Remember, remember!
The 5th of November,
The Gunpowder treason & plot;
I know of no reason
Why the gunpowder treason
Should ever be forgot!
ভি ফর ভেনডেটা মুভির কল্যাণে এই লাইন কয়টি অনেক মানুষের কাছেই পরিচিত। কিন্তু কী ঘটনার উপর ভিত্তি করে এই কবিতাটি রচিত, তা অনেকেরই অজানা। কী হয়েছিল নভেম্বরের ৫ তারিখ? কবেই বা ঘটেছিল এই ঘটনা? কী ছিল এর নেপথ্যের কাহিনী? চলুন জেনে আসি।
ঘটনার সূত্রপাত ইংল্যান্ডে। ১৬০৫ সালের ৫ নভেম্বর ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা প্রথম জেমসকে হত্যার উদ্দেশ্যে পার্লামেন্ট হাউজ অফ লর্ডস উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের কিছু লোক। তবে ঐ পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পূর্বেই ধরা পড়ে যায় পরিকল্পনার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা। অভিযান ব্যর্থ হলেও এই ৫ নভেম্বরের ‘গানপাউডার ট্রিজন এন্ড প্লট’ স্মরণীয় হয়ে আছে এখনো।
পটভূমি
১৫৩৩ সাল থেকে ১৫৪০ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন রয়্যাল হাউজ ‘হাউজ অফ টুডোর’ এর রাজা সপ্তম হেনরি রোম থেকে ইংলিশ চার্চের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলেন, তখন থেকেই ইংল্যান্ডে চলা কয়েক দশকের ধর্মীয় টানাপোড়েনের সূত্রপাত হলো। সদ্য পৃথক হওয়া এবং ক্রমবর্ধমান প্রোটেস্ট্যান্ট (খ্রিষ্টান ধর্মের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংগঠন) চার্চ অফ ইংল্যান্ডের অধীনস্থ সমাজে টিকে থাকতে ক্যাথলিকদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। ক্যাথলিকদের প্রতি এই বিমাতাসুলভ ব্যবহারের কারণ ছিল তাদের রোমের প্রতি আনুগত্য, এই ব্যাপারটিকে ইংরেজ শাসকরা বরাবরই বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। ক্যাথলিকদের জন্য পরিস্থিতি আরো অবনতি হলো, যখন অষ্টম হেনরির কন্যা প্রথম এলিজাবেথ রানী হয়ে ‘এলিজাবেথ রিলিজিয়াস সেটেলমেন্ট’ প্রকাশের মাধ্যমে এই ধর্মীয় বিভাগের প্রতি তার প্রতিক্রিয়া দিলেন।
এলিজাবেথ রিলিজিয়াস সেটেলমেন্ট অনুসারে প্রত্যেককে ইংল্যান্ডের রাজা/রানীকে প্রধান গির্জা এবং রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে মেনে নিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করতে হতো। যারা তা মানতে অস্বীকৃতি জানাতো, তাদের জন্য শাস্তি ছিল কঠোর, অমান্যের জন্য প্রাথমিকভাবে বড় অংকের জরিমানা করা হতো, আর বারবার অমান্যকারীকে জেল এমনকি প্রাণদণ্ডও দেওয়া হতো।
জোর করে ধর্ম পালনে বাধা সৃষ্টিকারী কাজকর্মের জন্য ক্যাথলিকদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা দানা বাঁধতে থাকল। অনেক ক্যাথলিকই বিশ্বাস করতেন, ইংরেজ সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী এলিজাবেথের জ্ঞাতি বোন মেরি, যিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাণী এবং ক্যাথলিক ধর্মানুসারী। কিন্তু তাকেও রাজদ্রোহের অভিযোগে ১৫৮৭ সালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় সচিব গোপনে মেরির ছেলে, স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমসের সাথে যোগাযোগ করেন। তাই যখন চিরকুমারী ও সন্তানহীনা এলিজাবেথ মারা যান, কোন বাধা ছাড়াই ক্ষমতা চলে আসে জেমসের হাতে। তাকে রাজা হিসেবে সবাই উৎসাহের সাথেই বরণ করে নিয়েছিল। এমনকি জেশুইট পুরোহিতরা (Jesuit Priest), ইংল্যান্ডে যাদের উপস্থিতির শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড, তারাও জেমসকে স্বাগত জানিয়েছিল।
ক্যাথলিকরা ভেবেছিল, রাজা জেমসের মাধ্যমে তাদের উপর প্রায় ৪৫ বছরের নিপীড়নের সমাপ্তি ঘটবে এবং তারা মুক্তভাবে নিজেদের ধর্ম পালন করতে পারবে। এমনটি ভাবার পেছনে যৌক্তিক কিছু কারণও ছিল। জেমসের আচরণ ক্যাথলিকদের প্রতি অনেক সহনশীল ছিল শুরুতে। তিনি বলেছিলেন, যারা নীরবে নিজেদের ধর্ম পালন করবে এবং আইনের প্রতি অনুগত থাকবে তাদের উপর অযথা নির্যাতন হবে না। এমনকি তিনি মৃত্যুদণ্ডের বদলে নির্বাসনের সাজা প্রণয়নের কথা বলেন। কিন্তু যেমনটা আশা করা হচ্ছিল, তার কিছুই বাস্তবে ঘটল না। বাকি সব প্রোটেস্ট্যান্ট রাজাদের মতোই জেমসের সাম্রাজ্যেও চলতে থাকলো ক্যাথলিকদের উপর নির্যাতন। এরই প্রেক্ষিতে ক্যাথলিক সমাজের কিছু পাদ্রীর সমন্বয়ে গড়া একটি সংঘ নিজেরাই ব্যাপারটি সামাল দেবার কথা ভাবলেন। তারা প্রাথমিকভাবে একটি পরিকল্পনা করলেন জেমসকে অপহরণ করার, যেটি ‘বাই প্লট’ নামে পরিচিত। ঠিক একই সময়ে ‘মেইন প্লট’ নামে আরেকটি পরিকল্পনা করে পাদ্রীদের আরেকটি দল, যাদের উদ্দেশ্য ছিল জেমসকে তার পরিবার সহ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। কিন্তু দুটি পরিকল্পনার খবরই পৌঁছে যায় সেসিলের কাছে, গ্রেফতার করা হয় এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের। ১৬০৩ সালের এই দুটি পরিকল্পনাই পরবর্তীতে ‘গানপাউডার প্লট’ সৃষ্টিতে পরোক্ষ ভূমিকা রাখে।
গানপাউডার প্লট
গানপাউডার প্লটের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল একজন গোড়া ক্যাথলিক রবার্ট কেটসবাই (Robert Catesby), যার বাবা ছিল রাণী এলিজাবেথের নিপীড়নের স্বীকার। রবার্ট সফলভাবে তার পরিচিত কিছু মানুষকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছিল যে, রাজা জেমস এবং তার সহায়তাকারীদের তাদের কৃতকর্মের জন্য চরম শাস্তি দেওয়ার ফরমান জারি করেছেন খোদ ঈশ্বর! ১৬০৪ সালের ২০ মে এই ষড়যন্ত্রের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সদস্য সংখ্যা ছিল পাঁচ, যার মধ্যে একজন হলেন গাই ফোকস (Guy Fawkes), তিনি ছিলেন একজন প্রাক্তন সেনা সদস্য।
পার্লামেন্টের অধিবেশন মুলতবী হয়ে যাওয়ায় ষড়যন্ত্রকারীদের ১৬০৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এর মধ্যে অন্যান্য প্রস্তুতি নেওয়া চলতে থাকে, বারুদ ও বিস্ফোরক যোগাড় করা, সেগুলো হেফাজত করা, কোথায় বিস্ফোরণ ঘটানো হবে তার ম্যাপ বানানো, পার্লামেন্টের কাছে বাসা ভাড়া নেয়া, সবই চলতে থাকে পরিকল্পনামাফিক।
পার্লামেন্টের একদম পাশেই একটি বাসা নেওয়া হয়, যার মাটির নিচের ভাণ্ডার ঘর ছিল পার্লামেন্টের সাথে যুক্ত। প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল জুলাইয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর, কারণ তখনই পরবর্তী অধিবেশন বসার কথা। কিন্তু সেই সময়ে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে অধিবেশন পিছিয়ে যায় নভেম্বর পর্যন্ত। ৫ নভেম্বর অধিবেশন বসার কথা, সব ঠিকঠাক, এদিকে গাই ফোকসও ৩৬ ব্যারেল বিস্ফোরক নিয়ে পৌঁছে গেছে সুড়ঙ্গ পথে পার্লামেন্টের নিচে, এখন কেবল বিস্ফোরণ ঘটানোর পালা।
কিন্তু অধিবেশনের আগে ষড়যন্ত্রকারীদের একজনের বোনের স্বামী ও পার্লামেন্ট সদস্য উইলিয়াম পার্কার, ৪র্থ লর্ড মন্টিয়েগেল (Lord Monteagle) একটি উড়ো চিঠি পান, যেখানে তাকে সতর্ক করা হয় যেন তিনি পরদিন পার্লামেন্ট যাওয়া বাতিল করেন। খটকা লাগায় মন্টিয়েগেল চিঠিটা সেসিলের কাছে হস্তান্তর করেন।
১ নভেম্বর রাজাকে চিঠিটি দেখানো হয়। চিঠিতে ‘উড়িয়ে দেওয়া’ শব্দটি দেখে জেমস সন্দেহ করেন, এই ষড়যন্ত্রে বিস্ফোরক দ্রব্যের অস্তিত্ব আছে। তার নির্দেশে নভেম্বরের ৪ তারিখ পার্লামেন্টের ভেতর ও আশেপাশের দালানগুলোতে তল্লাশী চালানো হয়। হাউজ অফ লর্ডসের তলদেশে বিপুল সংখ্যক জ্বালানী দেখে সন্দেহ হয় তল্লাশী চালানো দলের। ওগুলোর সাথে যাকে পাওয়া যায় সে নিজেকে চাকর হিসেবে পরিচয় দেয় এবং নিজের নাম বলে ‘জন জনসন’। কিন্তু তাকে তল্লাশী করে মেলে কিছু ম্যাচ, পকেট ঘড়ি এবং শুকনো কাঠ। গ্রেফতার করা হয় জন জনসনরূপী গাই ফোকসকে। এভাবেই ভেস্তে যায় বহুল প্রতীক্ষিত গানপাউডার প্লট।
পরবর্তী ঘটনাসমূহ
গাই ফোকসকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তার সাথের ষড়যন্ত্রকারীদের নাম জানতে পারে সরকার। পরবর্তী কিছু সপ্তাহে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে কর্তৃপক্ষ একে একে সবাইকে গ্রেফতার করে। কেউ কেউ গ্রেফতারের সময়ই মারা পড়ে, যারা বেঁচে থাকে, তাদেরকে বিচারের জন্য পাঠানো হয়।
গাই ফোকস এবং বাকী মুখ্য ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ৩১ জানুয়ারি ১৬০৬ সালে ফাঁসিকাষ্ঠে ওঠার সিঁড়ি থেকে ফোকস লাফিয়ে পরে এবং ঘাড় ভেঙে ওখানেই মারা যায়।
এই পরিকল্পনা ফাঁস হবার পর ইংরেজ সরকার ক্যাথলিকদের ওপর আরো কড়া আইনকানুন প্রয়োগ করা শুরু করে। অন্যান্য সকল দমনকারী বিধিনিষেধের পাশাপাশি তাদের ভোটাধিকার বাতিল করা হয়। মূলত যে কারণে এই ষড়যন্ত্রের সূচনা, তার সম্পূর্ণ বিপরীত ফল পায় ক্যাথলিকরা।
গ্রেট ব্রিটেনে প্রতি নভেম্বরের ৫ তারিখ পালন করা হয় ‘গাই ফোকস ডে’ আর ‘বনফায়ার নাইট’। সন্ধ্যা নামলেই সেখানে অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয় আর গাই ফোকসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়।
গানপাউডার প্লট সফল হয়ে গেলে কী হতো, কেউ জানে না। হয়ত ক্যাথলিকদের বছরের পর বছর নিপীড়িত জীবনের অবসান ঘটত কিংবা আবার কোনো প্রোটেস্ট্যান্ট রাজা আসত আর তাদের ভাগ্য ঠিক একই থাকত। যা-ই হোক না কেন, গানপাউডার প্লট ও গাই ফোকসকে সবাই মনে রাখবে, হয়ত কেউ নায়ক হিসেবে, আর কেউ খলনায়ক হিসেবে।