সেলফি শব্দটি তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও সেলফি তোলার ইতিহাস কিন্তু মোটেও নতুন না। বিশ্বের প্রথম সেলফিটি তোলা হয়েছিল ক্যামেরা আবিষ্কারের পরপরই, সেই ১৮৩৯ সালে। কিন্তু Selfie শব্দটি প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয় মাত্র সেদিন, ২০০২ সালে। আর শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে সময় নেয় আরও প্রায় এক দশক। ২০১২ সালে টাইম ম্যাগাজিন সেলফি শব্দটিকে বছরের ১০টি আলোচিত শব্দের তালিকায় স্থান দেয়। আর ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারি সেলফি শব্দটিকে তাদের ‘ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার’ হিসেবে ঘোষণা দেয়।
অক্সফোর্ড ডিকশনারি এবং মেরিয়ান-ওয়েবস্টার ডিকশনারি, উভয়ের মতে সেলফি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান মৌখিক ইংরেজি থেকে। ২০০২ সালে এক অস্ট্রেলিয়ান ব্লগার ন্যাথান হোপ প্রথম শব্দটি ব্যবহার করেন। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটে ফেলার পর তিনি নিজেই নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে সেই কাটা ঠোঁটের একটি ছবি তুলে একটি ফোরামে পোস্ট করেন। তখনও মোবাইল ফোনে সেলফি ক্যামেরার চল শুরু হয়নি, কাজেই ফ্রন্ট ক্যামেরা দিয়ে তোলা ছবিটি ঝাপসা ওঠায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করে ব্যাখ্যা করেন, “… sorry about the focus, it was a selfie.“
পরবর্তীতে অবশ্য ন্যাথান হোপ ব্যাখ্যা করেন, শব্দটি তিনি নিজে আবিষ্কার করেননি। সে সময় তার আশেপাশে অনেকেই মৌখিকভাবে শব্দটি ব্যবহার করত, তিনি কেবল সেটি প্রথম কোনো লিখিত মাধ্যমে ব্যবহার করেছেন।অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে প্রায়ই বিভিন্ন শব্দের শেষে ie যোগ করে সেটাকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন- তারা ফায়ার অফিসারকে বলে ফায়ারি, ট্রেডসম্যানকে বলে ট্রেডি, এবং বারবিকিউকে বলে বারবি। এই রীতি থেকেই মূলত নিজে নিজে (self) তোলা ছবি তাদের মধ্যে self+ie = selfie হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
সেলফি বলতে সাধারণ এমন ছবিকে বোঝানো হয়, যেটি কেউ নিজে নিজে তোলেন। সে হিসেবে বিশ্বের প্রথম সেলফিটি ছিল ১৮৩৯ সালে তোলা মার্কিন ফটোগ্রাফার রবার্ট কর্নেলিয়াসের ছবিটি। সে বছরের অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় তিনি এই সেলফিটি তোলেন। ছবিটি সে সময়ের ড্যাগারোটাইপ প্রযুক্তিতে তোলা। যেহেতু এই পদ্ধতিতে ছবি তুলতে অনেক লম্বা সময় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, তাই কর্নেলিয়াস অন্য কাউকে অনুরোধ না করে নিজেই ক্যামেরার সামনে ১০-১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন, যার ফলাফল ছিল তার এই সেলফিটি।
অক্সফোর্ড ডিকশনারির সংজ্ঞা অনুযায়ী অবশ্য এই ছবিটিকে ঠিক সেই অর্থে সেলফি বলা যায় না। কারণ অক্সফোর্ড ডিকশনারির মতে, সেলফি হচ্ছে এমন একটি ছবি, যা কেউ নিজে নিজে তোলে, প্রধানত “স্মার্টফোন অথবা ওয়েবক্যাম দিয়ে”, এবং এরপর কোনো সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইটে আপলোড করে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী ড্যাগারোটাইপ পদ্ধতিতে ১৮৩৯ সালে তোলা কর্নেলিয়াসের ছবিটিকে তাই ঠিক সেলফি বলা যাবে না, বরং বলতে হবে সেলফ পোর্ট্রেট।
এ ধরনের সেলফ-পোর্ট্রেটের সংখ্যা অবশ্য একেবারে কম না। ক্যামেরা আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই ফটোগ্রাফাররা বিভিন্ন সময় বিচিত্র পদ্ধতিতে নিজেই নিজের ছবি তুলে এসেছেন। এ ধরনের সেলফ পোর্ট্রেটের মধ্যে বিখ্যাত একটি হলো রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাসের কন্যা, ডাচেস আনাসতাসিয়া নিকোলাভনার তোলা একটি ছবি। ১৯১৪ সালে ১৩ বছর বয়সী কিশোরী আনাসতাসিয়া এই ছবিটি তোলেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। পোর্টেবল ক্যামেরা আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এটি বিশ্বের প্রথম ঐতিহাসিক সেলফি, এবং হয়তো বা বিশ্বের প্রথম সেলফি। কিশোরীদের সেলফি তোলার প্রবণতা যে শুধুমাত্র একবিংশ শতাব্দীর সমস্যা না, ছবিটি তারও একটি প্রমাণ।
বিশ্ববিখ্যাত সেলফ পোর্ট্রেটগুলোর মধ্যে আরেকটি হলো মহাশূন্যে তোলা বাজ অলড্রিনের একটি ছবি। বাজ অলড্রিন মূলত ১৯৬৯ সালে নীল আর্মস্ট্রংয়ের সাথে চাঁদের মাটিতে হাঁটার জন্যই বেশি বিখ্যাত। কিন্তু এটি ছাড়াও তিনি আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন- মহাশূন্যে প্রথম সেলফি তোলার ইতিহাস। ১৯৬৯ সালে জেমিনি-১২ স্পেস মিশনের অধীনে মহাশূন্যে দুই ঘন্টা বিচরণ করার পর তিনি ফিরে আসছিলেন, তখন খেয়ালের বশে তিনি নিজের এই ছবিটি তুলে নেন, পরবর্তীতে যা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়।
ক্যামেরা যত আকারে ছোট এবং ওজনে হালকা হয়ে আসতে থাকে, সেই সাথে সেলফ পোর্ট্রেটের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে ক্যামেরাগুলোতে সেলফ টাইমার অপশন যুক্ত হওয়া এবং সত্তরের দশকে পোলারয়েড ক্যামেরার আবির্ভাব মানুষকে সেল পোর্ট্রেট তোলার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ছবি তোলার সময় ফটোগ্রাফাররা নিজেদের চেহারা দেখতে পারত না। সম্পূর্ণ অনুমানের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে সেলফি তুলতে হতো।
সত্যিকার অর্থে সেলফি ক্যামেরা তথা ফ্রন্ট ক্যামেরা বাজারে আসে ২০০৩ সালে। সে বছর সনি তাদের Sony Ericsson Z1010 মোবাইল ফোনের সাথে প্রথম ফ্রন্ট ক্যামেরা সংযুক্ত করে। কিন্তু অত্যন্ত কম রেজোল্যুশনের এই ক্যামেরাটি সেলফি জগতে খুব বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। এছাড়া এর প্রধান উদ্দেশ্যও ছিল মূলত ভিডিও কনফারেন্সিং। ২০১০ সালে আইফোন ফোর যখন ০.৩ মেগাপিক্সেলের সেলফি ক্যামেরা যুক্ত করে, তখন থেকেই মূলত সেলফি তোলার জোয়ার শুরু হয়।
২০১০ সালের অক্টোবরে যাত্রা করে ফটো শেয়ারিং অ্যাপ ইনস্টাগ্রাম। মাত্র এক বছরের মধ্যেই এক কোটি মানুষ এতে রেজিস্ট্রেশন করে এবং কোটি কোটি ছবি পোস্ট করতে শুরু করে। এই ইনস্টাগ্রামে প্রথম সেলফি হ্যাশট্যাগের (#selfie) ব্যবহার পাওয়া যায় ২০১১ সালের ১৬ই জানুয়ারির একটি ছবিতে। Jennifer Lee নামের এক ব্যবহারকারীর তোলা সেলফিটি সেই হিসেবে আধুনিক সেলফি হ্যাশট্যাগের পথিকৃত। তিনি অবশ্য শুরুতেই হ্যাশট্যাগটি ব্যবহার করতে পারেননি, কারণ সে সময় ইনস্টাগ্রামে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করার অপশন চালু হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে যখন ট্রেন্ডটি চালু হয়, তখন তিনি ট্যাগটি যুক্ত করে দেন।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইটই মূলত সেলফির জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। প্রথম প্রথম শুধুমাত্র কিশোরবয়সীদের মধ্যে সেলফি তোলার প্রবণতা দেখা গেলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সব ধরনের মানুষের মধ্যেই বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে সেলফি তোলা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। সেলিব্রেটিদেরকে তো বটেই, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদেরকেও তাই মাঝেমাঝেই সেলফি তুলতে দেখা যায়। ২০১৩ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এবং ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রী হেলে থর্নিং শ্মিডটের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার তোলা একটি সেলফি সে সময় বেড় আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
তবে এখন পর্যন্ত তোলা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সেলফি হচ্ছে ২০১৪ সালের অস্কার অনুষ্ঠানের সময় তোলা এলেন ডিজেনেরেসের সেলফি। অনুষ্ঠানের বিরতিতে হলিউডের সবচেয়ে বড় তারকাদেরকে একত্রিত করে তিনি একটি সেলফি তোলার আয়োজন করেন। সেলফিটি তোলেন অভিনেতা ব্র্যাডলি কুপার, কিন্তু এরপর সেটি টুইটারে শেয়ার করেন ডিজেনেরেস। মেরিল স্ট্রিপ, ব্র্যাড পিট, জেনিফার লরেন্স, কেভিন স্পেসিসহ হলিউডের সেরা সেরা সব শিল্পীকে এক ফ্রেমে পেয়ে তার ফ্যানরা সবাই ছবিটি রিটুইট করতে শুরু করে। ছবিটি সর্বমোট ৩০০ কোটি বার রিটুইট হয়, যা ইন্টারনেটের ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি।
সেলফি যে শুধুমাত্র মানুষই তোলে, এমন না। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পশুপাখির তোলা, এমনকি যন্ত্রপাতির তোলা ছবিও ভাইরাল হয়েছে। ২০১৫ সালে মঙ্গল গ্রহের মাটিতে নাসার কিউরিওসিটি রোভারের তোলা সেলফিটি বেশ বিখ্যাত একটি সেলফি, যদিও টেকনিক্যাল অর্থে এটি ঠিক একটি সেলফি না, অনেকগুলো সেলফির সমন্বিত একটি ছবি। এছাড়াও ২০১১ সালে ইন্দোনেশিয়ার একটি জঙ্গলে একটি বানর ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার ডেভিড স্লেটারের ক্যামেরা নিয়ে নিজের অজান্তেই অনেকগুলো সেলফি তুলে ফেলে, যেগুলো পরবর্তীতে ভাইরাল হয়ে যায়। বানরের দ্বারা তোলা সেলফিগুলোর কপিরাইট কি বানরের হবে, নাকি ফটোগ্রাফারের, সেটি নিয়ে সে সময় ফটোগ্রাফারের সাথে উইকিপিডিয়ার লড়াই আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছিল।
সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটে এবং সেই সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের রুচির এবং সাংস্কৃতিক ট্রেন্ডেরও পরিবর্তন ঘটে। সেদিক থেকে বর্তমান সময়ে যে সেলফির জয়জয়কার চলছে, সেটি অস্বাভাবিক কিছু না। দশ বছর আগে সেলফির চল ছিল না, দশ বছর পরেও হয়তো এর জনপ্রিয়তা এখনকার মতো থাকবে না। বর্তমান যুগ যেহেতু সেলফির যুগ, তাই এই সেলফি তোলার স্রোতে গা ভাসাতে দোষ নেই। কিন্তু সেটি যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে অনেক সময় বিপদের কারণও হতে পারে। “অতিরিক্ত সেলফি তোলা মানসিক সমস্যা”- এ জাতীয় যে গবেষণাগুলো আছে, সেগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে না চাইলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সামান্য কয়েকটি লাইকের জন্য বিপজ্জনক জায়গায় সেলফি তুলতে গিয়ে যে অনেক সময়ই দুর্ঘটনা কিংবা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে, সে ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে।