ইউরোপের মাটিতে প্রথম সভ্যতা গড়ে তুলেছিল কারা? প্রশ্নটির বেশিরভাগ উত্তরই হয়ত হবে গ্রিকরা। কথাটাকে পুরোপুরিভাবে উড়িয়েও দেওয়া যায় না, কারণ প্রাচীন গ্রিসকে বলা হয় এজিয়ান সভ্যতার বিরাট একটি অংশ, যদিও তা বেশ পরের ঘটনা। এজিয়ান উপসাগর কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা সভ্যতাগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। শুরুটা করেছিল ক্রিট দ্বীপের মাইনোয়ানরা, তারপর এজিয়ান উপসাগরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দ্বীপগুলোর সাইক্লেডীয় সভ্যতা, শেষমেশ গ্রিসের মূল ভূখন্ডের হেলাডিক সভ্যতা।
মাইনোয়ানদের ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ৩,৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। গ্রিসের মূল ভূখন্ড পাড়ি দিয়ে ইন্দো-ইউরোপীয়রা আস্তানা গেড়েছিল ভূমধ্যসাগরে শুয়ে থাকা ক্রিট দ্বীপে। ক্রিটের উর্বর জমি আর চমৎকার আবহাওয়া মাইনোয়ানদেরকে জীবন অনেকটাই সহজ করে দিয়েছিল। ১২০ মাইল লম্বা আর ৩০ মাইল চওড়া দ্বীপটির চারপাশে নীল অথৈ সাগর। পানিতে মানুষ তখনও গোলা ছোঁড়া শুরু করেনি, তাই তখনও মাইনোয়ানদের উপদ্রব করার মতো তেমন কেউ ছিল না। যুদ্ধ-বিগ্রহবিহীন মাইনোয়ানরা তাই সহজেই নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতির দিকে নজর দিতে পেরেছিল।
মাইনোয়ানরা কৃষিকাজে বেশ দক্ষ ছিল, ক্রিটের উর্বর মাটিতে তৈরি হওয়া শস্য আর মদ সাগরপথে পৌঁছে যেত এশিয়া মাইনর, গ্রিস আর নিম্নতর মিশরে। তারা একই মাঠে একাধিক ফসল চাষ করার দক্ষতাও অর্জন অরেছিল। চাষের কাজে ব্যবহার করত কাঠ আর হাড় দিয়ে বানানো জিনিসপত্র, যেগুলো ব্রোঞ্জ যুগ আসার পর পরিণত হয় ব্রোঞ্জে। অন্যান্যদের মতো তারাও পশুপালন করত। তবে যে জিনিসটা তাদের আলাদা করেছিল তা হলো মৌমাছি পালন। এছাড়াও পশু শিকারের জন্য তারা মিশর থেকে বিড়াল আমদানি করত!
মাইনোয়ানদের বেশিরভাগ অংশই বাস করত গ্রামাঞ্চলে, ছোট ছোট কুটিরে। ব্রোঞ্জ আর পাথর দিয়ে ছুরি তৈরি করত, বানাত চিমটা আর কুঠার, আর এগুলোর উপর ফুটিয়ে তুলত অসাধারণ সব কারুকার্য। আমদানী করা সোনা আর তামা দিয়ে বিভিন্ন রকম গহনা তৈরি করতে মাইনোয়ানদের জুড়ি মেলা ছিল ভার। তারা আগুনে না পুড়িয়েই খোদাই করে নেকলেস, ব্রেসলেট সহ নিজেদের ব্যবহার্য গহনাপাতি বানিয়ে ফেলত!
তবে মাইনোয়ানরা ইতিহাস সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে তাদের কুমোরশিল্প দ্বারা। এদিক থেকে তাদের দক্ষতা যে প্রশ্নাতীত তা বলাই বাহুল্য। মাটির তৈজসপত্রের উপর সুদৃশ্য নকশার সাথে তারা যোগ করত সামান্য জ্যামিতিক জ্ঞান। এছাড়াও বিভিন্ন প্রাণীর আদলে তৈরি করা তৈজসপত্রের সংখ্যাও কম না। সময় যত বাড়তে থাকল, মাইনোয়ানদের মাটির তৈজসপত্রের উপরের ত্রিভুজ-রেখার নকশাগুলো পরিবর্তিত হতে থাকল পশু-প্রাণীর দিকে। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরণের সামুদ্রিক মাছ, স্কুইড, মাছের হাড়, পাখি আর ফুলের নকশার প্রভাব খুব বেশিই ছিল।
ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে ভূমধ্যসাগর আর এজিয়ান উপসাগর চষে বেড়ানো মাইনোয়ানরা অন্যান্য অনেক সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছে, বিশেষ করে মিশরের কথা না বললেই নয়। গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া মাইনোয়ানদের তৈরি জিনিসপত্র থেকেই বোঝা যায় মাইনোয়ানদের সাথে হেলাডিকদের গভীর সম্পর্ক ছিল। এছাড়াও মাইসিনের বিভিন্ন সমাধি থেকে মাইনোয়ান জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। আনাতোলিয়া, মিশর এমনকি সুদূর মেসোপটেমিয়াতেও মাইনোয়ানদের তৈজসপত্রের প্রমাণ মেলে। মাইনোয়ানরা যে তৎকালীন সময়ে কিংবা তার পরের অনেক সময় পর্যন্ত শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল তা বলাই বাহুল্য। এর মূল কারণ যে ভূমধ্যসাগরের এক নির্জন দ্বীপে যুদ্ধ-বিগ্রহ বিহীন অবস্থায় কাটানো তা সহজেই অনুমেয়।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে মাইনোয়ান সভ্যতা বেশ বড় একটা লাফ দেয়। ক্রিটের বিভিন্ন স্থান ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। সংগঠিত হওয়ার কারণে মাইনোয়ানদের মধ্যে বেশ কিছু নেতৃত্বস্থানীয় লোকের উদ্ভব ঘটে। ফলে মাইনোয়ানরা শহর তৈরিতে উদ্যোগী হয়, গড়ে তোলে রাজকীয় প্রাসাদসহ বিভিন্ন পাবলিক বিল্ডিং, তৈরি হয় কেন্দ্রীয় সরকার। কাদামাটির ফলকে লেখাজোঁকা শুরু হয়। মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সৃষ্টি করা হয় ক্রেটান হায়ারোগ্লিফ, পরে এখান থেকেই Linear A এর মতো লেখন পদ্ধতি আবিষ্কার হয়।
মাইনোয়ানরা ক্রিটের উত্তর দিকে ভূমধ্যসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে তোলে তাদের সবচেয়ে বড় শহর নসোস। পাহাড়ের সাথে গা লাগিয়ে তৈরি করে রাজা মাইনোসের বিশাল প্রাসাদ। তবে প্রাসাদটি মূলত ছিল অনেকগুলো দালানের সমষ্টি, মাঝখানে শান বাঁধানো উঠোন। প্রধান শাসক থাকতেন সবচেয়ে বড় দালানটিতে, সাগরের দিকে মুখ ফিরানো জানালাগুলো দিয়ে উপভোগ করতেন ভূমধ্যসাগরের নীলাভ সৌন্দর্য্য।
মাইনোয়ানদের প্রাসাদের ভিতরটুকুও কম সুন্দর ছিল না, প্রাসাদের ভিতরের দেয়ালে উজ্জ্বল রং দিয়ে ফ্রেস্কো বা দেয়ালচিত্র আঁকা হত। তাতে ফুটে উঠত মাইনোয়ানদের নিত্যদিনের সমাজ ও জীবন যাত্রার গল্প। নসোসের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষে এখনো উজ্জ্বল রঙের ফ্রেস্কোর দাগ লেগে আছে। ফ্রেস্কোর মধ্যে প্রাধান্য পেত ষাঁড়ের ছবি। মাইনোয়ানরা ষাঁড়ের পূজা করত, প্রচলিত ছিল ষাঁড় নৃত্য। মনে করা হয়, গ্রিক পুরাণের ষাঁড় মাথাওয়ালা জন্তু “মাইনোটর” থেকে মাইনোয়ান শব্দের উৎপত্তি। অনেকের মতে এর উৎপত্তি মাইনোয়ানদের রাজা “মাইনোস”-থেকে। রাজা মাইনোসের প্রাসাদের এক অংশে গোলকধাঁধার ভিতরে মাইনোটরকে আটকে রাখা হত, যার পেট চলত মানুষের মাংস দিয়ে!
বহিরাগত শত্রুর কোনো রকম উপদ্রব না থাকায় ক্রিট শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। প্রাসাদগুলোও ছিল সাধারণ, অন্যান্য সভ্যতার মত দুর্গের আকার দেওয়া হয়নি। তবে এমনিতে প্রাসাদের পাথরের দেওয়াল আর থামগুলো বেশ শক্তিশালী ছিল। প্রাসাদের নিচে গড়ে ওঠা নসোস শহরের বাড়িগুলোও ছিল মজবুত, ইট-পাথরের মিশ্রণে তৈরি দুই-তিনতলা দালানে বাস করত মাইনোয়ানরা।
এজিয়ান উপসাগরে ভূকম্পন খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না, মাইনোয়ানরাও ভূকম্পনকে স্বাভাবিকভাবে নিত। কিন্তু ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ভয়াবহ এক ভূকম্পনে নসোস তো ধূলিসাৎ হয়ই, মাইনোসের প্রাসাদও অনেকাংশে ভেঙে পড়ে।
নসোস ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি শহর গড়ে তুলেছিল মাইনোয়ানরা। মালিয়া, কাটা জাকরোস, গ্যালাটাস শহরে গড়ে তোলা হয়েছিল প্রাসাদ, এদের মধ্যে ফাইস্টোস ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম। ধারণা করা হয়, এক সময় দ্বীপটি দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। নসোস আবিষ্কার হওয়ার অনেক পরে গোর্নিয়া, পিরগোস, সেইরা, জোমিন্থোস সহ আরও কয়েকটি শহরের ধ্বংসাশেষ খুঁজে পাওয়া যায় ক্রিটের আনাচেকানাচে।
ভূমিকম্পের পর মাইনোয়ানরা আবার নতুন করে শহর নির্মাণ করার কাজে হাত দেয়, মাইনোসের জন্য তৈরি করা হয় নতুন চোখধাঁধানো প্রাসাদ। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭ থেকে ১৬ শতক ছিল মাইনোয়ানদের সোনালী যুগ, এ সময় মাইনোয়ান সভ্যতা ফুলে ফেঁপে ওঠে। পুরো ভূমধ্যসাগরে মাইনোয়ানরা ইতিহাসে সর্বপ্রথম ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি গড়ে তোলে। নৌ-বহরের আকার আরও বড় হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যও ছিল আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রাণচঞ্চল এবং ব্যাপক পরিসরের। চিত্রকলা এবং ভাষারও যুগপৎ পরিবর্তন ঘটে। ১৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হঠাৎ করেই ক্রিটের শহরগুলো আবারও ধ্বংস হয়ে যায়। ঠিক কিভাবে ধ্বংস হয়েছিল তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় থেরার অগ্ন্যুৎপাত অথবা এজিয়ান সাগরের সুনামিই এর জন্যে দায়ী ছিল।
মাইসিন শহরের বর্বর অধিবাসী মাইসেনিয়ানরা আগেও বেশ কয়েকবার ক্রিট ঘেরাও করে রেখেছিল। মাইনোয়ানদের শহর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সুযোগে তারা নসোস দখল করে নেয়। মাইনোয়ানরা ক্রীতদাসে পরিণত হয়, শহর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার এই ধাক্কা তারা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মাইনোয়ান সংস্কৃতির বেশ কিছু অংশ মাইসেনিয়ানরা মেইনল্যান্ডে নিয়ে যায়। মাইনোয়ানদের লেখার পদ্ধতি অনুকরণ করে তারা আরেকটি লেখার পদ্ধতি Linear B আবিষ্কার করে যা ছিল আরও সহজবোধ্য। মাইসেনিয়ানরা মাইসিন ছাড়াও তিরিন, পাইলোস ও থেসেলিতে বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করলেও মাইনোয়ানদের মত সভ্যতার উৎকর্ষে পৌঁছাতে পারেনি। তারা নিজেদের অধিকাংশ সময় ব্যয় করত যুদ্ধ-বিগ্রহে, নতুন শহর হামলা করতে আর লুটপাট চালাতে। সাইপ্রাস আর এশিয়া মাইনরেও অবিরত হামলা চালিয়েছে তারা।
গ্রিসের মূল ভূখন্ড, ক্রিটসহ এজিয়ান উপসাগরের বেশিরভাগ দ্বীপে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল মাইসেনিয়ানরা। মাইনোয়ানদের কুমোরশিল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মাইসেনিয়ানরাও এই শিল্পকে আরও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। খ্রিস্টপূর্ব বার শতকের শেষ দিকে বর্বর ডোরিয়ানদের হামলায় মাইসেনিয়ানদের বড় বড় শহর ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, মাইসেনিয়ানরা গ্রিসের বিভিন্ন জায়গায় ছিটকে চলে যায়। সমগ্র এজিয়ান উপসাগরে অন্ধকার নেমে আসে। এজিয়ান-মাইনোয়ান-মাইসেনিয়ান সভ্যতা অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার আরও বেশ কয়েক শতাব্দী পর অবশেষে আবারও গ্রিস মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার সমগ্র সৌন্দর্য ও শক্তি দিয়ে। সূচনা হয় নতুন যুগের, প্রাচীন ধ্রুপদী গ্রিসের।