দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে ইতালির বহু গল জাতি হ্যানিবালের সাথে হাত মিলিয়েছিল। এদের মধ্যে ইন্সাব্রেস আর বই জাতি অন্যতম। ইতালি থেকে হ্যানিবালের বিদায় ও কার্থেজের পরাজয়ের পরেও লম্বা সময় ধরে গলদের বিভিন্ন জাতির সাথে রোমের সংঘাত অব্যাহত ছিল। ২০১ থেকে শুরু করে ১৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অনেক লড়াই, অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর অবশেষে রোম সিসাল্পাইন গলকে মোটামুটিভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়, যদিও বিচ্ছিন্নভাবে আরো কিছু অভিযান পরে পরিচালনা করা হয়েছিল।
সিসাল্পাইন গলে রোমান অভিযান বর্ণিত হয়েছে লিভির কাছ থেকে। অন্যান্য ক্ষেত্রে লিভি যেমন বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, এ স্থলে তা পাওয়া যায় না। কিন্তু লিভি ছাড়া আর কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে আধুনিক ঐতিহাসিকরা এই দীর্ঘ সংঘাতের আলোচনা বের করতে পারেননি। কাজেই লিভির লেখাই আমরা অনুসরণ করব।
মিউটিলামের পরাজয় (২০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
হ্যানিবালের সমর্থক গল জাতিগুলোর বিরুদ্ধে রোমান জেনারেল অ্যাম্পিয়াস বইদের অঞ্চলে সেনা অভিযান করেন। তার সাথে অন্যান্য সৈনিকদের সাথে কন্সাল পিটাসের অভিজ্ঞ সেনাদলের কিছু অংশও ছিল। মিউটিলামের কাছে যখন রোমান সেনারা খাদ্য সংগ্রহে ব্যস্ত, তখন শত্রুবাহিনী অকস্মাৎ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অ্যাম্পিয়াসসহ প্রায় ৭,০০০ রোমান সেনা নিহত হয়। এই ঘটনার পর রোমানরা পিছিয়ে আসে। পরবর্তীতে কন্সাল পিটাস লিগুরিয়ান ইঙ্গুয়ানি গোষ্ঠীর সাথে শান্তিচুক্তি করলেও বইদের বিরুদ্ধে এ বছর আর অগ্রসর হননি।
ক্রেমনার লড়াই (২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
ইতালিতে রয়ে যাওয়া কার্থেজিনিয়ান অফিসার হ্যামিলকারের নেতৃত্বে বই, ইন্সাব্রেস, সিনোম্যানি এবং অন্যান্য অনেক লিগুরিয়ান গোত্র একত্রিত হলো। তাদের মিলিত সেনাদলের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ৪০,০০০। প্ল্যাসেনশিয়া তছনছ করে তারা ক্রেমনা অবরোধ করল।
এই বাহিনীর বিরুদ্ধে অ্যারিমিনিয়ামে ২০,০০০ রোমান সেনা জমা হলো। তাদের প্রধান ছিলেন সেখানকার প্রিটর পারপুরিও। তিনি অপেক্ষা করছিলেন কন্সাল গাইয়াস অরিলিয়াস কটার জন্য। কিন্তু ক্রেমনা অবরুদ্ধ খবর পেয়ে তিনি কন্সালের অপেক্ষায় না থেকেই সেদিকে যাত্রা করেন। তার মোকাবেলা করতে হ্যামিলকার এগিয়ে গেলেন।
পারপুরিও তার ইতালিয়ান মিত্রদের সামনে রেখে রোমান লিজিয়নকে রাখলেন তাদের পেছনে। গলবাহিনী যখন আক্রমণের জন্য বিন্যস্ত হচ্ছিল ঠিক সেই সময় রোমান সেনারা ইতালিয়ান মিত্রদের দুই পাশে সরে এলো। এর ফলে রোমান সেনাদলের সম্মুখ সারি গলদের থেকে বিস্তৃত হয়ে পড়লে হ্যামিলকার বাধ্য হলেন তার সেনাদের একইভাবে ছড়িয়ে দিতে, যাতে তারা রোমান বাহিনী দিয়ে দুদিকে বেষ্টিত না হয়ে পড়ে। কিন্তু এর ফলে তার বাহিনীর মধ্যভাগ দুর্বল হয়ে পড়ল এবং যুদ্ধ শুরু হলে রোমের ইতালিয়ান মিত্ররা সহজেই তা ভেদ করতে সমর্থ হয়। ওদিকে রোমের অভিজ্ঞ সৈন্যদের আঘাতে হ্যামিলকারের সেনাদলের দুই বাহুতেও বিপর্যয় দেখা দেয়। ৩৫,০০০ এর মতো হতাহত ও বন্দি ফেলে শত্রুপক্ষ পালিয়ে যায়। রোমানদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল ২,০০০ সেনা।
সিসাল্পাইন গলে অভিযানের বিরতি
দ্বিতীয় মেসিডোনিয়ান যুদ্ধ (২০০-১৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আরম্ভ হলে রোম তার মনোযোগ সেদিকে সরিয়ে নিল। এই সময় বড় কোনো অভিযান রোম পরিচালনা করেনি। তবে ১৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রিটর ট্যাম্ফিলাস ইন্সাব্রেসদের এলাকাতে অনুপ্রবেশ করলেই পাল্টা আঘাতে প্রায় ৬,৭০০ সেনা ফেলে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। এরপর সেই বছরের কন্সাল লেন্টুলাস ও পরের বছরের কন্সাল সেক্সটাস পুরো সময় ব্যয় করেন প্ল্যাসেনশিয়া এবং ক্রেমনার বিধ্বস্ত রোমান কলোনি মেরামত ও বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের কাজে।
মিনসিয়াস নদীর যুদ্ধ (১৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
ইন্সাব্রেস ও সিনোম্যানিরা সৈন্য সমাবেশ করলে বইরা তাদের সাথে গিয়ে যোগ দিল। কন্সাল ক্যাথেগাস এই বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন। অপর রোমান কন্সাল রুফাস লিগুরিয়ানদের অঞ্চলে ঢুকে তাদের অনেক গোষ্ঠীকে পরাস্ত করে পূর্বদিকে ঘুরে বইদের এলাকাতে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকলে বইরা ইন্সাব্রেস ও সিনোম্যানিদের থেকে পৃথক হয়ে রুফাসকে ঠেকাতে গেল। বইদের ছাড়াই তখন বাকি গল সেনাদল মিনসিয়াস নদীর কাছে ক্যাথেগাসের মুখোমুখি হলো।
ক্যাথেগাস আগেই গোপনে সিনোম্যানিদের সাথে চুক্তি করেছিলেন। ফলে যুদ্ধ শুরু হলে দেখা গেল শুধু ইন্সাব্রেসরাই লড়াই করছে, সিনোম্যানিরা নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে আছে। যুদ্ধের একপর্যায়ে তারা উল্টো ইন্সাব্রেসদেরকেই পেছন থেকে হামলা করে বসে।শেষ পর্যন্ত ইন্সাব্রেসদের পরাজয় ঘটে। প্রায় ৩৫,০০০ ইন্সাব্রেস যোদ্ধা হতাহত হয় এই লড়াইয়ে, আর ৫,২০০ জনকে রোমানরা বন্দি করে।
ওদিকে বইরা রুফাসের বাহিনীকে পরাস্ত করলেও রোমানদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। এই পরিস্থিতিতে তারা তাদের সুরক্ষিত শহরগুলোতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়লো। রুফাস সেদিকে না গিয়ে বইদের এলাকাতে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ফিরে এলেন।
কোমামের পতন (১৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
নতুন বছরে কন্সাল নির্বাচিত হলেন মার্সেলাস এবং পারপুরিও। দুজনেই সিসাল্পাইন গলে রোমের প্রাধান্য বিস্তারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেন। দুই কন্সাল আলাদা আলাদাভাবে গল অঞ্চলে প্রবেশ করেন। বইয়েরা মার্সেলাসের ক্যাম্পে হামলা চালালে প্রায় ৩,০০০ এর মতো রোমান সেনা নিহত হয়, তবে মার্সেলাস তার শিবির রক্ষা করতে সক্ষম হন এবং শেষপর্যন্ত বইরা পিছিয়ে যায়।
মার্সেলাস কোমাম শহরের দিকে এগিয়ে এলেন। এখানে ইন্সাব্রেসদের বাহিনীর আঘাতে তার সম্মুখ সারি ভেঙে পড়লেও অশ্বারোহী যোদ্ধা ও ইতালিয়ান মিত্রদের সহযোগিতায় তিনি তাদের পরাজিত করে কোমাম অধিকার করেন। এর সূত্র ধরে মার্সেলাসের হাতে আরো আটাশটি নগরের পতন হয়।
ওদিকে পারপুরিও তার সেনাদল নিয়ে তাণ্ডব চালাতে চালাতে বর্তমান ইটালির বলোগনা অবধি চলে আসেন। পো নদির তীরে তিনি বইদের এক ছোট দলকে ধ্বংস করে দেন। সব মিলিয়ে এই বছর ছিল রোমের জন্য শুভ।
১৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ঘটনাবলী
এই বছরের রোমান কন্সাল ছিলেন ফ্ল্যাকাস ও সেম্প্রোনিয়াস। লিটানা ফরেস্টের কাছে ফ্ল্যাকাস বইদের এক বাহিনীকে পরাস্ত করে প্রায় ৮,০০০ শত্রুসেনাকে হত্যা করেন। এরপর তিনি প্লাসেনশিয়া ও ক্রেমনাতে রোমান কলোনির প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য মেরামতের কাজ সম্পন্ন করেন। শীতের শুরুতে বর্তমান মিলানের কাছে ডরুল্যাটাস বই ও ইন্সাব্রেসদের মিলিত বাহিনী নিয়ে আবার ফ্ল্যাকাসের সাথে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। এবারো ফ্ল্যাকাস জয়লাভ করেন। প্রায় ১০,০০০ গল যোদ্ধা নিহত হয়। এই লড়াইয়ের পর ইন্সাব্রেসদের সামরিক শক্তি প্রায় নিঃশেষিত হয়ে যায়। ফলে রোমের বিরোধিতা করার মতো ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলে।
এদিকে সেম্প্রোনিয়াস বইদের অঞ্চলে হামলার শিকার হন। গলরা দুই দলে ভাগ হয়ে রোমান ছাউনির দুই দিকের প্রবেশপথে আক্রমণ করল। সামনের দিকের প্রবেশপথে রোমানরা উদ্যমের সাথে শত্রুবাহিনীর আঘাত প্রতিহত করতে থাকে। এর মধ্যেই দুই রোমান অফিসার ভিক্টোরিয়াস ও অ্যাটিনিয়াস রোমান ঝাণ্ডা শত্রুদের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে তা উদ্ধারের জন্য সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ফলে রোমান সৈনিকরা তাদের প্রতি আক্রমণের তীব্রতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু পেছন দিকের প্রবেশপথ দিয়ে গলরা ঢুকে পড়ে। তবে ছাউনির ভেতরে থাকা ইতালিয়ান মিত্রদের দৃঢ়তায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। রোমান বাহিনী গলদের শিবিরে পাল্টা আক্রমণ করলেও অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে তারাও পিছিয়ে আসে। সবমিলিয়ে ১১,০০০ গল ও ৫,০০০ রোমান এই সংঘর্ষে প্রাণ হারায়। যদিও এর ফলে কোনো পক্ষই কিছু অর্জন করতে পারেনি।
মিউটিনার যুদ্ধ (১৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
বইদের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে লিগুরিয়ানরা পিসা অবরোধ করলে কন্সাল থারমাস তাদের বাধা দিতে অগ্রসর হলেন। অপর কন্সাল মেরুলা বইদের এলাকাতে প্রবেশ করলে তারা মিউটিনার কাছে এক গিরিখাতে ফাঁদ পাতে। সৌভাগ্যক্রমে রোমান অশ্বারোহীদের চোখে তা ধরা পড়ে গেলে মেরুলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেন। গিরিখাতের সংকীর্ণতা বিবেচনা করে তিনি সেনাদলের বাম বাহুকে মাঠে নামিয়ে ডান বাহু রিজার্ভে রাখলেন। কিন্তু গলদের প্রবল চাপে রোমান ব্যুহ ভেঙে পড়ার উপক্রম দেখে দ্রুত তিনি ডান বাহুকে কাজে লাগান। নতুন করে শক্তিশালী হয়ে রোমান সেনারা বিপুল বিক্রমে গলদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর সাথে অশ্বারোহী ও ইতালিয়ান মিত্রদের আঘাত গল সেনাবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ১৪,০০০ এর মতো শত্রুসেনা নিহত হয়, বহু সেনা অস্ত্রসমর্পণ করে। রোমের ক্ষতিও কম ছিল না, ৫,০০০ এর অধিক সেনা তারা হারায়।
সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের সমাপ্তি
১৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কন্সাল সিপিও ন্যাসিকা বই জাতির ৫০,০০০ এর একটি বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ২৮,০০০ গল সেনা হতাহত হয়। বলা হয়- এরপর বৃদ্ধ ও বালক ছাড়া রোমের সাথে লড়াই করার মতো বইদের আর কেউ অবশিষ্ট ছিল না। প্রায় ১১ বছর নিরন্তর অভিযানের পর শেষ পর্যন্ত গল অঞ্চলে রোমের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। এরপরেও রোম কিছু বিচ্ছিন্ন অভিযান পরিচালনা করে, তবে ব্যাপকভাবে রোমের বিরুদ্ধে গল জাতির প্রতিরোধের এখানেই সমাপ্তি হয়।
পরবর্তী ঘটনাক্রম
পরবর্তী বছরগুলোতে রোম গল অঞ্চলে তার উপস্থিতি সুরক্ষিত করার নানা আয়োজন করে। এই লক্ষেই রোমান সেনাদলের চলাচলের সুবিধার্থে রোম আর আরমিনিয়ামকে যুক্ত করে ভিয়া ফ্ল্যামিনিয়া নামে একটি রাস্তা নির্মাণ করা হয়, যা সম্পন্ন হয় ১৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পরে এই রাস্তা প্ল্যাসেনশিয়া পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। বর্ধিতাংশের নামকরণ করা হয় ভিয়া অ্যামিলিয়া। একইভাবে ১৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরেকটি রাস্তা রোম থেকে ইট্রুরিয়া হয়ে পো নদির অববাহিকাতে এসে পৌঁছে, এর নাম ভিয়া ক্যাসিয়া। এসব রাস্তা সুরক্ষিত রাখতে রোম বেশ কিছু দুর্গ স্থাপন করে।
এছাড়াও গল অঞ্চলে ল্যাটিনাইজেশনের পথ প্রশস্ত করার তাগিদে নতুন নতুন রোমান কলোনি স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ১৮৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্থাপিত বনোনিয়া আর ১৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্থাপিত অ্যাকুইলিয়া উল্লেখযোগ্য। এ দুটি ছিল ল্যাটিন কলোনি, যেখানে রোমের ল্যাটিন মিত্রদের লোকজন এসে বসতি করেছিল। শুধুমাত্র রোমান কলোনি স্থাপিত হয় পারমা ও মিউটিনাতে, ১৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
লিগুরিয়া দখল
বারংবার সামরিক অভিযান চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম লিগুরিয়ার বিভিন্ন গোত্রকে নিজের অধীনে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। এসময় রোমের সীমানা দক্ষিণ গল ছাড়িয়ে ম্যাসালিয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। পিসা (১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও লুনাতে (১৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রতিষ্ঠিত হয় রোমান কলোনি। বলা যায়, এই সময়ে পুরো ইতালিতে রোম ছাড়া আর কোনো শক্তি ছিল না।