১৮ এপ্রিল, ১৭৫৭।
১১৬,০০০ সৈন্যের বিরাট বাহিনী তিন কলামে ভাগ করে ফ্রেডেরিক ঝড়ের গতিতে বোহেমিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করলেন। প্রুশিয়ানদের ধাক্কায় অস্ট্রিয়ান সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। তারা আশ্রয় নিল সুরক্ষিত শহর প্রাগে। অস্ট্রিয়ানদের নেতৃত্বে আছেন ফিল্ডমার্শাল ব্রাউন এবং লরেইনের যুবরাজ চার্লস, যিনি কিনা আবার মারিয়া থেরেসার বোনের স্বামী। প্রাগের প্রাচীরের আড়ালে তারা অপেক্ষা করছিলেন অস্ট্রিয়ান ফিল্ডমার্শাল ডনের (Daun), যিনি অতিরিক্ত সাহায্য নিয়ে আসার কথা।
ব্যাটল অফ প্রাগ
অস্ট্রিয়ানদের সাথে প্রায় ৬০ হাজার সেনা আর ৬০টি কামান। পয়লা মে থেকে চার্লস তাদের সাজাতে শুরু করলেন প্রাগের ঠিক পূর্বে যিস্কাবার্গ পাহাড়কে কেন্দ্র করে। অস্ট্রিয়ান শিবির সেখান থেকে পূর্বদিকে লাউপ্টিন আর কাইজ গ্রাম অবধি ৬ কিলোমিটার বিস্তৃত। তাদের সামনে রুক্ষ দুর্গম ভূমি শত্রুপক্ষের অগ্রাভিযানে বাধা সৃষ্টি করবে। চার্লসের কাছে খবর ছিল ফ্রেডেরিক বর্তমানে শিমিৎজ (Czimitz) আর ফিল্ডমার্শাল শ্রেরিন ব্রান্দেসে অবস্থান করছেন। তার হিসেব ছিল কমপক্ষে ৭ মে-র আগে তারা কেউই প্রাগের কাছে পৌঁছতে পারবেন না। শহরের আশেপাশে প্রহরার তিনি জন্য কয়েকটি চৌকি স্থাপন করেন যাতে তারা প্রুশিয়ানদের দেখামাত্র সবাইকে সতর্ক করে দিতে পারে। এদের একটি ছিল শহরের উপকণ্ঠে প্রোসেক এলাকাতে।
১৭৫৭ সালের মে মাসের ৫ তারিখ। রাত একটা।
ব্রান্দেস থেকে তিন সারিতে বেরিয়ে এলো প্রুশিয়ান সেনাদল। গন্তব্য প্রোসেক। ঠিক চার ঘণ্টা পর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ফ্রেডেরিক শিমিৎজ থেকে বেরিয়ে এলেন। প্রোসেকের ঠিক সামনে এসে দুই বাহিনী একত্রিত হয়। সৈন্যসংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ৬৫,০০০, সাথে ২৬০টি কামান। ঘড়ির কাঁটা তখনো সকাল ছয়টা স্পর্শ করেনি।
চার্লসের কাছে চরেরা ব্রান্দেস থেকে প্রুশিয়ান অগ্রাভিযানের সংবাদ নিয়ে এলো। প্রোসেক থেকে অস্ট্রিয়ানরাও জানাল শত্রুরা দোরগোড়ায়। চার্লস বুঝলেন ফ্রেডেরিক তাদের চমকে দিতে রাতে মার্চ করে এসেছেন। ফ্রেডেরিক আসলেও সফল হয়েছিলেন কারণ চার্লস এত তাড়াতাড়ি প্রুশিয়ানদের আশা করেননি।
এদিকে শ্রেরিন আর আরেক অফিসার উইন্টারফেল্ডকে নিয়ে ফ্রেডেরিক অস্ট্রিয়ান লাইন পর্যবেক্ষণ করলেন। তার জেনারেলরা ঘুরে এলো কাইজ গ্রাম পর্যন্ত। মতামত দিল যে দক্ষিণ দিক থেকে অস্ট্রিয়ান সেনাদের ডান বাহুতে আক্রমণ শানানোই হবে সবথেকে সুবিধাজনক, কারণ উত্তরদিকে প্রাগের দুর্গপ্রাচীর অস্ট্রিয়ানদের সুরক্ষা দিচ্ছে। এছাড়া পাহাড়ের উপর থাকায় উচ্চভূমির পুরোপুরি সুবিধা অস্ট্রিয়ানরা পাচ্ছিল।
ঠিক সকাল ছয়টার দিকে অস্ট্রিয়ানরা যুদ্ধসাজে সজ্জিত হতে শুরু করল। সকাল নয়টার ভিতরে দুই পক্ষই দাঁড়িয়ে গেল মুখোমুখি। ফ্রেডেরিকের পরিকল্পনা মোতাবেক প্রুশিয়ান অশ্বারোহীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অস্ট্রিয়ানদের ডান বাহুর উপর। সেদিকে থাকা অস্ট্রিয়ান অশ্বারোহীরা বিশৃঙ্খল হয়ে গেলেও পূর্বদিকে ফিল্ডমার্শাল ব্রাউন প্রুশিয়ান ইনফ্যান্ট্রি আক্রমণ ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হন। কিন্তু এজন্য তিনি উত্তর দিকে অস্ট্রিয়ান লাইন থেকে অতিরিক্ত সেনা ও কামান সরিয়ে এনেছিলেন, ফলে সেদিকে দুর্বলতা তৈরি হয় যা প্রুশিয়ান সেনাপতিদের নজর এড়ায়নি।
২২টি প্রুশিয়ান ব্যাটালিয়ন তীব্র বেগে এই দুর্বল অংশে আঘাত করে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। তাদের তড়িৎ হামলাতে অস্ট্রিয়ান ডানবাহু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মূল সেনাদল থেকে, আর বাকি প্রুশিয়ান সেনারা বাম বাহুর উপর গোলাগুলি দাগতে থাকে। চার্লস এবং ব্রাউন বুঝতে পারলেন খোলা মাঠে লড়াই চালিয়ে গেলে অস্ট্রিয়ানরা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। দ্রুত তারা পিঠটান দিয়ে সুরক্ষিত প্রাগে চলে যান। ফ্রেডেরিকের নিজস্ব বয়ানে রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষ চলেছিল সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। তিনি দাবি করেছেন ১৮,০০০ প্রুশিয়ান সেনার বিপরীতে শত্রুদের ২৪,০০০ সেনা খতম করবার। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকদের ধারণা প্রুশিয়ান ফিল্ডমার্শাল শ্রেরিনসহ ১৪,২০০ সেনা সংঘর্ষে হতাহত হয়, অস্ট্রিয়ানদের ক্ষতি ছিল ১৩,৪০০ সৈন্য, যাদের মধ্যে ফিল্ডমার্শাল ব্রাউন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।
অস্ট্রিয়ান সেনারা শহরে থাকা গ্যারিসনের সাথে যোগ দিলে সেখানে সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল ৫০,০০০। এর সাথে ছিল প্রায় এক লাখ বেসামরিক নাগরিক। ফ্রেডেরিক অস্ট্রিয়ানদের খোলা ময়দানে পরাজিত করেছেন বটে, কিন্তু তার ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ। নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত করে তিনি আদেশ দিলেন শহরে গোলা দাগতে। ২৯ মে থেকে সূচনা হলো প্রাগ অবরোধ। চার্লস দুবার শহর থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। তিনি প্রতিক্ষা করতে থাকলেন মার্শাল ডনের আগমনের।
কলিনের লড়াই
এদিকে পূর্ব বোহেমিয়াতে কলিন শহরের কাছে ঘাঁটি গেড়ে মার্শাল ডন ব্যস্ত সেনা সমাবেশে। ৩০,০০০ সৈন্য তার হাতে, আরো সহায়তা পথে রয়েছে। তার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়ে ডিউক অফ বেভার্নকে ১৮,০০০ সেনাসহ প্রেরণ করা হলো। ফ্রেডেরিক এরপর কী মনে করে ১৪,০০০ সেনা নিয়ে নিজেই বেভার্নকে অনুসরণ করলেন।
কলিনে মার্শাল ডনের কাছে অতিরিক্ত সেনা এসে পৌঁছলে তিনি শহরের বাইরে এক পাহাড় শ্রেণীর ঢাল জুড়ে অস্ট্রিয়ান প্রতিরক্ষা গড়ে তুললেন। পঞ্চাশ হাজারের বেশি সৈনিক আর ১৫৪টি কামান তাকে আত্মবিশ্বাস যোগাচ্ছিল। ফ্রেডেরিকের হাতে কামানের সংখ্যা অনেক কম, মাত্র ৯৮টি। তিনি পরিকল্পনা করলেন সেনাদের নিয়ে ঘুরে অস্ট্রিয়ানদের পেছন দিকে চলে যাবার। এরপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ধাক্কা দিয়ে সমতলে নামিয়ে আনতে হবে, যাতে প্রুশিয়ান অশ্বারোহীরা তাদের কচুকাটা করতে পারে।
পরিকল্পনা মোতাবেক প্রুশিয়ানরা ১৭ জুন রাতে পাহাড়ের পেছনে কেৎজোয়া (Krzeczor) গ্রাম দখল করে নেয়। মার্শাল ডন আগেই অনুমান করেছিলেন এরকম কিছু হতে পারে, এ কারণে অস্ট্রিয়ান লাইনের পূর্বদিকে তিনি প্রচুর সেনা মোতায়েন রেখে দিয়েছিলেন। ১৮ জুন গ্রাম থেকে আক্রমণ চালাতে গিয়ে প্রুশিয়ানরা তাই হতভম্ব হয়ে গেল। ছয়বার অশ্বারোহীরা চার্জ করে ছয়বারই গোলাগুলির মুখে তারা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিন ঘণ্টা মরণপণ যুদ্ধ চলার পর অস্ট্রিয়ানদের মধ্যভাগে দুর্বলতা দেখা গেল। এই অবস্থায় তাদের ইনফ্যান্ট্রি সামনে বাড়তে থাকলে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। প্রুশিয়ানরা প্রাগের মতো এই সুযোগ নিতে সর্বাত্মক হামলা চালালো অস্ট্রিয়ান লাইনের মাঝে। কিন্তু এবার ডন প্রস্তুত ছিলেন। তার আদেশে মুহুর্মুহু তোপ দেগে প্রুশিয়ানদের সারি মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হলো। এরপর অস্ট্রিয়ান অশ্বারোহী সেনাদল তীব্র হামলা করে বহু শত্রুসেনাকে হত্যা করে। দিন ফুরোবার আগেই কেৎজোয়া ফ্রেডেরিকের হাতছাড়া হয়ে যায়। পরাজয় মেনে নিয়ে তিনি অবশিষ্ট সেনাবাহিনী নিয়ে সরে যান। প্রাগের অবরোধ উঠিয়ে ফিরে গেলেন সিলিসিয়ার রাজধানী ব্রেস্লাউয়ের সুরক্ষিত দুর্গে। নবোদ্যমে অস্ট্রিয়ানরা এক লাখ সেনা জড়ো করল প্রুশিয়াকে চূড়ান্ত শিক্ষা দিতে।
পূর্ব প্রুশিয়া
ফ্রেডেরিক যখন সিলিসিয়াতে, তখন রাশিয়ানদের মনোযোগ পূর্ব প্রুশিয়াতে। এখানে ৩২,০০০ প্রুশিয়ান সেনার দায়িত্বে আছেন ফিল্ডমার্শাল লেভাল্ট। ৫৫,০০০ সৈন্য নিয়ে রাশান ফিল্ডমার্শাল অ্যাপ্রাস্কিন জুনে এখানে প্রবেশ করেন। ৫ জুলাই তারা মেমেলের বন্দর অধিকার করে নেন। সেখান থেকে তাদের ইচ্ছা কনিগসবার্গে হামলা করবার। এই উদ্দেশ্যে তারা গ্রস-ইয়েগাসদর্ফ শহরে ছাউনি ফেললেন। এখান থেকে ৩০ আগস্ট ভোর পাঁচটায় রাশান বাহিনী যখন বের হচ্ছিল লেভাল্ট তখন অতর্কিতে পশ্চিম দিক থেকে আঘাত করেন। রাশান সেনাদের সংখ্যা প্রুশিয়ানদের দ্বিগুণ। প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলতে থাকে। রাশিয়ান আর্টিলারি চার দফা গোলা মেরে প্রুশিয়ান সেনাদের কচুকাটা করে ফেলে। ৪,৫০০ সেনা ফেলে তারা পালিয়ে যায়। রাশিয়ানদের ক্ষতি ছিল অবশ্য বেশি, ৬,০০০।
রাশিয়ানরা চাইলে পলায়নরত প্রুশিয়ানদের ধাওয়া করে কচুকাটা করে দিতে পারত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তারা তা করল না। শুধু তা-ই নয়, এই পরাজয়ের পর ফ্রেডেরিক সেনাদের পূর্ব প্রুশিয়া থেকে উঠিয়ে নিয়ে যান পার্শ্ববর্তী পোমেরানিয়াতে, যেখানে সুইডেন গণ্ডগোলের ফাঁকে পোমেরানিয়ে হাতিয়ে নিতে চাইছে। কনিগসবার্গ রাশিয়ানদের সামনে উম্মুক্ত, কিন্তু অ্যাপ্রাস্কিন সেদিকে আর গেলেন না, তিনি অক্টোবরে প্রুশিয়া থেকে চলে যান পোল্যান্ডে। এই কাজের জন্য তাকে অপসারণ করে সেন্ট পিটার্সবার্গ ডেকে পাঠানো হয়। ১৭৫৮ সালের জানুয়ারিতে নতুন কম্যান্ডারের অধীনে ৭২,০০০ রাশিয়ান সেনা পূর্ব প্রুশিয়ার দখল নেয়, এবং যুদ্ধ শেষ হওয়া অবধি এই দখল বজায় ছিল।
অ্যাপ্রাস্কিন কেন আর অগ্রসর হননি এই বিষয়ে কয়েকটি তত্ত্ব আছে। তিনি দাবি করেছিলেন সেনাদের প্রয়োজনীয় মালসামানের অভাব ছিল, এবং সরবরাহ লাইনের অবস্থাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তার কথায় কিছুটা সত্যতা থাকলেও অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেন এখানে রাজনৈতিক হিসাব নিকাশই মুখ্য। সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথের স্বাস্থ্য ভাল যাচ্ছিল না, তার উত্তরাধিকারী পিটার ফ্রেডেরিকের গুণমুগ্ধ। তিনি সিংহাসনে বসলে রাশিয়া কোন পক্ষ নেবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কাজেই কোন রাশিয়ান জেনারেল যদি প্রুশিয়ার মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেন তাহলে পিটারের কোপানলে তাকে পড়তেই হবে। সেই কারণেই নাকি অ্যাপ্রাস্কিন আর বেশি দূর আগাননি।
প্রুশিয়ান সমর পরিকল্পনা
রিশেঁলিউর, সুবি আর জোসেফে তখন নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে একত্রিত হবার মানসে যাত্রা করেছেন। এই সম্মিলন ঠেকাতে ফ্রেডেরিক রওনা হলেন। সিলিসিয়াতে ৩০,০০০ সেনা রেখে গেলেন প্রতিরক্ষার জন্য। কিন্তু অস্ট্রিয়ানরা দলে দলে সিলিসিয়াতে ঢুকে পড়ে এবং সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে প্রুশিয়ান সেনাপতি ব্রান্সউইক-বেভার্ন ময়স এলাকাতে তাদের কাছে পরাস্ত হলেন। ফ্রেডেরিক দোলাচল পড়ে গেলেন, তিনি কি সিলিসিয়ার দিকে যাবেন না ফরাসি-রাশান জোটের মুখোমুখি হবেন। ভাবতে ভাবতেই তিনি পূর্বদিকে মুখ ঘোরালেন, ব্রান্সউইকের চার্লস উইলিয়াম ফার্দিন্যান্দকে রেখে যান স্যাক্সে-হিল্ডেনবার্গহাউসেনের উপর নজর রাখতে। তার কাছ থেকে খবর আসল ফরাসি এবং জার্মান মিত্ররা জড়ো হয়েছে থুরিঙ্গিয়াতে। রিশেঁলিউ সেদিকেই আসছিলেন। তার সেখানে পৌঁছানোর আগেই তাদের মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্রেডেরিক সেদিকে চলে যান।
রোসবাহ
স্যাক্সোনির থুরিঙ্গিয়া অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম রোসবাহ (Rossbach), একমাত্র স্থান যেখানে সেভেন ইয়ার্স ওয়ারে ফ্রেঞ্চ এবং প্রুশিয়ান সেনারা পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। ফরাসি সেনাধ্যক্ষ প্রিন্স অফ সুবি ৪২,০০০ ফরাসি এবং জার্মান মিত্র নিয়ে তখন ব্র্যান্ডেনবার্গের পথ ধরেছেন। কয়েকটি পরাজয়ের পর ফ্রেডেরিকের বাহিনীর লোকবল তখন অনেক কম। ২১,০০০ সৈন্য নিয়ে ৪/৫ নভেম্বর, ১৭৫৭ সালে তিনি রোসবাহ গ্রামের নিকটে সুবির সম্মুখিন হন।
সুবির আদেশে সারিবদ্ধ বাহিনী প্রুশিয়ানদের লাইনে আঘাত হানতে মার্চ শুরু করে। ফ্রেডেরিক মেজর জেনারেল সেডলিটজকে অশ্বারোহী সেনাদল দিয়ে পাঠালে তারা এমন বিক্রমে শত্রুদের সম্মুখ সারির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যে তারা তছনছ হয়ে যায়। সুবি আর জোসেফের মধ্যে সমরকৌশল নিয়ে মতবিরোধের কারণে তাদের সেনারাও দ্বিধাবিভক্ত ছিল। এই পরিস্থিতিতে প্রুশিয়ান অশ্বারোহীদের পেছন পেছন ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট চার্জ করলে ফরাসি-জার্মান সেনারা প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হয়। তারা ব্যুহ ভেঙে পালাতে থাকলে পলায়নরত ফ্রেঞ্চ-জার্মান সৈন্যদের উপর প্রুশিয়ান সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরই মধ্যে প্রুশিয়ান অশ্বারোহীরা নতুন করে সুবির ইনফ্যান্ট্রি লাইনের উপর আক্রমণ করে বসে, এবং প্রুশিয়ান কামানও শত্রুদের সমূহ ক্ষতি করতে সক্ষম হয়। এত দ্রুত সব ঘটে যায় যে ফ্রেডেরিকের পুরো বাহিনী নাকি যুদ্ধক্ষেত্রে নামবারই সুযোগ পায়নি। ১০,০০০ হতাহত রেখে সুবি পালিয়ে যান, প্রুশিয়ানদের ক্ষতি ছিল যৎসামান্য, মাত্র ৫০৮ জন।
ব্যাটল অফ লাইটেন/ব্যাটল অফ লিসা
নভেম্বরের শুরুতে অস্ট্রিয়ানরা সিলিসিয়াতে প্রবেশ করল। তাদের কম্যান্ডে সেই লরেইনের যুবরাজ চার্লস। ব্রেস্লাউ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ১৯,০০০ সেনা ছোট এক দলকে তারা সহজেই পরাস্ত করে তারা ২৫ তারিখ শহর দখল করে নেয়। সংবাদ পেয়ে ফ্রেডেরিক দ্রুত ব্রেস্লাউয়ের দিকে অগ্রসর হলেন। ১৭৫৭ সালে ৫ ডিসেম্বর সিলিসিয়ার লাইটেন (Leuthen) গ্রামের লিসা (lissa) প্রান্তরে ৩৩,০০০ প্রুশিয়ান সম্মুখিন হলো দ্বিগুণ সংখ্যক অস্ট্রিয়ানের। এই যুদ্ধই ব্যাটল অফ লাইটেন অথবা ব্যাটল অফ লিসা নামে পরিচিত।
লিসার প্রান্তরে চার্লস সেনাদের সাজিয়েছিলেন লম্বা সারিতে, যার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখাই দুঃসাধ্য। ফ্রেডেরিকের প্ল্যান ছিল দক্ষিণ দিক অস্ট্রিয়ান বাম বাহুর উপর আক্রমণ করা এবং ঠেলে তাদের উত্তরদিকে পাঠানো। এতে তাদের সমরবিন্যাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এদিকে চারিদিক দেখে চার্লস ধারণা হয়েছিল প্রুশিয়ানরা হামলা করবে তার মধ্যভাগের ডান দিকে। তাই তিনি সেদিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন।
চার্লসকে ধোঁকা দিতে ফ্রেডেরিক একদল সেনা পাঠিয়ে দেন অস্ট্রিয়ানদের মধ্যভাগে আক্রমণ করতে। অধিকাংশ সেনা আগেই তিনি চুপিসারে দক্ষিণে সরিয়ে নিয়েছিলেন। অস্ট্রিয়ান জেনারেল নাদাস্তি ফ্রেডেরিকের ছল আঁচ করতে পারলেন। তিনি অবিলম্বে দক্ষিণ দিকে অতিরিক্ত সেনা পাঠাতে চার্লসের কাছে আবেদন জানান। এদিকে ফ্রেডেরিক কিন্তু দেরি করলেন না। তিনি চার্লস কোনো সাহায্য পাঠানোর আগেই আঘাত হানলেন। ছত্রভঙ্গ অস্ট্রিয়ান সেনারা তার উদ্দেশ্য পূরণ করে উত্তরে সরে যেতে থাকে। এদিকে তাদের শক্তিশালী করতে চার্লস অন্য জায়গা থেকে সেনা সরিয়ে আনার নির্দেশ জারি করলে অস্ট্রিয়ান লাইনে তুমুল গোলমালের সৃষ্টি হলো।
অস্ট্রিয়ার পিছিয়ে আসা সেনা আর জায়গা পরিবর্তন করে এগিয়ে আসা সৈনিকদের মধ্যে সৃষ্টি হয় গোলযোগ। এই হট্টগোলে প্রুশিয়ানরা পাখি শিকার করার মতো অস্ট্রিয়ানদের উপর গুলি চালাতে থাকে। বন্দুক আর কামানের অনবরত আঘাতে তিষ্ঠোতে না পেরে দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে চার্লস লাইটেন গ্রাম থেকে রণেভঙ্গ দিলেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে তার নির্দেশে অশ্বারোহী বাহিনী প্রুশিয়ানদের ইনফ্যান্ট্রি লাইনের উপর হামলা করতে যায়, কিন্তু প্রুশিয়ান অশ্বারোহীরা সতর্ক ছিল। তারা এই আক্রমণ নস্যাৎ করে দেয়।
সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াইয়ের পর ২২,০০০ সঙ্গী ফেলে চার্লসের সেনারা বাধ্য হলো পিছিয়ে যেতে। ফ্রেডেরিকের ক্ষতি ছিল এর অর্ধেক। বিপুল মালামাল তার হস্তগত হয়, যার মধ্যে ছিল ১৩৪টি কামান। চার্লসকে এরপর যুদ্ধ চলাকালীন আর কোনো সেনা কমান্ড দেয়া হয়নি। এই পরাজয়ে সিলিসিয়া আর ব্রেস্লাউয়ের উপর ফ্রেডেরিকের কর্তৃত্ব আরেকবার প্রতিষ্ঠিত হলো। ব্রেস্লাউতে থাকা অস্ট্রিয়ান গ্যারিসন তার কাছে আত্মসমর্পণ করে। তিনি এরপর রাশিয়ান এবং সুইডিশদের দুটি দলকে এই অঞ্চল থেকে হটিয়ে দেন। ১৭৫৭ সালের ক্যাম্পেইন সমাপ্ত হলো।