সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে আশ্চর্য আর রহস্যঘেরা সব গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাস। এমনকি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক আর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপর নজরদারি করতে এবং তাদের মানসিক অবস্থার ব্যাপারে ধারণা পেতে তাদের মলমূত্র সংগ্রহ করে তা নিয়েও গবেষণা চালিয়েছে সোভিয়েত গোয়েন্দারা। মলমূত্রে থাকা রাসায়নিক উপাদান থেকে কীভাবে একজন মানুষের মানসিক অবস্থার ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যাবে, এ ব্যাপারটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করেছে সোভিয়েত গবেষক আর গোয়েন্দাদের সম্মিলিত বাহিনী। স্টালিনের সময়ে তার গোপন পুলিশ বাহিনীর হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপরে নজরদারি করার এই মহাযজ্ঞ। তবে পুরো প্রক্রিয়াটিই যে অত্যন্ত গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা ছিল, তা বলাই বাহুল্য।
স্টালিনের সময়কালে গোয়েন্দা নজরদারিকে আরো বেশি কার্যকর করে তোলার লক্ষ্যে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক উপায়ের উপরেও গুরুত্ব দেয়া হয়। ১৯৪৯ সালের সেই দিনগুলোতে উন্নত প্রযুক্তির টেপ রেকর্ডার কিংবা ক্যামেরার প্রচলন তেমন ছিল না। তাই সোভিয়েত গোয়েন্দারা কোনো ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য বেছে নিলেন তার মলমূত্র। মলের এ পরীক্ষা চালানো হয়েছিল চীনের নেতা মাও সে তুং এর উপরেও! কী ছিল সেই কাহিনী?
চীন আর সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই দেশেই সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার। তবে একই ঘরের দুই বাসিন্দার মধ্যে মনোমালিন্যও কম ছিল না। বিভিন্ন সময়ে তাদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়েও দেখা দেয়। তবে সমাধানের চেষ্টাও কম করা হয়নি। স্টালিনের সত্তরতম জন্মদিনের শুভ মূহুর্তকে সামনে রেখে ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং সোভিয়েত সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ সোভিয়েত ইউনিয়নে পা রাখলেন চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং। সোভিয়েত প্রশাসনও যেন তার সাথে শীতল আচরণ শুরু করে। তার গতিবিধি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখেছিল সোভিয়েতের তুখোড় সব গোয়েন্দারা। ব্যাপারটি মোটেও পছন্দ হচ্ছিল না চীনা নেতাদের। তাদের সাথে যেন অনেকটা বন্দীর মতো আচরণ করা হচ্ছিল।
অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে মস্কোতে পা রাখার কয়েকদিন পরেও স্টালিনের সাথে দেখা হচ্ছে না। তবে তার খাদ্য আর বাসস্থানের ব্যাপারে আতিথেয়তার কমতি রাখেনি সোভিয়েত প্রশাসন। অতিরিক্ত এই বাড়াবাড়িতে রাগান্বিত হয়ে তিনি নাকি বলে বসেছিলেন,
“I am here to do more than eat and shit!”
কিন্তু স্টালিনের জালে ততক্ষণে বেশ ভালোভাবেই ফেঁসে গিয়েছেন তিনি। সোভিয়েত প্রশাসনের মুখে চপেটাঘাত করে চলেও যেতে পারছেন না আবার স্টালিন তার সাথে দেখাও করছেন না। এমতাবস্থায় মাও সে তুং কিংবা তার দলের বাকিরা একটু হলেও টের পেয়েছিলেন হয়তো তাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের ধারণাও ছিল না সোভিয়েত প্রশাসন তাদের উপর কী ধরনের নজরদারি চালাতে পারে।
মাও সে তুংয়ের মস্কো থাকাকালে তার কক্ষে স্থাপন করা হয়েছিল বিশেষ ধরনের টয়লেট। এ টয়লেট থেকে মলমূত্র সরাসরি ড্রেনেজ সিস্টেমে যেতো না। পরে সংগ্রহ করা হতো বাক্সে করে। সেগুলো পরবর্তীতে গবেষণা কাজে ব্যবহার করার লক্ষ্যে গোপন গবেষণাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো।
সম্প্রতি ইগোর আতামানেঙ্কো নামের এক সাবেক সোভিয়েত এজেন্ট রাশিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের আর্কাইভ নিয়ে গবেষণা করার সময় অতি গোপনীয় এই প্রজেক্টের ব্যাপারে সন্ধান পেয়েছেন। তার গবেষণা থেকে আরো বেরিয়ে এসেছে এই গোপন গবেষণাগারের সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন লাভেরিন্তি পাভলোভিচ বেরিয়া নামের এক রাজনীতিবিদ। এই পাভলোভিচ বেরিয়া ছিলেন স্টালিনের সবচেয়ে কাছের ব্যক্তিদের একজন।
গবেষণা থেকে কীভাবে ফলাফল পাওয়া যেত?
মলমূত্র থেকে তাদের উদ্দিষ্ট তথ্য উদঘাটন করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের চালানো গবেষণার ভিত্তিতে তারা দেখেছেন যে, মলে ট্রিপটোফ্যান নামক রাসায়নিক পদার্থের উচ্চ উপস্থিতি প্রমাণ করে ঐ ব্যক্তি বেশ শান্তশিষ্ট। তাকে যেকোনো প্রস্তাবে বাগে আনা বেশ সহজ হবে।
তবে মলে ট্রিপটোফ্যান শনাক্ত করাও সহজ কাজ নয়। জটিল সব রাসায়নিক বিক্রিয়া আর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সেই উপাদানের উপস্থিতি যাচাই করা হয়। তবে শুধু ট্রিপটোফ্যান নয়, সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা মলে পটাসিয়ামের উপস্থিতির সাথেও বেশ কিছু মনোজাগতিক ঘটনার সম্পর্ক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, মলে যদি পটাসিয়ামের পরিমাণ অনেক কম থাকে তাহলে সে ব্যক্তি স্নায়বিক সংকটে ভুগছেন। সহজ কথায়, তার মানসিক অবস্থা ঠিকঠাক নেই, কিংবা ইনসমনিয়া কিংবা নিদ্রাহীনতায় ভোগা ব্যক্তিদের মলে খুবই স্বল্প পটাসিয়াম পাওয়া যায়।
মলে থাকা এমন আরো অনেক রাসায়নিক পদার্থের সাথে মানুষের মনোজাগতিক অবস্থার সম্পর্ক তৈরি করেন রাশিয়ান গবেষকরা। আর এই গোপন গবেষণাগারগুলো থেকে মলমূত্র গবেষণার ফলাফল লাভেরিন্তি পাভলোভিচ বেরিয়ার হাত হয়ে চলে যেত স্টালিনের হাতে। খুব কম মানুষেরই জানার সুযোগ হয়েছিলো আশ্চর্য এই গবেষণাকর্ম নিয়ে।
এই গবেষণা কতটা যৌক্তিক?
শুরুতে ব্যাপারটা অনেকটাই কাল্পনিক শোনালেও মলমূত্র ব্যবহার করে যে মানুষের মনের অবস্থা সম্পর্কে বেশ পরিষ্কার ধারণা নেওয়া সম্ভব, সে ব্যাপারে এখন বিজ্ঞানীরা বেশ নিশ্চিত। এমনকি বর্তমান সময়ে নানা ধরনের রোগ শনাক্ত করার কাজেও মল সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করা হয়। তবে বর্তমান সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, মলে পটাসিয়ামের উপস্থিতির সাথে মনোজাগতিক অনেক ঘটনার যে সংযোগ ঘটানো হয়েছিল, তা অনেকটাই পরিসংখ্যানগত তথ্যের ভিত্তিতে। বাস্তবে আরো অনেক রাসায়নিক উপাদান এই ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত। তবে ট্রিপটোফ্যানের উচ্চমাত্রার উপস্থিতির সাথে যে ঘটনাগুলোকে সংযোগ দেওয়া হয়েছিল সেগুলো অনেকটাই যৌক্তিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক।
তবে ১৯৪৯ সালে মলে ট্রিপটোফ্যান কিংবা অন্যান্য রাসায়নিক সঠিকভাবে পরিমাপের ব্যাপারটি নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীদের মধ্যে সন্দেহের অবকাশ আছে। তাই অনেক বিজ্ঞানীদের ধারণা, লাভেরিন্তি পাভলোভিচ বেরিয়া হয়তো স্টালিনকে সেই ফলাফলটিই পৌঁছে দিতেন, যেটি স্টালিন শুনতে চাইতেন। কারণ খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল পরিমাণ মলের স্যাম্পল থেকে তথ্য স্টালিনের হাতে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ দেয়া থাকতো গবেষকদের উপর।
সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া
তবে অনেক গোপনীয় তথ্যের আড়ালে মাও সে তুং-এর মল নিয়ে গবেষণার তথ্যটিও প্রকাশিত হয়নি কখনো। হয়তো চীন-রাশিয়া সম্পর্কের কোনো চড়াই উৎরাইয়ে হারিয়ে গিয়েছে কিংবা লুকিয়ে আছে রাশিয়ার কোনো গোপন নথিতে। সম্প্রতি এসব তথ্য নতুন করে উদঘাটিত হওয়ার ফলে অনেকটাই চাপের মুখে পড়েছে রাশিয়া প্রশাসন। রাশিয়ার প্রশাসনের কাছে এই অদ্ভুত গোয়েন্দাগিরির ব্যাপারে জানতে চাইলে অনেকটাই চেপে গেছেন রাশিয়ান ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস। স্টালিনের এই গোপন প্রকল্প নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতেই রাজি নয় এই সংস্থার সদস্যরা।
বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই
স্টালিনের সময় চালু হওয়া এই গোপন মহাযজ্ঞে ভাঁটা নেমে আসে তার মৃত্যুর পরপরই। পরবর্তী সময়ে মলমূত্র নিয়ে গবেষণা করা এবং সেখান থেকে তথ্য উদঘাটনের ব্যাপারটি ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ে। ততদিনে আড়িপাতা আর গোয়েন্দাগিরির নতুন সব পন্থা চলে আসায় জনপ্রিয়তাও হারিয়েছে কঠিন আর সময়সাধ্য এই প্রক্রিয়া। সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের সময়কালে গোপন এই ল্যাবরেটরির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ফিচার ইমেজ: Associated Press