তাদের হাতে তিনটি রাস্তা খোলা ছিল। তারা পাহাড় কামড়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসতে পারতো। সেই পথটি ছিল ল্যান্ড মাইনে পরিপূর্ণ। তারা এক লেনের সরু ব্রিজ পেরিয়ে আসতে পারতো, কিন্তু ব্রিজে প্রতিপক্ষের গার্ডরা তখন পাহারা দিচ্ছে। মৃত্যু নিশ্চিত সেখানে। শেষ রাস্তা ছিল সামনের একটি হিমায়িত নদীর উপর দিয়ে স্কি করে আসা। কমান্ডোরা তৃতীয় পথটাই বেঁছে নেয়।
গভীর রাত, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় যখন দুর্দান্ত গতিতে যখন দলটি স্কি করে নামছে, ঠিক তখনই পেছনে শোনা গেল তীব্র বিস্ফোরণের শব্দ। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে বেজে উঠলো অ্যালার্ম। তারপরেই কিছু গুলি ছুটে গেল মাথার উপর দিয়ে। শত্রুরা সবাই তখন বেরিয়ে পড়েছে তাদের ধরতে।
না। সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে জেমস বন্ড কোনো মিশনে বের হননি। সত্যিই এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪২ সালে। কয়েক মুহূর্ত আগেও স্বপ্নে বিভোর জার্মানদের স্বপ্নভঙ্গ হলো। পেছনের ঘটনা তাহলে জেনে আসা যাক।
১৯৪২ সাল। ইউরোপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জার্মানদের প্যানজার ট্যাংক। রোমেলের মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন জেনারেলরা এনে দিচ্ছেন একের পর এক বিজয়। তবে যুদ্ধ শুধুই ট্যাংক আর বন্দুকের খেলা না। যুদ্ধবাজ জেনারেলদের সবসময় চাই নতুন অস্ত্র যা প্রতিপক্ষ থেকে কয়েকধাপ এগিয়ে দেবে। এমনই এক বোমা তৈরির কথা ভাবছে সবাই, যেটা কি না গোটা একটি শহরকে জ্বালিয়ে দিবে। কাগজে-কলমে একেক দেশে একেক নাম থাকলেও গোপনে প্রায় সবাই তখন পারমাণবিক বোমা তৈরি চেষ্টায় লিপ্ত।
১৯৩৯ সালের এপ্রিলে নাৎসিরা তাদের পারমাণবিক প্রজেক্ট শুরু করে। কার্ট ডিবেনারের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন শীর্ষ বিজ্ঞানী এই কাজে যোগ দেন। এদের মধ্যে ছিলেন হাইজেনবার্গ, ওয়াল্টার বুথ, পল হার্টেক ও ক্লাউস ক্লুসিয়াস। Uranverein নাম দেয়া হয় এই প্রকল্পের, বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ইউরেনিয়াম ক্লাব।
নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের এক অপরিহার্য বস্তু ভারী পানি। দেখতে সাধারণ পানির মতো হলেও ভারী পানি সাধারণ পানি অপেক্ষা শতকরা ১১ ভাগ বেশি ঘন। ভারী পানি আণবিক চুল্লিতে দ্রতগামী নিউট্রনের গতি মন্থর করতে ব্যবহৃত হয়। জার্মানরা ভারী পানির উৎপাদনের উপায় খুঁজতে শুরু করলো। সাধারণত ৪১ মিলিয়ন পানির অনুতে ১ অনু ভারী পানি পাওয়া যায়।
দ্রুতই কপাল খোলে তাদের। তীব্র আক্রমণ এবং নরওয়ের প্রতিরক্ষমন্ত্রী কুইজলিংয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় নরওয়ে কবজা করেন হিটলার। নরওয়ের পুতুল সরকারের প্রধান করা হয় তাকে। প্রশাসনিকভাবেও নরওয়ের প্রত্যেকটি অঞ্চল চলে যায় নাৎসিদের হাতে। জুকান অঞ্চলের ভেমর্ক ভারী পানি উৎপাদন কারখানাও জার্মানদের আয়ত্বে চলে আসে। এই কেন্দ্রে পার্শ্ববর্তী বাঁধ থেকে পানি সংগ্রহ করা হতো। মূলত নাইট্রোজেন সারের অ্যামোনিয়া প্রস্তুত করার জন্য এখানে পানিকে তড়িৎবিশ্লেষণ করা হতো।
১৯৩৩ সালে দুজন রসায়নবিদ এই প্ল্যান্টটির নকশা করেন। ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি নাগাদ এই কেন্দ্রটি ১০০ গ্রাম ভারী পানি উৎপাদন করে। তখনকার সময়ে ভারী পানি উৎপাদন করতে পারা বিশ্বের বৃহত্তম প্ল্যান্ট ছিল সেটি।
জার্মানরা ভেমর্ক দখলে নেয়ার পর সকল কর্মীকে জোরপূর্বক কেন্দ্র চালু রাখতে বাধ্য করে এবং কেন্দ্রের সক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। ১৯৪১ সালের শেষ নাগাদ কেন্দ্রটিকে প্রতিদিন ৪ লিটার ভারী পানি উৎপাদনের পর্যায়ে নিয়ে যায়। নরওয়েজিয়ান গেরিলা মারফত ব্রিটিশ গোয়েন্দারা প্রথম এই বিষয়ে জানতে পারে। দুজন নকশাকারের একজন লিফ ট্রনস্তাডও ভয়াবহতা আঁচ করেন। গোপনে তিনি সুইডেন হয়ে পালিয়ে আসেন লন্ডনে। নড়েচড়ে বসে ব্রিটিশরা। নাৎসিদের থামানোর পরিকল্পনা শুরু হয়। স্থানীয়রাও গোপনে তথ্য দিচ্ছিল। কিন্তু ভেমর্ককে বলা হতো প্রাকৃতিক দুর্গ।
ঐ ঘাঁটিতে প্রবেশ করা যেতো একটিমাত্র ব্রিজ দিয়েই। ভূমি থেকে ৬০০ ফুট উঁচু এই ব্রিজটির নিচে গিরিখাদ। কড়া পাহারায় থাকা এই ব্রিজ দিয়ে প্রবেশ করতে গেলে রীতিমতো এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যেরও সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। শুধুমাত্র একদিকেই একটু কম নিরাপত্তা ছিল। কারণ সেদিকে আরেকটি পাহাড় খাড়াভাবে উঠে গেছে। ভারী অস্ত্র তো দূরে থাক, হালকা অস্ত্র নিয়েই সেদিকে যাওয়ার অর্থ একপ্রকার মৃত্যু।
পর্বতের কোল ঘেঁষে কারখানাটি এমন অবস্থানে রয়েছে যেখানে বিমান হামলা করেও খুব একটা লাভ হবে না। বিমান থেকে নির্ভুল অবস্থানে বোমা ফেলা বেশ দুঃসাধ্য বটে, তাছাড়াও ভূমিতে যথেষ্ট প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়া আছে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো, কোনোভাবে অ্যামোনিয়ার গুদামে বোমা পড়লে পুরো এলাকাই ছাই হয়ে যাবে। মারা যাবে নিরীহ লোকজন। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ভারী পানি আছে মাটির নিচের এক গুদামে, যেখানে বোমা পৌঁছানোর সম্ভাবনা খুব কম। বিমান হামলার পরিকল্পনা তাই বাদ দেয়া হলো। একমাত্র ভরসা কমান্ডোদের দিয়ে বোমা পেতে কারখানাটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া।
১৯৪২ সালের অক্টোবর মাস। ৩০ জন ব্রিটিশ কমান্ডোকে দুটি গ্লাইডারে ভেমর্ক অভিযানে পাঠানো হয়। কিন্তু শুরুতেই ঘটে বিপত্তি। একটি গ্লাইডার দুর্ঘটনায় পড়ে, আরেকটি ল্যান্ড করার স্থান থেকে অনেক দূরে চলে যায়। দুটি গ্লাইডারের সব কমান্ডো ধরা পড়েন। নির্মম মৃত্যু হয় তাদের। তবে আগে থেকেই মাটিতে থাকা আরেকটি দল জার্মানদের নজর এড়াতে সক্ষম হয়। তারা ঘাপটি মেরে নাৎসিদের পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল শুধু। ব্রিটিশরা এবার পরিকল্পনা বদল করে। ভাইকিংদের মাটিতে অপারেশনের জন্য বাছাই করা হয় ভাইকিংদের। ইওয়াখিম রনবার্গের নেতৃত্বে ৬ জনকে প্রস্তুত করা হয় এবার।
১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩; হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডার মধ্যে ৬ জন কমান্ডো বিমান থেকে প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপ দেয়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বরফের মধ্যে নেমে আসে তারা। নরওয়েজিয়ান কমান্ডোরা সবাই ব্রিটিশ সেনাদের পোশাক পরা ছিল। কারণ তারা ধরা পড়লে জার্মানরা স্থানীয়দের অত্যাচার করতো। ৫ দিন হাঁটার পর গানারসাইড দলটি পূর্বে অবস্থান করা শ্যালো দলের সাথে মিলিত হয়। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত অপারশনে নামে ৯ জন।
জার্মানদের ফাঁকি দিতে হাজার ফুট ঘুরে সেই উঁচু পাহাড়ে উঠে পড়ে ৯ জন। পাহাড়ের কিছু জায়গা এতটাই খাঁড়া ছিল যে, দড়ি বেঁধে ঝুলতে হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা। জার্মানরা ধারণাই করেনি এরকম খাঁড়া পাহাড়ে উঠে কেউ আবার নেমে আসবে। নিরাপত্তাও সেদিকে কম ছিল। “শান্তিপ্রিয়” নরওয়েজিয়ানরা যে পাল্টা আক্রমণ করতে পারে এটাও তাদের কল্পনাতীত ছিল।
দুটি প্লায়ার্স দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া কেটে প্ল্যান্টে প্রবেশ করে ৯ জন। রনবার্গ ক্যামব্রিজের বাজার থেকে সস্তায় প্লায়ার্স কিনেছিলেন, কারণ ব্রিটিশদের দেয়া করাতটা বেশ শব্দ করতো।
প্ল্যান্টে ঢুকে ৪ জনকে নিয়ে রনবার্গ রওনা দেয় ভূগর্ভস্থ গুদামের দিকে। বাকি ৫ জন কভার ফায়ারের দায়িত্বে থাকে। এককোনার একটি দরজা দিয়ে গুদামে ঢোকার সময়ই আসে প্রথম বাঁধা, দরজাটি বন্ধ। কিছুদূর ঘুরে আরেকটি টানেলের প্রবেশপথ পায় তারা। রনবার্গ ভেতরে ঢুকে পড়েন। কয়েক মুহূর্ত পরেই তিনি পিছনে ফিরে দেখেন, তার সাথে ফ্রেডরিক নামের শুধু একজন আছে। পথ হারিয়ে ফেলেছে বাকিরা। পরে জানলার কাঁচ ভেঙে ভেতরে আসে বাকি দুজন।
ভারী পানি যেখানে প্রস্তুত এবং সংরক্ষণ করা হতো, সেখানে বোমা পাতা শুরু হয়। ফিউজগুলো ২ মিনিট পরে বিস্ফোরণ হবার মতো করে ডিজাইন করা হয়। কিন্তু রনবার্গ ফিউজ ছোট করে কেটে ফেলেন, যাতে ৩০ সেকেন্ড পরে বিস্ফোরণ হয়। মিশন সফল হয়েছে কি না জানার জন্য বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাওয়া খুব জরুরি। আবার ২ মিনিট পরে বিস্ফোরিত হলে তারা অনেক দূর চলে যাবে, যেখান থেকে শব্দ না-ও পাওয়া যেতে পারে।
বোমা পাতা শেষ হলে বাইরে কভার দলের কাছে ফেরত যায় রনবার্গ। জার্মানদের চোখে ধুলা দিয়ে বের হয়ে আসে ৯ জন। দু’ভাগ হয়ে দুদিকে ছড়িয়ে পড়ে তারা। রনবার্গ তার দল নিয়ে হিমায়িত নদীর উপর স্কি করে এগিয়ে যায়। অন্যদিকে কভার দল যায় প্লেটাউ পর্বতের দিকে। ৩০ সেকেন্ড পরেই বিস্ফোরণ ঘটে। প্রশান্তির হাসি যেন চওড়া থেকে আরো চওড়া হয়ে উঠছে তখন। রনবার্গ তার দল নিয়ে ২০০ মাইল স্কি করে সুইডেন চলে যান। নাৎসিরা অনেক খোঁজাখুজি করেও কাউকে ধরতে পারেনি।
অপারেশন গানারসাইডে ভেমর্ক ভারী পানি উৎপাদন কারখানা ধ্বংস হয়ে যায়। কারখানাটি মেরামত করে আবার সচল করারও কোনো উপায় ছিল না। তবে এই অপারেশনে জার্মানদের সবথেকে বড় ক্ষতি ছিল, তারা ইতিমধ্যে তৈরি করা ৫০০ কেজি ভারী পানি হারায়। ১৯৪৩ সালের মে মাসে জার্মানরা ভেমর্ককে আবার কোনোরকম সচল করার চেষ্টা করে। কিন্তু নভেম্বর মাসেই আবার এই কারখানা হামলার শিকার হয়। ১৪০টি আমেরিকান বোমারু বিমান কারখানা লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করে। ভাগ্য এবার ভালো ছিল নাৎসিদের। কারণ, খুব কমসংখ্যক বোমাই জায়গামতো আঘাত হানতে পেরেছিল। কিন্তু জার্মানরা সিদ্ধান্ত নেয় এভাবে আর চালানো যাবে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে জার্মানরা পুরো পানি উৎপাদন প্ল্যান্ট এবং তৈরি করা কিছু ভারী পানি ফেরিতে চাপিয়ে জার্মানির দিকে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে। এবারও দুর্ভাগ্য জার্মানদের। খবর চাপা থাকে না। নরওয়ের কমান্ডো দল হামলা করে ডুবিয়ে দেয় ফেরিটি। ফেরির সাথে চিরকালের জন্য চাপা পড়ে হিটলারের পারমাণবিক বোমার স্বপ্নও।
২০১৮ সালের অক্টোবরে ৯৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ইওয়াখিম রনবার্গ। এই সফল অভিযানকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি সিনেমাও। হাতে সময় থাকলে দেখে ফেলতে পারেন The Heroes of Telemark এবং The Heavy Water War সিনেমা দুটো।
অপারেশন গানারসাইড সেই সময়ে ঘটা এক অপারেশন যখন বিশ্বের কেউই পারমাণবিক বোমার ধ্বংসলীলা দেখেনি। সেই দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা হয়তো নিজেরাই জানতেন না তাদের অপারেশনের গুরুত্ব। দেশমাতৃকা যখন ডাক দিয়েছে তখন গুরুত্ব বিচার করার সময়ই বা কোথায়! বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, জার্মানরা পারমাণবিক বোমা তৈরির ধারেকাছেও ছিল না, কিন্তু তারা পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জনের কাছাকাছি ছিল।
অপারেশন গানারসাইড হিটলারের পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জনের স্বপ্নকে স্তব্ধ করে দেয়। হয়তো হিরোশিমা-নাগাসাকির বদলে লন্ডন বা নিউ ইয়র্কও ধ্বংসস্তুপ হতে পারতো এই অভিযান সফল না হলে!