রাশিয়ান অ্যাডভেঞ্চার শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হবার পর নেপোলিয়নের মনে জার্মান রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে প্রুশিয়ার বিশ্বস্ততা নিয়ে সন্দেহ বৃদ্ধি পায়। তার জানা ছিল স্টেইনসহ আরো অনেক প্রুশিয়ান কর্মকর্তা আলেক্সান্ডারের দলে যোগ দিয়েছেন। তবে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম এবং হার্ডেনবার্গ তখন পর্যন্ত সরাসরি ফ্রান্সের সাথে সংঘাতে যেতে চাচ্ছিলেন না। বার্লিন থেকে ফ্রেঞ্চ রাষ্ট্রদূত অঁজারু নিজে নেপোলিয়নকে আশ্বস্ত করলেন, প্রুশিয়া এখনো তার সাথেই আছে। নেপোলিয়নের গ্র্যান্ড আর্মি রাশিয়াতে ধ্বংস হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার হাতে যে পরিমাণ সেনা এখনো মজুদ আছে তা দিয়ে তিনি প্রুশিয়াকে দু-তিনবার থেঁতলে দিতে পারেন। তবে প্রুশিয়ান জনগণ থেকে শুরু করে তরুণ সেনা অফিসাররা আনন্দে ভাসছে। তাদের ধারণা, নেপোলিয়নের সময় শেষ হয়ে এলো বলে।
সীমান্তে রাশিয়ান সেনাদল
রাশিয়ানদের অগ্রবর্তী বাহিনী ফরাসিদের পিছু ধাওয়া করে যখন প্রুশিয়ান সীমান্তে এসে উপস্থিত হলো তখন ১৮১২ সালের ডিসেম্বর। ২০ তারিখে পূর্ব প্রুশিয়ার সীমান্তের ঠিক বাইরে জেনারেল দিবিৎশের (Diebitsch) অধীনস্থ রেজিমেন্ট অবস্থান নেয়। তাদের সামনে প্রুশিয়ান জেনারেল ডি ইয়র্ক। রাশিয়া অভিযান তিনিও বাধ্য হন নেপোলিয়নের সঙ্গী হতে। সেখান থেকে নিজের ১৪,০০০ সেনা নিয়ে অতিকষ্টে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। ঊর্ধ্বতন ফরাসি মার্শাল ম্যাকডোনাল্ড তাকে আদেশ করলেন রাশিয়ানদের যেভাবেই হোক ঠেকিয়ে রাখতে, ইত্যবসরে তিনি নিজ বাহিনী নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবেন।
এদিকে রাশিয়ান কম্যান্ড থেকে ইয়র্কের কাছে অনুরোধের পর অনুরোধ আসতে লাগল। তাদের কথা- প্রুশিয়ার সাথে রাশিয়ার কোনো শত্রুতা নেই। দিবিৎশের লক্ষ্যবস্তু ফরাসি সেনাদল। কাজেই তাদের নির্বিঘ্নে যেতে দেয়া হোক। দিবিৎশ ইয়র্ককে এমনকি রাশানদের সাথে যোগ দিতেও বার্তা দিলেন। ক্রিসমাসের দিন দুই জেনারেল বৈঠকে বসেন। এরপর দিবিৎশ তার সাথে থাকা প্রাক্তন প্রুশিয়ান জেনারেল কাউসোভিতজকে দায়িত্ব দেন ইয়র্কের সাথে কথাবার্তা চূড়ান্ত করতে।
ইয়র্ক ভুগছিলেন ভীষণ দ্বিধায়। একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে তার চাওয়া ছিল ফরাসিদের পরাজয়, কিন্তু সেই দেশপ্রেম তাকে শিখিয়েছিল রাজার প্রতি শর্তহীন আনুগত্য। ফ্রেডেরিক উইলিয়াম তখন পর্যন্ত নেপোলিয়নের সাথে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ, তাই ম্যাকডোনাল্ডের আদেশ অমান্য মানে রাজারই বিরুদ্ধাচরণ। কিন্তু কাউসোভিতজ তাকে বোঝালেন রাশানদের বিশাল বাহিনী এগিয়ে আসছে। ইয়র্ক যদি ম্যাকডোনাল্ডের আদেশ পালন করতে চান তা হবে আত্মহত্যারই নামান্তর। ৩০ তারিখে প্রুশিয়ার সীমান্ত থেকে ৪০ কিলোমিটার পূর্বে, বর্তমান লিথুয়ানিয়ার শহর টাউরোজেনের নিকটে ইয়র্ক দিবিৎশকে জানালেন তিনি দুই মাসের জন্য নিষ্ক্রিয় থাকবেন এবং এই সময় রাশিয়ানরা কোনো বাধা ছাড়াই প্রুশিয়ার ভেতরে চলাচল করতে পারবে (Convention of Tauroggen)।
সাদা চোখে ইয়র্কের এই কান্ড দেশদ্রোহিতার সমপর্যায়ে পড়ে। ফ্রেডেরিক উইলিয়ামও রাগে অস্থির হয়ে গেলেন। তিনি সূক্ষ্মভাবে সবদিকে ভারসাম্য বজায় রেখে চলছিলেন, এখন ইয়র্ক তাকে বিপদজনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। ১৮১৩ সালের ৩ জানুয়ারি পাঠানো চিঠিতে ইয়র্ক তার কাজের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ফরাসিদেরকে প্রুশিয়ার আসল শত্রু বলে চিহ্নিত করেন। তার বক্তব্য ছিল খুব স্পষ্ট, রাজা তার কাজকে অনুমোদন দিলে দেবেন, না হয় যেকোনো শাস্তি তিনি মাথা পেতে নিতে রাজি আছেন।
ফ্রেডেরিক অবিলম্বে ইয়র্ককে গ্রেফতারের আদেশ জারি করেন। জেনারেল ক্লেইস্টকে সেখানে গিয়ে সেনাদের কমান্ড নিয়ে রাশিয়ান বাহিনীকে বাধা দেবার জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু দিবিৎশ ততদিনে পূর্ব প্রুশিয়াতে জাঁকিয়ে বসেছেন। রাজার নির্দেশ পালন করতে হলে সেই আদেশের কপি তো ইয়র্কের কাছে যেতে হবে, দিবিৎশ সংবাদ বহনকারীকে কিছুতেই ইয়র্ক পর্যন্ত যেতে দিলেন না। ফলে ফ্রেডেরিকের আদেশ রয়ে গেল কাগজে-কলমেই।পরে তিনি ষষ্ঠ কোয়ালিশনে যোগ দিলে ইয়র্ককে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা করে দেয়া হয়।
এদিকে একই সময় ফ্রান্সের সাথে মিত্রতা শক্তিশালী করার জন্য ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের নির্দেশে হার্ডেনবার্গ একটি পরিকল্পনা ফরাসি রাষ্ট্রদূতের কাছে পেশ করেন। এতে প্রুশিয়ার রাজপুত্রের সাথে নেপোলিয়নের পরিবারের কোনো রাজকন্যার বিয়ের প্রস্তাব করা হয়। শুধু তা-ই নয়, ১২ জানুয়ারি, ১৮১৩ সালে রাজা ফরাসি মন্ত্রী ডিউক অফ বাসানোকে লেখেন যদি ফ্রান্স অর্থ সহায়তা দেয় তাহলে তিনি নেপোলিয়নের স্বপক্ষে ৫০,০০০-৬০,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী জমায়েত করতে পারেন।
প্রুশিয়ান স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা
ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের শত চেষ্টা সত্ত্বেও ফরাসিরা তার ব্যাপারে কখনোই নিঃসন্দেহ ছিল না। ফলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ফরাসি সেনারা প্রুশিয়ার রাজাকে গ্রেফতার করতে যাচ্ছে। ফলে ১৮১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি ফ্রেডেরিক উইলিয়াম হার্ডেনবার্গ এবং আরো সত্তরজনের মতো সঙ্গী নিয়ে পটসড্যাম ছেড়ে সিলিসিয়ার ব্রেস্লাউতে চলে আসেন।
এদিকে ফ্রেব্রুয়ারির মধ্যেই পূর্ব প্রুশিয়াতে রাশিয়ানরা শক্ত অবস্থানে চলে যায়। সেখানে প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখাশোনা করতে জার পাঠালেন ব্যারন স্টেইনকে। ৫ তারিখে কনিগসবার্গে প্রাদেশিক সরকারি কর্মকর্তাদের এক সভা আহবান করলেন তিনি। সেখানে ইয়র্ক উপস্থিত হয়ে ফরাসিদের বিরুদ্ধে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করবার প্রতিজ্ঞা করেন। অবিলম্বে ২০,০০০ ল্যান্ডওয়াহ (landwehr/স্থানীয় মিলিশিয়া) এবং আরো কমপক্ষে দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবী একত্রিত করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক সকলকে অস্ত্র ধরতে নির্দেশ জারি হলো। মার্চের ৪ তারিখে রাশিয়ান কোস্যাক বাহিনী বার্লিনে প্রবেশ করে, ১১ তারিখে সেখানে রাশিয়ানদের হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয়।
ফ্রেডেরিক পড়েছেন উভয় সংকটে। পূর্ব প্রুশিয়া আক্ষরিকভাবে রাশিয়ানদের হাতে, পশ্চিমে ফরাসিরা বসে আছে যেকোনো উস্কানি পেলেই তাদের উপর হামলে পড়ার জন্য। ফ্রেডেরিক যদি ফ্রান্সের পক্ষ ত্যাগ করেন তার মানে তাকে সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে, অতীতে যা ভাল ফল বয়ে আনেনি।তবে রাজার কর্মকান্ড ইঙ্গিত করে তিনি কোন দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।
শ্যানহর্স্টকে পুনরায় ডেকে পাঠানো হলো। প্রত্যেক সক্ষম পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক সেবার আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু জনতা চাইছিল প্রকাশ্যে রাশিয়ার সাথে মৈত্রী। রাজার অন্যতম উপদেষ্টা অ্যানসিলন ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে সতর্ক করলেন যে গদি বাঁচাতে হলে তাকে অবশ্যই অবিলম্বে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে হবে। পারিপার্শ্বিক চাপে ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান পোল্যান্ডের অন্তর্গত কালিশ আর ব্রেস্লাউতে ফ্রেডেরিক রাশিয়ানদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। রচিত হলো ষষ্ঠ কোয়ালিশনের ভিত্তি, যা শেষ পর্যন্ত নেপোলিয়নের পতন ডেকে আনবে। ইতোমধ্যেই রাশিয়ার জোটে ছিল ইংল্যান্ড আর সুইডেন। ইংল্যান্ড তো গত প্রায় আট বছর ধরে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ চালিয়েই যাচ্ছে। সুইডেনের ক্রাউন প্রিন্স প্রাক্তন ফ্রেঞ্চ মার্শাল বার্নাডোট বিরক্ত ছিলেন পোমেরানিয়ার সুইডিশ অংশে ফরাসি উপস্থিতিতে, সাথে উপরি হিসেবে তিনি বাগিয়ে নিতে চান নরওয়ে। তিনিও ৩ মার্চ তার প্রাক্তন কমান্ডারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
রাশিয়ানদের সাথে চুক্তির শর্ত মোতাবেক প্রুশিয়া ১৮০৬ সালের পূর্বে তার সীমান্ত ফিরে পাবে বলে স্থির হয়। কিন্তু তারা সিলিসিয়া এবং পূর্ব প্রুশিয়ার মধ্যে সংযুক্তকারী একখন্ড জমি ছাড়া দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পোলিশ পার্টিশন থেকে প্রাপ্ত সকল এলাকা রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দেবে। বিনিময়ে জার্মানিতে ভবিষ্যতে দখলকৃত ভূখন্ড পাবেন ফ্রেডেরিক। তবে তার মূল চাওয়া একটাই- স্যাক্সোনি।
যুদ্ধ প্রস্তুতি
১৭ মার্চ, ১৮১৩।
আনুষ্ঠানিকভাবে নেপোলিয়নের পক্ষ ত্যাগ করে রাশিয়ানদের সমর্থন করবার কথা জানিয়ে দিলেন ফ্রেডেরিক। ২৫ মার্চ কালিশে’র ঘোষণায় (Proclamation of Kalisch) ফ্রেডেরিক এবং আলেক্সান্ডার একীভূত জার্মানির পক্ষে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে কাজে লাগানোর কথা বলেন। শ্যানহর্স্ট রাশান কম্যান্ডারদের সাথে রণ পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। স্টেইন দায়িত্ব নিলেন জার্মান ভূখন্ড থেকে সেনা সংগ্রহের এবং ভবিষ্যৎ দক্ষিণ এবং পশ্চিম জার্মানির প্রশাসনিক কাঠামো নির্ধারণের। রাজার নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে যেসব অঞ্চল অনেকটা খেয়াল খুশিমতো চলছিল তাদের উপর শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। ১৭ মার্চ এক আবেগঘন ভাষণে রাজা দেশবাসীকে দখলদার ফরাসিদের মোকাবেলা করতে আহবান জানালেন। জনসমর্থন নিজের দিকে টেনে নিতে প্রতিশ্রুতি দিলেন ফরাসিদের তাড়িয়ে দিয়ে তিনি প্রুশিয়ান নাগরিকদের জন্য সাম্যবাদি একটি সংবিধান প্রবর্তন করবেন।
ব্রেস্লাউ হয়ে ওঠে সমস্তকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। প্রাসাদের অনতিদূরে সেপ্টা (Szepter) হোটেল ছিল স্বেচ্ছাসেবীদের নাম লেখানোর জায়গা, যা পরিচালনা করছিলেন মেজর লুটজঁ। লুটজঁ এককালে মেজর শ্যের সাথে কাজ করেছেন। তার এই স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী পরিচিত হয়েছিল ব্ল্যাক ব্যান্ড নামে, যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩,০০০। ২১ এপ্রিল ল্যান্ডস্ট্রাম (Landsturm) নামে আরেকটি মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। পুরোদমে চারিদিকে প্রশিক্ষণ আর কর্মযজ্ঞ চলতে থাকে। বিশেষ একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী হিসেবে ফ্রি কর্পস অফ লুতয প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন নামে এক বিখ্যাত শরীরচর্চা বিশারদ। তিনি ও তার দলের অনেকেই এই কর্পসে যোগ দিয়েছিলেন।
ফরাসি বাহিনী
“যদি তুমি সবকিছুই দখলে রাখতে চাও,” ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট একবার বলেছিলেন, “তাহলে নিশ্চিত থাক যে তুমি সবকিছুই খোয়াবে”। নেপোলিয়ন এই সাবধানবাণী কানে তুললে ভাল করতেন। রাশিয়াতে এত বড় বিপর্যয়ের পরেও তার হাতে ছিল অনেক সেনা। আইবেরিয়ান পেনিনসুলাতে লাখের উপরে ফরাসি সৈন্য, জার্মানিতে আরো দেড় লাখ। ফ্রান্সের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল আরো কয়েক লাখ। বুদ্ধিমানের কাজ হত স্পেন ত্যাগ করে সমস্ত সেনা এক জায়গায় নিয়ে এসে শত্রুদের উপর মরণ আঘাত হানা।
কিন্তু নেপোলিয়নের অগাধ বিশ্বাস ছিল অস্ট্রিয়ার উপর, যার সম্রাটের কন্যাকে তিনি ১৮১০ সালে বিয়ে করেছেন। তিনি ভেবেছিলেন কন্যার স্বার্থে অস্ট্রিয়ান সম্রাট কখনোই তার বিরুদ্ধদলে যোগ দেবেন না, বরং প্রয়োজনে নেপোলিয়নকে সেনা দিয়ে সহায়তা করবেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন দেশের স্বার্থ বৈবাহিক সম্পর্কের কাছে কিছুই না। তবে কনফেডারশন অফ রাইন ফ্রান্সের সাথে মিত্রতা বজায় রাখল। নেপোলিয়ন স্পেন থেকে ফিরিয়ে আনলেন মাত্র ৩০,০০০ সেনা। এদিক সেদিক মিলিয়ে মোট সাড়ে তিন লাখের এক বাহিনী তিনি দাঁড়া করান, কিন্তু এরা বেশিরভাগই অনভিজ্ঞ।
লুটযেন আর বাতযেনের লড়াই
নেপোলিয়নের প্রথমে ইচ্ছা ছিল পোল্যান্ডের ভিস্তুলা নদী বরাবর ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি জার্মানিতে নিজেকে সুরক্ষিত করবার ফয়সালা করলেন। স্যাক্সনির লাইপজিগের কাছে এপ্রিল মাসের মধ্যে প্রায় দুই লাখ সেনা নিয়ে তিনি হাজির হন। এদিকে প্রুশিয়ান সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে আসেন ব্লুশা, রাশানদের সেনাপতি জেনারেল উইগটেনস্টেইন।
লাইপজিগের কাছে লুটযেন (Lützen) শহর। এর অনতিদূরে পড়েছে ফরাসিদের ডান বাহু, যেখানে আছেন মার্শাল নেই। ২ মে সম্মিলিত বাহিনী তার উপর হামলা করলে নেপোলিয়নের আদেশে নেই আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসতে থাকেন। শত্রুরা তার ফাঁদে পা দিয়ে অনুসরণ করলে নেপোলিয়ন এক লাখ সেনা নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিকাল পাঁচটার দিকে সম্রাট নিজে ইম্পেরিয়াল গার্ডদের নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ঢুকে যান। রাশিয়ান এবং প্রুশিয়ান বাহিনী পিছিয়ে যায়। কিন্তু সন্ধ্যা নেমে আসতে থাকায় এবং ঘোড়ার সংখ্যা অপ্রতুল হবার কারণে তাদের ধাওয়া করবার সামর্থ্য নেপোলিয়নের ছিল না।
সম্মিলিত বাহিনী মোটামুটি অক্ষতই ছিল। প্রুশিয়ান ৮,৫০০ এবং রাশিয়ান ৩,০০০ সেনা হতাহত হয়। সেই তুলনায় নেপোলিয়নের ক্ষতি ছিল অনেক বেশি, প্রায় ২২,০০০। প্রুশিয়ানরা পূর্বে বার্লিনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়, আর রাশিয়ানরা গেল স্যাক্সোনির রাজধানী ড্রেসডেনে। ৮ মে নেপোলিয়ন ড্রেসডেনে প্রবেশ করেন, উইগটেনস্টেইন সরে যান বাটযেন শহরে। ২০-২১ মে ব্যাটল অফ বাটযেনেও সম্মিলিত বাহিনী পশ্চাদপসরণ করে, কিন্তু তাদের ১১,০০০ এর তুলনায় নেপোলিয়নের ক্ষয়ক্ষতি ছিল দ্বিগুণ। এখানে নেপোলিয়নের দেড় লাখ লোকের বিপরীতে কোয়ালিশনের সৈন্য ছিল এক লাখের কিছু বেশি। মার্শাল নেইয়ের উপর দায়িত্ব ছিল নেপোলিয়ন যখন সামনে থেকে শত্রুদের ব্যস্ত রাখবেন তখন ডান এবং পেছন দিক থেকে অতর্কিতে হামলা করবার। তিনি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কোয়ালিশন নিরাপদে পালাতে পারল।
অস্ত্রবিরতি
বাটযেনের পর সম্মিলিত সেনাদল সিলিসিয়াতে পিছিয়ে যায়। নিজের অবস্থা পর্যালোচনা করে নেপোলিয়ন ৪ জুন – ১০ আগস্ট পর্যন্ত অস্ত্রবিরতি মেনে নেন। এই সুযোগে রাশিয়া এবং প্রুশিয়া যেভাবে নিজেদের গুছিয়ে নেয়, নেপোলিয়ন তা করতে ব্যর্থ হন। ১৪-১৫ জুন রাইখেনবাখের কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়, যার ফলশ্রুতিতে ইংল্যান্ড নেপোলিয়নের সাথে লড়াইয়ের জন্য প্রায় সাত মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ করে। এদিকে তখন পর্যন্ত অস্ট্রিয়া কোয়ালিশনের বাইরে। অস্ট্রিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেটেরনিখ (Metternich) বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সন্ধির চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কোয়ালিশনের শর্ত ছিল মূলত চারটি:
- ওয়ার’শ ডাচি অবলুপ্ত করতে হবে।
- প্রুশিয়াকে ফিরিয়ে দিতে হবে ১৮০৬ সালের আগের সমস্ত এলাকা।
- কনফেডারশন অফ রাইন ভেঙে দিতে হবে।
- ট্রিস্তে এবং ডালমেশিয়া অঞ্চল অস্ট্রিয়াকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
শর্তগুলো ছিল যথেষ্ট নমনীয়, এবং এর পরেও নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের আকার ইতিহাসের যেকোনো ফরাসি রাজার থেকে বেশি থাকত। সবচেয়ে বড় কথা- বছরের পর বছর যুদ্ধবিগ্রহের পর শান্তির একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু নেপোলিয়ন একের পর এক বিজয়ে এতটাই অহংকারী আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন যে সামান্যতম ছাড় দিতেও তিনি রাজি ছিলেন না। ফলে সন্ধির চেষ্টা ভেস্তে যায়। ১১ আগস্ট অস্ট্রিয়া যোগ দিল ষষ্ঠ কোয়ালিশনে। তাদের সেনাদের নেতৃত্ব নিলেন প্রিন্স শোয়ার্জেনবার্গ।