ক দেয়া হয়। সাড়ে ছাব্বিশ টন ওজনের এ ট্যাঙ্কের দৈর্ঘ্য ছিলো ৬.৬৮ মিটার, প্রস্থ ৩ মিটার এবং উচ্চতা ২.৪৫ মিটার।
এরপরই প্রায় ৫ মাসব্যাপী এক ট্রেনিংয়ে অংশ নেন মারিয়া। ততদিনে তার বয়স হয়ে গিয়েছিলো ৩৮। কিন্তু মনের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুনের কাছে সেগুলো ছিলো কেবলই একটি সংখ্যা। ট্রেনিং শেষ হবার পর ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে ২৬তম গার্ডস ট্যাঙ্ক ব্রিগেডে একজন ট্যাঙ্ক ড্রাইভার ও মেকানিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ‘ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড’ নামটি নিজের ট্যাঙ্কে লিখে নিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য মারিয়ার এমন প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে নেয়া সিদ্ধান্তকে যে সবাই স্বাগত জানিয়েছিলো তা কিন্তু নয়। বরং তার সাথে কাজ করা অনেকেই এমন কাজকর্মকে কেবল প্রচারের জন্য ভাবতো এবং কিছুটা কৌতুকের দৃষ্টিতেও দেখতো। তবে নিজের জীবনের প্রথম যুদ্ধেই এসব সমালোচকের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছিলেন মারিয়া ভাসিল্য়েভ্না অক্টিয়াব্রিস্কায়া।
মারিয়ার প্রথম যুদ্ধটি ছিলো ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর। মস্কো থেকে ৩৬০ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণ পশ্চিমের শহর স্মলেন্স্কে। শত্রুপক্ষের তুমুল গোলাবর্ষণ অগ্রাহ্য করে সেদিন এগিয়ে যাচ্ছিলো মারিয়ার ট্যাঙ্ক। মেশিনগান এবং অন্যান্য আর্টিলারি গানের জায়গাগুলো ধ্বংস করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি এবং তার ক্রুরা। যদি কোনো গোলার আঘাতে ট্যাঙ্কের ক্ষতি হতো, তাহলে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ট্যাঙ্ক থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে যেতেন তিনি। প্রবল গোলাবর্ষণের মাঝেই মারিয়ার হাতের ছোঁয়ায় মেরামতের পর আবার এগিয়ে যেতো তার ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড। যুদ্ধে এমন সাহসিকতা প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরুপ তাকে সার্জেন্ট পদে উন্নীত করা হয়।
এক মাস পরের কথা। ১৭-১৮ নভেম্বরের দিকে সোভিয়েত বাহিনী বেলারুশের ভিতেব্স্ক শহরের নভোইয়ে সেলো এলাকাটি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এখানকার যুদ্ধে নিজেকে আবারো নতুন করে চেনান মারিয়া। ১৭ তারিখে নভোইয়ে সেলোর কাছাকাছি জার্মান ঘাঁটিগুলোতে গোলাবর্ষণ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলো তার ফাইটিং গার্লফ্রেন্ড। হঠাৎ করে শত্রুপক্ষের এক গোলার আঘাতে সমস্যা দেখা দেয় ট্যাঙ্কের ট্র্যাকে, থেমে যায় ফাইটিং গার্লফ্রেন্ডের অগ্রযাত্রা। বাহিরে চলতে থাকা তুমুল গোলাগুলো অগ্রাহ্য করে এক ক্রুকে নিয়েই ট্যাঙ্ক থেকে নেমে পড়েন মারিয়া। ট্যাঙ্কের অন্যান্য ক্রুরা তখন টারেটে থেকে তাদের সুরক্ষার ব্যাপারটি নিশ্চিত করছিলো। ট্যাঙ্ক মেরামত শেষ হলে বেশ কিছুদিন পর তারা মূল টিমের সাথে গিয়ে যোগ দেন।
প্রায় দু’মাস পর ১৯৪৪ সালের ১৭ জানুয়ারি রাতের বেলায় আরেকটি যুদ্ধে অংশ নেন মারিয়া। এবারের যুদ্ধটি ছিলো ভিতেব্স্কের কাছাকাছি এক গ্রামে, নাম শ্ভেদী। এ যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়েছিলেন তিনি। তার ফাইটিং গার্লফ্রেন্ডের সামনে জার্মান প্রতিরক্ষা তছনছ হয়ে যাছিলো। বিভিন্ন ট্রেঞ্চে শত্রুসেনাদের প্রতিরোধ ভেঙে দিয়ে, মেশিনগানারদের অবস্থা বারোটা বাজিয়ে দিয়েই এগোচ্ছিলেন মারিয়া।
খুব বেশিক্ষণ অবশ্য এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা গেল না। কিছুক্ষণ পরেই এক অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফাইটিং গার্লফ্রেন্ডের ট্র্যাক। ফলে থেমে যেতে বাধ্য হন তারা। আগের দু’বারের মতো সেদিনও মৃত্যুভয় অগ্রাহ্য করে তুমুল গোলাবর্ষণের মাঝেই ট্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসেন মারিয়া, লেগে যান ট্র্যাক ঠিক করার কাজে। ট্র্যাক ঠিক করতে সক্ষমও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। ট্র্যাক ঠিক করতে পারার পরমুহূর্তেই তার খুব কাছে একটি আর্টিলারি শেল বিষ্ফোরিত হয়। এর ছোট ছোট অংশগুলো সরাসরি এসে তার মাথায় আঘাত হানে। ফলে সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যান তিনি।
যুদ্ধের পরপরই মারিয়াকে কিয়েভের কাছাকাছি ফ্যাস্তভের এক সোভিয়েত মিলিটারি ফিল্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু আর চোখ মেলে তাকানোর সৌভাগ্য হলো না এ বীরের। প্রায় দু’মাস কোমায় থাকার পর ১৫ মার্চ পরপারে পাড়ি জমান মারিয়া ভাসিল্য়েভ্না অক্টিয়াব্রিস্কায়া। ভিতেব্স্কের যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের স্বীকৃতি স্বরূপ আগস্ট মাসে তাকে ‘হিরো অব সোভিয়েত ইউনিয়ন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।