কেবল বিজ্ঞানের মাঝেই যে মহামতি নিউটনের জ্ঞানপিপাসা সীমাবদ্ধ ছিল না, তা পাঠকগণ ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছেন। নিকোলাস ফ্লামেলের পর নিউটনের জীবনেরও বড় অংশ কেটে যায় অজানার পিছে।
নিউটন ১৭০৩ সালে ব্রিটেনের রয়াল সোসাইটির প্রধান হয়ে যান। ১৭০৫ সালে যখন নিউটন ট্রিনিটি কলেজ পরিদর্শন করতে যান, তখন রানী তাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং এরপর থেকেই তিনি স্যার আইজ্যাক নিউটন। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিজ্ঞানী যিনি নাইট উপাধি পান, আগের বিজ্ঞানী নাইট ছিলেন স্যার ফ্রান্সিস বেকন।
নিউটন তার জীবনের শেষ অংশ কাটান তার ভাগ্নি আর ভাগ্নির স্বামীর সাথে উইনচেস্টারের কাছে এক জায়গায়। ১৭২৭ সালের ২০ মার্চ সকালবেলা আবিষ্কার করা হয়, স্যার আইজ্যাক নিউটন ঘুমের মধ্যেই মারা গেছেন। একজন মহামানবের নীরব প্রয়াণ।
মারা যাবার পর তার চুল পরীক্ষা করে অত্যাধিক পারদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। রহস্য জট বাধা শুরু করে। কেন এত পারদ?
ধীরে ধীরে নিউটনের অপ্রকাশিত লেখাগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। আলকেমির জন্য জীবনের বেশিরভাগ সময় পার করে দেয়া নিউটনের অজানা সব দিক আলোতে আসতে থাকে। আসুন দেখা শুরু করা যাক, কী কী করেছিলেন নিউটন।
প্রথমেই বলে নেয়া যায়, নিউটন তার পাণ্ডুলিপিতে লিখে গেছেন ফিলোসফারস স্টোন বা পরশ পাথর তৈরির রেসিপি! তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি ঠিক পথেই আছেন।
তবে সমসাময়িক আলকেমিস্টদের চেয়ে তিনি বেশি রকমের গোপনীয়তা বজায় রাখতেন। যেমন, তার সময়ের আরেক আলকেমিস্ট ছিলেন রবার্ট বয়েল। নামটি পরিচিত লাগবার কথা।
১০ লক্ষেরও বেশি শব্দ নিউটন লিখে গেছেন কেবল এই আলকেমির ফিলোসফারস স্টোন বা পরশমণির ওপর! বেশ কিছু রূপক শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন- সাংকেতিক শব্দ যেগুলার অর্থ আমরা জানি না, যেমন “Green-Lion,” “Neptune’s Trident,” আর “Scepter of Jove”।
নিউটন আর বয়েল নিজেদের মধ্যে এসব আলকেমি নিয়ে গবেষণাগুলো শেয়ার করতেন। তারা কি তাহলে গোপনে স্বর্ণ বানাতে পেরেছিলেন?
রবার্ট বয়েলের কর্মকাণ্ড কিন্তু সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। বয়েল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে সোনা তৈরির উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে আইন ছিল সেটা তুলে নেবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন! কিন্তু কেন? হতে কি পারে, এর কারণ তিনি সোনা তৈরির উপায় বের করে ফেলেছিলেন? আমরা কি জানতে পারব কখনও?
১৬৯১ সালে বয়েল মারা যান। এরপর ব্যাপারটা আরও গুরুতর হয়ে দাঁড়ায় যখন বয়েলের আরেক সহযোগী জন লক (আরেকজন আলকেমিস্ট) বয়েলের বাড়ি থেকে লাল গুঁড়ো আবিষ্কার করেন, সাথে সেই গুঁড়ো প্রস্তুতের ফর্মুলা। সেটি ফিলোসফারস স্টোন তৈরির একটা ধাপ ছিল, পরশ পাথর তৈরির ধাপগুলো আগের একটি পর্বে পাঠকগণ পড়ে এসেছিলেন। জন লক সেটা সরাসরি নিউটনের কাছে পাঠিয়ে দেন।
নিউটন কী করলেন সে লাল গুঁড়ো পাবার পর? দুঃখজনক হলেও সত্য, ইতিহাস সেটা আমাদের জানায় না। তবে, আমরা এটা জানি যে, এরপর নিউটন পাগলামির লক্ষণ প্রকাশ করা শুরু করেন। আর এর জন্য দায়ী ছিল অতিরিক্ত পারদের উপস্থিতি।
আপনি জানেন কি, লাল গুঁড়ো প্রস্তুতির ফরমুলার প্রথম ধাপগুলো ছিল পারদের বারবার উত্তপ্তকরণ আর শীতলীকরণ? এজন্যই নিউটনকে বেশি সময় কাটাতে হয়েছিল পারদের সংস্পর্শে।
১৭২৭ সালে নিউটন মারা যাবার পর সেই লাল গুঁড়ো এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদি নিউটন বা তার কোনো সহকর্মী সুকৌশলে সেই লাল গুঁড়োর নমুনা লুকিয়ে রেখে থাকেন, তবে আশা করা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই- কেউ যেন সেটা খুঁজে পায়।
বিংশ শতাব্দীতে খুঁজে পাওয়া নিউটনের এসব আলকেমি সংক্রান্ত পাণ্ডুলিপি পড়ে যেটা বোঝা যায় তা হলো, নিউটনের আলো আর মহাকর্ষ বিষয়ক গবেষণাগুলো আলকেমিকাল গবেষণা থেকেই পাওয়া।
তার একজন ভৃত্য জানিয়েছিলেন, “নিউটন কখনোই রাত দুটা বা তিনটার আগে শুতে যেতেন না, কখনও কখনও পাঁচটা বা ছ’টা। তিনি চার কি পাঁচ ঘণ্টা ঘুমোতেন। তার ল্যাবের আগুন কখনও বন্ধ হত না।”
মজার ব্যাপার, জীবনের শেষ দিকে ‘কোনো এক কারণে’ তাকে ইংল্যান্ডের স্বর্ণ মজুদের রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।
এবার আসা যাক নিউটনের ধর্মীয় গবেষণার দিকে। ১৭০৪ সালের এক পাণ্ডুলিপিতে নিউটন লিখে গেছেন, তিনি হিসেব করে বের করেছেন, ২০৬০ সালের আগে কোনোমতেই পৃথিবী ধ্বংস হবে না!
তার ধর্মীয় গবেষণার আরেকটি বিষয় ছিল নবী সুলাইমানের (আ) মসজিদ, বা সলোমন’স টেম্পল। এককথায় যা কি না বাইতুল মুকাদ্দাস, যার সাথে জড়িত মসজিদুল আকসা। সোনালি গম্বুজের চমৎকার মসজিদটি চোখে পড়লেই অনেকে মনে করেন মসজিদুল আকসা বুঝি ওটাই। কিংবা, কেউ কেউ মসজিদুল আকসা বলতেই বোঝেন বাইতুল মুকাদ্দাসকে। সোনালি গম্বুজের মসজিদ আর মসজিদুল আকসা যে এক নয়, কিংবা বাইতুল মুকাদ্দাস বলতে আসলে কী বোঝায়, ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিম সকলের কাছে কেন পবিত্র এ বাইতুল মুকাদ্দাস- এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন আমাদের এ লেখাটি: মসজিদুল আকসা আর বাইতুল মুকাদ্দাসের ইতিবৃত্ত
তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাইতুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা বা এ সংক্রান্ত যা যা আছে সবই অবস্থিত টেম্পল মাউন্ট (Temple Mount) এলাকায়। হিব্রুতে একে ডাকা হয় ‘হার হা-বেইত’ (הַר הַבַּיִת) নামে। ‘হার’ মানে পাহাড় বা মাউন্ট। ‘বেইত’ বা ‘বাইত’ মানে গৃহ বা ঘর। তাই এর অর্থ ‘ঈশ্বরের ঘরের পাহাড়’। জেরুজালেমের ওল্ড সিটির এ টিলার ‘টেম্পল মাউন্ট’ কমপ্লেক্সটি মুসলিমদের কাছে আল হারাম আশ-শারিফ (الحرم الشريف) বা হারাম শরিফ নামে পরিচিত, মক্কার মসজিদুল হারামকেও একই নামে ডাকা হয়। আবার ‘আল হারাম আল কুদস আল শারিফ’ (الحرم القدسي الشريف) নামেও পরিচিত এ জায়গা। উমাইয়া শাসনের যুগ থেকেই এখানে রয়েছে তিনটি ঐতিহাসিক স্থাপনা- মসজিদুল আকসা, চার মিনার, ডোম অফ দ্য রক এবং ডোম অফ দ্য চেইন। ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, এখানে সুলাইমান (আ) নির্মাণ সম্পন্ন করেন ফার্স্ট টেম্পল বা বাইতুল মুকাদ্দাস। সেটি ধ্বংসের পর গড়ে তোলা হয় সেকেন্ড টেম্পল। সেটিও ধ্বংস হয়ে যায়। ইহুদীরা তাই অপেক্ষায় পবিত্র থার্ড টেম্পলের, অর্থাৎ তৃতীয় মন্দিরের। হিব্রুতে সেই পবিত্র উপাসনালয় বা হোলি টেম্পলকে ‘বেইত হা-মিকদাস’ ডাকা হতো। ‘মিকদাস’ মানে পবিত্র, মুকাদ্দাস বা আল-মাক্বদিস বলতে আরবিতে যা বোঝায়, আর হিব্রু বেইত হলো ‘ঘর’, আরবিতে যা বাইত (بَـيْـت)। তো এই ধ্বংসপ্রাপ্ত ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ বা ‘পবিত্র ঘর’ এখন না থাকলেও অনুমান করা যায় যে সেটা এই টেম্পল মাউন্ট বা হারাম শরীফ এলাকাতেই ছিল। ঘরটি না থাকলেও ঘরের পবিত্রতা এখনো আছে এবং ছিল। তাই মূল সেই গৃহকাঠামোর অনুপস্থিতিতে এ জায়গাটিকেই ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ বলা হয়।
আইজ্যাক নিউটন বিশাল গবেষণা করেন সলোমনের এ টেম্পল (Temple of Solomon) বা বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে। আর এজন্য হিব্রু না জানলে চলবে না, তাই তিনি তা শিখে নেন, যেমনটা নিকোলাস ফ্লামেল শিখে নিয়েছিলেন। তিনি হিব্রু থেকে নিজে সব অনুবাদ করেন! নিজের হাতে টেম্পল অফ সলোমন বা বাইতুল মুকাদ্দাসের কাঠামোর মূল নকশা আঁকেন। নিচে তার আঁকা সেই নকশার একটি অংশ দেখুন-
ইহুদীদের ধর্মবিশ্বাসের একটি প্রধান অংশ হলো মসীহে বিশ্বাস করা। মসীহ (מָשִׁיחַ) হিব্রু শব্দ যার অর্থ ত্রাতা। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম যেখানে ইহুদী জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে মসীহ (مسيح) বা মেসায়াহ (Messiah) ছিলেন যীশু খ্রিস্ট বা ঈসা (আ)-কে চিহ্নিত করে, সেখানে ইহুদী বিশ্বাস মতে তাদের মসীহের আগমন এখনও হয়নি। ইহুদী ধর্মের বিশ্বাস ঘাঁটতে গিয়ে আমরা মেলাখিম এর ১১ অধ্যায়ে (মিশনেহ তোরাহ) পাই, ”যে মসীহে বিশ্বাস করে না, বা তার আগমনের অপেক্ষায় নেই, সে মুসা (আ) সহ সকল নবীকেই অস্বীকার করলো।” ইহুদী ভবিষ্যৎবাণী মতে, তাদের মসিহ বা ত্রাণকর্তা জেরুজালেমের থার্ড টেম্পল থেকে দুনিয়া শাসন করবে। খ্রিস্টধর্ম আর ইসলাম ধর্ম অবশ্য সেই মসীহকে প্রকৃত মসীহ বলে না, বরং ‘বিস্ট’ বা ‘দাজ্জাল’ হিসেবে অভিহিত করে। আর এ সময়কালে যীশু বা ঈসা (আ) এর দ্বিতীয় আগমন হবার কথা বলা হয়।
ভাবছেন, কেন এগুলো বলা হলো? নিউটনের সাথে এর কী সম্পর্ক? নিউটনের এগুলো নিয়েও গবেষণা করেছেন! তার ‘হিসেব’ অনুযায়ী, শেষ যুদ্ধ (আরমাগেডন/Armageddon) বা যীশুর দ্বিতীয় আগমন হবে ২০৬০ সালের আশেপাশে একটি সময়, এর আগে পৃথিবী ধ্বংস হবে না। অবশ্য তার হিসেবে ২০৩৪ সালের কথাও উল্লেখ আছে। এটাও বলা আছে যে, ২০১৬ পর্যন্ত অ্যান্টিক্রাইস্ট বা দাজ্জালের রাজত্ব চলবে। তবে পরবর্তীতে তিনি তার হিসেবনিকেশ সম্ভবত ‘সংশোধন’ করেন এবং ২০৬০ এর কথা আনেন।
ধর্ম নিয়ে নিউটনের এত গবেষণা থাকায় স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তার ধর্মবিশ্বাস কী ছিল? উত্তর হলো, তিনি পুরোপুরিই আস্তিক ছিলেন, বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্মে, তবে মূলধারায় নয়। তিনি তার ধর্মবিশ্বাস তখন উন্মুক্ত করেননি এ কারণে যে, সেটি তখন মানুষ গ্রহণ করতে পারত না এবং তাকে ধর্মত্যাগী বলা হতো তাহলে। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন।
পরশমণি নয় কেবল, অমরত্ব লাভের আরেকটা উপকথা ছিল হলি গ্রেইল। খ্রিস্টধর্মের উপকথা অনুযায়ী হলি গ্রেইল হলো সেই পেয়ালা যেটাতে করে যীশুর ক্রুশবিদ্ধ দেহের রক্ত ধারণ করা হয় আর যেটাতে করে পানি খেলে অমরত্ব পাওয়া যাবে।
প্রায় সকল ধর্মেই আছে এমন ‘সুধা’র কাহিনী- অমরত্বের সুধা। বিশেষ করে ইসলামের একটা উপকথা, কোহেকাফ শহরের অমরত্বের ঝর্ণার কাহিনীটা এখানে বলাই লাগে।
তবে তার আগে নিউটনের প্রসঙ্গ শেষ করা যাক। বয়েলের মৃত্যুর পর নিউটন পাগলাটে ভাব দেখান শুরু করেন, সেটা আগেই বলা হয়েছে। এটার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হতো, এ সময়টাতে জন লক নিউটনকে একজন বিধবার সাথে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যান। কিন্তু নিউটনের ছিল নারীভীতি। অনেকে নিউটনের পাগলামির জন্য এই বিবাহপ্রচেষ্টাকেই তাই দায়ী করেন। নিউটন নাকি বিবাহ এড়াতে পাগলামি ভাব দেখান। বলা বাহুল্য, নিউটনের ‘স্ত্রী’ সংক্রান্ত প্রচলিত কৌতুক যা যা আছে তার সবই বানোয়াট। কারণ, নিউটন বিয়েই করেননি। বিয়ের বাইরেও কোনো নারী সংস্পর্শে যাননি। ঐতিহাসিক গেইল ক্রিস্টিয়ান্সনের লেখা থেকে আমরা পাই, নিউটন ভার্জিন বা কুমার অবস্থাতেই মারা যান ৮৪ বছর বয়সে।
অমরত্বের তরল সুধার কাহিনী শুরু হোক তবে পরের পর্বে!
পরের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন:
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৭: অমরত্বের সুধার খোঁজে
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন:
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-১: আলকেমি আর পরশমণি
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-২: পরশমণির খোঁজে আলকেমিস্ট নিকোলাস ফ্লামেল
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৩: নিকোলাস ফ্লামেলের রহস্যময় জীবন
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৪: নিকোলাস ফ্লামেলের ‘রহস্যময়’ অন্তর্ধান
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৫: যুগের শেষ ‘জাদুকর’ স্যার আইজ্যাক নিউটন
বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-