১৯৩৯ সাল, শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই সময় ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসনে ছিলেন রাজা পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় সন্তান ষষ্ঠ জর্জ। রাজা ষষ্ঠ জর্জের পরিবারে ছিলেন তার স্ত্রী এলিজাবেথ ও তাদের ফুটফুটে দু’টি কন্যা সন্তান, দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও মার্গারেট। যুদ্ধের প্রাক্কালে রাজকন্যা এলিজাবেথের বয়স ছিল ১৪ বছর। যুদ্ধের সময় সকলেই জীবন নিয়ে এদিক-সেদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছে আর কিছুদিন বেঁচে থাকার তাগিদ ও এত নির্মম মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করার প্রয়াস নিয়ে। এমন সময় ডৌগলাস হগ, যিনি কিনা বহু বছর যাবত ব্রিটেনের রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ ছিলেন; অবসর নেওয়ার পরেও সবাই তাকে বেশ মান্য করত। তৎকালীন রানী এলিজাবেথকে তিনি বললেন, মেয়েদেরকে কানাডায় পাঠিতে দিতে যেন তারা যুদ্ধের নৃশংসতা থেকে দূরে থাকতে পারে। কিন্তু রানী এই প্রস্তাব নাকচ করেন।
বলেন,
“আমার মেয়েরা আমাকে ছাড়া কোথাও যাবে না। আর আমি রাজাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। রাজা এই দুর্দিনে প্রজাদের ছেড়ে একচুলও নড়বেন না।”
ইংল্যান্ডের রাজপরিবার থেকে গেলো সেখানে। হয়তো এখান থেকেই রাজকন্যা এলিজাবেথ ও মার্গারেটের মনে রাজ্য ও প্রজাদের প্রতি ভালোবাসার বীজ বপন হয়েছিল। ইংল্যান্ডের এই দুর্দিনে রাজপরিবার ব্রিটিশদের সাথে থেকে তো গেলো, কিন্তু তাদের রাজপ্রাসাদে থাকা সম্ভব হলো না। স্কটিশ হাইল্যান্ডসের বালমারো রাজ্য বরাবরই রাজপরিবারের এক বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছে। এবারও এটি তার ঐতিহ্য ধরে রাখলো। রাজার পরিবারকে আগলে রাখল এই রাজ্য। বড়দিন পর্যন্ত রাজকন্যাদ্বয় আত্মগোপন করলো এখানে।
ব্রিটিশ সেনারা বালমারো রাজ্যে ছড়িয়ে গেলে ষষ্ঠ জর্জ পরিবার নরফোকের স্যান্ড্রিনঘাম হাউজে আত্মগোপন করে। যুদ্ধ আরও জোরালো হলে রাজকন্যা এলিজাবেথ ও মারগারেট স্যান্ড্রিনঘাম হাউজ থেকে দক্ষিণের উইন্ডসোরের রাজ প্রাসাদে পালিয়ে যান। এবং যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করেন।
বালমারোতে থাকাকালীন রাজকন্যা এলিজাবেথ যুদ্ধে আহত, পরিবারহারা ও বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়া ব্রিটিশদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন,
“আমি তোমাদের সাহস ও একাগ্রতার প্রশংসা করি। কিন্তু আমাদেরকে আরও শক্ত হতে হবে, আশাবাদী থাকতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, ইংল্যান্ডে আবার শান্তি ফিরে আসবে। মনে রাখবে, শান্তি যদি আসে, তাহলে সেটা আমরাই ফিরিয়ে আনতে পারবো। কারণ আজকের শিশুর আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।”
বিবিসির রেডিও প্রোগ্রাম, চিল্ড্রেন’স আওয়ার রাজকন্যা এলিজাবেথের এই ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করে। এটি ছিল তার প্রথম জনসম্মুখে আসা, প্রথম জাতির উদ্দেশে কিছু বলা।
১৯৪০ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রকোপ আরো বেড়ে যায়। ফলে উইন্ডসোর প্রাসাদের ভেতরে একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করতে লাগলো, কারণ রাজকন্যারা বুঝতে পেরেছেন, জাতি ভেঙে পড়ছে। এবার পরাজয় নিশ্চিত! এভাবে তো পরাজয় মেনে নেওয়া যায় না, তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, ইংল্যান্ডবাসীকে আবার জাগিয়ে তুলতে তারা মূকাভিনয় করবেন এবং তার মাধ্যমে জাগিয়ে রাখবেন নিজস্ব চেতনা। প্রথম মূকাভিনয়ে তারা বেশ সফল হন, অনেক টাকা উপার্জনও করেন। রাজপরিবারের এই দুই মহীয়সী নারী সিদ্ধান্ত নেন, তারা এই টাকা কুইন’স ঊল ফান্ডে জমা করবেন এবং সেনাবাহিনীদের নতুন পোশাক বানিয়ে দিবেন। মূকাভিনয়ের কার্যক্রমটা এত কার্যকর ছিল যে যুদ্ধ চলাকালীন প্রতি বছর তারা এটা করে গেছেন।
যুদ্ধের সময় এভাবেই কেটে যাচ্ছিল রাজপরিবারের দিন। সময়গুলো নিয়ে অভিযোগ ছিল না তাদের, কিন্তু ১৯৪২ সালে ঘটলো এক বিপত্তি। রাজা ষষ্ঠ জর্জের ভাই, কেন্টের ডিউক, প্রিন্স জর্জ ছিলেন রয়্যাল এয়ার ফোর্সের একজন সদস্য, যিনি বিমান নিয়ে একা একটি গোপন মিশনে যাত্রা করেন। দুর্ভাগ্যবশত, ২৫ আগস্ট স্কটল্যান্ডের কেথনেসের পাহাড়ি এলাকায় প্লেন ক্র্যাশ করে মারা যান উনি। প্রিন্স জর্জ ছিলেন রাজকন্যা এলিজাবেথের প্রিয় চাচা, তাই তার মৃত্যুতে রাজকন্যা গভীরভাবে শোকাহত হয়ে পড়েন এবং যুদ্ধে পরিবার হারানো ব্রিটিশদের কষ্ট আরও ভালো করে অনুভব করতে পারেন। এক বছর পর, ১৯৪৩ সাল, ২য় এলিজাবেথ আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি সেনাবাহিনীর গ্রেনেডিয়ার গার্ডদের তদারকি করেন যারা ইতোমধ্যে যুদ্ধে বেশ ভালো একটা ভূমিকা রেখেছে। ভবিষ্যতে যেন তারা আরও ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন, সেই লক্ষ্যেই রাজকন্যা এদের নিরীক্ষায় রাখেন। রানী এলিজাবেথ ও তার কন্যাদ্বয়ের এই তৎপরতা সেনাসদস্যদের আরও বেশি চাঙ্গা করে তোলে।
১৯৪৫ সাল, রাজকন্যা এলিজাবেথের বয়স যখন ১৮, তখন তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন সেনাবাহিনীতে যোগদান করার। কিন্তু রাজা ষষ্ঠ জর্জ ঘোষণা করলেন, “রাজকন্যা এলিজাবেথ এখন রানী হওয়ার জন্য শিক্ষা নিতে শুরু করবেন। তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করবেন না।” কিন্তু রাজকন্যার মনে ছিল প্রবল দেশপ্রেম, দেশের সেবা করার দৃঢ় ইচ্ছা, তাই তিনি রানী হওয়ার শিক্ষা নিতে নাকচ করেন এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নারী শাখায় যোগদান করেন, যেটি উইমেন’স অক্সিলারি টেরিটোরিয়াল সার্ভিস নামে পরিচিত। তিনিই রাজপরিবারের প্রথম মেয়ে, যিনি পুরোপুরিভাবে সেনাবাহিনী দলের সাথে যুক্ত হয়েছেন। ফ্রান্সের বিভিন্ন এলাকা, বাসা এবং নানান দুঃস্থ এলাকায় কাজ করা ছাড়াও এরা যুদ্ধে পরোক্ষভাবে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যেমন: রেডিও অপারেশন, ড্রাইভিং, বিমানবাহিনীর বন্দুক ও স্পটলাইট তৈরি- এসব কাজ করত এই শাখাটি। কিন্তু কখনও এদেরকে যুদ্ধের ময়দানে প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের পারদর্শিতা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। তবে রাজকন্যা এলিজাবেথ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নারী শাখায় যুক্ত হওয়ার পূর্বে রানী এলিজাবেথ উইমেন’স রয়্যাল নেভাল সার্ভিস, উইমেন’স অক্সিলারি এয়ার ফোর্স ও উইমেন’স অক্সিলারি টেরিটোরিয়াল সার্ভিসের কম্যান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে কাজ করেছেন।
উইমেন’স অক্সিলারি টেরিটোরিয়াল সার্ভিসে যোগদান করে এলিজাবেথ ম্যাপ দেখা শেখেন এবং একজন ট্রাক-চালক ও মেকানিক হিসেবে কাজ করেন। এখান থেকেই ড্রাইভিংয়ের প্রতি তার বিশেষ ভালোলাগা তৈরি হয় এবং অনেক বয়স পর্যন্ত তিনি অনায়াসে স্কটল্যান্ডের এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে গেছেন।
রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে সেনাবাহিনী প্রশিক্ষনে বিশেষ কোনো সুবিধা পাননি এলিজাবেথ। তবে তার ঘুমানোর ব্যবস্থা ছিল সবার চেয়ে ভিন্ন, রাজকীয়। তিনি সকলের সাথে সেনাবাহিনী ক্যাম্পে ঘুমাতেন না বরং তার উইন্ডসোর রাজপ্রাসাদে ঘুমাতেন। এছাড়া আর কোনো সুযোগ-সুবিধা পান নি এই ব্রিটিশ রাজকন্যা। সকল নবীন সেনার মতো করেই তিনি প্রশিক্ষণ পান সেনাবাহিনী ক্যাম্পে। ধীরে ধীরে তার দক্ষতা ও পারদর্শিতার কারণে তিনি জুনিয়র কম্যান্ডারের পদটা অর্জন করে নেন।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করতে গিয়ে এলিজাবেথ জানতে পেরেছেন, সেনাবাহিনীদের জীবন কতটা কণ্টকাকীর্ণ এবং রাজপরিবারের সাথে দেখা করার পূর্বে তাদের কত প্রস্তুতি নিতে হয়। এই প্রশিক্ষণ চলাকালে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কেও অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
১৯৫২ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা যাওয়ার পর সিংহাসনে বসেন এলিজাবেথ। বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক রাজ-সন্তান হিসেবে এখনও তিনি শাসন করে চলেছেন রাজ্য।