১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা বেজে ১০ মিনিট। দিনটি ছিল রবিবার। মার্কিন সেনামণ্ডলীর অধ্যক্ষ জর্জ মার্শাল একটি জরুরি বার্তা পাঠালেন পার্ল হারবারে অবস্থিত সামরিক ঘাঁটিতে। সেই জরুরি বার্তায় তিনি জানিয়েছিলেন যে, জাপানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা ভেঙে গিয়েছে। তাই পার্ল হারবার যেন সামরিক দিক থেকে সর্তক থাকে। সেদিন খারাপ সিগন্যাল থাকার জন্য মার্শাল তার এই জরুরি বার্তাটি আর্মি রেডিও মারফত পাঠাতে সমর্থ হননি। বার্তাটি পাঠানো হয়েছিল কমার্শিয়াল চ্যানেল মারফত হনুলুলুর সামরিক ঘাঁটিতে।
এর ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে সকাল সাড়ে ৬টার কিছু পরে পার্ল হার্বার নৌ-ঘাঁটির অদূরে পাহারারত এক মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ছোট্ট একটি জাপানী সাবমেরিনকে ডুবিয়ে দেয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মার্কিন ডেস্ট্রয়ারে থাকা নাবিকদের কেউই কল্পনাই করতে পারেনি আসন্ন কোনো আক্রমণের কথা।
এর কিছু পরেই হনলুলুতে স্থাপিত একটি রাডারে অনেকগুলো বিমানের ছায়া ভেসে আসতে লাগলো। রাডারে ধরা পড়া এই দৃশ্য তৎক্ষণাৎ তথ্যকেন্দ্রের অফিসার লেফটেনেন্ট কারমিট টেইলারকে জানিয়ে দেওয়া হলো। টেইলার মনে করলেন, বিমানগুলো মার্কিন বোমারু বিমান ‘বি-১৭’ হবে। কারণ তার কাছে তথ্য ছিল যে, মার্কিন বোমারু বিমানগুলো ক্যালিফোর্নিয়া থেকে হাওয়াই দ্বীপের উত্তর পূর্বদিকে আসার কথা ছিল।
বলাই বাহুল্য, তথ্যকেন্দ্রের অফিসারের এই মারাত্মক ভুলের কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ১৮৯টি জাপানী বোমারু বিমান প্রায় নিঃশব্দে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করলো।
কোথায় অবস্থিত এই পার্ল হার্বার?
উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নৌ-ঘাঁটি এই পার্ল হার্বার। ১৯০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নৌ-ঘাঁটি স্থাপন করে। পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ক্যালিফোর্নিয়া থেকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হার্বার এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নৌ-ঘাঁটি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। প্রশান্ত মহাসাগরের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ছিল এটি। সামরিক কৌশলগত দিক দিয়েও এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক এলাকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ২,০০০ মাইল এবং জাপান থেকে প্রায় ৪,০০০ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল পার্ল হার্বারের মূল নৌ-ঘাঁটিটি।
এই মার্কিন নৌ-ঘাঁটিতে ছিল ৯৪টি যুদ্ধ সহায়ক জাহাজ, যার মধ্যে ৯টি ব্যাটলশিপ, ৮টি ক্রুজার, ২৯টি ডেস্ট্রয়ার, ৫টি ডুবোজাহাজ, ৮টি মাইন প্ল্যান্টার ও ১০টি মাইন সুইপার। পাল হার্বারের বিমান বাহিনীতে ছিল ৩৯৪টি যুদ্ধ বিমান আর বিমান বিরোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ছিল ২৯৪টি বিমান বিধ্বংসী কামান। ফলে তখন থেকেই এটি জাপান সাম্রাজ্যের জন্য এক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নৌ-ঘাঁটিটি দুর্গবেষ্টিত ছিল। তা এতই সুরক্ষিত ছিল যে, দুর্গের অভ্যন্তরে যুদ্ধজাহাজের বন্দুকের গুলি, বোমাবর্ষণেও ৪০ সে.মি. প্রস্থের স্থাপনকৃত দেয়াল ভেদ করা ছিল এককথায় অসম্ভব। সেখানে কোনো পতিত জমি না রাখায় প্রতিপক্ষের নৌবাহিনীর গোলাবর্ষণ করে সাফল্য লাভ করাও ছিল অসম্ভবের মতোই।
পার্ল হার্বার আক্রমণের নৈপথ্যে
- জাপানীদের এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-বহরের মূল শক্তিসমূহ বিধ্বস্ত করে দেওয়া।
- প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
- দক্ষিণ সমুদ্রসমূহের বিভিন্ন অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ অভিযানে সাফল্য নিশ্চিত করা।
- জাপানের দখলকৃত ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ এবং মালয়ে প্যাসিফিক অঞ্চলগুলোকে মার্কিন হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখা।
- আক্রমণের মধ্য দিয়ে জাপানের সামরিক অবস্থানকে আরো দৃঢ় করা এবং তার নৌ-শক্তি বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত সময় নেওয়া।
- এই আক্রমণের মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ আমেরিকানদের নৈতিক মনোবল চূর্ণ করা।
কার পরিকল্পনায় ঘটল এই আক্রমণ?
‘ইম্পেরিয়াল জাপানিজ নেভি’র প্রধান সেনাপতি এডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতো স্বয়ং এই পার্ল হারবার আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯০৪ সালে তিনি জাপান নেভাল একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েট হন। ১৯২৬ সাল থেকে তিনি ওয়াশিংটনে জাপানের রাষ্ট্রদূতের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ১৯৪১ সালে জাপানের যৌথবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন।
তবে শুরুতে ইয়ামামোতো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জাপানের যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক দ্বন্দ্বে জাপানের অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে ভেবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী টোজো হিদেকি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিতে আগ্রহী হন। ইয়ামামোতো প্রধানমন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে আচমকা আক্রমণ পরিচালনা করলে জাপানের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে বলে মত দেন। এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিজেদের অধিকারে আসবে বলেও তিনি প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চয়তা দেন।
পার্ল হার্বার আক্রমণ
১৯৪১ সালের ২৬ নভেম্বর। জাপানী বিমানবাহী জাহাজগুলোর একটি ইউনিট আক্রমণের জন্য রওনা হলো। এই ইউনিটে ছিল ৬টি বিমানবাহী জাহাজ। এই জাহাজগুলোর অধীনে ছিল ৩৫৩টি বিমান। এছাড়াও ছিল ২টি ব্যাটলশিপ, ৩টি ক্রুজার, ১১টি ডেস্ট্রয়ার ও ৩টি ডুবো জাহাজ। কুরিল দ্বীপপুঞ্জ পাড়ি দিয়ে ৭ ডিসেম্বর সকালের দিকে পার্ল হারবার থেকে ৩৬০ কিলোমিটার উত্তরে পৌঁছে যায় সেই ইউনিটটি। সকাল সাড়ে আটটার দিকে প্রথম জাপানী বোমারু বিমান থেকে পার্ল হারবারের নৌঘাঁটি লক্ষ্য করে একের পর এক টর্পেডো নিক্ষিপ্ত হতে লাগলো। সঙ্গে চললো প্রচণ্ড বোমা হামলা ও উপর্যুপরি মেশিনগানে গুলিবর্ষণ। ধ্বংস হতে থাকে একের পর এক পার্ল হার্বার ঘাঁটিতে থাকা যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমানসহ যুদ্ধে ব্যবহৃত নানা সমরাস্ত্র।
এই অতর্কিত আক্রমণে মার্কিন প্রশাসন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়ে যে, এই আক্রমণের কোনো তাৎক্ষণিক প্রত্যুত্তর দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। জাপান থেকে প্রায় ৪,০০০ মাইল দূরে অবস্থিত আমেরিকার সবচেয়ে বড় নৌ-ঘাঁটি পার্ল হার্বারের ওপর এ ধরনের আক্রমণ হতে পারে, তা যেন ছিল তাদের কল্পনার বাইরে। তার উপর ডিসেম্বরের সেদিনটি ছিল রবিবার, সরকারী ছুটি। ফলে দ্বীপে অবস্থানরত সামরিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্থানীয় বাসিন্দারা সকলেই ছিলেন ছুটির মেজাজে। তাই এই আক্রমণে স্বাভাবিকভাবেই সকলেই হতচকিত হয়ে পড়ে।
এই আক্রমণে ক্ষতিও তাই নেহাত কম নয়। এই আক্রমণে অধিকাংশ যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়ে সমুদ্রে ডুবে যায়। অকেজো হয়ে যায় ৯টি মার্কিন ব্যাটলশিপের মধ্যে ৮টি, ৬টি ক্রুজার, ১টি ডেস্ট্রয়ার এবং অনেকগুলো ছোট ছোট জাহাজ। বিধ্বস্ত হয় ২৭২টি মার্কিন বিমান।
এই আক্রমণে প্রায় আড়াই হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হয়, আহত হয় আরো এক হাজারেরও অধিক। হতাহতের মধ্যে মার্কিন সৈন্যরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল হাওয়াই দ্বীপুঞ্জের বেসামরিক জনগণও। সকাল দশটার মধ্যেই জাপান এই আক্রমণ শেষ করে ফিরে আসে নিজের গন্তব্যে। যুদ্ধে জাপানের তেমন উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না হলেও ৬০টির মতো জাপানী বিমান ধ্বংস হয়েছিল বলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর দেওয়া এক তথ্য হতে জানা যায়।
আক্রমণ পরবর্তী ঘটনা
পার্ল হার্বার আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা পর জাপানের সম্রাট হিরোহিতো আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৮ ডিসেম্বর ১৯৪১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট কংগ্রেসের উভয় পরিষদের সম্মিলিত বৈঠকে একটি বক্তব্য দেন।
সেদিনের প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের সভা থেকে জাপানের বিরুদ্ধে সর্বসম্মতিক্রমে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর কিছু পরেই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র যুক্তরাজ্যও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে রচিত হয় রক্তপাতে পরিপূর্ণ ইতিহাসের আরেকটি যুদ্ধময় অধ্যায়।
তথ্যসূত্র
১. বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়; জাপানী যুদ্ধের ডায়েরি
২. বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইতিহাস; পৃষ্ঠা নং- ৪৮৭- ৫০১
৩. বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইতিহাস; পৃষ্ঠা নং- ৪৬৯- ৪৮০
ফিচার ইমেজ: Wikipedia