অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস (বর্তমান বেলজিয়াম) ছিল দ্যুমুরিয়ের মূল লক্ষ্য। তিনি চাচ্ছিলেন এই অঞ্চল দখল করে অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়ার সাথে একটি বাফার জোন তৈরি করতে। সেই উদ্দেশ্যেই প্যারিসে বসে তিনি ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে অনুমতি আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। এর মাঝেই অস্ট্রো-প্রুশিয়ান যৌথ বাহিনীর আগ্রাসন ঠেকাতে তাকে মাঠে নামতে হলো।
এদিকে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসের টুর্নাউ শহরে ছিল অস্ট্রিয়ানদের সামরিক ঘাঁটি। সেখানকার কম্যান্ডে স্যাক্সে-টেশেনের ডিউক, মারিয়া থেরেসার প্রিয় কন্যা মারিয়া ক্রিস্টিনার স্বামী আলবার্ট। ফার্দিন্যান্দের পাশাপাশি ১৭৯২ সালের মাঝামাঝিতে তিনি কিছু সেনা পাঠিয়েছিলেন ফরাসি ভূখণ্ডে। এরা ফরাসি সেনাদের বেশ কয়েকটি সংঘর্ষে পরাস্ত করে। ৫ সেপ্টেম্বর একদল অস্ট্রিয়ান রওনা হলো দুর্গবেষ্টিত লিঁলে শহরের দিকে। ২৫ সেপ্টেম্বর ডিউক আলবার্ট তাদের সাথে যোগ দিলেন।
ব্যাটল অফ জাঁমেপ
অস্ট্রো-প্রুশিয়ানদের পিছু হটিয়ে এবার দ্যুমুরিয়ে তার লক্ষ্যে মনঃসংযোগ করেন। নিঁস, স্যাভোয়, রাইনল্যান্ড (জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল) অধিকার করে ১৭৯২ এর নভেম্বরের ৪ তারিখ অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসের অন্তর্গত মঁন্স নগরীর কাছে ছোট্ট শহর জাঁমেপে (Jemappes) এসে উপস্থিত হলেন তিনি। শহরের সামনে এক উঁচু টিলায় ঘাঁটি করেছে অস্ট্রিয়ানরা, নেতৃত্বে আলবার্ট এবং ক্লারাফেত। ১৩-১৪ হাজার অস্ট্রিয়ানের বিপরীতে ৫০ হাজারের মতো ফরাসি সেনা। ৫ তারিখ সারাদিন দ্যুমুরিয়ে কামান মোতায়েন করলেন, ৬ তারিখ থেকে শুরু হলো তুমুল গোলাবর্ষণ। অনভিজ্ঞ ফরাসি সেনাদের দিয়ে দিনভর চেষ্টার পর টিলার গোড়াতে কিছু অংশ দ্যুমুরিয়ে কব্জা করতে পারলেন। পরিস্থিতি অনুকূল নয় উপলব্ধি করে আলবার্ট পশ্চাদপসরণ করেন। এরপর দ্রুতই পুরো বেলজিয়াম অঞ্চল দ্যুমুরিয়ের অধীনস্থ হয়, তবে এই প্রথম দখল কয়েক মাস মাত্র বজায় ছিল।
নতুন প্রুশিয়ান অভিযান
দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক উইলিয়াম দ্যুমুরিয়ের সাথে বার্তা বিনিময় করেন। দ্যুমুরিয়ে হাই কম্যান্ডকে জানালেন প্রুশিয়ান রাজার সন্ধি করার ইচ্ছা তার কাছে খাঁটি বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু নানা কারণে আলোচনা ভেস্তে গেলে ১৭৯৩ সালের বসন্তের শুরুতে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম হামলা করে বসেন। রাইনের দক্ষিণ তীরে রাইনল্যান্ডের প্রধান নগরী মাইয়েন্স (Mayence)। এখানে ফরাসি দুর্গ পাহারা দিচ্ছে নিয়মিত এবং অনিয়মিত সেনাদের মিশেলে এক বাহিনী। ফ্রেডেরিক ৫৫,০০০ সৈন্য নিয়ে রাইন পার হয়ে এপ্রিলে শহর অবরোধ করেন। অতিরিক্ত অস্ট্রিয়ান সেনা এসে পৌঁছলে তার শক্তি আরো বেড়ে যায়। মাইয়েন্সের গ্যারিসনে ফরাসিদের সংখ্যা ছিল ২০,০০০ এর মতো। তবে রাইনল্যান্ড অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাদের সেনা সংখ্যা ছিল ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের কাছাকাছি।
ফ্রেডেরিক নিজে অবরোধ তদারকি করছিলেন। মুহুর্মুহু গোলায় শহর প্রকম্পিত হতে থাকে। কয়েকবার ফরাসি সৈন্যরা অবরোধ ভাংতে সরাসরি আক্রমণ চালায়, প্রত্যেকবারই তাদের পরাস্ত করা হলো। অবশেষে জুলাইয়ের ২৫ তারিখ তারা আত্মসমর্পণ করে। এক বছর পর্যন্ত প্রুশিয়া এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করবে না এই শর্তে ফ্রেডেরিক তাদের গোলা বারুদ সহ চলে যেতে দেন। ততদিনে যুদ্ধবিগ্রহের উপর থেকে তার মন উঠে গেছে।
কিন্তু চাইলেই কি পিছিয়ে আসা যায়? অর্থের ঝনঝনানি নিয়ে হাজির হলো ইংল্যান্ড। তারা কোয়ালিশনে নাম লিখিয়েছে। ইংল্যান্ড প্রতিশ্রুতি দিল লড়াই জারি রাখলে প্রুশিয়ান বাহিনীর ব্যয় বাবদ মাসিক ২,৫০,০০০ ডলার দেবে, সাথে আনুষঙ্গিক খরচাপাতি। রাজার মন গলাতে তারা ব্যক্তিগতভাবে তাকে প্রায় দশ লাখ ডলার দেবে বলে লোভ দেখাল। ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের অপব্যয়ে প্রুশিয়া তখন অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। কাজেই লোভনীয় এই প্রস্তাব পায়ে ঠেলে দেয়া সম্ভব ছিল না। ফ্রেডেরিক উইলিয়াম প্রায় ৬৪,০০০ সেনা ফরাসিদের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ার গড়ে তোলা যৌথবাহিনীতে প্রেরণ করেন।
কোয়ালিশন বাহিনীর সাফল্য
১৭৯৩ সালের শুরুতে ফ্রান্স ষোড়শ লুইকে গিলোটিনে পাঠিয়েছিল। নিজেদের শক্তিতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে অস্ট্রিয়া এবং প্রুশিয়ার নতুন মিত্র ইংল্যান্ড, স্পেন এবং হলি রোমান এম্পায়ারের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কাউন্সিল যুদ্ধের ডাক দিয়ে বসল। জবাবে অস্ট্রিয়ান বাহিনী নিয়ে স্যাক্সে-কোবার্গের যুবরাজ ফ্রেডেরিক অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসে প্রবেশ করেন (ফ্ল্যান্ডার্স ক্যাম্পেইন)। বেশ কয়েক জায়গায় ফরাসিদের নাজেহাল করে তিনি ১৭৯৩ সালের ১৮ মার্চ বেলজিয়ামের এক গ্রাম নিরউইন্ডেনের (Battle of Neerwinden) সামনে ফ্রেডেরিক দ্যুমুরিয়েকেও পরাস্ত করতে সক্ষম হন।
পরাজিত ফরাসি জেনারেলদের প্রাণদন্ড দেয়া তখন ফরাসি বিপ্লবী রাষ্ট্রে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আবার জ্যাকোবিনদের উত্থানে রাজনৈতিকভাবেও প্যারিসে তখন দ্যুমুরিয়ে কোণঠাসা। ফলে তিনি পক্ষ ত্যাগ করে অস্ট্রিয়ানদের কাছে চলে আসেন। তার ফরাসি উত্তরসূরিরা ক্রমাগত ব্যর্থ হতে থাকে, অন্যান্য দিকেও কোয়ালিশন সাফল্য পায়। বেশ কিছু শহরে লুইয়ের সমর্থকেরা সরকারী সেনাদের হটিয়ে দিয়ে আধিপত্য বিস্তার করে। তুঁলো শহরের রাজতন্ত্রপন্থি বিদ্রোহীরা সহায়তা চাইলে ইংল্যান্ড এবং স্পেনের যুদ্ধজাহাজ সেখানে হাজির হয়। জলপথে তাদের নৌবাহিনী ফ্রান্সকে ঘিরে ছিল।
কোয়ালিশন বাহিনীর তুলনায় ফরাসি বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা অপ্রতুল। স্বেচ্ছাসেবীরা দলে দলে যোগ দিলেও প্রয়োজনীয় সেনা সংস্থান হচ্ছিল না। দিকে দিকে মার খেয়ে প্যারিসে তদানীন্তন সর্বোচ্চ শাসনকাজ বিষয়ক সংস্থা কমিটি অফ পাবলিক সেফটি প্রাপ্তবয়স্ক ফরাসি জনগণের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্ব পালনের আদেশ জারি করে। এর প্রতিবাদে অনেক মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিরোধিতা নির্মূল করতে কমিটি এবং তার অন্যতম নেতা কার্নট ও রবোস্পিয়ার কায়েম করেন কুখ্যাত রেইন অফ টেরর, যা চলেছিল পরবর্তী বছর গিলোটিনে রবোস্পিয়ারের মৃত্যু পর্যন্ত। অজস্র মানুষকে এই সময় তুচ্ছ সন্দেহের উপর ভিত্তি করে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। বহু নিরপরাধ লোক প্রাণ হারায় শুধুমাত্র ক্ষমতার কোন্দলের খেলায়। তবে কার্নট ও রবোস্পিয়ার সফল হন একটি বড় আকারের ফরাসি সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে, যার সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখ।
ফরাসি প্রতিআক্রমণ
নিজেদের গুছিয়ে ফরাসিরা আক্রমণ শুরু করে। অনেক শহর তারা পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়। ১৭৯৪ এর অক্টোবর মাসে ওয়াটিনির যুদ্ধে (Battle of Wattignies) অস্ট্রিয়ানরা পরাজিত হয়। ১৯ ডিসেম্বর তুঁলো পুনরায় সরকারী বাহিনীর হস্তগত হয়, যেখানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন নেপোলিয়ন নামে এক নির্ভীক সেনা অফিসার।
১৭৯৪ সালের ভেতর ফ্রান্স অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস পুরোটাই দখল করে নেয়। হাবসবুর্গ সম্রাট এই অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ক্যাটালুনিয়া, রাইনল্যান্ড এবং জেনোয়ার কিছু এলাকাও ফরাসি অধিকারে আসে। প্রুশিয়া তখন ব্যস্ত থার্ড পার্টিশনের মাধ্যমে পোল্যান্ড ভক্ষণ করতে, ফলে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে তার ইচ্ছা এবং মনোযোগ অনেক কম।
বাসেল চুক্তি
রাইনের সংঘাত কিন্তু শেষ হয়নি। ১৭৯২ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছর নতুন নতুন ফরাসি কমান্ডারের সাথে যৌথবাহিনীর সংঘাত হয়। রক্তের স্রোতে লাল হয়ে যায় রাইন নদী। কখনো প্রুশিয়ানরা ফরাসীদের তাড়িয়ে দিচ্ছিল অপর পারে, কখনো ফরাসীরা শত্রুদের বাধ্য করছিল পিছিয়ে যেতে। কিন্তু অন্যান্য ফ্রন্টে ফরাসি বাহিনীর অগ্রাভিযান শেষ পর্যন্ত প্রুশিয়াকে আলোচনার টেবিলে টেনে নিয়ে আসে।
পোল্যান্ডের অংশ নিয়ে প্রুশিয়ার আয়তন এখন তিন লাখ বর্গ কিলোমিটারের বেশি, সেখানে বাস করছে প্রায় আট মিলিয়ন মানুষ। দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের উদর পরিপূর্ণ, তিনি ফ্রান্সের সাথে আর ঝামেলা করতে চাইলেন না। বাসেলে ৫ এপ্রিল ১৭৯৫ সালে ফরাসি এবং প্রুশিয়ান প্রতিনিধিদের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। প্রুশিয়ান নিরপেক্ষতার বিনিময়ে উত্তর জার্মানিতে ফ্রান্স হস্তক্ষেপ না করার অঙ্গিকার করে, ফলে সেখানে প্রুশিয়া অন্যান্য জার্মান রাষ্ট্রগুলোকে নিজের প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসবার সুযোগ পেয়ে যায়।
হ্যানোভারসহ এই ছোট রাষ্ট্রগুলো প্রুশিয়ার নিরপেক্ষতার অংশীদার হলো, ফলে হলি রোমান এম্পায়ারের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ জার্মান রাষ্ট্রগুলি বাধ্য ছিল এম্পায়ারের প্রয়োজনে সামরিক সাহায্য দিতে, কিন্তু নিরপেক্ষতার চুক্তি সেই কাজে বাধা দিল। রোমান এম্পেররের প্রতি বাস্তবিকপক্ষে তাদের আনুগত্য তখন প্রায় শূন্য। এছাড়া চুক্তির গোপন ধারা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত ছিল ফ্রান্স যদি রাইনল্যান্ডে দখলদারিত্ব বজায় রাখে, তাহলে তারা প্রুশিয়াকে সহায়তা করবে রাইনের পূর্বদিকের এলাকা দখল করে নিতে, যা বর্তমানে হলি রোমান এম্পায়ারের অধীন।
চুক্তির পর প্রুশিয়ার থেকে নিশ্চিত হয়ে ফ্রান্স পুরো মনোযোগ ঢেলে দেয় অস্ট্রিয়ার প্রতি। ফলে আপাতদৃষ্টিতে প্রুশিয়ার সুবিধাই হলো, কারণ জার্মানিতে আধিপত্য বিস্তারে অস্ট্রিয়া ছিল তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে প্রুশিয়ার ক্ষতি হয়। নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে গিয়ে প্রুশিয়া হয়ে পড়েছিল একঘরে। উত্তর জার্মানিতে ফরাসি আগ্রাসন হলে তার দরকার হত শক্তিশালী মিত্র। কিন্তু চুক্তির ফলে ফরাসি বিরোধী দেশগুলো ফ্রেডেরিককে চিহ্নিত করেছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে, সুতরাং ফ্রান্স আক্রমণ করলেও কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফ্রান্সের কাগজ কলমের প্রতিশ্রুতিও যে খুব টেকসই হবে তাও জোর দিয়ে বলা ভার।
এসব সমস্যার পাশাপাশি আরেক ইস্যু পোল্যান্ড। পোল্যান্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রুশিয়ার হয়ে যাওয়ায় ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো রাশিয়ার সাথে প্রুশিয়ার সীমান্ত তৈরি হয়, যা পাহারা দিতে প্রয়োজনীয় অর্থ এবং লোকবলের কমতি ছিল। ফ্রেডেরিক উইলিয়াম মনে করেছিলেন তিনি অনেক কিছু ফ্রান্সের সাথে করা চুক্তিতে আদায় করে নিতে পেরেছেন, কিন্তু সত্যিকার অর্থে মিত্রবিহীন প্রুশিয়া ছিল ইউরোপিয়ান পরাশক্তিগুলোর সহজ টার্গেট। ফ্রেডেরিক উইলিয়াম প্রুশিয়াকে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম ছিলেন না।
বাসেল চুক্তি শুধু প্রুশিয়াকে দিয়ে সমাপ্ত হয়নি। একই বছর ২২ জুলাই স্পেন এবং ২৮ আগস্ট হেসে-কেসেল আলাদাভাবে ফ্রান্সের সাথে বাসেলে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে।
প্রথম কোয়ালিশন যুদ্ধের সমাপ্তি
ইটালি এবং জার্মানিকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা করল। ১৭৯৬ সালে ইটালির ক্যাম্পেইনের নেতৃত্ব তুলে দেয়া হলো ইতোমধ্যে নিজের জাত চেনানো সুদক্ষ কম্যান্ডার নেপোলিয়ন বোনাপার্টের হাতে। জার্মানিতে জেনারেল জর্ডান আর মঁরিউ মুখোমুখি হলেন অস্ট্রিয়ান সমরনায়ক আর্চডিউক চার্লসের। এখানে চার্লস ফরাসিদের বিরুদ্ধে সাফল্য পান। তারা অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়। কিন্তু ইটালিতে দুর্বার বেগে এগিয়ে চলা নেপোলিয়ন কোয়ালিশন বাহিনীকে চুরমার করে দিচ্ছিলেন। একমাত্র সেন্ট ভিনসেন্টের নিকটবর্তী সাগরে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হোরাশিও নেলসনের এক নৌযুদ্ধে বিজয় ছাড়া তার বিপক্ষে বলার মতো কোনো সফলতা কোয়ালিশন বাহিনীর ছিল না। ফলে চার্লসকে সেদিকে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
কিন্তু নেপোলিয়ন ততদিনে উত্তর ইটালি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ভিয়েনার দিকে নিশানা করেছেন। তার ইচ্ছেই অস্ট্রিয়ানদের ভয় দেখিয়ে চুক্তিতে রাজি করানো। ১৭ অক্টোবর ১৭৯৭ সালে নেপোলিয়নের সামনেই ইটালিতে স্বাক্ষরিত হলো ক্যাম্পে ফার্মিও চুক্তি। অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসে ফরাসী আধিপত্য মেনে নিলেন হাবসবুর্গ সম্রাট। ইটালির অনেক অঞ্চলও ফ্রান্সের হাতে চলে আসে। অন্যান্য কোয়ালিশন সদস্যও আলাদা আলাদাভাবে ফ্রান্সের সাথে মিটমাট করে নেয়, একমাত্র ইংল্যান্ড ছাড়া। হলি রোমান এম্পায়ার ভেঙে পড়বার উপক্রম হলো, আর ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের রেখে যাওয়া শক্তিশালী প্রুশিয়া ধাবিত হলো অবক্ষয়ের দিকে।
রাইনল্যান্ডের পরিণতি
১৬ নভেম্বর ১৭৯৭ সালে দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক উইলিয়াম মৃত্যুবরণ করেন। ছেলে তৃতীয় ফ্রেডেরিক উইলিয়াম নাম নিয়ে সিংহাসনে বসলেন একদিন পরেই। এদিকে অস্ট্রিয়ার সাথে ফ্রান্সের সমঝোতার পর রাইনল্যান্ডের ভাগ্য ঝুলে ছিল। ফলে ১৭৯৭ এর নভেম্বরেই প্রুশিয়া সহ জার্মান মিত্রশক্তি এবং ফরাসি প্রতিনিধিরা ব্যাডেনের রাস্টাট শহরে বৈঠকে বসলেন। ফরাসিদের দাবি ছিল রাইন হবে ফ্রান্স এবং জার্মান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সীমানা। রাইনের তীরবর্তী জার্মানির দিকে পঞ্চাশ একর জায়গা, রাইনের সমস্ত দ্বীপ, স্ট্র্যাসবুর্গের বিপরীতে কেল (Kehl) অঞ্চল এবং মাইয়েন্সের নিকটবর্তী কেসেল অঞ্চল ফ্রান্সের হাতে থাকবে। রাইনের পূর্বতীরে প্যালাটাইনের অন্যতম দুর্গ আহ্রেনবাস্টাইন ভেঙে ফেলার দাবিও তারা জানাল। স্বভাবতই জার্মানদের কাছে এগুলো ছিল অগ্রহণযোগ্য। তারা যুক্তি দিল রাইন নদী প্রাকৃতিকভাবে একটি সুরক্ষিত সীমান্তের কাজ করছে, ফ্রান্স যদি এর সাথে জার্মান অঞ্চলের এত এলাকাও দাবি করে তাহলে সীমান্ত হিসেবে রাইনের তো কোনো প্রয়োজনীয়তাই থাকে না। সমঝোতার জন্য তারা রাইনের মূল শাখার ডানে সমস্ত দ্বীপ ফ্রান্সের এবং বাম দিকের দ্বীপ জার্মান অধিকার থাকবে বলে প্রস্তাব করল। অনেক বাদানুবাদের পর সেপ্টেম্বর মাসে এই শর্তেই চুক্তি হলো।