মিশরীয়দের অদ্ভুত কীর্তির শেষ নেই। তাদের অজানা ও আজব সব কাহিনীর মাঝে কয়েকটি কাহিনী তুলে ধরা হলো আজকের লেখায়।
উল্কা থেকে লোহা নিষ্কাশন
প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রাচীন সমাধি থেকে ধাতুর জপমালা বা পুঁতি খুঁজে পেয়েছেন। এই পুঁতিগুলো একেবারে ভিন্ন ছিলো, কারণ মিশরের অধিবাসীরা মাত্র ২,০০০ বছর পরই লোহা গলানো শুরু করে। চিন্তার বিষয় হলো, তাহলে কীভাবে তারা ধাতুর সেই জপমালা বা পুঁতি খুঁজে পেয়েছিলো? এই প্রশ্নের উত্তরটি লুকিয়ে আছে একটি হায়ারোগ্লিফে (চিত্রলিপিতে ব্যবহৃত বর্ণমালা বিশেষ) এবং তার ভাবানুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা এরকম- ‘আকাশ থেকে আসা ধাতু’। সেসব জপমালা বা পুঁতিগুলো সম্ভবত উল্কাপিণ্ড বা উল্কার উপাদান দিয়ে তৈরি ছিলো।
টুথপেস্ট উদ্ভাবন
মিশরীয়রা যে খ্রিষ্টের জন্মের ৫,০০০ বছর পূর্বে টুথপেস্ট তৈরির কাজ শুরু করেছিলো সে বিষয়ে রয়েছে হাজারো প্রমাণ। তারা এমন একধরনের গুঁড়া বা পাউডার তৈরি করতো যার মধ্যে থাকতো তাদের কাছে সহজলভ্য নানা উপাদান (পোড়ানো ডিমের খোসা এবং ঝামাপাথর)। কিন্তু এখনকার দিনে আমরা এই জাতীয় পেস্টের ব্যবহার সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। বলা যায় যে, এ বিষয়ে শুধুমাত্র অনুমানই করতে পারি আমরা।
চিকিৎসাক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক বা জীবাণু-প্রতিরোধী পদার্থের ব্যবহার
যদিও অ্যান্টিবায়োটিক আনুষ্ঠানিকভাবে আবিষ্কৃত হয় বিংশ শতাব্দীতে, তবুও প্রাচীন মিশরের চিকিৎসকেরা পচন বা ক্ষত সারানোর জন্য ছাতা পরা সেকেলে একপ্রকার রুটি ব্যবহার করতেন। আর সেই চিকিৎসা রোগীদের জন্য ভালো কাজে দিতও বটে!
বিশ্বের প্রথম পুলিশ বাহিনী গঠন
বিশ্বের সর্বপ্রথম পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়েছিলো মধ্য রাজত্বের সময়কালে (২০৫০-১৮০০ খ্রিস্টপূর্বে)। আর এই বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত ছিলো বিশ্বস্ত সব যোদ্ধা এবং ভিনদেশী ভাড়াটে সৈনিকেরা। মিশরীয় সেই পুলিশ বাহিনীর সাথে থাকতো কুকুর এবং বানর। পুলিশ কর্মকর্তারা মন্দির ও শহর চত্বর, সমাজের উচ্চ শ্রেণীর প্রতিনিধি এবং ভ্রমণকারী মরু যাত্রীদল বা কাফেলাকে রক্ষার কাজ করতেন। তাদের সেই পুলিশ বাহিনী ছিলো ঠিক আজকের দিনেের মতোই। শুধুমাত্র পার্থক্য এই যে, তাদের সাথে বানর থাকতো, কিন্তু এখনকার পুলিশ বাহিনীর সাথে বানর রাখার নিয়মটি নেই।
প্রথম বিয়ার (পানীয়) প্রস্তুতকারী
এই বিষয়টি মোটামুটি সকলেরই জানা যে, যেসব শ্রমিক পিরামিড তৈরি করেছিলো তাদেরকে পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিদিন ৪-৫ লিটার করে বিয়ার দেয়া হতো। এই বিষয়টি থেকে সহজেই আঁচ করা যায় যে, পাতা ভিজিয়ে বা ফুটিয়ে পানীয় প্রস্তুত করার বিষয়টি বেশ ভালো একটি পর্যায়ে ছিলো সেই সময়ে। মিশরীয়রা এই পানীয় প্রথম দিককার প্রস্তুতকাররকদের মধ্যে একজন ছিলেন।
জটিল অস্ত্রোপচার
প্রাচীন মিশরীয়দের চিকিৎসা জ্ঞান এতটাই সঠিক এবং ভিন্ন মাত্রার ছিলো যে তা আজকের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে নির্দ্বিধায় তুলনা করা যায়। যে সকল বিজ্ঞানীরা মমিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন, তাদের কাছ থেকে কিছু চ্যালেঞ্জিং অপারেশনের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন- হার্ট বাইপাস সার্জারি, প্লাস্টিক সার্জারি ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, তাদের এসব জ্ঞান এখন বিলুপ্ত হয়েছে। তাই খুব সহজেই আমরা বলতে পারি না যে, সেসব প্রাচীন চিকিৎসকেরা এখন থাকলে তারা তাদের সেই বিশেষ জ্ঞানগুলো দিয়ে রোগ নিরাময়ের কত পদ্ধতিই না অবলম্বন করতেন!
দরজায় তালার ব্যবহার
দরজার তালা মিশর এবং চীনেই তৈরি হয়েছিলো। কারণ সেখানে সম্ভবত এর প্রয়োজন ছিলো। একটি জায়গায় যতটা ঘনবসতি হতো, সে জায়গার প্রতিবেশীরা সাবধানতা অবলম্বনের জন্য দরজায় তালার ব্যবহার নিশ্চিত করতো। মিশরীয় সেই কাঠের তালাগুলো বানানোর প্রক্রিয়া বেশ সহজ ছিলো।
ধর্মীয় তাৎপর্য রক্ষায় পোষা প্রাণী হিসেবে বানর ও বিড়াল
প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে কিছু কিছু পশু-পাখির ছিলো ঐতিহাসিক তাৎপর্য। তাদের মধ্যে একটি হলো বিড়াল। আর পোষা প্রাণীদের মধ্যে বিড়াল ছিলো মিশরীয়দের সবচাইতে প্রিয়। অনেক সময় সেই পোষা বিড়ালদের তাদের মালিকের সাথে মাটিতে পুঁতে দেয়া হতো যেন পরজন্মে তারা একসাথে থাকতে পারে। তবে ধর্মীয় তাৎপর্য ও গাম্ভীর্যের তালিকায় পোষা প্রাণী হিসেবে শুধুমাত্র বিড়ালই ছিলো না, এর সাথে ছিলো বানরও! শুনতে অবাস্তব মনে হলেও ধর্মীয় কার্যক্রম ও জাদুটোনা করার সময় বানরদের আশেপাশে রাখা হতো সম্মান দেখানোর জন্য এবং আনন্দের বস্তু হিসেবেও বানরগুলোকে সাথে রাখা হতো। এই বানরগুলোকে বশে আনতে তাদের অনেক কষ্ট করতে হতো, কারণ বানরগুলোর বসবাস সেসব এলাকায় ছিলো না। ঐতিহাসিকদের মতে, বানরগুলোকে আমদানি করার সময় জাহাজে আনা বাধ্যতামূলক ছিলো। তবুও তারা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, তাদেরকে দেবতাদের সাথে যুক্ত অনেক ধর্মীয় চিত্রাবলীতে দেখা যায় এবং প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসে স্থায়ীভাবে সম্মানিত স্থানে তাদের দেখা হয়।
চোখের চিকিৎসা
মিশরের অধিবাসীদের মধ্যে খুব সাধারণ ও প্রচলিত একটি রোগ ছিলো চোখের ইনফেকশন। তারা বিভিন্ন রকমের এবং কোনো কোনো সময়ে খুবই উদ্ভট রকমের চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করতো। কখনো কখনো তারা জীবাণুনাশক রঙ এবং ঔষধ ব্যবহার করতো যা মানুষের মস্তিষ্ক দিয়ে তৈরি করা হতো। একটি প্রতিকারের উপাদান প্রস্তুত পদ্ধতি অনেকটা এরকম ছিলো- প্রথমে মানুষের মস্তিষ্ককে দুই ভাগে ভাগ করা হতো। এরপর প্রথম ভাগকে মধুর সাথে মিশিয়ে বিকালবেলা চোখে লাগিয়ে রাখা হতো। আর পরের ভাগের অংশটি শুকিয়ে সকালবেলা চোখে লাগানো হতো। এরকম অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর চিকিৎসা আসলেই কাজে দিত কিনা কে জানে!
ফেরাউনরা ছিলো ভয়ঙ্কর রকমের মেদবহুল
ফেরাউনদের বেশিরভাগ ছবিতেই দেখা যায় শুকনা পাতলা গড়নের শরীর। কিন্তু তারা দেখতে মোটেই এ রকম ছিলেন না। তাদের ছবিতে দেখতে এ রকম লাগার কারণ হলো, তারা তাদের চিত্রশিল্পীদের নির্দেশ দিতেন যেন ছবিতে তাদের দেখতে সুন্দর দেখায়। মিশরের বেশিরভাগ রাজকীয় পরিবারের সদস্যরা ছিলেন বাড়তি ওজনের অধিকারী। মিশরের শাসকদের খাদ্যাভ্যাস ছিলো ভীষণ ভয়ানক।
তারা তাদের রাধুনীদের প্রতিদিন তিনবার ভারী ভোজনবিলাসের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিতেন যাতে থাকতো গরুর মাংস, বিভিন্ন রকম কেক ও মদ জাতীয় পানীয়। যেসব মমি পাওয়া গিয়েছিলো তাদের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিলো বদ্ধ ধমনী, স্ফীত পেট ও শরীরের ভাঁজে ভাঁজে চর্বি। মোট কথা, স্থূলতা মিশরের ফেরাউনদের মাঝে বেশ সাধারণ একটি বিষয় ছিলো। আর তাদের এই স্থূলতার বিষয়টি এতটাই পরিচিত ছিলো যে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সাল থেকে এর ভয়াবহতা ও পরিণতি নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বই লেখা হচ্ছিলো।
রাজা তুতেনখামেনকে মৃত্যুর পর সমাহিত করা হয়েছিলো খাড়াভাবে
যখন হাওয়ার্ড কার্টার রাজা তুতেনখামেনের সমাধি খুঁজে পেয়েছিলেন, তখন তিনি এমন কিছু ঐশ্বর্যমণ্ডিত সম্পদ ও ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পেয়েছিলেন, যেগুলোর সন্ধান আগে কোনো ঐতিহাসিক পাননি। তুতেনখামেনের অনেক বিষয়ই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে রাজা তুতেনখামেনের মমি যে একটি নির্মিত অট্টালিকার সাথেই কবর দেয়া হয়েছিলো তা প্রায় অনেকেই জানেন না। কেউ সঠিক বলতে পারে না যে কেনই বা তার মমি এমনভাবে কবর দেয়া হয়েছিলো। এই বিষয়ে ভিন্ন মতবাদ ও তর্ক-বিতর্ক রয়েছে।
ফিচার ইমেজ: LiveInternet