হার্ডোনিয়ার প্রথম সংঘর্ষ ও ট্যারেন্টামের যুদ্ধ
আপুলিয়ার হার্ডোনিয়াতে হ্যানিবাল গেনিয়াস ফ্ল্যাকাসের ১২,০০০ সেনার সম্মুখীন হলেন। এখানেও হ্যানিবাল তার অ্যাম্বুশ পদ্ধতি কাজে লাগান। তিনি ৩,০০০ এর মতো সেনাকে আশেপাশে লুকিয়ে রাখলেন এবং ম্যাগোকে দায়িত্ব দিলেন ২,০০০ অশ্বারোহী সেনা নিয়ে শত্রুপক্ষের পালানোর রাস্তা বন্ধ করার জন্য।
ফ্ল্যাকাসের সেনাদল অতি আত্মবিশ্বাসী ছিল এবং যুদ্ধের শুরুতেই তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফ্ল্যাকাসের নেতৃত্বও ছিল অত্যন্ত দুর্বল। হ্যানিবালের সেনাবাহিনী সহজেই তাদের প্রতিরক্ষা ভেঙে ফেলে। পরিস্থিতি দেখে ফ্ল্যাকাস ২০০ অশ্বারোহীসহ পালিয়ে যান। মাত্র ২,০০০ রোমান সেনা এই যুদ্ধ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিল।
একই বছর ম্যাগনা গ্রেসিয়ার ট্যারেন্টাম থেকে রোমের বিপক্ষদল হ্যানিবালকে শহর দখলের আমন্ত্রণ জানায়। হ্যানিবালের সাথে পরামর্শ করে তারা রোমান বিউগল জোগাড় করে। নির্দিষ্ট রাতে বিউগল বাজালে নিয়ম অনুযায়ী তারা পূর্বনির্ধারিত স্থানে সমবেত হয়। সেখানে হ্যানিবালের সেনারা তাদের হত্যা করে। শহর দখল করে নিলেও এর বন্দরের নিকটে অবস্থিত রোমান দুর্গ দখল করতে তারা ব্যর্থ হয়। ট্যারেন্টাম রোমানরা পুনর্দখল করা পর্যন্ত এই দুর্গ টিকে ছিল।
বেটিসের যুদ্ধ (২১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
আবার ঘুরে আসা যাক স্পেন থেকে।
ইটালিতে হ্যানিবাল আর রোমের লড়াই যখন তুঙ্গে, তখন স্পেনে দুই সিপিও ভাই রোমের অবস্থান সুসংহত করায় ব্যস্ত। ২১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাদের দলে ২০,০০০ স্থানীয় মার্সেনারি যোগ দিলে তাদের শক্তি বেড়ে যায়। তারা সংকল্প করলেন এবার স্পেনের যুদ্ধের হেস্তনেস্ত করে ছাড়বেন।
সিপিও ভাইদের বিরুদ্ধে ছিল তিনটি কার্থেজিনিয়ান সেনাদল। এর মধ্যে হাসড্রুবাল গিসগো আর ম্যাগোর নেতৃত্বাধীন দুই দল তাদের থেকে পাঁচ দিনের দূরত্বে, আর হাসড্রুবাল বারর্কার সেনাদল একদিনের। কাজেই তারা বাহিনীকে দুই ভাগ করলেন। পাব্লিয়াস দুই তৃতীয়াংশ সেনা নিয়ে হাসড্রুবাল গিসগো আর ম্যাগোর মোকাবেলা করতে গেলেন, অন্যদিকে গেনিয়াস চললেন হাসড্রুবালের দিকে।
হাসড্রুবাল গেনিয়াসের মার্সেনারি যোদ্ধাদের ঘুষ দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। তাদের হারিয়ে গেনিয়াসের সৈন্য কমে গেলে তিনি যুদ্ধ না করে পিছু হটতে থাকলেন। হাসড্রুবাল তাকে তাড়া করলেন।
এদিকে পাব্লিয়াসের অবস্থাও ভাল না। রোমান ক্যাম্প নুমিডিয়ান অশ্বারোহীদের মুহুর্মুহু আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত। এই অশ্বারোহীদের পরিচালনা করছে ম্যাসিনিসা। এর মধ্যে পাব্লিয়াস খবর পেলেন ৭,৫০০ স্প্যানিশ সৈন্য আসছে কার্থেজের বাহিনীকে শক্তিশালী করতে। তিনি স্বল্প সংখ্যক সৈন্যকে ক্যাম্পে রেখে রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে তাদের পথ আটকালেন। সমানে সমানে যুদ্ধ চলতে থাকল। এর মধ্যে ম্যাসিনিসা এসে পড়লেন। তার পিছু নিয়ে হাজির হলেন ম্যাগো ও হাসড্রুবাল গিসগো। রোমান সেনারা দলে দলে মারা যেতে লাগল। পাব্লিয়াস তাদের সাহস যোগাতে ছোটাছুটি করার মাঝে বর্শার আঘাতে নিহত হন। পরাজিত হলেও রাতের আঁধারের কারণে রোমান অনেক সেনা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং ক্যাম্পে ফিরে যায়।
এরপর ম্যাগো ও হাসড্রুবাল গিসগো দ্রুত হাসড্রুবালের সাথে গিয়ে যোগ দেন। পাব্লিয়াসের বাহিনী ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার ২৯ দিন পর কার্থেজের যৌথ সেনাবাহিনী গেনিয়াসের সেনাদলকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে এবং গেনিয়াসকে হত্যা করে। সিপিও ভাইদের নিহত হবার পর ইব্রোর দক্ষিণে কার্থেজের আধিপত্য পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই বিজয় কার্থেজ পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয় এবং ইব্রোর উত্তরে স্পেনে রোমান বাহিনীর অবশিষ্টাংশ একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। তারা প্রতীক্ষা করতে থাকে একজন দক্ষ জেনারেলের, যিনি তৃতীয় সিপিও আফ্রিকানাস।
হার্ডোনিয়ার দ্বিতীয় সংঘর্ষ ও নুমিস্ট্রোর লড়াই (২১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
হার্ডোনিয়া কার্থেজের আনুগত্য স্বীকার করেছিল আগেই। তবে শহরের কিছু অভিজাত গোপনে রোমানদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। এর প্রেক্ষিতে প্রাক্তন কন্সাল সেন্টিউম্যালাস শহরের কাছাকাছি এসে শিবির করলেন।
হ্যানিবাল হার্ডোনিয়া রোমের হাতে চলে যাক চাইলেন না। তিনি সেন্টিউম্যালাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করলেন। লিভি সেন্টিউম্যালাসকে সাহসী তবে হঠকারী বলে উল্লেখ করেছেন। তার সমর কুশলতাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার বাহিনী আক্রমণাত্মকভাবে সাজিয়েছিলেন।
যুদ্ধের শুরুতে হ্যানিবাল তার অশ্বারোহী বাহিনীকে রিজার্ভে রাখলেন। রোমান সেনারা যখন পরিপূর্ণভাবে তার পদাতিকদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত, সেই মোক্ষম মুহূর্তে তিনি অশ্বারোহীদের দুই দলে বিভক্ত করে একদল পাঠালেন রোমানদের পেছন থেকে হামলা করতে। আরেকদল গেল রোমান শিবির তছনছ করে দিতে। অশ্বারোহীদের প্রবল আঘাতে রোমান সেনারা দিশেহারা হয়ে গেলে। যুদ্ধক্ষেত্রেই অন্যান্য সেনাদের সাথে সেন্টিউম্যালাসের পতন হলো। ৭,০০০ মতান্তরে ১৩,০০০ রোমান সেনা নিহত হয়েছিল। হ্যানিবাল শহরে প্রবেশ করে রোমের সাথে চক্রান্তকারী অভিজাতদের চিহ্নিত করলেন। তাদের হত্যা করে শহর জ্বালিয়ে দেয়া হলো এবং অধিবাসীদেরকে ভিন্ন শহরে স্থানান্তর করা হয়।
হার্ডোনিয়ায় থেকে এসে হ্যানিবাল লুসেনিয়া অঞ্চলের নুমিস্ট্রো শহরের বিপরীতে ছোট একটি পাহাড়ের উপর ক্যাম্প করলেন। মার্সেলাস ও রোমান সেনাদল ঠিক তার বিপরীতে সমতলভূমিতে অবস্থান নিল। পরের দিন শুরু হলো যুদ্ধ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমুল লড়াই চলল। যখনই সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল তাদের স্থানে নতুন সৈন্য আসছিল। অনেক হতাহত সত্ত্বেও রোমানরা তাদের অবস্থান ধরে রাখতে সমর্থ হয়। প্রথম দিনের যুদ্ধ শেষ হলো অমীমাংসিতভাবে।
রাতের আঁধারে নীরবে ক্যাম্প উঠিয়ে নিয়ে হ্যানিবাল চলে গেলেন। সম্ভবত তিনি নুমিস্ট্রোকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি অথবা এটি তার দীর্ঘমেয়াদি সমরকৌশলের অংশ ছিল। যেটাই হোক না কেন, পরদিন রোমান বাহিনী যুদ্ধ করতে এসে কার্থেজিনিয়ানদের অনুপস্থিতি আবিষ্কার করে। মার্সেলাস হ্যানিবালকে তাড়া করলেন। তবে অল্প আকারে কিছু সংঘর্ষ ছাড়া হ্যানিবালের কোনো ক্ষতি তিনি করতে পারলেন না।
ট্যারেন্টাম পুনর্দখল (২০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
নবনির্বাচিত রোমান কন্সাল কুইন্টাস ভেরুকোসাস ট্যারেন্টাম দখলের সংকল্প করলেন। তিনি মার্সেলাসকে আদেশ দিলেন আপুলিয়াতে হ্যানিবালকে ব্যস্ত রাখতে। ম্যাগনা গ্রেসিয়াতে রোমের অন্যতম মিত্র রেগিয়াম তার অনুরোধে ক্যালোনিয়া দখল করে পার্শ্ববর্তী এলাকাতে লুটতরাজ চালাতে থাকে, যাতে কার্থেজের দৃষ্টি সেদিকে সরে যায়।
ভেরুকোসাস ট্যারেন্টামের পোতাশ্রয়ের মুখে ঘাঁটি তৈরি করলেন। এখান থেকে সাগর ও নৌপথে তিনি ট্যারেন্টামে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করলেন। ট্যারেন্টামে তখনো রোমান দুর্গ অক্ষত রয়েছে। তিনি সেখানে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলেন।
হ্যানিবাল ট্যারেন্টামে ছোট একটি সেনাদল রেখে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ইটালির ব্রুটিয়ান গোত্রের কিছু লোক ছিল। লিভির বর্ণনা মতে, এক ব্রুটিয়ান অফিসার সুন্দরী এক ট্যারেন্টাইন তরুণীর প্রেমে বিমুগ্ধ ছিল। এই তরুণীর ভাই ভেরুকোসাসের সেনাদলে কাজ করত। ভাই-বোনের মিলিত প্রয়াসে ব্রুটিয়ান অফিসার দলত্যাগ করে রোমকে সাহায্য করতে রাজি হয়।
নির্দিষ্ট রাতে ভেরুকোসাস তার বাহিনী কয়েকভাগে ভাগ করে পোতাশ্রয়, রোমান দুর্গ ও নগর প্রাচীরের নানা স্থানে অবস্থান নিলেন। উপযুক্ত সময়ে সমস্ত জায়গা থেকে ট্রাম্পেট বাজিয়ে আক্রমণের সংকেত দেয়া হলো। যেসব জায়গা দিয়ে আক্রমণের সম্ভাবনা নেই সেখানেই সবচেয়ে জোরে শব্দ করা হয়। এই কৌশলে শহর প্রতিরক্ষা বাহিনী বিভ্রান্ত হয়ে যায়। অনেকেই যেখানে বেশি শব্দ হয়েছে সেদিকে অগ্রসর হয়। ফলে প্রাচীরের কয়েক স্থান অরক্ষিত হয়ে পড়ে।
ব্রুটিয়ান অফিসার আগেই ভেরুকোসাসকে জানিয়ে দিয়েছিলেন কোথায় কোথায় ব্রুটিয়ান মার্সেনারিরা পাহারায় থাকবে। এদের সকলেই তার প্ররোচনায় কার্থেজের পক্ষ ত্যাগ করেছে। সেসব জায়গা দিয়ে রোমানরা মই বেয়ে প্রাচীরে উঠে পড়ে এবং দলে দলে শহরে ঢুকে পড়ে। ট্যারেন্টাইনরা টের পেয়ে বাধা দিতে চাইলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। রোমানরা নির্বিচারে বাসিন্দাদের হত্যা করে, কে কার্থেজিনিয়ান কে না সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
ক্যানুসিয়ামের যুদ্ধ (২০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
আপুলিয়ার ক্যানুসিয়াম অঞ্চলে হ্যানিবাল নাগরিকদের রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উস্কানি দিচ্ছিলেন। মার্সেলাস তাকে তাড়া করলেন। খোলা প্রান্তরে হ্যানিবাল মার্সেলাসের মুখোমুখি হতে চাইলেন না। তিনি পিছিয়ে একটু গাছগাছালি আচ্ছাদিত এলাকাতে চলে গেলেন। মার্সেলাস অগ্রসর হলে হ্যানিবাল মূল বাহিনী না পাঠিয়ে হাল্কা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কিছু যোদ্ধা পাঠালেন মূলত রোমান বাহিনীকে উত্যক্ত করার জন্য। সেদিনই আবার রাতের আঁধারে তিনি ক্যাম্প গুটিয়ে চলে গেলেন।
মার্সেলাস আবারো ধাওয়া করলেন। সমতল এক খোলা মাঠে তিনি হ্যানিবালের নাগাল পেলেন। দুই বাহিনী দ্রুত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিল। দুই ঘণ্টার কিছু বেশি যুদ্ধ চলার পর রোমান ডান বাহু দুর্বল হয়ে পড়লে মার্সেলাস সেনাদলের কিছু অংশ সেদিকে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন।
কিন্তু এই সেনা স্থানান্তরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সময় লেগে গেল। ইত্যবসরে রোমান ব্যূহ কার্থেজিনিয়ানদের প্রবল চাপে ভেঙে পড়ল। বিশৃঙ্খলভাবে রোমান সেনারা পিছু হটে ক্যাম্পে ফিরে গেল। এদিন প্রায় ২,৭০০ রোমান ও মিত্র যোদ্ধা হতাহত হয়।
সেনাদলের দুর্বলতা সত্ত্বেও মার্সেলাস পরের দিন আবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। প্রবল যুদ্ধ চলতে লাগল। একপর্যায়ে হ্যানিবাল তার হস্তিবাহিনী নামিয়ে দিলে রোমান সেনাদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। তখন সাহসী কিছু রোমান যোদ্ধা বর্শা ছুঁড়ে মেরে কয়েকটি হাতি আহত করতে সক্ষম হয়। আহত হাতিগুলো তখন উল্টো দিকে দৌড় দিলে হ্যানিবালের সেনাদলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তার সেনারা পিছু হটতে থাকে। কিন্তু ক্যাম্পের কাছে এসে দেখতে পায় দুটি হাতির মৃতদেহ দিয়ে প্রবেশপথ বন্ধ। এখানেই সবচেয়ে বেশি কার্থেজিনিয়ান যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। লিভির গণনানুসারে হ্যানিবালের প্রায় ৮,০০০ সেনা নিহত হয়, বিপরীতে রোমানরা হারায় প্রায় ৩,০০০ যোদ্ধা।
সেদিন রাতে আবার হ্যানিবাল নিঃশব্দে ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। তাকে তাড়া করার ইচ্ছা থাকলেও বিপুল সংখ্যক আহত সেনার পরিচর্যার জন্য মার্সেলাসকে থেকে যেতে হয়।