দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরোদস্তুর উন্নত সামরিক শক্তি হয়ে ওঠেনি। তবে সরকারের প্রবল আগ্রহে দেশজোড়া তখন সামরিক বিদ্যার অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। স্তালিন বেশ বুঝতে পেরেছিলেন সমাজতন্ত্র বিস্তার করতে হলে পশ্চিম ইউরোপের সমর যন্ত্রের মুখোমুখি একদিন না একদিন হতেই হবে। একটা বিষয়ে কেবল তিনি ভুল করেছিলেন। সেটা হচ্ছে হিটলারের মতলব।
দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মলোটভ আর রিবেনট্রপ এক অনাক্রমণ চুক্তি করে বসলেন ১৯৩৯ এর আগস্টে। জার্মানরা পোল্যান্ড আক্রমণ করার কিছুদিনের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বড় এক টুকরো পোলিশ জমি বাগিয়ে নিল। আচমকা হিটলারের জার্মানি শুরু করলো অপারেশন বারবারোসা। বিস্তীর্ণ সোভিয়েত দেশ জুড়ে জার্মানরা এগুতে থাকলো। গুড়িয়ে গেল সমস্ত প্রতিরোধ। তবে লাল ফৌজ এক সময় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ালো। তাদের জয়যাত্রা গিয়ে থামলো সোজা বার্লিনে, রাইখস্ট্যাগের ছাদে কাস্তে হাতুড়ি খচিত লাল পতাকা ওড়াবার মাধ্যমে।
এর মাঝের সময়টাতে কত মানুষ মরলো, কত দালান গুড়িয়ে গেল, কত মাঠ শস্যশূন্য হল, কত বনভূমি পুড়ে খাক হল সে হিসেবে আমরা যাব না। কত বীর যে এই মহাযুদ্ধের মাধ্যমে খ্যাতির শীর্ষে উঠলো, কত নেতা যে নিজেদের আখের গোছালো সেই হিসেবও পরে হবে। আজকের লেখা সোভিয়েত সমরযন্ত্রদের অন্যতম এক বিশিষ্ট সদস্যকে নিয়ে। সেটি হল ইলিউশিন ইল-২ ওরফে ইলিউশা ওরফে উড়ন্ত ট্যাংক ওরফে উড়ন্ত সৈন্য ওরফে স্তরমোভিক (আক্ষরিক রুশীতে এর অর্থ তুফান পাখি)। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো যুদ্ধবিমান এত বিপুল পরিমাণে তৈরি হয়নি। সোভিয়েতদের যুদ্ধে জেতার পেছনে অন্যতম নিয়ামক ছিল এই যুদ্ধবিমান।
সোভিয়েত বিমান শিল্প ও ইলিউশন
ইউরোপ আমেরিকার সাথে পাল্লা দিয়েই জারের আমল থেকে রাশিয়ায় বিমান শিল্প নিয়ে কাজ করা শুরু হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় রাশিয়া বেশ কিছু ছোটখাট যুদ্ধবিমান নির্মানে সক্ষম হলেও পরবর্তী বলশেভিক বিপ্লব এবং গৃহযুদ্ধের ডামাডোলে যুদ্ধবিমান আর কেউ বানাতো না।
স্তালিন তিরিশের দশকে বিমান শিল্পকে আবার গড়ে তোলেন। সোভিয়েত নেতারা বিশ্বাস করতেন যে মুক্তবাজার অর্থনীতির তীব্র প্রতিযোগিতা শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। সামরিক নেতারা বিমান বাহিনীর কর্তাদের কাছ থেকে শুনে নিতেন কী ধরনের বিমান তাদের প্রয়োজন। তারপরে সেই সব চাহিদা অনুসারে অনেকগুলি ডিজাইন ফার্ম আলাদা আলাদাভাবে কাজ করতো। পরে এই সমস্ত ডিজাইনের তুলনামূলক বিচার শেষে একটা ডিজাইন বেছে নিয়ে সেই অনুযায়ী বিমান বানানো হত।
সের্গেই ভ্লাদিমিরোভিচ ইলিউশিনের জন্ম সোভিয়েত ইউনিয়নের কোন এক অজপাড়াগাঁয়ে। পরে নানা ঘাটের জল খেয়ে শেষমেষ তিনি প্রথম মহাযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধ থামলে জড়িয়ে পড়েন বলশেভিকদের সাথে। ছোটবেলা থেকেই বিমানের প্রতি ঝোঁক ছিল। যুদ্ধ যেন সেই ঝোঁক মেটাবার দুয়ারটা খুলে দিল। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অধ্যয়ন করলেন বিমানবিদ্যা। পরে সোভিয়েত সরকারের ডিজাইন ব্যুরোগুলোতে নানা পদে চাকরি করে শেষমেষ তিনি নিজেই একটা ডিজাইন ব্যুরোর প্রধান হয়ে বসেন। ইলিউশিন ওকেবি নামের এই ডিজাইন ব্যুরো দেশকে পরবর্তীতে অনেক বিখ্যাত যুদ্ধবিমান আর বেসামরিক বিমান উপহার দিয়েছে। তবে তাদের সেরা সৃষ্টি ছিল সম্ভবত ইলিউশিন ইল-২।
স্তরমোভিকের খুটিনাটি
১৯৩৮ সালে ইলিউশিন ডিজাইন ব্যুরো ইলিউশিন ইল-২ ডিজাইন করে। এর প্রথম প্রটোটাইপটি ১৯৩৯ সালে সরকারি প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ হিসেবে মনোনীত হলে সোভিয়েত ফ্যাক্টরিগুলি এই বিমান নির্মাণ শুরু করে দেয়। তবে গতি ছিল খুবই ধীর। ১৯৪১ এর জুনে যখন জার্মান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে, তখন সোভিয়েত বিমানবাহিনীর হাতে মাত্র আড়াইশটি ইল-২ ছিল।
ইলিউশিন ইল-২ হচ্ছে ৩৮ ফুট লম্বা, একক প্রপেলার চালিত যুদ্ধবিমান। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নিচু উচ্চতা দিয়ে উড়তে উড়তে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা, শত্রু লাইনে বোমাবর্ষণ এবং প্রয়োজনে ছোটখাট বিমান যুদ্ধে লড়া। আকাশ যুদ্ধের জন্য ইল-২ খুব একটা উপযুক্ত ছিল না। উড়ন্ত অবস্থায় বিমানটির ওজন দাঁড়াতো প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোগ্রাম। ঘন্টায় মাত্র আড়াইশো মাইল বেগে উড়তো এই বিমানটি যা সেই সময়ের দ্রুতগতির যুদ্ধবিমানগুলো থেকে অনেক কম। ওজন কমানোর জন্য পরে অনেক ইল-২ তে গানারের সিটটা খুলে ফেলা হত।
ইল-২ তে সাধারণত দুজন বসবার ব্যবস্থা থাকতো। ককপিটের সামনে পাইলট, পেছনে উল্টোদিকে একজন গানার। গানারের কাজ ছিল তার ১২.৭ মিমি মেশিনগান দিয়ে বিমানের পেছন দিকটার সুরক্ষা দেওয়া। পাইলটের মূল অস্ত্র ছিল দুই ডানার দুটি ২৩ মিলিমিটার মেশিনগান। প্রায় ৬০০ কেজি বোমার পাশাপাশি বিমানটি নিতে পারতো ৪টি আরএস-১৩২ রকেট অথবা ৮টি আরএস-৮২ রকেট। ইল-২ এর বৈশিষ্ট্য ছিল এর পুরু ইস্পাতের তৈরি দেহাবরণ। একইসাথে বিমানের ফ্রেম এবং গোলাগুলি প্রতিরোধী বর্ম হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছিল গোটা ইস্পাতের চাদরটিকে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং স্তরমোভিক
জার্মানরা আক্রমণ করবার সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত এমন মাত্র ৭০টি ইল-২ ছিল গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নে। আর যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি ছিল মাত্র ২০টি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইল-২ এর অভিষেক হয় ১৯৪১ সালের ২৭ জুনে। সেদিন পাঁচটি ইল-২ একদল জার্মান ট্যাংককে ধ্বংস করে দেয়।
জার্মান সেনারা এই জাঁকালো এবং ভারী যুদ্ধবিমানটিকে কংক্রিটের বিমান বলে ডাকতো। পুরু বর্মের জন্য সাধারণ মেশিনগান কিংবা ২০ এমএম কামান দিয়েও এই বিমানের কোনো ক্ষতি করা যেত না। নিচু দিয়ে গম্ভীর গর্জন করতে করতে অসংখ্য ইল-২ একটানা বোমাবর্ষণ করে যেত। বিমানটি খুব একটা নিখুঁতভাবে বোমা ফেলতে পারতো না। আর ভারী বর্মের কারণে বোমা বহনের ক্ষমতাও এর কম ছিল। পুষিয়ে নেবার জন্য সোভিয়েত কর্তারা অনেকগুলো ইল-২ একত্রে যুদ্ধের ময়দানে ছাড়তেন। এর ফলে একক বিমান হামলায় এর যে অদক্ষতা ছিল, সেটা অনেকটা ঢাকা পড়ে যেত। ১৯৪৩ এর কুর্স্ক যুদ্ধের সময় জার্মানির নবম পাঞ্জার ডিভিশনের ৭০টি ট্যাংক ইল-২ আক্রমণে মাত্র ২০ মিনিটে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া স্থলের সেনাদের ওপরে এমন ধ্বংসাত্মক আক্রমণের মানসিক প্রভাবও হত দীর্ঘস্থায়ী। সোভিয়েত পাইলটেরা মাত্র ৩০০ ফুট উচ্চতায় নেমে এসে কার্পেট বোম্বিং করতেন। কয়েকশত যুদ্ধবিমান একত্রে এই কাজ করলে কী মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হত অনুমান করাই কঠিন। স্তালিনগ্রাদ বা কুর্স্ক এর মত বড় যুদ্ধগুলোতে ইল-২ সোভিয়েতদের বিজয়ে দারুণ সাহায্য করেছে।
ইল-২ এর যে কোনো দুর্বলতা ছিল না এমন নয়। ধীর গতির কথা তো আগেই বলা হয়েছে। আকাশযুদ্ধে জার্মান মেসারস্মিট-১০৯ এবং ফোক উলফ-১৯০ এর কাছে ইল-২ কোনো পাত্তাই পেত না। কিন্তু জার্মান বোমারু বিমান, বিশেষ করে বহুল ব্যবহৃত ইয়ুংকার-৫২ কিংবা হেইনেকেল-১১১ এর বিরুদ্ধে এদের সাফল্য দেখার মত। তবে যুদ্ধে প্রচুর ইল-২ ধ্বংস হত প্রতিপক্ষের ফাইটার বিমান কিংবা মাটি থেকে ছোড়া শক্তিশালী বিমান বিধ্বংসী কামানের গোলার আঘাতে।
দুর্বলতা থাকলেও সোভিয়েত সেনাবাহিনীর হাতে ইল-২ এর কদর ছিল দেখবার মতো। মোট ৩৬ হাজার ইলিউশন ইল-২ তৈরি হয়েছে যুদ্ধের আগে ও পরে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, মঙ্গোলিয়া, যুগোস্লাভিয়া এবং বুলগেরিয়াও এই বিমান ব্যবহার করেছে। টি-৩৪ ট্যাংক কিংবা কাতিউশা রকেট লঞ্চারের মতো ইউলিশান ইল-২ ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত সমর শক্তির সেরা নিদর্শনের মর্যাদা পেয়েছে। জোসেফ স্তালিনের ভাষ্যমতে, লাল ফৌজের জন্য ইল-২ বিমান পানি আর রুটির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। মাসে একটা সময় গড়ে ৩০০ করে ইল-২ বানানো হত। বিমানবাহিনীর ৩০ শতাংশ বিমানই ছিল ইল-২।
স্তরমোভিকের কল্যাণে নাম কামিয়েছেন বহু সোভিয়েত পাইলট। লেফটেন্যান্ট আন্না ইয়োগোরেভা ২৪৩টি মিশনে উড়েছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল নেলসন স্তেপান ২৩৯টা মিশনে ডুবিয়েছেন ৫৩টি জাহাজ, ৮০টি ট্যাংক, ৬০০ সাজোয়া যান আর ২৭টি যুদ্ধবিমান। অবশ্য যুদ্ধের সময়ের তথ্যসূত্রগুলো সর্বদাই একটু ঘোলাটে থাকে। কিন্তু ইল-২ যে যুদ্ধবিমান হিসেবে খুবই সফল তা বলার অপেক্ষা থাকে না। এরই আরেকটা ভার্সন ইল-১০ যুদ্ধের শেষদিকে জাপানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। সোভিয়েত সাহিত্যেও উঠে এসেছে এই বিমানের কথা। বিখ্যাত উপন্যাস ‘মানুষের মতো মানুষ’ এর মূল চরিত্র আলেক্সেই মারিসিয়েভকে বর্ণনা করা হয়েছে একজন ইলিউশন-২ পাইলট হিসেবে।
ফিচার ইমেজ – youtube