আমরা অনেকেই হয়তো বিভিন্ন সিনেমা বা বইয়ে বিভিন্ন মানুষের অজানা, অচেনা এবং প্রতিকূল পরিবেশে হারিয়ে যাওয়া এবং সেখানে তাদের বেঁচে থাকার লড়াই করাটা দেখেছি। আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে সুপ্ত বাসনা থাকে কোনো অজানা জায়গায়, যেমন সাগর বা বনে অভিযান পরিচালনা করার, হারিয়ে যাওয়ার, নতুন জায়গা আবিষ্কার করার, এমন কোনো স্থানে যাওয়ার যেখানে আগে মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি। কিন্তু সত্যিকারভাবে হারিয়ে যাওয়া কিছু মানুষের অভিজ্ঞতা, ঘটনা এবং তাদের বেঁচে থাকার লড়াই সম্পর্কে জানলে হয়তো আপনার এই ইচ্ছাটা দমেও যেতে পারে। আসুন আজ এরকম কিছু ব্যক্তি সম্পর্কে জানা যাক, যারা আসলেই দুর্গম পরিবেশে হারিয়ে গিয়েও বেঁচে থেকেছেন।
পুন লিম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুন লিম এসএস বেনলোমন্ড নামের একটি ব্রিটিশ সশস্ত্র জাহাজে সেকেন্ড স্ট্যুঅর্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কেপটাউন থেকে সুরিনামে ভ্রমণরত অবস্থায় ১৯৪২ সালের ২৩ নভেম্বর জাহাজটিকে ইউ-১৭২ নামের একটি জার্মান সাবমেরিন আক্রমণ করে। দুটি টর্পেডোর আঘাতে জাহাজটি ডুবে যায়। মাত্র ৬ জন সে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে পেরেছিলেন, যার মধ্যে পুন লিম একজন।
প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে সাঁতারের পর পুন লিম একটি আট ফুট বর্গাকার কাঠের ভাসমান ভেলা দেখতে পান। তিনি সেটি আঁকড়ে ধরেন। ভেলাটিতে সৌভাগ্যবশত আগে থেকেই কিছু বিস্কুট, এক জগের মতো পানি, একটি ফ্ল্যাশলাইট এবং আরো কিছু জিনিসপত্র ছিল। কিন্তু এগুলোও পরিমাণে ছিল মাত্র কয়েকদিন চলার মতো। খাবারের স্বল্পতা দেখে পুন লিমকে অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিলো। মাছ ধরতে হয়েছিলো এবং বৃষ্টির পানি ধরে জমিয়ে রাখার ব্যবস্থাও করতে হয়েছিলো। একবার একটি ঝড়ে তিনি তার সংগ্রহ করা সমস্ত মাছ হারিয়ে ফেলেন। সেসময় তাকে একটি পাখি ধরতে হয়েছিলো এবং বেঁচে থাকার জন্য পাখিটির রক্তও পান করতে হয়। এমনকি তিনি একটি হাঙর ধরেও তার রক্ত পান করেছিলেন তৃষ্ণা মেটাতে।
পুন লিম এভাবে মোট ১৩৩ দিন সাগরে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর অবশেষে তিনি একটি দ্বীপে নামেন এবং সেখানে একজন ব্রাজিলীয় জেলে তাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। পরবর্তীতে রাজা ষষ্ঠ জর্জ তাকে ব্রিটিশ এম্পায়ার মেডেল পুরষ্কার দেন এবং রাজকীয় নৌবাহিনী পুন লিমের এই কাহিনী বেঁচে থাকার কৌশল হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
রবার্টসন পরিবার
ডুগাল রবার্টসন ছিলেন ব্রিটিশ বণিক জাহাজের একজন স্কটিশ নাবিক। নৌবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি পুরোদস্তুর দুগ্ধখামারি হয়ে যান। কিন্তু সাগর তার রক্তে মিশে ছিল। তাই ১৯৭১ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি নিজের স্কুনারে করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ইংল্যান্ডের ফলমাউথ থেকে গালাপাগোস দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
এর প্রায় পনেরো মাস পর, ১৯৭২ সালের ১৫ জুন তার স্কুনারটিকে কিছু খেপাটে তিমি আক্রমণ করে। তিমিগুলোর আঘাতে নৌকাটির নিচে বেশ কিছু গর্তের সৃষ্টি হয়, যার ফলে সেটি ডুবতে থাকে। পরিবারটি দ্রুত তাদের সঙ্গে আনা বাতাসের মাধ্যমে ফোলানো যায় এমন ভেলায় উঠে পড়েন। কিন্তু সেটিও একরাতের বেশি ব্যবহারযোগ্য ছিল না, যার ফলে তাদের নৌকার সাথে যে তিন মিটার লম্বা ডিঙিটা আগে থেকেই ছিল, তাতে উঠে পড়েন তারা। ছোট্ট ডিঙিতে জায়গার সঙ্কুলান না হওয়ায় তাদেরকে সবচেয়ে দরকারি জিনিসপত্র ছাড়া বাকি সবকিছুই পানিতে ফেলে দিতে হয়েছিলো।
তারপর তাদের শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। তারা বৃষ্টির পানি জমিয়ে পান করা শুরু করেন। এছাড়াও তারা ডলফিন, উড়ন্ত পাখি এবং কচ্ছপ ধরে এগুলোর মাংস এবং রক্ত পান করেছিলেন। তাদেরকে তাদের সাথে থাকা স্বল্প শুষ্ক মাংস এবং পানি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জমিয়ে রাখতে হয়েছিলো। এভাবে মোট ৩৮ দিন লড়াই চালিয়ে যাবার পর একটি জাপানী মাছধরা ট্রলার রবার্টসন ও তার চার সন্তানকে দেখতে পায়। অবশেষে তারা তাদের এই অমানবিক বেঁচে থাকার লড়াই থেকে মুক্তি পান।
অ্যাডা ব্লাকজ্যাক
অ্যাডা ব্লাকজ্যাকের জীবনটা ছিল বেশ মর্মান্তিক। একটি দুর্ঘটনায় তার স্বামী এবং দুই সন্তান পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলো। তিনি এবং তার এক সন্তান বেঁচে গিয়েছিলেন কোনোমতে। কিন্তু তাকে সেই সন্তানটিকেও একটি অনাথাশ্রমে দিয়ে আসতে হয়েছিলো দরিদ্রতার দরুন। এরপর তিনি ১৯২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভিলজালমুর স্টেফানসন কর্তৃক পরিচালিত একটি অভিযানে অংশ নেন। মোট পাঁচজনের অভিযানটি ছিল মূলত কানাডার অধীনে র্যাংগেল দ্বীপটিকে নিয়ে আসা। অ্যাডা সেখানে রাঁধুনি এবং দর্জি হিসেবে যোগদান করেন। তবে তিনি এ ধরনের কার্যকলাপে মোটেও দক্ষ ছিলেন না। পাশাপাশি তিনি ছিলেন ভীতু। বন্দুক এবং মেরু ভালুকের ভয়ে সবসময়ে তিনি তটস্থ থাকতেন।
কিন্তু দ্বীপটিতে পৌঁছে তারা মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। প্রচণ্ড ঠান্ডায় তাদের বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়েছিলো। এই রূঢ় আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে এবং খাবারের অপ্রতুলতার কারণে দলের তিনজন সদস্য দ্বীপ ত্যাগ করেন সাহায্য পাবার আশায়। পেছনে পড়ে থাকেন অ্যাডা এবং অন্য একজন সাথী। অ্যাডার এই সাথীটিও কয়েকদিনের মাথায় মারা যায়। কিন্তু এই অদক্ষ অ্যাডাই সেই কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ হয়তো তার আর হারানোর কিছু ছিল না। মোট দু’বছর ছিলেন তিনি সেই দ্বীপে। তারপর তাকে স্টেফানসনেরই একজন সহকর্মী উদ্ধার করেন। এতটা বিরূপ পরিবেশেও লড়াই করে বেঁচে থাকায় অ্যাডা ব্লাকজাককে উপাধি দেয়া হয় ‘নারী রবিনসন ক্রুসো’ হিসেবে।
সালভাদোর আলভারেঙ্গা
তিনি পেশায় ছিলেন একজন জেলে। ২০১২ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি তার এক সহকর্মীর সাথে মেক্সিকান উপকূলে নিজের মাছধরা নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু তারা তাদের যাত্রা শুরু করার প্রথমেই ঝড়ের কবলে পড়েন। যে ঝড়টি টানা পাঁচদিন স্থায়ী ছিল। ঝড় শেষ হবার পর তারা বুঝতে পারলেন যে তারা দিকভ্রষ্ট হয়েছেন। তাদের কাছে নৌকা চালানোর মতো কোনো সরঞ্জামও ছিল না, ফলে নৌকাটি স্রোতের সাথে ভেসে চলছিলো অজানা এক লক্ষ্যে।
নিজেদের সাথে থাকা খাবার দ্রুতই ফুরিয়ে গেলো এবং তাদেরকে বেঁচে থাকার জন্য অন্য উপায় বের করতে হলো। তারা মাছ, কচ্ছপ, জেলিফিশ এবং সামুদ্রিক পাখি শিকার করতে শুরু করলেন। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য তাদেরকে নির্ভর করতে হলো বৃষ্টির পানি, কচ্ছপের রক্ত, এমনকি নিজেদের মূত্রের উপরও। এভাবে প্রায় চারমাস চলার পর সালভাদোরের সাথীটি মারা যান। এর কিছুদিন পরেই তিনি মার্শাল দ্বীপে পৌঁছান, যেখানে স্থানীয়রা তাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। সালভাদরই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সাগরে হারানোর পরেও শুধু ছোট্ট একটি নৌকায় প্রায় ১৩ মাস অতিবাহিত করে বেঁচে গিয়েছেন।
আলেকজান্ডার সেলকির্ক
সেলকির্ক তার যুবক বয়সে নৌবাহিনীতে যোগ দেন। সেসময় স্প্যানিশ যুদ্ধের একটি অভিযানে তিনি রয়্যাল নেভি অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। উইলিয়াম ড্যাম্পারের অধীনে ১৭০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তারা চিলির অধীনে থাকা অজানা একটি উপকূলে আসেন তাদের খাবার এবং পানির মজুদ পরিপূর্ণ করে নিতে।
কিন্তু সে জায়গা থেকে ফিরে যাবার সময় আলেকজান্ডার তাদের জাহাজটি পর্যবেক্ষণ করে সেখানে উঠতে অপারগতা জানান। তার মতে, জাহাজটি সাগরে চলার মতো অবস্থায় নেই এবং যেকোনো দুর্যোগে ডুবে যাবার সম্ভাবনা আছে। তাই তিনি দ্বীপটিতেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। জাহাজের ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডারকে একটি ছুরি, রান্না করার পাত্র, কিছু কাপড় এবং একটি বাইবেল দিয়ে সাগরে বেরিয়ে পড়ে। শুরু হয় আলেকজান্ডারের দ্বীপে বসবাস। সেই দ্বীপে আলেকজান্ডারকে প্রথম প্রথম কাঁটাযুক্ত চিংড়ি খাওয়া শুরু করতে হয়। এবং এই প্রথমই তিনি জাহাজে ফিরে না যাবার জন্য অনুশোচনা বোধ করেন।
দ্বীপটিতে ছিল প্রচুর জলহস্তী এবং ইঁদুর। তারা তার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছিলো। আলেকজান্ডার তার বেঁচে থাকার যুদ্ধ চালিয়ে যান সেখানকার বন্য ছাগলের দুগ্ধপান এবং মাংস খাওয়ার মাধ্যমে। পাশাপাশি তাকে শালগম, শুষ্ক মরিচ এবং বিভিন্ন জাম জাতীয় ফলও খেতে হতো। এসবের মাঝে তাকে অনেকবার আঘাতও পেতে হয়েছে। সেসময়ে আলেকজান্ডার বাইবেল পড়ে তার মনোবল ধরে রেখেছিলেন। এভাবে তিনি চার বছর সেই দ্বীপে কাটান। সবশেষে সেই একই উইলিয়াম ড্যাম্পার কর্তৃক পরিচালিত আরেকটি জাহাজের মাধ্যমে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়।
ফিলিপ এশটোন
ফিলিপ পেশায় ছিলেন একজন জেলে। ১৭২২ সালের জুনে তিনি নোভা স্কটিয়া, শেলবার্নের উপকূলে গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। দুর্ভাগ্যবশত তিনি জলদস্যুদের হাতে ধরা পড়েন। কিন্তু ফিলিপ মোটেই ভীতু বা দমে যাওয়ার মত ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন কিছুটা বদমেজাজি এবং একগুঁয়ে।
তাই জলদস্যুদের হাতে ধরা পড়ার পর তিনি বিচলিত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো বিদ্রোহ করে বসেন। তিনি মোটেই দস্যুদের কথামতো চলতেন না, তাদের কথায় কানই দিতেন না! কোনো কাজে হাতও দিতেন না, যার ফলে তারা তাকে প্রায়ই হুমকি-ধামকি দিত। কিন্তু ফিলিপ থোড়াই কেয়ার করতেন!
জলদস্যুরা একবার রোয়াটান দ্বীপে নোঙর ফেলে। সুযোগ বুঝে ফিলিপ সবার অলক্ষ্যে পালিয়ে যান। জঙ্গলের ভেতর গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন। জঙ্গলটি ছিল সবরকমের পোকামাকড় এবং কুমিরে ভর্তি। আবহাওয়া ছিল প্রচণ্ড গরম। প্রথমদিকে তাকে শুধু জঙ্গলের ফলমূল খেয়েই চলতে হয়েছে, কারণ প্রাণী হত্যা করার মতো কোনো অস্ত্র তার কাছে ছিল না।
তবে অবাক করা বিষয় হলো, ফিলিপ সেই দ্বীপে আরেকজন ইংরেজ ব্যক্তির দেখা পান, যিনি নিজেও হারিয়ে গিয়েছিলেন। ফিলিপকে আরো বেশি অবাক করে এবং রহস্যে ফেলে দিয়ে সেই ইংরেজ ব্যক্তি কয়েকদিন পরেই আবার উধাও হয়ে যায়। তাকে আর ফিলিপ খুঁজে পাননি। তবে চলে গেলেও ইংরেজ ব্যক্তিটি একটি ছুরি, গানপাউডার, তামাক এবং আরো কিছু জিনিসপাতি রেখে গিয়েছিলো, যেগুলো ব্যবহার করে ফিলিপ কচ্ছপ এবং চিংড়ি শিকার করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যান। এর প্রায় ১৬ মাস পর ম্যাসাচুসেটসের একটি জাহাজ ফিলিপকে সেখান থেকে উদ্ধার করে।
ফিচার ইমেজ: mirror.co.uk