মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের নাম মনে করলে প্রথমদিকেই আমাদের মনে আসে সেলজুকদের কথা। তারা ছিল এক তুর্কি বংশোদ্ভূত রাজবংশ। এই সেলজুকদের একটি বিশেষ শাখা সেলজুকস অফ রুম বা রুমের সেলজুকীয়রা। তারা একাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত আনাতোলিয়া বা রুমের বেশিরভাগটাই শাসন করেন। বর্তমানে যে অঞ্চল তুরস্ক নামে পরিচিত, সেসময় তাকে লোকে রুম বা আনাতোলিয়া নামেই জানত। ইস্টার্ন রোমান এম্পায়ারের অংশ হওয়ায় এ অঞ্চলের এরকম নামকরণ করা হয়। এই রুমের সেলজুকদের নিয়েই রোর বাংলার পাঠকদের জন্য এবারে আমাদের আয়োজন।
সুদীর্ঘ এই সিরিজে আমরা তাদের উত্থান-পতন, বিখ্যাত শাসকগণ এবং সমস্ত বিবরণী জানতে পারব। আজকে থাকছে এই সিরিজের প্রথম পর্ব। এই পর্বে আমরা আদি সেলজুকদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানব। তারপরে ধীরে ধীরে পর্ব যত এগোতে থাকবে, আমরা ততই রুমের সেলজুকদের সম্পর্কে গভীরে জানতে থাকব। তাহলে আর দেরি না করে চলুন পাঠক শুরু করা যাক!
সেলজুকরা মূলত তুর্কি বংশোদ্ভূত ওঘুজ গোত্রের। একাদশ শতাব্দীতে তারা নিজেদের সামরিক যোগ্যতাবলে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বর্তমান মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইরান প্রভৃতি অঞ্চল নিজেদের শাসনে আনতে সক্ষম হয়। এভাবে তাদের হাত ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে তুর্কি প্রভাব-বলয় শুরু হয়।
দশম শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া এবং রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব এলাকা হতে একশ্রেণীর যাযাবর লোকের আবির্ভাব হয়। তাদের মধ্যে একটি গোত্র ছিল, যাদের নেতার নাম সেলজুক। এ গোত্রটি পরবর্তীতে সুন্নি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তারা সামানি সাম্রাজ্য এবং গজনি সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একসময় তারা নিজেরা গজনি সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেয়। সেলজুকের দুই নাতি চাগরি বেগ ও তুঘরিল বেগ নিজেদের অধীনে পারসিকদের অঞ্চলে খণ্ড সাম্রাজ্য কায়েম করে। চাগরি খোরাসান এলাকা দখলে নেয় এবং তুঘরিল নেয় পশ্চিম ইরান এবং মেসোপটেমীয় এলাকা।
আলপ আরসালান এবং মালিক শাহ্র রাজত্বকালে সেলজুকরা পুরো ইরান এবং মেসোপটেমিয়া, এমনকি সিরিয়া, ফিলিস্তিন পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ১০৭১ সালে ইতিহাসখ্যাত মানজিকার্টের যুদ্ধে এক বিশাল বাইজেন্টিয় বাহিনীকে সুলতান আলপ আরসালান হারিয়ে দেন এবং বাইজান্টাইন সম্রাট চতুর্থ রোমানোস ডাইয়োজেনাসকে বন্দী করা হয়। যুগান্তকারী এই যুদ্ধের মাধ্যমে তুর্কিদের জন্য আনাতোলিয়ার দরজা চিরদিনের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। অবশ্য প্রখ্যাত গবেষক হিলেনব্র্যান্ডের মতে, ১০৭১ সালে সংঘটিত ঐতিহাসিক মানজিকার্টের যুদ্ধের কমপক্ষে চার দশক আগে থেকে সেলজুক সালতানাতের সূচনা, (Hillenbrand, ২০০৭, পৃষ্ঠা ৩-২৫)।
মানজিকার্টের যুদ্ধের দুই দশক আগেই তুঘরিল বেগের নেতৃত্বে সেলজুকরা বাগদাদে বুওয়িদদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে সুন্নি ইসলামের অধীনে পুরো মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করতে ভূমিকা রাখে। বাগদাদ জয়ের পর তুঘরিল বেগ বাগদাদের তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা কায়্যিমের কন্যাকে বিয়ে করার জন্য খলিফার দরবারে বিবাহ-প্রস্তাব পাঠান। খলিফা কায়্যিম তাতে সম্মতি দেন এবং তুঘরিল বেগকে সুলতান উপাধি প্রদান করেন। বিয়ের মাত্র ছ’মাস পর তুঘরিল বেগ মৃত্যুবরণ করেন। তখন সাম্রাজ্যের জন্য তার কোনো পুত্রসন্তান উত্তরাধিকারী না থাকায় দায়িত্ব বর্তায় তার ভাতিজা আলপ আরসালানের (চাগরি বেগের পুত্র) কাঁধে।
চাগরি বেগের কনিষ্ঠ স্ত্রীর গর্ভে জন্ম হয় আলপ আরসালানের। তারপর আলপ আরসালান এবং মালিক শাহ উভয়ই নিজেদের রাজত্বকালে সেলজুক সাম্রাজ্যকে মিশরের উপকণ্ঠ পর্যন্ত নিয়ে যান। যখন তারা এই সামরিক অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন, সেসময় তাদের রাজ্যপরিচালনার বিষয়সহ অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়-আশয় উজির নিজাম উল মুলক দেখাশোনা করেছিলেন।
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উভয়ক্ষেত্রেই সেলজুক সাম্রাজ্য ইসলামি মূল্যবোধে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যায়। সেসময় মাদ্রাসাগুলোর ভেতর আন্তঃযোগাযোগ সৃষ্ট হয়। এগুলোকে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক দায়িত্বপালনে সক্ষম করে গড়ে তোলা হয়। তুর্কিগণ সংস্কৃতিগতভাবে পারসিকদের সংস্কৃতি আত্তীকরণ করে। শুধু ধর্মীয় কাজ বাদে আরবির ব্যবহার বেশ কমে যায়। এসময় ইসমাইলি শিয়াদের উত্থান ঘটে, ধারণা করা হয় ১০৯২ সালে নিহত উজির নিজাম উল মুলককে তারাই হত্যা করেছিল। এছাড়াও, তাদের শাসকের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে রাজ্য বিভক্তকরণের নীতির কারণে সেলজুকদের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্রমেই হ্রাস পায়। কারণ, এতে করে অনেকগুলো স্বাধীন রাজ্যের জন্ম হতে থাকে যা গোটা সাম্রাজ্যকেই এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। ইরানি সেলজুকদের শেষ সুলতান ১১৯৪ সালে যুদ্ধের ময়দানেই মারা যান এবং ১২০০ সালের শুরুর দিকে বলা যায় সেলজুক সাম্রাজ্য আনাতোলিয়াতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
আলপ আরসালানের মানজিকার্টে বিজয়ের সূত্র ধরে ওঘুজ গোত্রগুলোর জন্য বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত অঞ্চলের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। দ্রুতই তারা বাজেন্টাইনদের অন্তঃদ্বন্দের কারণে সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। বাইজান্টাইনদের সাহায্যার্থে সেখানে তাদের অভিগম্যতা বাড়তে থাকে। এক সম্রাটকে সিংহাসনে বসাতে সাহায্য করার স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের আনাতোলিয়ার নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ১০৯৭ সালে ক্রুসেডারদের তাড়া খেয়ে তারা আরও ভেতরে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। এভাবেই পশ্চিমে বাইজান্টীয় আর পূর্বে সিরিয়ার প্রদেশসমূহে ক্রুসেডার কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে সেলজুকদের সালতানাত অফ রুম।
অঞ্চলটিতে বাসিন্দা হিসেবে খ্রিস্টান, আর্মেনিয়, গ্রিক, সিরিয় এবং ইরানি মুসলমান থাকলেও জাতিগত, ধর্মগত বৈষম্য ছাড়াই তারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছিল। সেখানে তাদের ধর্ম-বর্ণভিত্তিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ব্যবসা এবং কৃষির সমন্বিত প্রয়াসে রাজ্য অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হয়ে ওঠে। ১২৩০ সালে ইরানের খাওয়ারিজমের সুলতানের বিরুদ্ধে রুমের সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ অভিযান পরিচালনা করেন যা মাধ্যমে রুম আর ইরান আবার সেলজুকদের অধীনে আবার একত্রিত হয়। কিন্তু ১২৪৩ সালে কোসেদাগের যুদ্ধের মাধ্যমে সেলজুকদের সার্বভৌমত্ব চিরতরে শেষ হয়ে যায়। একটা সময় পর্যন্ত সেলজুক সালতানাত মঙ্গোলদের অধীনে থেকে পুতুল শাসক হিসেবে শাসন করেছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে এসে সেলজুক সাম্রাজ্য চিরতরে বিলুপ্ত হয়।
সেলজুকদের স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনা কিন্তু আলপ আরসালানের সময় থেকেই। তুঘরিল বেগের মৃত্যুর পরে সেই ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দেই সেলজুক সালতানাতের মসনদের জন্য আলপ আরসালানকে এক ব্যর্থ চ্যালেঞ্জ করেন তুঘরিল বেগের এবং চাগরি বেগের (মৃত্যু ১০৬০) একজন চাচাত ভাই কোতলোমোস বিন আরসালান ইসরাইল বিন সেলজুক। আলপ আরসালানের শাসনকাল ছিল ১০৬৩-৭২। কোতলোমোসের পুত্র সোলায়মান (বা সোলায়মান শাহ) বিন কোতলোমোসকে প্রথাগতভাবে আনাতোলিয়ায় সেলজুক সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
সেলজুক পরিবারের এই দুটি শাখার মধ্যে সম্পর্ক মোটেই মধুর ছিল না। তাদের এই সম্পর্ক সবসময়ই বেশ দূরে দূরেই ছিল এবং সময়ে সময়ে বৈরীও ছিল। যদিও পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকগণ এই জটিল সম্পর্কের বিষয়ে নমনীয় কথা বলেছেন। পিককের বইয়ে আমরা তেমনটিই দেখতে পাই, (Peacock, ২০০৪, পৃষ্ঠা ১০১-০৭)।
রুমের সালজুকদের ইতিহাসকে তিনটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে –
- প্রথম ভাগ, দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ অবধি স্থায়ী। এটি সালতানাতের অজানা দলিলযুক্ত সময়, যখন এটি আনাতোলিয়ার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে ওঠে;
- দ্বিতীয়টি, দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ১২৩৭ সাল অবধি বিস্তৃত। এসময়ে সালতানাত তার সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করে। তখন এটি মধ্য প্রাচ্যের অন্যতম ধনী এবং সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে ওঠে; এবং
- চূড়ান্ত পর্ব চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এসময়ে সেলজুক সুলতানগণ ইরানের ইল-খানিদ এবং মঙ্গোল শাসনের অধীনে নামমাত্র পুতুল শাসক হিসাবে রাজ্য চালাতেন।
চলবে …