১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি; বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে এসে দেখলেন তার সোনার বাংলা পুড়িয়ে খাঁক করে দিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ত্রিশ লাখ মানুষের গণহত্যার পাশাপাশি অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে পাকিস্তানি সেনারা, সাথে ছিল তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী। আজকে আমরা জানব সেসব মা-বোনদের কথা, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য সহ্য করেছেন পৈশাচিক নির্যাতন। সেই সাথে জানব ধর্ষিতা সেই নারীদের কোল জুড়ে জন্ম নেয়া শিশুদের কথা, যাদের সমাজের চাপে, কলঙ্কের ভয়ে বাধ্য হয়ে মায়েরা তুলে দিয়েছিলেন অন্যের হাতে। অবুঝ শিশুদের হতে হয়েছিল নির্বাসিত!
নির্যাতিত এসব নারীদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাম দিয়েছিলেন ‘বীরাঙ্গনা’। তাদের অনেকে যুদ্ধের পুরো নয় মাস বন্দি ছিলেন বিভিন্ন সেনা ক্যাম্পে। যুদ্ধশেষে দেশ যখন স্বাধীন হল, দুর্ভাগা বীরাঙ্গনাদের বেশিরভাগেরই আর ঠাঁই হলো না বাবা বা স্বামীর সংসারে। কলঙ্ক আর অপমানের বোঝা বইতে না পেরে অনেকেই করেছেন আত্মহত্যা। বাকিরা নীরবে দেশ ছেড়েছেন, ভারতে চলে গিয়েছেন অনাহূত সেই শিশুদের জন্ম দিতে বা গর্ভপাত করাতে।
বিভিন্ন সূত্রে দেখা যায়, ২ থেকে ৪ লক্ষ নারী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ধর্ষণের শিকার হন। পাকিস্তানি সেনাদের ভাষ্য ছিল, যত বেশি সংখ্যক নারীর গর্ভে তাদের শিশুর জন্ম হবে, তত বেশি ‘সাচ্চা মুসলিম’ বা ‘সাচ্চা পাকিস্তানি’র জন্ম হবে। পাশবিক নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নারী এর ফলে গর্ভবতী হন। পরবর্তীতে তাদের অনেকেরই যেতে হয় গর্ভপাতের মতো ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে।
বাংলাদেশ সরকার এই বীরাঙ্গনাদের সাহায্য করতে ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ উইমেন্স রিহ্যাবিলিটেশন বোর্ড (BWRB) নামে একটি বোর্ড গঠন করে, যেটির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল তিন থেকে চার মাসের সীমিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা ধর্ষণের শিকার নারীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া এবং তাদের জন্য কারিগরী প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট তৈরি করা, যাতে তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করে মর্যাদার সাথে পুনর্বাসিত করা যায়। তাছাড়াও দেশজুড়ে দেশি-বিদেশি ডাক্তারদের সমন্বয়ে গঠিত ২২টি ‘সেবা সদন’ নামে হাসপাতালের মাধ্যমে গর্ভপাত বা প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাও দেয়া হয় এ নারীদের।
দখলকৃত বাংলাদেশ ও স্বাধীন বাংলাদেশ ভ্রমণ করে কানাডিয়ান ইউনিসেফ কমিটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ওটোয়াতে তার হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট পাঠান- দেশজুড়ে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশুর সংখ্যা প্রায় দশ হাজার। যদিও প্রকৃত সংখ্যা কোনোদিনও জানা যায়নি। এর মধ্যে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ২২টি সেবা সদনেই জন্ম নেয় তিন থেকে চারশ শিশু। বীরাঙ্গনাদের কোলজুড়ে জন্ম নেয়া এসব শিশুদের সম্মান এবং মর্যাদার জীবন নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা চালান। বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে জেনেভাভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিস (ISS) এর যুক্তরাষ্ট্র শাখা প্রথম আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে এ ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিতে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশের দুটি স্থানীয় সংস্থার সাথে মিলে এ সংস্থাটি যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে দেশ হিসেবে কানাডা সর্বপ্রথম আগ্রহী হয় এসব শিশুকে দত্তক নিতে। এছাড়াও মাদার তেরেসা ব্যক্তিগতভাবে কাজ করেন যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে। মন্ট্রিল এবং টরন্টোভিত্তিক দুটি অলাভজনক দত্তক প্রতিষ্ঠানও কানাডাতে যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে কাজ করে।
পরবর্তীতে কানাডাসহ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশই এগিয়ে আসে এসব শিশুর দায়িত্ব নিতে। অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হল্ট এডপশন প্রোগ্রাম এবং ইঙ্ক এন্ড টেরে দেস হোমস নামক দুটি প্রতিষ্ঠানও এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়।
আন্তঃদেশীয় দত্তক প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ সরকার ‘দ্য বাংলাদেশ অ্যাবান্ডান্ড চিলড্রেন (স্পেশাল প্রভিশন্স) অর্ডার ১৯৭২’ নামক অধ্যাদেশ জারি করে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পনেরো যুদ্ধশিশুর প্রথম দলটি কানাডায় প্রবেশ করে ১৯ জুলাই, ১৯৭২ সালে। কানাডার সংবাদপত্রগুলোতে নিয়মিত এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যাতে কানাডার জনগণসহ বিশ্বে এ সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এবং আরও বেশি মানুষ ভাগ্যাহত যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে এগিয়ে আসে।
এদিকে এ নিয়ে কাজ করা মানুষদের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে সেসব মায়েদের আর্তনাদের চিত্র। সমাজকর্মী নীলিমা ইব্রাহীম এবং তৎকালীন সময়ে দত্তক সংক্রান্ত কাজে জড়িত অন্যান্য কর্মীদের ভাষ্যমতে, এসব শিশুর জন্মদাত্রী মায়েদের অনেকেই স্বেচ্ছায় তার বাচ্চাকে তুলে দিতে চাননি অন্যের হাতে। করেছেন কান্নাকাটি, কড়া সিডেটিভ জাতীয় ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে মায়েদের অজান্তেই তাদের সন্তানদের তুলে দিতে হয়েছে নতুন মা-বাবার হাতে।
কেমন আছেন সেসব যুদ্ধশিশু? ‘৭২ সালে যারা ছিলেন নিতান্তই অবুঝ শিশু, আজ তারা পরিণত বয়স্ক মানুষ। তাদের অনেকেই শেকড়ের সন্ধানে বার বার ফিরে এসেছেন বাংলাদেশে। খুঁজে পেতে চেয়েছেন তাদের জন্মদাত্রী মা, স্বজনদের। দেখতে এসেছেন নিজেদের জন্মভূমি। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে উঠে এসেছে তাদের কথা।
এমনই একজন হলেন কোহিনূর। নরওয়েতে বেড়ে উঠেছেন তার পালক বাবা-মায়ের আশ্রয়ে। আজ তিনি সেদেশে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে বেশ পরিচিত। তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে, তিনি একজন যুদ্ধশিশু। ২০১১ সালে এসেছিলেন মাতৃভূমিতে। তিনি জানান, নরওয়েতে তার মতো আরও একশোজনের মতো যুদ্ধশিশু আছেন।
কানাডায় যাওয়া ১৫ যুদ্ধশিশুর মধ্যে একজন ছিলেন রায়ান গুড। ১৯৮৯ সালে ১৯ বছর বয়সে প্রথমবার তার পালক বাবা-মায়ের সাথে আসেন বাংলাদেশে। শেকড়ের তীব্র টানে আবার ফিরে আসেন নিজের গর্ভধারিনী মায়ের খোঁজ করতে। এবার তার সাথে ছিলেন বন্ধু ব্রেন্ট জিঞ্জারিক, চেষ্টা করেছেন মাকে খুঁজে পেতে, কিন্তু তাকে বিফল হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। তিনি কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন যে, তার মা বরিশালের মেয়ে। তাই ঐটুকু তথ্যের উপর ভিত্তি করে ছুটে যান বরিশাল। ছোটাছুটি বিফলে যায়, তবুও হাল ছাড়েননি, আবার নতুন উদ্যমে ছুটে গিয়েছেন কলকাতার মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রধান কেন্দ্রে, যদি তার মায়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়! কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। তিনি মাকে না পেলেও মাতৃভূমির টান ভুলে যেতে পারেননি। তাই তো ১৯৯৮ সালে আবার আসেন এদেশে, এবার পাক্কা এক বছর অবস্থান করে জানার চেষ্টা করেন বাংলাদেশকে।
রায়ান বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নেন, বক্তৃতাও দেন। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে ২০০৩ সালে নির্মিত রেমন্ড প্রভঁশের ‘ওয়ার বেবিজ’ নামক বিখ্যাত প্রামাণ্যচিত্রে রায়ান গুড ছিলেন প্রধান চরিত্রগুলোর একজন। সেবা সদনের রেকর্ড বইতে তার নাম লেখা হয়েছিল ‘বাথল’। রায়ান নিজেকে পুরোদস্তুর বাঙালী করতে বাথল নামটিও নিজের নামের সাথে রেখে দেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে তা পেয়ে যান। যখন জানতে পারলেন, নিজের বাংলা ‘বাথল’ নামের কোনো অর্থ নেই তখন তিনি তা পরিবর্তন করে নাম রাখেন ‘বাদল’। এখন তিনি রায়ান গুড বাদল।
রায়ানের মতো সবাই ভাগ্যের সাথে যুদ্ধ করে নিজের জীবনের চরম সত্যটাকে মেনে নিতে পারেনি, রানীও পারেননি। রানী কানাডায় যাওয়া পনেরো যুদ্ধশিশুর একজন। নিজের জন্ম সংক্রান্ত সত্য জেনে রানীর মধ্যে দেখা দেয় অস্বাভাবিক পরিবর্তন। তার ভেতরে বয়ে যায় এক কষ্টের নদী। ধীরে ধীরে তার মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে যায়, তিনি তার আশেপাশে দেখতে শুরু করেন তার মাকে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, চিকিৎসকরা জানান, রানী বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। সাত বছর তার চিকিৎসা চলে, অবশেষে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৯৯৮ সালে ২৭ বছর বয়সে রানী তার জীবনের অবসান ঘটান নিজ হাতে। বড় অভিমান নিয়ে চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। বেঁচে থাকতে তিনি ‘নদীর সন্তান’ নামে কবিতায় তার মাকে লিখে গিয়েছিলেন।
‘ত্যাগ করেছিলে তুমি আমাকে যখন আমি শিশু,/কেন তা জানি না আমি, কখনো জানব না,/কিন্তু তুমি সারাক্ষণ থাকবে মা আমার ভাবনায়, ভালোবাসবোই জেনো, যেমন কখনও ভালোবাসি।/ছিলাম বিষণ্ন সদা, কেঁদেছি তোমার জন্য কত,/জর্জর ব্যথায় ভরা কত যে রাত্রিতে,/তোমাকে ছোঁবার আগে, জড়িয়ে ধরার আগে/মনে হতো এই ব্যথা কখনো যাবার নয় আর; …।’
বাংলাদেশের জন্মের সাথে জড়িয়ে আছে এমনি অনেক বেদনার কাব্য, অসংখ্য মায়ের ত্যাগের গাথা, অনেক ছেলের শহীদ হওয়ার গল্প। স্বাধীনতার সাথে মিশে আছে অনেক অজানা দুর্ভাগ্যের কাহিনী। ‘একবার যদি পেতাম আমার জন্মদাত্রী মায়ের দেখা!’ ৪৭ বছর ধরে বাংলাদেশ বয়ে চলেছে যুদ্ধশিশুদের এই করুণ আর্তি।
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/
একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো:
১) একাত্তরের যুদ্ধশিশু
২) ‘৭১-এর যুদ্ধশিশু : অবিদিত ইতিহাস
৩) আমরা যুদ্ধশিশু