চেচনিয়ার নাম সবাই জানে। নব্বইয়ের দশকের দুটো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, বেসলান স্কুল সংকট বা মস্কো থিয়েটারের সেই জিম্মি সংকট; সংবাদমাধ্যমকে খোরাক জোগাতে চেচনিয়া কখনোই কার্পণ্য করেনি। আধুনিক রুশ ফেডারেশনের এক অন্যতম সমস্যা হচ্ছে এই চেচনিয়া। বারংবার রুশীদের সাথে চেচেনদের যুদ্ধ বেঁধেছে, দুই পক্ষই মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে বিস্তর। আজ আলোচনা হবে নব্বইয়ের দশকের এই উত্তংগ যুদ্ধ নিয়ে।
পূর্বকথা
চেচনিয়া রাশিয়ার ককেশাস অঞ্চলের একটি অংশ। এর পার্শ্ববর্তী আরো দুটি প্রজাতন্ত্র হলো ইঙ্গুশেতিয়া আর দাগেস্তান। দাগেস্তানে নানা জাতির বাস। চেচেন আর ইঙ্গুশরা বাকি অঞ্চলে বাস করে। অতীতে তারা নাখ নামক গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উত্তর ককেশাসের এই প্রজাতন্ত্রগুলোর বেশিরভাগ মানুষ ধর্মে সুন্নি মুসলিম।
তেল সমৃদ্ধ ককেশাস নিয়ে সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে লড়েছে পারস্য, রাশিয়া আর অটোমান তুরস্ক। চেচেনরা বরাবরই নিজেদের সুবিধামতো কোনো একটা পক্ষ নিয়ে লড়াই করেছে, তবে রুশরা ছিল তাদের জাতশত্রু। ককেশাস অঞ্চলে এমন হাড্ডাহাড্ডি শত্রুতা নতুন কিছু না। রুশ বাদেও চেচেনরা নিজেদের প্রতিবেশী ওসেত কিংবা জর্জীয়দের দেখতে পারে না। বহু শত বছর ধরেই এই অঞ্চলটিতে এমন জাতিগত বিরোধ চলে আসছে।
১৯১৭ এর বলশেভিক আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্য দিয়ে চেচেনরা তাদের প্রতিবেশী ইঙ্গুশ আর দাগেস্তানের অন্যান্য জাতিগুলোর সাথে মিলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে, তাদেরকে সহায়তা করছিল জার আমলের সেনাদল। ১৯২১ সাল নাগাদ বলশেভিকেরা গোটা অঞ্চলটাকে রাশিয়ার সাথে জুড়ে নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে চেচনিয়াকে স্বায়ত্ত্বশাসনের কিছু সুবিধা দেওয়া হয়, শিক্ষা-দীক্ষার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানও বাড়ে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বহু চেচেন আর ইঙ্গুশ যোদ্ধা বীরত্ব দেখিয়েছিলেন সোভিয়েতদের পক্ষে। অথচ ১৯৪৪ সালে তাদেরকে লাখে লাখে জবরদস্তি করে পাঠানো হয় কাজাখস্তানে। সেখানে বহু লোক মারা পড়ে।
কেন সোভিয়েতরা চেচেন আর ইঙ্গুশদেরকে সরিয়ে নিচ্ছিল তা নিয়ে নানা মতবাদ আছে। বহুল প্রচলিতটি হচ্ছে, স্ট্যালিন তুরস্কে অভিযান চালাতে ইচ্ছুক ছিলেন। মুসলিম ককেশীয়দের ওপরে ভরসা করতে না পারার কারণেই তাদেরকে এভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া যুদ্ধের সময় কিছু চেচেন সোভিয়েতবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত ছিল। পরে খ্রুশ্চেভের আমলে অধিকাংশ চেচেন ফেরত আসেন। এখান থেকেই শুরু হয় অভিবাসী রুশদের সাথে চেচেনদের গোলমাল। ককেশাসে রুশ ভাষার প্রাধান্য বিস্তার, রুশীদের জমিজমা বৃদ্ধি- এগুলো চেচেন বা ইংগুশ জনগণ ভালভাবে নেয়নি। ষাটের দশকে দুই পক্ষের মধ্যে এসব নিয়ে কয়েক দফা ভয়াবহ দাঙ্গা হয়।
প্রথম চেচেন যুদ্ধ
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে চেচেনরা তাদের নেতা প্রাক্তন সোভিয়েত জেনারেল ঝোখার দুদায়েভের নেতৃত্বে একটি প্রায় স্বাধীন অঞ্চল গঠন করে। নাম দেওয়া হয় চেচেন রিপাবলিক অব ইচকেরিয়া। রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলতসিন তখন পার্লামেন্টে নিজের ক্ষমতা সংহত করা নিয়েই ব্যস্ত। এদিকে ‘স্বাধীন’ চেচনিয়াতে মানুষ দুদায়েভের শাসনে মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না। দুদায়েভের অত্যাচারে বহু রুশ আর চেচেন পালিয়ে যায়, এদের অনেকেই রুশ সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে দুদায়েভকে হটানোর জন্য। দুদায়েভের শাসনামলে রাজধানী গ্রোজনী হয়ে ওঠে যতসব দাগী সন্ত্রাসী, জঙ্গী, অস্ত্র আর মাদক চোরাকারবারীদের আড্ডা। ইংগুশরা দুদায়েভের শাসনে বিরক্ত হয়ে ১৯৯২ সালে আলাদা প্রজাতন্ত্র গঠন করে।
চেচনিয়া আর রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর মধ্যে টুকটাক সংঘর্ষ লেগেই ছিল। দুদায়েভের বাহিনী প্রায় সবগুলোতেই রুশদের পরাস্ত করে। যা-ই হোক, দুদায়েভের বিরোধীদের সাহায্য করবার জন্য ১৯৯৪ এর ১১ ডিসেম্বর রুশ বাহিনী গ্রোজনী অভিমুখে হামলা চালায়। চেচনরা কিন্তু রুশদেরকে দারুণ পর্যদুস্ত করতে থাকে। শামিল বাসায়েভ আর সৌদি জঙ্গী ইবন আল খতিবের নেতৃত্বে বহু তুর্কি, আফগান, চেচেন যোদ্ধা রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। জাতিগত বিরোধ থেকে যুদ্ধটা ক্রমেই ধর্মীয় দিকে মোড় নিতে থাকে নব্য মৌলবাদীদের হাতে। দুদায়েভ আফগান যুদ্ধের সময় বিমান বাহিনীর পাইলট হিসেবে বহু বোমা ফেলেছেন। চেচেনদের একটা বড় অংশ তাকে পরিত্যাগ করে কট্টর মৌলবাদীদের সাথে হাত মেলাতে থাকে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রুশ বাহিনীতে চরম বিশৃংখলা দেখা দেয়। চেচনিয়ার মতো পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধের জন্য রুশেরা শুরুতে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। টি-৮০ ট্যাংকের বিশাল বহর নিয়ে গ্রোজনীতে ঢুকতে গিয়ে রুশেরা কাতারে কাতারে মরতে থাকে। মাতাল, উচ্ছৃঙ্খল রুশ সেনাদের হাতে বহু নিরপরাধ চেচেন নারী ধর্ষিত হয়, সংঘটিত হয় অনেকগুলো গণহত্যা। এদিকে গ্রোজনীতে রুশেরা আক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে থাকে। বিমান আর গোলন্দাজ বাহিনী শহরটাকে একদম মিশিয়ে দেয় বলা চলে। রুশেরা অল্প কিছুকালের জন্য গ্রোজনী দখল করতে পারলেও ১৯৯৫ এর মার্চ-এপ্রিল নাগাদ আবার গ্রোজনী চেচেনদের হাতে চলে যায়।
হাজার হাজার সৈন্যের মৃত্যু, রুশ ফেডারেশনের আর্থিক বিশৃংখলা, ইয়েতসিলিনের শাসনের প্রতি অনাস্থা- সব মিলিয়ে ক্রেমলিন একসময় বাধ্য হয় চেচেনদের সাথে একটা বোঝাপড়া করতে। দুদায়েভ ইতোমধ্যে বিমান হামলায় মারা পড়েছেন। গোটা বিশ্ব রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ব্যর্থতা, সাধারণ মানুষের মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে রাশিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে। রাশিয়ার মান সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে যায়। পাঁচ-চৌদ্দ হাজার রুশ সেনা প্রাণ দেয় চেচেন যুদ্ধে, আহত হয় আরো অনেক। বহু সেনা চেচেনদের হাতে বন্দীত্ব বরণ করে। চেচেনদের ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। অন্তত এক লক্ষ মানুষ এই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে, তবে তাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক চেচেন আর ইংগুশ।
চেচেন রিপাবলিক অব ইচকেরিয়া এবং অন্তদ্বর্ন্দ
আসলান মাসখাদভ ছিলেন একজন সোভিয়েত কর্নেল। প্রথম চেচেন যুদ্ধের সময় তিনি দারুণ সামরিক দক্ষতা দেখান। ১৯৯৭ সালে তিনি চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। ওই বছরই রুশ-চেচেন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী রুশেরা চেচেন সরকারকে টুকটাক সাহায্য করতো। তবে মাসখাদভ সুশাসক ছিলেন না। হরদম তার সাথে বিরোধীদের লড়াই লেগে থাকতো। তেল পাচার, অস্ত্র আর মাদকের ব্যবসা, যুদ্ধ আর দুর্নীতিতে ভরপুর সরকার মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। ১৯৯৯ এর শেষদিকে মাসখাদভের বিরোধীরা শরিয়া মোতাবেক একটি রাষ্ট্র গড়বার কথা ঘোষণা করেন। তাদের পরিকল্পনায় ছিল চেচনিয়ার সাথে প্রতিবেশী দাগেস্তান আর ইংগুশেতিয়াকে জুড়ে নেওয়া। শামিল বাসায়েভ ছিলেন এদের অন্যতম নেতা।
দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ
চেচনিয়ার প্রতিবেশী দাগেস্তানে চেচেনরা মাঝেমধ্যে হামলা চালাতো। ১৯৯৯ সালে এক রুশ জেনারেলকে অপহরণ আর খুন করা হলে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। সামিল বাসায়েভ আর ইবন আল খাতাবের নেতৃত্বে একদল কট্টর জঙ্গী দাগেস্তানে হামলা চালালে দুই পক্ষে ভয়ানক লড়াই লাগে। রুশেরা জিতলেও তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে চেচেনদের বোমা হামলায় শ’তিনেক বেসামরিক মানুষ মারা যায়। এসব হামলার প্রতিক্রিয়া হয় ভয়ানক। অক্টোবরে রুশ বাহিনী আবার চেচনিয়াতে প্রবেশ করে। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে গ্রোজনীর পতন হয়। রাশিয়া ২০০২ সাল পর্যন্ত ব্যাপক সামরিক অভিযান চালায়, চেচেন যোদ্ধাদের একেবারে গুড়িয়ে দেওয়া হয়। যদিও রুশেরা এই দফাতেও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলো।
২০০৩ সালে চেচনিয়ার ক্ষমতায় বসেন রুশপন্থী আখমাদ কাদিরভ। বিরোধীরা বার বার আলোচনার জন্য আহ্বান জানালেও এবারে রুশ বাহিনী কোনো ছাড় দেয়নি। ২০০৫ সালে আসলান মাসখাদভকে হত্যা করে রুশ বাহিনী। মাসখাদভের প্রধানমন্ত্রী বাসায়েভ ২০০৬ সালে নিহত হন। এই বাসায়েভই বেসলান স্কুল আর মস্কো থিয়েটারে হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রুশবাহিনী তাকে আবখাজিয়ায় যুদ্ধের সময় নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করেছিল বলে রটনা আছে। ২০০৯ সাল নাগাদ চেচনিয়াতে জঙ্গী তৎপরতা একরকম বন্ধ হয়ে যায়। তবে পাহাড়ে এখনো কিছু জঙ্গী সক্রিয় আছে।
পরিশিষ্ট
দুদায়েভের মৃত্যুর পরে চেচেন যোদ্ধাদের নেতৃত্ব গিয়ে পড়ে মৌলবাদী চেচেনদের হাতে। শামিল বাসায়েভ এবং তাদের সহকারীরা সৌদি ওয়াহাবি মতবাদের ভক্ত ছিলেন। সেই সাথে ছিলেন দারুণ নৃশংস। বাসায়েভ নাকি জর্জিয়া-আবখাজ যুদ্ধের সময় শ’খানেক জর্জীয় সৈন্যের মাথা কেটে তা দিয়ে ফুটবল খেলার আয়োজন করেছিলেন। এছাড়া রাশিয়া জুড়ে অনেকগুলো সন্ত্রাসী হামলা চেচেন মৌলবাদীদের প্রতি রুশ, সাধারণ চেচেন ও বাইরের বিশ্বের মানুষকে বিতৃষ্ণ করে তোলে।
রুশরাও অবশ্য কম অত্যাচার আর হত্যাকান্ড চালায়নি। চেচনিয়ার অধিকাংশ জমি বেশুমার বোমাবর্ষণের কারণে অনুর্বর হয়ে পড়েছে, পৃথিবীর সবথেকে বেশি মাইন উপদ্রুত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি চেচনিয়া। ভয়াল এই যুদ্ধগুলো রাশিয়ার মানুষকে নাকি আরো বেশি উগ্র জাতীয়তাবাদী করে তুলেছে, আর এই সুযোগটাই নিয়ে চলেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। নব্বইয়ের দশকে চেচেন যুদ্ধকে পুরোদমে নিজের পক্ষে ব্যবহার করে এখন তিনি ঝুঁকেছেন পূর্ব ইউরোপের দিকে।
যা-ই হোক, চেচনিয়ার ক্ষমতায় আছেন এখন আখমাদ কাদিরভের ছেলে রমজান কাদিরভ। দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ থাকলেও চেচনিয়াকে নতুন করে গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তিনি। যুদ্ধবিদ্ধস্ত অঞ্চলটি অবশ্য এখনো জঙ্গীদের নাগালে পড়বার আশংকায় আছে। কাজেই চেচনিয়ার শান্তি কতটা টেকসই তা নিয়ে বিতর্ক চলমান।
ফিচার ইমেজ – The Interpreter