আপনি কি জানেন, টিনের ক্যান আবিষ্কৃত হয়েছিলো ১৮১০ সালে; কিন্তু টিন-ক্যান খোলার ক্যান-ওপেনার আবিষ্কার হয়েছিলো ১৮৫৮ সালে! জেনে হয়তো অবাক হবেন, ই-বুকের ব্যাপারটিও প্রায় একই। ই-বুক রিডার আবিষ্কার হবার অনেক আগেই, প্রায় ৩০ বছর আগে ই-বুক আবিষ্কার হয়েছিলো। চলুন আজ ই-বুক আবিষ্কারের ইতিহাসটি জানা যাক।
১৯৭১ সালের দিকের কথা। মাইকেল হার্ট ছিলেন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। তিনি আজীবন ছিলেন বিভিন্ন যন্ত্র ও এদের কার্যপ্রণালীর প্রতি উৎসুক একজন ব্যক্তি। তিনি এতটাই দক্ষ ছিলেন যে, ৭ বছর বয়সেই টেলিভিশন এবং রেডিও খুলে দেখতেন সেগুলো ঠিক কীভাবে কাজ করে। পুনরায় সেগুলো ঠিকঠাক জোড়া লাগাতেও পারতেন।
এক গ্রীষ্মে তার দুজন বন্ধু তাকে একটি যন্ত্রের কাছাকাছি আসার ব্যবস্থা করে দেন, যেটি ছিলো তার এ পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে জটিল যন্ত্র। সেটি ছিলো জেরক্স সিগমা ৫ মেইনফ্রেম কম্পিউটার। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ল্যাবের একটি অংশ ছিলো কম্পিউটারটি। কম্পিউটারটি দেশের অন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সামরিক বাহিনীর প্রায় ১০০টি কম্পিউটারের সাথে যুক্ত ছিলো। যে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেগুলো যুক্ত ছিলো তার নাম হলো ARPANET (Advanced Research Projects Agency Network)। একে বলা যেতে পারে বর্তমান ইন্টারনেটের পূর্বপুরুষ।
যন্ত্রটি চোখের সামনে দেখলেও তা নিজের হাতে পরখ করে দেখার সুযোগ পান সে বছর জুলাইয়ের ৪ তারিখে। সে সময়ে সেই কম্পিউটারের অধিকাংশ ব্যবহারকারী কম্পিউটারটির বিভিন্ন প্রোগ্রাম লিখতে ব্যস্ত থাকত। কিন্তু হার্ট কম্পিউটারটি ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে এতটাই চমকপ্রদ হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি আর সকলের মতো প্রোগ্রাম লিখতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন ব্যতিক্রমী কিছু তৈরি করতে। কিন্তু সেটি কী, তখন তা তিনি নিজেও জানতেন না।
তবে তিনি তার উত্তর পেয়ে গেলেন একটু পরেই। কিছু খাওয়ার জন্য তিনি যখন নিজের ব্যাগের ভেতর হাত রাখলেন, কিছু স্ন্যাকসের সাথে তিনি এক কপি ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পান। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,
“আমার মাথায় তখন যেন বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠলো! আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম এমন কোনো কিছু করতে পারি কিনা, যা কম্পিউটারটিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র টাইপ করার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে এবং যা ১০০ বছর পরেও থেকে যাবে। কিন্তু আমার মাথায় তখন কিছুই আসছিলো না।”
তিনি সে সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পুরো ১,৪৫৮ শব্দই সেই মেইনফ্রেম কম্পিউটারে নিজের হাতে টাইপ করে লিখেছিলেন।
শুনে হয়তো মনে হতে পারে, ১,৪৫৮টি শব্দ টাইপ করে একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে মেইনফ্রেম কম্পিউটারে রাখা এ আর এমন কী! তবে তৎকালীন তথাকথিত সুপার কম্পিউটার জেরক্স সিগমা ৫ কিন্তু মোটেও বর্তমান কম্পিউটারগুলো ব্যবহার করার মতো এতটা সহজ ছিলো না।
মেইনফ্রেম কম্পিউটারটির দাম ছিলো তখন প্রায় ৩ লক্ষ মার্কিন ডলার, যার হার্ডড্রাইভ ছিলো মোটে ৩ মেগাবাইট! এবং যা একটি পুরো ঘর দখল করে থাকতো। কিন্তু এর ছিলো না কোনো পর্দা বা কিবোর্ড। হার্টকে টাইপ করার জন্য টেলিটাইপ নামের অন্য আরেকটি যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছিলো। যন্ত্রটি মূলত ব্যবহার করা হতো টাইপকৃত লেখা টেলিগ্রাফ লাইনের মাধ্যমে কোথাও প্রেরণ করতে, যাতে টেলিগ্রাফ অপারেটরদের মোর্স কোড শেখা না লাগে।
টেলিটাইপ যন্ত্রটি হার্টের টাইপ করা লেখাটি কম্পিউটার কোডে রূপান্তরিত করেছিলো একটি কাগজের রিবনে ছিদ্র করার মাধ্যমে, যে কোডটি পরবর্তীতে হার্ট সেই মেইনফ্রেম কম্পিউটারে প্রদান করেছিলেন। আর যেহেতু সে সময়ে কম্পিউটারগুলো ছোট হাতের বা বড় হাতের লেখা নিজ থেকে অনুধাবন করতে পারতো না, সেহেতু হার্টকে পুরো ঘোষণাপত্র বড় হাতের অক্ষরেই লিখতে হয়েছিলো।
তার কাজ যখন শেষ হলো তখন দেখা গেলো ডকুমেন্টটির আকার হয়েছে ৫ কিলোবাইট, যা বর্তমান মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের একটি ফাঁকা পাতার আকারের প্রায় ৬ গুণ বড় ছিলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তার এই ডকুমেন্টটি নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকা অন্য সকল কম্পিউটারে প্রেরণ করবেন। কিন্তু তার একজন সহকর্মী তাকে বাধা দিলেন। বললেন, এত বড় একটি ডকুমেন্ট যদি প্রেরণ করা হয়, তাহলে পুরো ARPANET ক্র্যাশ করতে পারে। এজন্য হার্ট যা করলেন তা হলো, তিনি সকল ব্যবহারকারীর উদ্দেশ্যে একটি নোটিশ প্রেরণ করে বললেন, তার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ইলেকট্রনিক ভার্সন, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ই-বুক, সিস্টেমের ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে। যদি কারো প্রয়োজন পড়ে, তাহলে সিস্টেমে সংরক্ষণ করে রাখা ডকুমেন্টটি যেকোনো ব্যবহারকারী দেখে নিতে পারবেন। ৬ জন ব্যবহারকারী সেসময়ে ডকুমেন্টটি ব্যবহার করেছিলো।
হার্টকে অনেক কাজই করতে হয়েছিলো ডকুমেন্টটি টাইপ করে মেইনফ্রেম কম্পিউটারটিতে সংরক্ষণ করতে। তার কাজ যখন শেষ হলো, হার্ট বুঝতে পারলেন যে, তার ই-বুক ভার্সনটি যুগ যুগ ধরে সেখানে রাখা যাবে। এমনকি চাইলে শতাব্দী অব্দিও। কারণ এটি রাখতে ব্যবহার করা হয়েছিলো ASCII (American Standard Code for Information Interchange), যা সেসময়ের শতকরা ৯৯ ভাগ কম্পিউটারই চিনতে সক্ষম ছিলো।
প্রায় অর্ধশত বছর পরে বর্তমানের প্রায় সকল কম্পিউটারও ASCII কোড চিনতে সক্ষম। অর্থাৎ হার্টের তৈরি করা সেই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ই-বুক তখন যেমন পড়া যেত, এখনকার কম্পিউটারের মাধ্যমেও তা পড়া সম্ভব। তবে হার্টের সেই ডকুমেন্টটি পরবর্তীতে পুনরায় টাইপ করা হয়েছে বড় হাতের এবং ছোট হাতের লেখা ঠিকঠাক করে, যাতে তা পড়ার জন্য সুবিধাজনক হয়।
তবে হার্ট শুধু একটি ই-বুক তৈরি করেই থেমে যাননি। ১৯৭২ সালে তিনি ‘বিল অফ রাইটস’ এর একটি ই-বুক ভার্সন টাইপ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের বাকিটুকু টাইপ করেন। ১৯৭৪ সালের দিকে তিনি কিং জেমস বাইবেলের বিভিন্ন বইয়ের উপর কাজ করা শুরু করেন, যেগুলো একটি ফ্লপি ডিস্কে সংরক্ষিত করা যেত। তবে হার্ট সেসময়ে ঐতিহাসিক সব লেখা এবং যেগুলো একটি ফ্লপি ডিস্কে রাখা যাবে এরকম ছোট ছোট লেখাতেই আটকে ছিলেন। কারণ সেগুলো টাইপ করা সহজ ছিলো এবং সেসময়ে এক কম্পিউটার থেকে আরেক কম্পিউটারে তথ্য প্রেরণের একমাত্র উপায় ছিলো সেই ফ্লপি ডিস্কগুলো।
হার্ট তার ই-বুকের ডকুমেন্টগুলোর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রজেক্ট গুটেনবার্গ’, যা হচ্ছে জোহানেস গুটেনবার্গের নামে। এই জার্মান ব্যক্তি ১৪৫০ সালে বিশ্বের প্রথম বহন করা যায়, এমন টাইপ করার প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কার করেছিলেন। গুটেনবার্গের প্রেস বইয়ের মূল্যহ্রাস এবং তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেয়ার দিক দিয়ে একধরনের বিপ্লব সাধন করেছিলো। হার্টেরও ঠিক একই উদ্দেশ্য ছিলো। তিনি চেয়েছিলেন কেউ যাতে খুব কম খরচে বা কোনো খরচ বাদেই ই-বুকের মাধ্যমে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বই পেতে পারে।
আর ঠিক এভাবেই ২০ বছর ধরে প্রজেক্ট গুটেনবার্গের উন্নয়ন সাধিত হয়েছিলো। প্রথমদিকে হার্ট একাই তার অবসর সময়ে বিভিন্ন ই-বুক তৈরি করতেন নিজ হাতে টাইপ করে। এজন্য ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত লেগে গিয়েছিলো তার কিং জেমস বাইবেলের সকল বইয়ের ই-বুক তৈরি করতে। ১৯৯১ সালে তিনি Alice’s Adventures in Wonderland এর ই-বুক বের করেন, যা ছিলো প্রজেক্ট গুটেনবার্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় ই-বুক। কারণ এটি ছিলো প্রথম কোনো সাহিত্যের বই, যা আসলেই পাঠকেরা পড়তে চেয়েছিলো।
বইটির সাফল্যের পর হার্ট আরো বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন সাহিত্যের বইয়ের ই-বুক প্রকাশের দিকে। তিনি তার সকল ই-বুক প্রকাশ করতেন পাবলিক ডোমেইন থেকে। অর্থাৎ এমন বই, যেগুলোর কপিরাইট স্বত্ত্ব ইতোমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। তাই সেগুলো যদি পাবলিক ডোমেইনে না রাখা হতো, তাহলে তা লেখক বা প্রকাশকের অনুমতি ব্যতীত প্রকাশ এবং বিতরণ করা বেআইনি হয়ে যেত হার্টের জন্য।
এভাবে প্রায় ১৮ বছর ধরে ধীরে ধীরে প্রজেক্ট গুটেনবার্গের কাজ চলতে থাকে। তবে ১৯৮০ সালের পরে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এই প্রজেক্টের পালে হাওয়া লাগে। বিভিন্ন ডকুমেন্ট স্ক্যানার এবং অক্ষর চেনার যন্ত্র বা OCR সফটওয়্যার আবিষ্কার হওয়ার পর কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। এতে করে যেকোনো বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো সহজেই কম্পিউটারে স্ক্যান করে প্রদান করা যেত, হাতে টাইপ করার দরকারই পড়তো না। ১৯৯০ সালের মাঝের দিকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (WWW) জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে হার্টের জন্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করাও সহজ হয়ে গেলো। তারা নিজেরা বিভিন্ন ই-বুক সংযুক্ত করতে লাগলেন প্রজেক্টে।
প্রজেক্ট গুটেনবার্গের প্রথম ১০টি বই তৈরি করতে হার্টের লেগেছিলো ১৮ বছর। কে জানতো প্রযুক্তির উন্নয়ন এতটা বদলে দিবে সবকিছু! ফলে ১৯৯১ সালে তিনি প্রতি মাসে একটি নতুন ই-বুক এবং প্রতি বছরে তার ই-বুকের উৎপাদন মাত্রা পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেন। তিনি তার উভয় লক্ষ্যমাত্রাতেই পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এরপর থেকে ১৯৯২ সালে প্রতিমাসে প্রজেক্ট গুটেনবার্গে দুটি করে, ১৯৯৩ সালে চারটি এবং ১৯৯৪ সালে আটটি করে বই সংযুক্ত হচ্ছিলো। এধরনের কাজে পরিচালনা করতে অবশ্যই টাকার প্রয়োজন ছিলো এবং হার্ট ১৯৯৩ সালেই সর্বপ্রথম যথেষ্ট পরিমাণ টাকা বিভিন্ন অনুদান থেকে পেয়ে যান তার সকল কাজ পরিচালনা করার জন্য। এর পূর্বে তার নিজের পকেট থেকে প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়েছিলো। তার মতে, তিনি প্রায় ১ লক্ষ মার্কিন ডলার নিজ থেকে খরচ করেছেন এই প্রজেক্টে!
প্রজেক্ট গুটেনবার্গ তার উৎপাদন মাত্রা দ্বিগুণ করে ফেলে ১৯৯৫ সালে, মাসে ১৬টি ই-বুক প্রকাশের মাধ্যমে। তারপর সেটি ১৯৯৬ সালে প্রতি মাসে ৩২টি বইয়ে এসে দাঁড়ায়। পরবর্তী এক যুগ ধরে এই উৎপাদন মাত্রা অক্ষুণ্ণ ছিলো। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে হার্ট ও তার স্বেচ্ছাসেবকেরা মিলে প্রজেক্ট গুটেনবার্গে ৩,০০০ এর অধিক ই-বুক সংরক্ষণ করে ফেলেন। এরপর প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে প্রজেক্ট গুটেনবার্গের উৎপাদনমাত্রা আরো বাড়তে থাকে। ২০০৪ সালের দিকে এই প্রজেক্টে প্রতিমাসে ৩৩৮টি করে ই-বুক প্রকাশিত হচ্ছিলো, অর্থাৎ দিনে ১০টিরও বেশি।
মাইকেল হার্টের আশা ছিলো, তার অনুপস্থিতিতেও যেন তার প্রজেক্ট গুটেনবার্গ চলতে থাকে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৬৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তিনি যেমনটা আশা করেছিলেন, তার প্রজেক্ট গুটেনবার্গ এখনো তেমন বহাল তবিয়তেই রয়েছে। বর্তমানে সেখানে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বিভিন্ন ভাষার, যেমন- চীনা, সংস্কৃত, প্রাচীন হিব্রু, মাউরি, এসপেরান্তো ইত্যাদির ই-বুক রয়েছে, যা যে কেউ ডাউনলোড করে পড়তে পারবে বিনামূল্যে।
প্রজেক্ট গুটেনবার্গ ছিলো প্রথমে একটিমাত্র মানুষের স্বপ্ন। বর্তমানে এটি ছাড়া এখন ইন্টারনেট কল্পনাই করা যায় না। প্রজেক্ট গুটেনবার্গের পরবর্তী যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে তা হলো ১০০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষার প্রায় ১০ লক্ষ বইয়ের ই-বুক ভার্সন তৈরি করা। অর্থাৎ পুরো এক বিলিয়ন বই! আশা করা যায়, তারা খুব শীঘ্রই এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে যাবেন।
ফিচার ইমেজ: kompasiana.com