পোলিশ–বংশোদ্ভূত মার্কিন কূটনীতিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জবিগনিয়েভ ব্রেজিনস্কি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যবর্তী সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “ইউক্রেনকে ছাড়া রাশিয়া আর একটি সাম্রাজ্য থাকে না। ইউক্রেন অধীনস্থ ও অনুগত থাকলে রাশিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।”
২০০৩ সালে তদানীন্তন ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি লিওনিদ কুচমার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির শিরোনাম ছিল – “ইউক্রেন রাশিয়া নয়!”
ইউক্রেনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
ইউক্রেন পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। ইউক্রেনের উত্তরে বেলারুশ, উত্তর–পূর্ব, পূর্ব ও দক্ষিণ–পূর্বে রাশিয়া, দক্ষিণে রুমানিয়া, মলদোভা, কৃষ্ণসাগর ও আজভ সাগর এবং পশ্চিমে পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি অবস্থিত। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত আদমশুমারি অনুযায়ী, ইউক্রেনের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ কোটি ৮৪ লক্ষ। ২০০১ সালের পর ইউক্রেনে আর কোনো আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়নি, কিন্তু ২০২১ সালের হিসেব অনুযায়ী ইউক্রেনের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ১৩ লক্ষ। অর্থাৎ, ইউক্রেনের জনসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। তদুপরি, ২০১৪ সালে থেকে দক্ষিণ–পূর্ব ইউক্রেনে অবস্থিত দনবাস অঞ্চলের প্রায় ৩০.৫% ভূখণ্ড ইউক্রেনীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে এবং উক্ত ভূখণ্ডের জনসংখ্যা প্রায় ৩৮ লক্ষ। সুতরাং, বর্তমানে ইউক্রেনের প্রকৃত জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৭৫ লক্ষ।
২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ইউক্রেনের জনসংখ্যার প্রায় ৭৭.৮% ছিল জাতিগত ইউক্রেনীয়, প্রায় ১৭.৩% ছিল জাতিগত রুশ এবং অবশিষ্টরা অন্যান্য জাতিভুক্ত। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে প্রায় ১৫ লক্ষ জাতিগত রুশ ইউক্রেনের বাইরে চলে গেছে। তদুপরি, দনবাসের যে অংশ ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেই অংশে প্রায় আরো প্রায় ১৫ লক্ষ জাতিগত রুশ বসবাস করে। সেই হিসেবে বর্তমানে ইউক্রেন–কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যায় জাতিগত রুশদের শতকরা হার প্রায় ১৫% হিসেবে ধরা হয়। তদুপরি, ইউক্রেনের জাতিগত রুশদের পাশাপাশি জাতিগত ইউক্রেনীয়দের বড় একটি অংশ রুশভাষী, এবং কার্যত ইউক্রেনের জনসংখ্যার প্রায় এক–তৃতীয়াংশকে রুশভাষী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সামগ্রিকভাবে, ইউক্রেনকে চারটি ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয় – পূর্ব ইউক্রেন, দক্ষিণ ইউক্রেন, মধ্য ইউক্রেন এবং পশ্চিম ইউক্রেন। ইউক্রেনের বর্তমান ২৪টি প্রদেশের মধ্যে ৪টিকে (খারকিভ, দনিপ্রোপেত্রোভস্ক, দনেৎস্ক ও লুহানস্ক) পূর্ব ইউক্রেন, ৪টিকে (ওদেসা, খেরসন, জাপোরিঝিয়া ও মিকোলাইভ) দক্ষিণ ইউক্রেন, ৮টিকে (কিইভ, কিরোভোহরাদ, চেরকাসি, চের্নিহিভ, ঝিতোমির পলতাভা, সুমি ও ভিন্নিৎসিয়া) মধ্য ইউক্রেন এবং ৮টিকে (ইভানো–ফ্রাঙ্কিভস্ক, খেমেলনিৎস্কি, চের্নিভিৎসি, জাকারপাত্তিয়া, তেরনোপিল, ভোলিন, রিভনে ও লভিভ) পশ্চিম ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবশ্য রাজনৈতিকভাবে ইউক্রেনকে পূর্ব ইউক্রেন এবং পশ্চিম ইউক্রেন – এই দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের সম্পূর্ণ অংশ এবং মধ্য ইউক্রেনের অংশবিশেষকে পূর্ব ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, পশ্চিম ইউক্রেনের সম্পূর্ণ অংশ ও মধ্য ইউক্রেনের অবশিষ্টাংশকে পশ্চিম ইউক্রেন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ঐতিহাসিকভাবে, পূর্ব ইউক্রেনে জাতিগত রুশ ও রুশভাষীদের সংখ্যা পশ্চিম ইউক্রেনের তুলনায় বেশি, এবং পূর্ব ইউক্রেনের জাতিগত ইউক্রেনীয়দের মধ্যে রুশপন্থী মনোভাবের মাত্রা বেশি। অন্যদিকে, পশ্চিম ইউক্রেনে জাতিগত রুশ ও রুশভাষীদের সংখ্যা পূর্ব ইউক্রেনের তুলনায় কম, এবং পশ্চিম ইউক্রেনের জাতিগত ইউক্রেনীয়দের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ, রুশবিদ্বেষী মনোভাব ও পশ্চিমাপন্থী চিন্তাধারার আধিপত্য বেশি। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাশিয়ায় মোঙ্গল আক্রমণের সময় থেকে পশ্চিম ইউক্রেনের বৃহদাংশ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে উক্ত ভূখণ্ড আর রাশিয়ার কর্তৃত্বাধীনে আসেনি। এজন্য উক্ত ভূখণ্ডে জাতিগত স্বাতন্ত্র্যবোধের মাত্রা ইউক্রেনের বাকি অংশের তুলনায় বহুলাংশে তীব্র।
ইউক্রেনের ভূরাজনীতি: রুশ, ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি
রুশ দৃষ্টিকোণ থেকে, ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য সাংস্কৃতিক, জাতিগত, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক–কৌশলগত এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ড। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভকে রুশ সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ইউক্রেনের ভূখণ্ড ইতিহাসের প্রথম রুশ রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ইউক্রেনে বিপুল সংখ্যক জাতিগত রুশ বসবাস করে এবং জাতিগত ইউক্রেনীয়রা নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে জাতিগত রুশদের খুবই ঘনিষ্ঠ। রাশিয়ার পর ইউক্রেন বিশ্বের বৃহত্তম ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান–অধ্যুষিত রাষ্ট্র এবং ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা রুশ অর্থোডক্স চার্চের অধীনস্থ ছিল।
তদুপরি, ইউক্রেন ছিল রাশিয়ার ‘শস্যভাণ্ডার’ এবং সোভিয়েত আমলে ইউক্রেনে যে বিরাট মাত্রার শিল্পায়ন, বিদ্যুতায়ন, আধুনিকায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছিল, তার বড় একটি অংশের অর্থায়ন করা হয়েছিল রাশিয়ার সম্পদ ব্যবহার করে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের অর্থনীতি পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল। তাছাড়া, সোভিয়েত সামরিক শিল্পকারখানাগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইউক্রেনে নির্মিত হয়েছিল এবং রুশ সামরিক শিল্পের সঙ্গে ইউক্রেনীয় সামরিক শিল্পের সম্পূরক সম্পর্ক ছিল। শুধু তাই নয়, ইউক্রেন ছিল রাশিয়ার জন্য একটি ‘বাফার’ স্বরূপ, যেটি রুশ হৃদভূমিকে শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখত এবং রাশিয়ার ‘কৌশলগত গভীরতা’ বৃদ্ধি করত।
সর্বোপরি, রুশ রাষ্ট্রের ভৌগোলিক বিস্তারের সঙ্গে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ইউক্রেনের জনবল রুশ রাষ্ট্রের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ছিল এবং রুশ রাষ্ট্রের বিস্তারে ইউক্রেনীয়দের ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারে স্কটদের ভূমিকার অনুরূপ। কার্যত ১৬৫৪ সালে ইউক্রেনের রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার একটি ‘সাম্রাজ্য’ ও ‘বৃহৎ শক্তি’তে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, এবং ১৯৯১ সালে ইউক্রেনের সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ‘পরাশক্তি’ হিসেবে টিকে থাকার সামর্থ্যের বিলুপ্ত ঘটে (অবশ্য এক্ষেত্রে আরো নানাবিধ কারণ দায়ী ছিল)। এজন্য রাশিয়া বরাবরই ইউক্রেনকে নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে।
এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া সাধারণভাবে ইউক্রেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং সম্ভব হলে ইউক্রেনকে রুশ–নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক জোটগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করতে ইচ্ছুক। তদুপরি, রুশদের একাংশ ইউক্রেনকে, কিংবা অন্ততপক্ষে পূর্ব ইউক্রেনকে, পুনরায় রুশ রাষ্ট্রের সঙ্গে অঙ্গীভূত করতে ইচ্ছুক। কিন্তু রুশদের অপর অংশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ইউক্রেনকে রুশ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করতে ইচ্ছুক নয়, কারণ তাদের ধারণা, ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য একটি ‘অর্থনৈতিক বোঝা’য় পরিণত হবে।
অন্যদিকে, ইউক্রেনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল ও বহুমুখী। কার্যত রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, এই বিষয়ে স্বাধীন ইউক্রেন বরাবরই দ্বিধাবিভক্ত ছিল। ইউক্রেনীয়দের একাংশ রাশিয়া ও রুশদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, জাতিগত, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। অন্যদিকে, ইউক্রেনীয়দের আরেকটি অংশ (বিশেষত যাদের সঙ্গে রাশিয়া ও রুশদের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, জাতিগত ও ধর্মীয় সংযোগ দুর্বল) রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চায় এবং ইউরোপের বাকি অংশের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যেতে চায়। তদুপরি, ইউক্রেনীয়দের এই অংশের মধ্যে একটি উপদল রয়েছে, যারা কেবল পশ্চিমাপন্থীই নয়, বরং তীব্রভাবে রুশবিদ্বেষী এবং তারা রাশিয়া ও রুশদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল কিছুকেই ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেনীয়দের সিংহভাগ ইউক্রেনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বজায় রাখতে ইচ্ছুক, এবং এই ব্যাপারে মূলত পশ্চিম ও পূর্ব ইউক্রেনের জনমত প্রায় একই রকম ছিল। কিন্তু পূর্ব ইউক্রেনের জনমত রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার এবং মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ন্যাটো’ থেকে দূরে থাকার পক্ষপাতী ছিল। অন্যদিকে, পশ্চিম ইউক্রেনের জনমত পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে ইচ্ছুক এবং ইউক্রেনকে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী।
রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই তৃতীয় পক্ষ হিসেবে কাজ করেছে। বস্তুত ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান, এবং সময়ে সময়ে উভয় পক্ষ পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করলেও সাধারণভাবে তাদের সম্পর্ক ছিল শত্রুভাবাপন্ন। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমা বিশ্বের চিরন্তন লক্ষ্য হচ্ছে রাশিয়াকে যতদূর সম্ভব দুর্বল করে রাখা এবং সম্ভব হলে রুশ রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে ফেলা। বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে অতীতের পরিস্থিতির পার্থক্য হচ্ছে, অতীতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো (ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া ও সুইডেন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্স ও ব্রিটেন, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) রাশিয়াকে সরাসরি নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করতে আগ্রহী ছিল, আর বর্তমানে তারা রাশিয়াকে বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত করে ফেলতে আগ্রহী, যাতে করে সেগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করে মধ্য ইউরেশিয়ার বিস্তৃত সম্পদ হস্তগত করা সম্ভব হয়।
এজন্য পশ্চিমা (প্রধানত মার্কিন) দৃষ্টিকোণ থেকে, ইউক্রেনকে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে রাশিয়াকে দুর্বল করে রাখা সহজতর হবে। রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তবর্তী ৫টি রাষ্ট্র (নরওয়ে, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ড) ইতোমধ্যেই ন্যাটোর সদস্যে পরিণত হয়েছে, এবং ইউক্রেনও যদি ন্যাটোর সদস্যে পরিণত হয়, সেক্ষেত্রে রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তের সিংহভাগ জুড়ে ন্যাটোর উপস্থিতি থাকবে। সেক্ষেত্রে ন্যাটো রাশিয়ার দোরগোড়ায় নিজেদের কৌশলগত ভারী অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে এবং রাশিয়াকে সবসময় চাপের মুখে রাখতে পারবে। তদুপরি, রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে ন্যাটোর উপস্থিতি থাকার অর্থ হচ্ছে – পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে প্রভাব বলয় ছিল (এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যেটি যুক্তরাষ্ট্রের হস্তগত হয়েছে), রাশিয়া আর কখনো সেটি পুনরুদ্ধার করতে পারবে না এবং ইউরোপে মার্কিন আধিপত্য সুনিশ্চিত হবে। অর্থাৎ, পশ্চিমা বিশ্ব ব্রেজিনস্কির মতামতকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছে।
একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাশিয়া ও ইউক্রেন
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইউক্রেন রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্কের ব্যাপারে উপরে বর্ণিত দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। অবশ্য রাশিয়া ও ইউক্রেনে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্কেও গুণগত পরিবর্তন এসেছে। ১৯৯০–এর দশকে রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্কে বিভিন্ন জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়। কিন্তু একদিকে রুশ রাষ্ট্রপতি বোরিস ইয়েলৎসিনের (১৯৯১–১৯৯৯) বহুলাংশে পশ্চিমাপন্থী ও প্রায় বিশৃঙ্খল পররাষ্ট্রনীতি, এবং অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রথম দুই রাষ্ট্রপতি লিওনিদ ক্রাভচুক (১৯৯১–১৯৯৪) ও লিওনিদ কুচমা (১৯৯৪–২০০৫) কর্তৃক অনুসৃত তুলনামূলকভাবে সতর্ক ও মধ্যপন্থী পররাষ্ট্রনীতির কারণে এই সমস্যাগুলোর ফলে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে গুরুতর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়নি।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাশিয়া ও ইউক্রেনের শাসনক্ষমতায় পালাবদল ঘটে। ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর রুশ রাষ্ট্রপতি ইয়েলৎসিন আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন এবং তদানীন্তন রুশ প্রধানমন্ত্রী ও প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ভ্লাদিমির পুতিন ইয়েলৎসিনের স্থলাভিষিক্ত হন। পুতিন রাশিয়ার পশ্চিমাপন্থী নব্য অভিজাত শ্রেণির (oligarchs) রাজনৈতিক ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস করেন এবং তাদের পরিবর্তে রুশ সশস্ত্রবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের (যাদেরকে সাধারণভাবে ‘সিলোভিকি’ বা ‘силовики’ হিসেবে অভিহিত করা হয়) হাতে রাশিয়ার শাসনক্ষমতা চলে যায়। এদের সিংহভাগ (পুতিন–সহ) সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অংশ ছিলেন এবং তাদের সামরিক–রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সেভাবেই গড়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বিস্তৃত অর্থনৈতিক সংযোগে আবদ্ধ রুশ নব্য অভিজাতরা যেরকম পশ্চিমাপন্থী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতেন, রুশ সিলোভিকি সেরকম পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে আগ্রহী ছিল না।
পুতিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর রাশিয়া প্রাথমিকভাবে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু শীঘ্রই তাদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। এসময় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং রাশিয়ার বিপুল হাইড্রোকার্বন ভাণ্ডারকে কাজে লাগিয়ে পুতিনের নেতৃত্বাধীন রুশ সরকার রাশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়। এর ফলে রাশিয়ার পক্ষে নতুন করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রভাব বিস্তারে লিপ্ত হওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে।
এসময় ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ছিলেন লিওনিদ কুচমা এবং তার অধীনে ইউক্রেন রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে চলছিল। কুচমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তার সতর্ক পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল এবং তাকে ‘রুশপন্থী’ হিসেবে অভিযুক্ত করেছিল। কিন্তু বস্তুত কুচমার পররাষ্ট্রনীতি ছিল তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থী। স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার জন্য কুচমার অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি পছন্দনীয় ছিল না, কারণ কুচমা একদিকে যেমন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইউক্রেনকে পুরোপুরি অঙ্গীভূত করতে আগ্রহী ছিলেন না, অন্যদিকে তেমনি ইউক্রেনকে পুরোপুরি রাশিয়ার সঙ্গে অঙ্গীভূত করতেও আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু রাশিয়ার জন্য কুচমা ছিলেন ‘মন্দের ভালো’, কারণ কুচমা ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন এবং সম্ভাব্য ন্যাটোভুক্ত ও পশ্চিমাপন্থী ইউক্রেনের চেয়ে নিরপেক্ষ ও মধ্যপন্থী ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ ছিল।
২০০৪ সালের ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: ইউক্রেনে মার্কিন ‘রাজনৈতিক–মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে’র কৌশল
২০০৪ সালের অক্টোবরে ইউক্রেনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের প্রধান প্রার্থী ছিলেন দুইজন – ইউক্রেনের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ এবং ইউক্রেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ইয়ুশ্চেঙ্কো। ইয়ানুকোভিচ ছিলেন ‘অঞ্চলসমূহের দল’ বা ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’ (ইউক্রেনীয়: Партія регіонів) দলের সদস্য এবং উক্ত দলটি ছিল আঞ্চলিকতাবাদী, তুলনামূলকভাবে রুশপন্থী ও মধ্য বামপন্থী ধাঁচের। ইয়ানুকোভিচকে ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি কুচমা ও রাশিয়া সমর্থন দিচ্ছিল। অন্যদিকে, ইয়ুশ্চেঙ্কো ছিলেন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী, কিন্তু পশ্চিমাপন্থী ও লিবারেল ধাঁচের ‘আমাদের ইউক্রেন’ (ইউক্রেনীয়: Наша Україна, ‘নাশা উক্রায়না’) দলের নেতা। ইয়ুশ্চেঙ্কোকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমর্থন দিচ্ছিল। সরল ভাষায়, ২০০৪ সালের ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিল রুশ–পশ্চিমা প্রক্সি যুদ্ধেরই একটি অপেক্ষাকৃত ‘অহিংস’ সংস্করণ।
যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনে নিজেদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে (অর্থাৎ ইয়ুশ্চেঙ্কোকে) বিজয়ী করার জন্য ইউক্রেনে একটি গোপন কিন্তু বিস্তৃত ‘রাজনৈতিক–মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ পরিচালনা করে। এই ‘যুদ্ধে’র কৌশলসমূহের মধ্যে ছিল ছাত্র ও তরুণদের দিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করা, বিরোধী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং প্রচারমাধ্যমকে নিজেদের পছন্দনীয় প্রার্থীর পক্ষে সুকৌশলে ব্যবহার করা। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মার্কিন রাষ্ট্রীয় বৈদেশিক সহায়তা সংস্থা ‘ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট’, যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দল ‘রিপাবলিকান পার্টি’র ‘ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট’, তদানীন্তন বিরোধী দল ‘ডেমোক্রেটিক পার্টি’র ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট’, মার্কিন এনজিও ‘ফ্রিডম হাউজ’, মার্কিন ধনকুবের জর্জ সোরোসের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটিউট’ (বর্তমানে ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন্স’) এবং সর্বোপরি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মার্কিন অর্থায়নে ইউক্রেনে ‘পোরা!’ (ইউক্রেনীয়: Пора!) বা ‘এখনই সময়’ নামক একটি যুব সংগঠন স্থাপিত হয়। এই সংগঠনটি ইউক্রেন জুড়ে ১৫০টি গ্রুপ ও ৭২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন করে এবং অন্তত ৩০,০০০ ইউক্রেনীয় তরুণ–তরুণী এই সংগঠনের অংশ ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে, এই সংগঠনটির লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনে সরকারবিরোধী ‘অহিংস আন্দোলন’ গড়ে তোলা এবং ‘জাতীয় গণতন্ত্রে’র বিকাশ ঘটানো। কার্যত এই সংগঠনটি সৃষ্টির পশ্চাতে মার্কিনিদের উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এদেরকে ব্যবহার করা। মার্কিনিদের পরোক্ষ নির্দেশনায় এই গ্রুপগুলো ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। এর অংশ হিসেবে তারা বিভিন্ন ওয়েবসাইট খোলে এবং সেগুলোতে সরকারবিরোধী লেখালেখির মাধ্যমে ও সরকারকে ব্যঙ্গ করে জনসাধারণের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে দিতে থাকে।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইয়ুশ্চেঙ্কোর দল এবং ইউক্রেনের অন্যান্য বিরোধী দলকে ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়। এর ফলে ইয়ুশ্চেঙ্কোর ‘নাশা উক্রায়না’, ইউলিয়া তিমোশেঙ্কোর ‘ব্লক ইউলিয়া তিমোশেঙ্কো’ (ইউক্রেনীয়: Блок Юлії Тимошенко) এবং ওলেক্সান্দর মোরোজের ‘ইউক্রেনের সমাজতান্ত্রিক দল’ বা ‘সোৎসিয়ালিস্তিচনা পার্তিয়া উক্রায়নি’র (ইউক্রেনীয়: Соціалістична Партія України) সমন্বয়ে একটি সরকারবিরোধী জোট গঠিত হয় এবং উক্ত জোটটি নির্বাচনে ইয়ুশ্চেঙ্কোকে সমর্থন করে। তদুপরি, ইউক্রেনীয় উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলো এই নির্বাচনে ইয়ুশ্চেঙ্কোর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে।
তদুপরি, মার্কিন তত্ত্বাবধানে ইউক্রেনীয় সরকারবিরোধীরা ‘সমান্তরাল ভোট গণনা’র পদ্ধতি চালু করে। এই উদ্দেশ্যে ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট’ এবং ‘ফ্রিডম হাউজ’ ১,০০০–এর বেশি সংখ্যক ইউক্রেনীয়কে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ২০০৪ সালের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের পাশাপাশি মার্কিনিদের দ্বারা প্রশিক্ষিত উক্ত স্থানীয় পর্যবেক্ষকরাও নির্বাচনের স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণে অংশগ্রহণ করে। বাহ্যিকভাবে, এসব স্থানীয় পর্যবেক্ষকের লক্ষ্য ছিল নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কিনা সেটি পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু কার্যত এই পর্যবেক্ষকদের মোতায়েন করার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। এদের কাজ ছিল এরকম: যদি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত প্রার্থী (অর্থাৎ ইয়ুশ্চেঙ্কো) বিজয়ী হন, সেক্ষেত্রে নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে বলে ঘোষণা করা, আর যদি যুক্তরাষ্ট্রের অসমর্থিত প্রার্থী (অর্থাৎ ইয়ানুকোভিচ) বিজয়ী হন, সেক্ষেত্রে নির্বাচনে ‘অনিয়ম’ ও ‘কারচুপি’ হয়েছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করা।
সর্বোপরি, মার্কিন–প্রশিক্ষিত স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা ‘এক্সিট পোল’–এরও আয়োজন করে, অর্থাৎ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার আগেই ভোটারদের মতামতের ভিত্তিতে কোন প্রার্থী এগিয়ে রয়েছেন সেটি অনুমানের ব্যবস্থা করে। এই প্রক্রিয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল: আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগেই ইউক্রেনীয় জনসাধারণের মধ্যে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি করা যে, মার্কিন–সমর্থিত প্রার্থী ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। এটি ছিল একটি মনস্তাত্ত্বিক কৌশল, কারণ একজন প্রার্থী ভোটে এগিয়ে রয়েছেন, জনমনে এরকম একটি ধারণা সৃষ্টি হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক ফলাফলে যদি ভিন্ন কোনো প্রার্থী বিজয়ী ঘোষিত হয়, সেক্ষেত্রে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এই ধারণার সৃষ্টি হয় যে, কারচুপির মাধ্যমে তাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
এতকিছুর পরেও যদি ইয়ুশ্চেঙ্কো হেরে যান, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ছিল এরকম: এরকম পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধীদের সুদৃঢ়ভাবে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র গণবিক্ষোভের আয়োজন করতে হবে। শুধু তাই নয়, সরকারবিরোধী আন্দোলনের মাত্রা এতটা তীব্র করে তুলতে হবে, যাতে করে ইউক্রেনীয় সরকার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে আন্দোলনকারীদের প্রতি জনসাধারণের মধ্যে সহানুভূতির সৃষ্টি হবে এবং আন্দোলনের পরিধি ব্যাপক আকার ধারণ করবে। এই পরিস্থিতিতে নতি স্বীকার করা ছাড়া ইউক্রেনীয় সরকারের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা থাকবে না।
যুক্তরাষ্ট্র যে কেবল ইয়ুশ্চেঙ্কোর বিজয় নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিল, এমন নয়। এই প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও তারা সরবরাহ করেছিল। মার্কিন রাষ্ট্রপতির প্রেস সার্ভিসের তদানীন্তন প্রধান স্কট ম্যাকক্লেলানের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০০৪ সালে ইউক্রেনে ‘গণতন্ত্রের উন্নয়নে’র জন্য (অর্থাৎ মার্কিনপন্থী একটি সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য) প্রায় ৬ কোটি ৫০ লক্ষ (বা ৬৫ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার ব্যয় করেছিল। তদুপরি, ব্রিটেনভিত্তিক রুশ ধনকুবের বোরিস বেরেজোভস্কির ভাষ্যমতে, ‘কমলা বিপ্লবে’র অর্থায়নের জন্য তার মাধ্যমে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লক্ষ (বা ৪৫ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার সরবরাহ করা হয়েছে৷ উল্লেখ্য, ১৯৯০–এর দশকে রুশ সরকারের ওপর বেরেজোভস্কির ব্যাপক প্রভাব ছিল, কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থানের পর বেরেজোভস্কি তার প্রভাব হারান এবং রাশিয়া ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এর ফলে তিনি পুতিনের চরম শত্রুতে পরিণত হন এবং ‘কমলা বিপ্লবে’র তার অর্থায়নের পশ্চাতে এটি ছিল মূল কারণ।
ইউক্রেনে পরিচালিত উক্ত মার্কিন ‘রাজনৈতিক–মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত এরকম প্রথম গুপ্ত অভিযান ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন রাষ্ট্রে অনুরূপ অভিযান পরিচালনা করেছে। রাশিয়ায় পুতিনের উত্থানের পর (এবং ইউক্রেনের ২০০৪ সালের নির্বাচনের আগে) যুক্তরাষ্ট্র প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ায় ও জর্জিয়ায় অনুরূপ অভিযান পরিচালনা করে এবং সেখানকার রুশঘেঁষা সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করে। প্রচারমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত এই ধরনের অভিযানগুলো ‘রঙিন বিপ্লব’ (color revolution) নামে পরিচিতি লাভ করে।
নির্বাচন এবং ‘কমলা বিপ্লব’
২০০৪ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম দফায় ইয়ুশ্চেঙ্কো ৩৯.৯% এবং ইয়ানুকোভিচ ৩৯.২৬% ভোট লাভ করেন। কোনো প্রার্থীই ৫০% ভোট লাভ করেননি, এজন্য ইউক্রেনীয় সংবিধান অনুযায়ী ২১ নভেম্বর সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন শেষ হওয়ার আগেই মার্কিন–প্রশিক্ষিত স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের আয়োজিত ‘এক্সিট পোলে’র ভিত্তিতে দাবি করা হয় যে, ইয়ুশ্চেঙ্কো ইয়ানুকোভিচের চেয়ে ১১% ভোট বেশি পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা পর দেখা যায় যে, নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় ইয়ানুকোভিচ ৪৯.৪৬% এবং ইয়ুশ্চেঙ্কো ৪৬.৬১% ভোট লাভ করেছেন, অর্থাৎ ইয়ানুকোভিচ জয়ী হয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে এই নির্বাচনে ইউক্রেনীয় সমাজের বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই নির্বাচনের দুই দফাতেই পূর্ব ইউক্রেনের জনসাধারণের বৃহদাংশ ইয়ানুকোভিচের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, অন্যদিকে পশ্চিম ইউক্রেনের জনসাধারণের বৃহদাংশ ইয়ুশ্চেঙ্কোর পক্ষে ভোট দিয়েছিল।
কিন্তু নির্বাচনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রণীত কৌশল অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা আরম্ভ হয়ে যায়। ইয়ুশ্চেঙ্কো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং অভিযোগ করেন যে, ইয়ানুকোভিচ কারচুপির মাধ্যমে জয়লাভ করেছেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই রাজধানী কিয়েভ ও পশ্চিম ইউক্রেনে ইয়ুশ্চেঙ্কোর সমর্থকরা ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। এমনকি ইয়ুশ্চেঙ্কো ইউক্রেনীয় আইনসভায় কেবল তার দলীয় আইনসভা সদস্যদের উপস্থিতিতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
প্রকৃতপক্ষে ইয়ানুকোভিচের জয়লাভ কারচুপির মাধ্যমে হয়েছিল কিনা, সেটির নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী নব্য অভিজাত শ্রেণির (oligarch) বড় একটি অংশ ইয়ুশ্চেঙ্কোর পক্ষে ছিল এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম ইয়ুশ্চেঙ্কোর পক্ষে ও ইয়ানুকোভিচের বিপক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছিল। ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই রাজনৈতিক আন্দোলন ‘কমলা বিপ্লব’ (ইউক্রেনীয়: Помаранчева революція, ‘পোমারানচেভা রেভোলিউৎসিয়া’; ইংরেজি: Orange Revolution) নামে পরিচিতি লাভ করে, কারণ ইয়ুশ্চেঙ্কোর দলের নির্বাচনী রং ছিল কমলা।
মার্কিন–নিয়ন্ত্রিত ‘পোরা!’ সদস্যদের নেতৃত্বে ইয়ুশ্চেঙ্কোর সমর্থকরা তীব্র সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। কিয়েভসহ ইউক্রেনের বিভিন্ন স্থানে তারা বিভিন্ন সরকারি ভবন দখল বা ঘেরাও করতে শুরু করে। পশ্চিম ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি প্রদেশের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে এবং ইয়ুশ্চেঙ্কোর পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করে। অন্যদিকে, পূর্ব ইউক্রেনে ইয়ানুকোভিচের সমর্থকরা তার পক্ষে মিছিল বের করে। কিন্তু ইয়ানুকোভিচের সমর্থকদের তুলনায় ইয়ুশ্চেঙ্কোর সমর্থকরা অনেক বেশি উগ্রভাবে আন্দোলন পরিচালনা করে এবং এর ফলে ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা করা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুরু থেকেই এই সঙ্কটে ইয়ুশ্চেঙ্কোকে সমর্থন করে আসছিল। ‘ওএসসিই’র পর্যবেক্ষকরা দাবি করেন যে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উক্ত নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার হুমকি দেয়। ইউক্রেনীয় সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেন থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠায়। এমনকি তদানীন্তন মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন ও হিলারি ক্লিনটন ইয়ুশ্চেঙ্কোকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদানের আহ্বান জানিয়ে নরউইজীয় নোবেল কমিটিকে চিঠি প্রেরণ করেন, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
অন্যদিকে, ‘সিআইএস’ পর্যবেক্ষকরা দাবি করেন যে, নির্বাচন সাধারণভাবে স্বচ্ছভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সিআইএসভুক্ত রাশিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান প্রভৃতি রাষ্ট্র ইয়ানুকোভিচকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। এমতাবস্থায় ইউক্রেনীয় সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, রাশিয়া আন্দোলন দমনের জন্য ইউক্রেনে সৈন্য মোতায়েন করবে। কিন্তু ইউক্রেনীয় সরকার ও রাশিয়া দ্রুত এই দাবিকে নাকচ করে। রাশিয়া ইয়ানুকোভিচের পক্ষে ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সুপরিকল্পিতভাবে ইউক্রেনে সরকারবিরোধী আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল, ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে সেরকমভাবে হস্তক্ষেপ করার মতো সামর্থ্য রাশিয়ার ছিল না। এজন্য এই সঙ্কটের প্রতি রুশ সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল অপেক্ষাকৃত মৃদু। কিন্তু রাশিয়ার অভ্যন্তরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও প্রচারমাধ্যম ইউক্রেনে মার্কিন–সৃষ্ট সঙ্কটের কঠোর সমালোচনা করে এবং রাশিয়ার বৃহত্তম বিরোধী দল ‘রুশ ফেডারেশন কমিউনিস্ট পার্টি’র মহাসচিব গেন্নাদি জুগানভ ইউক্রেন সফরের পর ইউক্রেনের এই ‘বিপ্লবে’র জন্য সরাসরি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেন।
কিন্তু ইউক্রেনীয় সরকার রক্তপাতে আগ্রহী ছিল না এবং এজন্য তারা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া থেকে বিরত ছিল। এর ফলে সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ইয়ুশ্চেঙ্কোর সমর্থকদের তীব্র আন্দোলন ও পশ্চিমা বিশ্বের তীব্র চাপের মুখে ইউক্রেনীয় সরকার শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসে। তারা ২০০৪ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করে এবং ডিসেম্বরে পুনরায় নির্বাচনের আয়োজন করে। তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন ও প্রচারণার ফলে এসময় জনমতের পাল্লা সরকারবিরোধীদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। ফলশ্রুতিতে এই নির্বাচনে ইয়ুশ্চেঙ্কো ৫১.৯৯% এবং ইয়ানুকোভিচ ৪৪.২% ভোট লাভ করেন, অর্থাৎ ইয়ুশ্চেঙ্কো জয়যুক্ত হন। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ইয়ুশ্চেঙ্কো ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
নতুন ইউক্রেনীয় সরকার দাবি করেছিল যে, ইয়ানুকোভিচ যে নির্বাচনে কারচুপি করেছেন এই ব্যাপারে তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে এবং এর ভিত্তিতে তারা পূর্ববর্তী ইউক্রেনীয় সরকারের কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কাউকেই বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। অর্থাৎ, হয় নতুন ইউক্রেনীয় সরকারের কাছে বাতিলকৃত নির্বাচনে কারচুপির বিষয়ে কোনো প্রমাণ ছিল না, নয়তো তারা অভিযুক্তদের সঙ্গে গোপনে কোনো সমঝোতায় পৌঁছেছিল।
পরিশিষ্ট
ইয়ুশ্চেঙ্কোর অধীনে নতুন ইউক্রেনীয় সরকার তীব্র রুশবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইয়ুশ্চেঙ্কো ইউক্রেনকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রচেষ্টা চালান, রুশ ভাষাকে ইউক্রেনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, ক্রিমিয়ায় অবস্থিত রুশ নৌঘাঁটির ইজারার মেয়াদ বর্ধিত করার বিরুদ্ধে মত দেন, ইউক্রেনে সোভিয়েত শাসনের তীব্র সমালোচনা করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব ইউক্রেনীয় জার্মানদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল তাদেরকে গৌরবান্বিত করেন। কিন্তু ২০০৮ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট ইউক্রেনে আঘাত হানে এবং ইউক্রেনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে ওঠে। তদুপরি, ‘কমলা বিপ্লবে’র সময়কার ইয়ুশ্চেঙ্কোর রাজনৈতিক মিত্র ও ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া তিমোশেঙ্কোর মধ্যে তীব্র ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে ইয়ুশ্চেঙ্কোর জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে ইউক্রেনে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ইয়ুশ্চেঙ্কো শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং ইয়ানুকোভিচ বিজয়ী হয়ে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু ২০১৩–১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ইউক্রেনে নতুন একটি বিপ্লব/অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেন একটি প্রলম্বিত রাজনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত হয়, যেটি এখন পর্যন্ত চলমান রয়েছে।