মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পরেও বেঁচে গিয়েছিলেন যারা

পৃথিবীতে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান কাকে বলবেন? যিনি গুপ্তধনের খোঁজ পান বা কোনো লাখ টাকার লটারি জেতেন, তাকে? নাকি যিনি ভাগ্যক্রমে কোনো বড় পদে আসীন হন তাকে? এদেরকে যদি সৌভাগ্যবান ভাবেন, তাহলে যারা নিজের মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া সত্ত্বেও বেঁচে যান তাদেরকে কী বলে অভিহিত করবেন? যা-ই বলুন না কেন, চলুন আজ এমন কিছু ব্যক্তির সম্পর্কেই জানা যাক।

১. অ্যান গ্রিন

১৬৫০ সালের দিকটা যে মোটেও নারীদের জন্য খুব একটা সুসময় ছিল না, তা অ্যান গ্রিনের ঘটনা থেকে বোঝা যায়। তিনি ছিলেন একটি ইংরেজ পরিবারের গৃহ পরিচারিকা। যে বাসায় কাজ করতেন সে বাসার মালিকের নাতি কর্তৃক তিনি গর্ভবতী হন। কিন্তু তার বাচ্চাটি মারা যায়। মারা গেলে তিনি বাচ্চাটি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন, কিন্তু ধরা পড়ে যান। শিশু হত্যার দায়ে তাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

অ্যানের ঘটনার কার্টুনচিত্র; Source: davidkiddhewitt.files.wordpress.com

তাকে সময়মত ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়। ফাঁসি কার্যকর করার পর তাকে নিচে নামিয়ে আনা হলে তৎকালীন ডাক্তাররা যখন তাকে পরীক্ষা করলেন, তারা দেখলেন তখনও তার নাড়ির স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে! তারা তৎক্ষণাৎ সবরকমের চেষ্টা শুরু করলেন অ্যানকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য। একসময় তারা তামাক পাতার ধোঁয়া তার নাকে দিলেন এবং এতেই অ্যান চেতনা ফিরে পেলেন। তারপর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। তার এই মৃত্যু থেকে ফিরে আসার ঘটনায় অভিভূত হয়ে সবাই ভাবলো, অ্যান নিশ্চিতভাবে ঈশ্বরের চোখে নির্দোষ! তাই তারাও তাকে ক্ষমা করে দেন। অ্যান পরবর্তীতে বিয়ে করেন এবং নিজ স্বামী ও বাচ্চাদের নিয়ে থিতুও হন। তিনি তার জন্য প্রস্তুতকৃত কফিনটাকে নিজের স্মারক হিসেবে সংগ্রহও করে রেখেছিলেন!

২. জোলায়খা কাদখোদা

১৯৯৭ সালের ১১ আগস্ট, ইরানের ২০ বছর বয়সী জোলায়খাকে ব্যাভিচারের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পাথর নিক্ষেপ করে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার ফয়সালা হয়।

এরপর মাটিতে গর্ত করে তার দেহের অর্ধেকটা ভরাট করে দেওয়া হয়। তারপর গ্রামবাসী তার দিকে পাথর নিক্ষেপ শুরু করে। একসময় তাকে মৃত মনে করে গ্রামবাসীরা পাথর নিক্ষেপ বন্ধ করে দেয়। যখন তার দেহটাকে গর্ত থেকে তোলা হয়, দেখা যায় জোলায়খা তখনও বেঁচে আছেন এবং নিশ্বাস নিচ্ছেন! দ্রুত তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। চিকিৎসার মাধ্যমে একসময় তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। পরের বছর তাকে তৎকালীন প্রশাসন থেকে রাজক্ষমাও দিয়ে দেওয়া হয়।

৩. ওয়েনসেসলাও মোগুয়েল

মেক্সিকান বিপ্লবে মোগুয়েলের ভূমিকা থাকার দরুন কোনো বিচার ছাড়াই তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তার মৃত্যুদণ্ড আবার যেমন-তেমনভাবে কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়নি, পুরো একটি ফায়ারিং স্কোয়াডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার জন্য!

মোগুয়েল তার ক্ষতস্থান দেখাচ্ছেন; Source: tantannews.com

পরপর ৯টি গুলি করা হয় তাকে! যার একটি আবার খুব কাছে থেকে তার মাথায় করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তিনি এত গুলি খাওয়া সত্ত্বেও বেঁচে ছিলেন। এমনকি সে জায়গা থেকে পালিয়েও গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট-এ কাছ থেকে গুলি করার ফলে তার মুখের সৃষ্ট বিকৃতিরূপও দেখিয়েছিলেন।

৪. রমেল ব্রুম

২০০৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রমেল ব্রুমকে ১৪ বছর বয়সী ট্রিনা মিডলটনকে অপহরণ, ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। প্রাণঘাতী ইনজেকশনের মাধ্যমে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার হুকুম দেওয়া হয়।

রমেল ব্রুম দেখাচ্ছেন তার ইনজেকশন দেওয়া জায়গাগুলো; Source: mage.posta.com.mx

নির্দিষ্ট দিনে তাকে বেঁধে ফেলা হয় শক্তভাবে। তারপর কর্মরত জল্লাদেরা তাকে ইনজেকশন দেওয়ার কাজে নেমে পড়েন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তারা ব্রুমের শিরাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারা সর্বমোট ১৮ বার ইনজেকশন ফুটিয়েছেন ব্রুমের শরীরে, কিন্তু ব্যবহারযোগ্য কোনো শিরা খুঁজে পাননি। পুরো দু’ঘণ্টা ধরে তারা একই কাজ করে গেছেন। অবশেষে ইনজেকশন দেওয়ার ফলে সৃষ্ট প্রচণ্ড ব্যথায় ব্রুমের চিৎকার এবং কান্নায় তারা তাদের মৃত্যুদণ্ডের কার্যক্রম থামিয়ে দিতে বাধ্য হন। বর্তমানে ব্রুম আপিলের জন্য অপেক্ষা করছেন।

৫. জোসেফ স্যামুয়েল

ইংল্যান্ডে এক নারীর বাসায় ডাকাতি করার অপরাধে জোসেফ স্যামুয়েলকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, শুধু ডাকাতি করার জন্য মৃত্যুদণ্ডাদেশ কেন দেওয়া হলো? এ যেন লঘু পাপে গুরুদণ্ড! আসলে ডাকাতি করার সময় তারা একজন পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে ফেলেছিল, যার পেছনে জোসেফেরও হাত ছিল বলে ধরা হয়। যদিও জোসেফ বলেছিল, সেই পুলিশ হত্যায় তার কোনো ভূমিকাই ছিল না।

ফাঁসিকাষ্ঠ; Source: crimefeed.com

কিন্তু অবিশ্বাস্য যে ব্যাপারটি ঘটেছিল, তা হলো জোসেফ একবার-দু’বার নয়; মোট তিনবার তার ফাঁসির কার্যক্রম থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন! প্রথমবার ফাঁসির দড়ি ছিঁড়ে গিয়েছিল এবং জোসেফ মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার পুনরায় তাকে মঞ্চে তোলা হয় এবং আরেকটি দড়ি তার গলায় পরানো হয়। কিন্তু এবার দড়িটির প্যাঁচ আপনাআপনি খুলে যায় এবং তার পা মঞ্চ স্পর্শ করে। এসব দেখে উপস্থিত জনতা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে, তারা দাবি করে, জোসেফ নির্দোষ বলেই ঈশ্বরের ইচ্ছায় এমন হচ্ছে। জনতার এমন প্রতিবাদ দেখে উপস্থিত জল্লাদেরা দ্রুত আবার জোসেফের গলায় দড়ি পরায়। কিন্তু এবারও দড়িটা ছিঁড়ে যায়। এই অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ্য করে এবং জনতার রোষানল থেকে বাঁচতে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ স্থগিত করে দেওয়া হয়।

৬. ম্যাগি ডিকিনসন

অ্যান গ্রিনের মতো ম্যাগির বিরুদ্ধেও নিজের বাচ্চা সন্তানকে হত্যার অভিযোগ আসে। একজন দোকানদারের সাথে সম্পর্কের ফলে তিনি গর্ভবতী হয়েছিলেন। কোনোভাবে এই ঘটনা তিনি লুকিয়ে রাখতেও সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু অকালজাত বাচ্চাটি জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যায়। এরপর তিনি প্রথমে চেষ্টা করেছিলেন বাচ্চাটিকে নদীর পানিতে ছুঁড়ে মারার। কিন্তু সে কাজে ব্যর্থ হবার পর বাচ্চাটিকে নদীর পাড়ে রেখেই চলে আসেন। কিন্তু তৎকালীন প্রশাসন বাচ্চাটির খোঁজ পায় এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে ম্যাগিকে ধরে ফেলে। জনগণের সামনে তাকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ফাঁসিও দেওয়া হয়।

ম্যাগি ডিকিনসনের নামে সরাইখানা; Source: Wikimedia Commons

ফাঁসির কাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার আধাঘণ্টা পর তার লাশ একটি কফিনে করে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘটে যায় এক অদ্ভুত ঘটনা! কফিনে করে সমাধিক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার সময় ম্যাগি জেগে উঠেন এবং ভেতর থেকে কফিনে আঘাত করা শুরু করেন। উপস্থিত সকলে কফিনের ভেতরে সেই ধুপধাপ আওয়াজ শুনতে পায়। পরবর্তীতে তার এই ঘটনাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে মেনে নিয়ে তাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। ম্যাগি ডিকিনসনের এই ঘটনা এখনো কিংবদন্তী হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। তিনি ‘Half-Hangit Maggie‘ নামেও বেশ কয়েক জায়গায় প্রচলিত রয়েছেন। এমনকি তার নামে এডিনবরায় একটি সরাইখানাও রয়েছে।

৭. উইলি ফ্রান্সিস

ইতিহাসে উইলি ফ্রান্সিসের বিচার একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়। কারণ, ১৯৪৬ সালে ১৬ বছর বয়সী ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে সেইন্ট মার্টিনভিল, লুইজিয়ানার এক ঔষধের দোকানদার এন্ড্রু থমাসকে হত্যা করার অভিযোগ আসে, যা ছিল পুরোই বানোয়াট। পুলিশ উইলিকে সেই হত্যাকাণ্ডের ১৫০ মাইল দূর থেকে আটক করে। ফ্রান্সিস ছিল এক কৃষ্ণাঙ্গ গরিব পরিবারের ত্রয়োদশ সন্তান। আসলে সেদিন সে একটি স্যুটকেস হাতে বোনের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছিলো। একজন কৃষ্ণাঙ্গ ছেলের হাতে স্যুটকেস দেখে পুলিশ তাকে সন্দেহ করে এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। ফ্রান্সিস ছিল তোতলা এবং তার তোতলানো দেখে পুলিশ সন্দেহ করে- নিশ্চিত ফ্রান্সিস কিছু লুকোচ্ছে। পুলিশ তাকে একপ্রকার অন্যায়ভাবে চেপে ধরে এবং শাসানো শুরু করে। তার মুখ থেকে জোরপূর্বক এন্ড্রু থমাসকে হত্যার স্বীকারোক্তি বের করে। কিশোর ফ্রান্সিস না বুঝে, পুলিশের ভয়ে তাদের কথামতো পোর্ট আর্থারে অর্থাৎ যে জায়গায় সে কেবল পৌঁছেছিল সেখানে এক ব্যক্তিকে মারধর এবং ডাকাতি করার কথাও স্বীকার করে। ফলে তাকে বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়।

উইলি ফ্রান্সিস; Source: Wikimedia Commons

উইলি ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে আনা এই মিথ্যা অভিযোগ হয়তো ঈশ্বরও সহ্য করতে পারেননি। তাই তাকে যখন বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসানো হয় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য, তখন প্রথমবার সেটি ঠিকমতো কাজ করেনি। চেয়ারটিতে ত্রুটি থাকায় সুইচ চালু করার পর উপস্থিত ব্যক্তিরা শুনতে পায় ফ্রান্সিসের চিৎকার, “সরিয়ে ফেলো, এগুলো সরিয়ে ফেলো! আমাকে নিঃশ্বাস নিতে দাও, আমি মারা যাচ্ছি না!” তার মৃত্যুদণ্ডের কার্যক্রম তখন স্থগিত করে দেওয়া হয় এবং ফ্রান্সিস আপিল জানায় তার রায়ের বিরুদ্ধে। তবুও এর এক বছর পরেই তাকে আবার বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসানো হয় এবং তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

ফ্রান্সিসের পিতা এতটাই দরিদ্র ছিলেন যে, তিনি ভালো উকিলেরও ব্যবস্থা করতে পারেননি ফ্রান্সিসের জন্য। কোনোমতে যে উকিল ঠিক করেছিলেন, তার ফি স্বরূপ তিনি প্রথমে তার বাসায় কাজও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই উকিল সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলো। পরে তিনি নিজের ফলানো শাকসবজি ফি হিসেবে দিয়েছিলেন উকিলকে। উইলি ফ্রান্সিস দণ্ডাদেশ পেয়ে একবার বেঁচে গেলেও, তখনকার সমাজে উপেক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ পিতা তার নির্দোষ ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি।

ফিচার ইমেজ: br.rfi.fr

Related Articles

Exit mobile version