ক্রিমিয়ান/পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধের অবসানের পর থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত সুইডেন–নরওয়ে (১৯০৫ সাল থেকে সুইডেন) সামগ্রিকভাবে নিরপেক্ষতা নীতি অনুসরণ করে এবং এসময় সংঘটিত যুদ্ধগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সুইডেন–নরওয়ে/সুইডেন এসময় পুরোপুরি নিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ক্রিমিয়ান/পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধের সময় ১৮৫৫ সালের নভেম্বরে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এবং সুইডেন–নরওয়ের মধ্যে একটি সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এই চুক্তি অনুসারে, কোনো রাষ্ট্র সুইডেন–নরওয়ের ওপর আক্রমণ চালালে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সুইডেন–নরওয়ের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা ছিল। আপাতদৃষ্টিতে এটি ছিল সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে সুইডেন–নরওয়ের রক্ষাকবচ।
কিন্তু ১৮৭০–১৮৭১ সালের ফ্রাঙ্কো–জার্মান যুদ্ধে ফ্রান্স জার্মানির নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং ব্রিটেন এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। এর ফলে সুইডেন–নরওয়েকে প্রদত্ত ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সুইডেন–নরওয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় ছিল কঠোরভাবে নিরপেক্ষতা নীতি অনুসরণ করা এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করা। সুইডেন–নরওয়ে ঠিক সেই কাজটিই করতে থাকে। ১৮৮০–এর দশক থেকে ইউরোপে যে সামরিক জোটগুলো গঠিত হচ্ছিল, সুইডেন–নরওয়ে সেগুলোতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকে।
রুশ–জাপানি যুদ্ধ এবং সুইডেন–নরওয়ের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন
১৯০৪–১৯০৫ সালের রুশ–জাপানি যুদ্ধের সময় রাশিয়া জাপানের নিকট পর্যুদস্ত হয়। এসময় সুইডেন–নরওয়ে ওসমানীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন আলোচনায় লিপ্ত হয় এবং তাদের সঙ্গে মিলে একযোগে রাশিয়ার ওপর আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করে। জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রুশ সশস্ত্রবাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে সুইডেন–নরওয়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে এরকম একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে, সুইডেন–নরওয়ে উত্তর দিক থেকে এবং ওসমানীয় রাষ্ট্র দক্ষিণ দিক থেকে একযোগে রাশিয়ার ওপর আক্রমণ চালালে রাশিয়া উক্ত আক্রমণের মোকাবিলা করতে পারবে না। তদুপরি, তাদের ধারণা ছিল, এরকম পরিস্থিতিতে ব্রিটেন উক্ত আক্রমণে যোগদান করবে। কিন্তু কার্যত এই পরিকল্পনাটি ছিল অবাস্তব এবং সেসময় সুইডেন–নরওয়ে বা ওসমানীয় রাষ্ট্র কেউই রাশিয়ার বিরুদ্ধে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে এই পরিকল্পনাটি পরিত্যক্ত হয়।
রুশ–জাপানি যুদ্ধের সময় সুইডেন–নরওয়ের উক্ত পরিকল্পনা থেকে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সুইডেন–নরওয়ের নিরপেক্ষতা নীতি মোটেই অটল বা আদর্শভিত্তিক ছিল না। বরং এটি ছিল সম্পূর্ণরূপে সুইডেন–নরওয়ের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ উদ্ধারের একটি মাধ্যম এবং প্রয়োজনবোধে তারা যেকোনো মুহূর্তে উক্ত নীতি পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুইডেন–নরওয়ে একাকী বা ওসমানীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে রুশ–জাপানি যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেনি এবং এর ফলে সুইডেন–নরওয়ের আনুষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।
সুইডেনের জার্মানপ্রীতি এবং জার্মান–সুইডিশ রুশবিরোধী জোটের পরিকল্পনা
বিংশ শতাব্দী নাগাদ জার্মানি সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং সুইডেনের রাজপরিবার, রাজনৈতিক অভিজাতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ও জনসাধারণের বড় একটি অংশ জার্মানির প্রতি অনুরক্ত ছিল। ১৮৮০–এর দশকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও ইতালির সমন্বয়ে যে ‘ত্রিপক্ষীয় মৈত্রী’ (Triple Alliance) গড়ে উঠেছিল, সুইডেন সেটিতে যোগদান করেনি। কিন্তু সুইডেন ও জার্মানির মধ্যে সামরিক সহযোগিতার মাত্রা কার্যত এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, ১৯১০ সালের নভেম্বরে জার্মান ও সুইডিশ সশস্ত্রবাহিনীদ্বয়ের জেনারেল স্টাফদ্বয়ের মধ্যে একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং তারা রাশিয়ার তদানীন্তন রাজধানী সেইন্ট পিটার্সবার্গের ওপর যৌথভাবে আক্রমণ পরিচালনার বিষয়ে আলোচনা করে। কিন্তু রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পাদিত হয়নি।
জুলাই সঙ্কট এবং সুইডেনের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন
১৯১৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বসনিয়া–হার্জেগোভিনার রাজধানী সারায়েভোয় একজন সার্ব আততায়ীর গুলিতে অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিন্যান্ড ও তার স্ত্রী নিহত হন। অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং সার্বিয়াকে বেশ কিছু কঠোর দাবি সংবলিত একটি চরমপত্র প্রদান করে। সার্বিয়া তন্মধ্যে একটি দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং এর ফলে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে ও ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। রাশিয়া সার্বিয়ার প্রতি এবং জার্মানি অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। ‘জুলাই সঙ্কট’ নামে পরিচিত এই সময়ে সুইডেন জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরিকে এই মর্মে আশ্বস্ত করে যে, সুইডেন কখনোই রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে না।
সুইডেন আরো জানায় যে, যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সুইডেন নিরপেক্ষতা ঘোষণা করবে, কিন্তু এরপর সুইডেন কী করবে না করবে সেটা বেছে নেয়ার স্বাধীনতা সুইডেনের থাকবে। সুইডেনের আশঙ্কা ছিল যে, যুদ্ধের শুরুতেই সুইডেন জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির পক্ষে যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করলে ব্রিটেন যুদ্ধে রাশিয়া ও সার্বিয়ার পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে পারে। প্রত্যুত্তরে জার্মানি জানায় যে, ব্রিটেন যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করলে জার্মানি কেন্দ্রীয় শক্তির (জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি, ওসমানীয় রাষ্ট্র ও বুলগেরিয়ার সমন্বয়ে গঠিত সামরিক জোট) পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য সুইডেনকে চরমপত্র প্রদান করতে পারে। এসময় সুইডিশ ও জার্মান সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং যুদ্ধের ক্ষেত্রে জার্মানি যেন সুইডেনের ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করতে পারে সেজন্য প্রাথমিক প্রস্তুতিও নেয়া হয়।
একই সময়ে সুইডেন রাশিয়াকে এই মর্মে আশ্বস্ত করে যে, আসন্ন যুদ্ধে সুইডেন নিরপেক্ষ থাকবে। কিন্তু সুইডেন রুশ–সুইডিশ সীমান্তের ওপর নজর রাখার জন্য সেখানে সৈন্য মোতায়েন করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং সুইডেনের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ৩১ জুলাই সুইডেন অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ার মধ্যেকার যুদ্ধে নিজেদের নিরপেক্ষতা ঘোষণা করে। ১ আগস্ট জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ২ আগস্ট সুইডেন ব্রিটেনকে জানায় যে, সুইডেন যদি যুদ্ধে জড়িয়েই পড়ে, সেক্ষেত্রে সুইডেন কখনো রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করবে না। ৩ আগস্ট জার্মানি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। একই দিনে সুইডেন জার্মানি এবং রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যেকার যুদ্ধে নিজেদের নিরপেক্ষতা ঘোষণা করে। ৪ আগস্ট ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর মধ্য দিয়ে সুইডেনের আশঙ্কা বাস্তবায়িত হয়। জার্মানি সুইডেনকে তাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের জন্য চরমপত্র প্রদান করতে পারে, এই আশঙ্কায় সুইডেন জার্মানিকে জানায় যে, সুইডেনের নিরপেক্ষতা জার্মানির জন্য ‘উপকারী’ হবে।
৮ আগস্ট সুইডেন ও নরওয়ে যৌথভাবে ঘোষণা করে যে, তারা এই যুদ্ধে নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে এবং একে অপরের নিরপেক্ষতা রক্ষা করবে। একই বছরের ডিসেম্বরে সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্ক যৌথভাবে অনুরূপ একটি ঘোষণা দেয়। একই সময়ে সুইডেন রুশ–সুইডিশ সীমান্তে মোতায়েনকৃত সৈন্যদলকে প্রত্যাহার করে নেয়।
যুদ্ধের শুরুতেই জার্মানি বাল্টিক ও উত্তর সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী প্রণালীগুলোয় মাইন স্থাপন করার জন্য সুইডেনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। সুইডেন এই পদক্ষেপ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন জার্মানি এর পরিবর্তে ব্রিটিশ নৌবহর এতদঞ্চলে উপস্থিত হলে সেক্ষেত্রে সুইডেনের উপকূলে অবস্থিত লাইটহাউজগুলো নিষ্ক্রিয় রাখা এবং প্রণালীগুলোতে পথ প্রদর্শনকারী চিহ্নগুলো অপসারণ করার জন্য সুইডেনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। সুইডেন এই শর্তদ্বয় মেনে নেয়। অবশ্য অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, সুইডেন কার্যত এই শর্ত দুইটিকে পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত করেনি।
একই সময়ে সুইডেন জার্মানিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা প্রদান করে। সুইডিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জার্মানিকে সুইডিশ সাইফার ব্যবহার করে বিদেশে অবস্থিত জার্মান দূতাবাসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ করে দেয়। এর ফলে মিত্রশক্তির পক্ষে জার্মানদের যোগাযোগ ‘ইন্টারসেপ্ট’ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯১৫ সালে সুইডেন মিত্রশক্তিকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা জার্মানিকে আর এরকম সুযোগ প্রদান করবে না। কিন্তু সুইডেন এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি এবং জার্মানরা সুইডিশ সাইফার ব্যবহার অব্যাহত রাখে।
১৯১৫ সালে জার্মানি সুইডেনকে কেন্দ্রীয় শক্তির অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালায় এবং বছরের প্রথমার্ধে সুইডেনকে পরপর দুইটি প্রস্তাব দেয়। ১৯১৫ সালের শুরুতে প্রদত্ত প্রথম প্রস্তাবে সুইডেনের কেন্দ্রীয় শক্তিতে যোগদানের বিনিময়ে জার্মানি সুইডেনের অধীনে একটি ‘নর্ডিক ব্লক’ স্থাপনের (অর্থাৎ নর্ডিক রাষ্ট্রগুলোকে সুইডেনের অধীনে একত্রীকরণের) প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সুইডেন এই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। ১৯১৫ সালের জুনে প্রদত্ত দ্বিতীয় প্রস্তাবে সুইডেনের কেন্দ্রীয় শক্তিতে যোগদানের বিনিময়ে জার্মানি রাশিয়ার ফিনল্যান্ড ও বাল্টিক প্রদেশগুলোকে সুইডেনের কাছে হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সুইডেন এই প্রস্তাবে আগ্রহ দেখায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটিকেও প্রত্যাখ্যান করে।
১৯১৫ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ নৌবাহিনী বাল্টিক সাগরে বেশ কয়েকটি জার্মান রসদবাহী জাহাজ ও একটি জার্মান যুদ্ধজাহাজকে ডূবিয়ে দেয়। এসময় একটি জার্মান যুদ্ধজাহাজ ‘Hvalen’ নামক একটি সুইডিশ সাবমেরিনের ওপর গোলাবর্ষণ করে এবং এর ফলে সাবমেরিনটির একজন নাবিক নিহত হয়। এসময় সাবমেরিনটিতে সুইডিশ পতাকা উত্তোলিত ছিল এবং সাবমেরিনটি সুইডেনের আঞ্চলিক সমুদ্রের (territorial sea) মধ্যে ছিল। পরবর্তীতে জার্মানি এই ঘটনার জন্য সুইডেনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং নিহত নাবিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। এই পরিস্থিতিতে জার্মানি আবার সুইডেনের প্রণালীগুলোয় মাইন স্থাপন করার জন্য সুইডেনের ওপর চাপ দিতে থাকে এবং নিজেরাই সুইডেনের আঞ্চলিক সমুদ্রের অভ্যন্তরে মাইন স্থাপন করে।
১৯১৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে জার্মানি সুইডেনকে নিজেদের পক্ষে যুদ্ধে জড়ানোর উদ্দেশ্যে আরেকটি প্রস্তাব দেয়। তারা রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গের ওপর সম্ভাব্য একটি আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য সুইডেনকে আহ্বান জানায়। জার্মানি প্রতিশ্রুতি দেয় যে, বিনিময়ে জার্মানি সুইডেনকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করবে, রাশিয়ার সুইড–অধ্যুষিত আলান্দ দ্বীপপুঞ্জকে সুইডেনের কাছে হস্তান্তর করবে, সুইডেন ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্তকে সুইডেনের অনুকূলে নিয়ে আসবে (অর্থাৎ কিছু রুশ ভূখণ্ড সুইডেনকে প্রদান করবে) এবং ফিনল্যান্ডকে স্বাধীনতা/স্বায়ত্তশাসন প্রদান করবে। কিন্তু ১৯১৫ সালের নভেম্বরে সুইডেন এই প্রস্তাবটিও প্রত্যাখ্যান করে এবং সুইডেনের রাজা পঞ্চম গুস্তাফ জানান যে, যুদ্ধে যোগদানের ‘ন্যায়সঙ্গত কারণ’ (casus belli) ছাড়া সুইডিশ জনসাধারণ যুদ্ধকে সমর্থন করবে কিনা, এই বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন।
এদিকে যুদ্ধ শুরুর পর বাল্টিক সাগরে বেশ কিছু ব্রিটিশ ও ফরাসি বাণিজ্যিক জাহাজ আটকা পড়েছিল এবং এসময় ব্রিটেন ও ফ্রান্স সুইডেনের একটি প্রণালী ব্যবহার করে সেগুলোকে সরিয়ে নিচ্ছিল। জার্মানি সেখানে আক্রমণ চালাতে পারে, এই আশঙ্কায় সুইডেন ১৯১৬ সালের এপ্রিলে উক্ত প্রণালীতে মাইন স্থাপন করে। মিত্রশক্তি সুইডেনের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে এবং সুইডেনের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে।
যুদ্ধের শুরু থেকেই সুইডেন কেন্দ্রীয় শক্তি ও মিত্রশক্তি উভয়ের সঙ্গে বিস্তৃত বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখে। সুইডেনে উৎপন্ন লৌহ আকরিক জার্মানি ও ব্রিটেন উভয়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং যুদ্ধ চলাকালে সুইডেন উভয় পক্ষের নিকট বিপুল পরিমাণ লৌহ আকরিক বিক্রি করে। যুদ্ধের শুরুতেই ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে নৌ অবরোধ আরোপ করেছিল এবং এর ফলে জার্মানির জন্য বাইরে থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করা মারাত্মক কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে সুইডেন থেকে আমদানিকৃত লৌহ আকরিক ছিল জার্মানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সুইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ হলেও সামগ্রিক বিচারে তাদের সমর্থন ছিল জার্মানির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও জার্মান ইউ–বোটগুলো সমুদ্রে সুইডিশ জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া অব্যাহত রাখে। সামগ্রিকভাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মান ইউ–বোটের আক্রমণে মোট ২৮০টি সুইডিশ জাহাজের সলিলসমাধি ঘটে এবং এর ফলে অন্তত ৮০০ জন মানুষ নিহত হয়।
মিত্রশক্তি কর্তৃক সুইডেনের নিকট খাদ্যদ্রব্য রপ্তানির ওপর আরোপিত অবরোধ, জার্মান ইউ–বোটের আক্রমণে বহু সংখ্যক সুইডিশ রসদবাহী জাহাজের সলিলসমাধি এবং শস্য উৎপাদনে ব্যর্থতার ফলে ১৯১৭ সালের জানুয়ারি নাগাদ সুইডেনে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। মিত্রশক্তি বহু দিন যাবৎ জার্মানির নিকট লৌহ আকরিক রপ্তানি হ্রাস করার জন্য সুইডেনের ওপর চাপ দিচ্ছিল এবং বিনিময়ে সুইডেনের নিকট খাদ্য রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল। ১৯১৭ সালের এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তিতে যোগদানের পর সুইডেনের ওপর এই চাপের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু সুইডিশ সরকার আশঙ্কা করছিল যে, মিত্রশক্তির সঙ্গে এরকম একটি চুক্তি সম্পাদন করলে জার্মানির প্রতিক্রিয়া খুবই নেতিবাচক হতে পারে।
মিত্রশক্তির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে অনীহা ও আরো নানাবিধ কারণে সুইডেনে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং পরিস্থিতির চাপে ১৯১৭ সালের মার্চে সুইডেনের তদানীন্তন সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু তাতে সুইডেনের খাদ্য সঙ্কট ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান হয়নি। ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলে একটি নতুন সরকার সুইডেনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং এর ফলে সামাজিক গণতন্ত্রীরা (Social Democrats) সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান বন্ধ করে দেয়। এর ফলে আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস পায়, কিন্তু আন্দোলন পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
এদিকে ১৯১৭ সালের শেষার্ধে জার্মানি আবার সুইডেনকে প্রস্তাব দেয় যে, সুইডেন জার্মানির যুদ্ধ প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করলে এবং জার্মানির কাছে অতিরিক্ত লৌহ আকরিক রপ্তানি করলে বিনিময়ে জার্মানি আলান্দ দ্বীপপুঞ্জকে সুইডেনের কাছে হস্তান্তর করবে। এক্ষেত্রে জার্মানি হয় আলান্দ দখল করে সেটিকে সুইডেনের কাছে হস্তান্তর করবে, নয়তো আসন্ন শান্তি আলোচনায় সেটিকে সুইডেনের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করবে। ইতোমধ্যে ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ফিনল্যান্ড বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আলান্দ দ্বীপপুঞ্জ ফিনল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বীপপুঞ্জটির অধিবাসীরা প্রধানত সুইডিশভাষী এবং পরবর্তীতে সুইডেন সফরকারী আলান্দের একটি প্রতিনিধি দলের ভাষ্যমতে, সেখানে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটে সেখানকার ৯৫% অধিবাসী আলান্দকে সুইডেনের সঙ্গে যুক্ত করার পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু ফিনল্যান্ড আলান্দকে নিজস্ব ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করত এবং সুইডেন সদ্য স্বাধীন ফিনল্যান্ডের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী ছিল, সুতরাং এই পর্যায়ে সুইডেন আলান্দ দখল করে ফিনল্যান্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছুক ছিল না।
সুতরাং সুইডেন জার্মান প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় শক্তিকে এই মর্মে অনুরোধ করে যে, আলান্দে সুইডেনের স্বার্থ রক্ষিত হলেই সুইডেন সন্তুষ্ট থাকবে এবং দ্বীপপুঞ্জটিকে ‘নিরপেক্ষকরণ’ (neutralization) করলে সবচেয়ে ভালো হবে। ১৯১৮ সালের ৪ জানুয়ারি সুইডেন ফিনল্যান্ডকে তাদের ঘোষিত সীমানায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আলান্দের ওপর ফিনল্যান্ডের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়।
আলান্দ দ্বীপপুঞ্জে সুইডিশ আক্রমণ এবং যৌথ জার্মান–সুইডিশ দখলদারিত্ব
১৯১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আলান্দ থেকে স্থানীয় সুইডদের একটি প্রতিনিধি দল সুইডিশ সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং আলান্দে অবস্থানরত সোভিয়েত রুশ সৈন্যরা স্থানীয় জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করে (তাদের এই বিবরণ ছিল অতিরঞ্জিত)। তারা সোভিয়েত রুশ সৈন্যদের হাত থেকে আলান্দের সুইড জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য সুইডেনের সাহায্য প্রার্থনা করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সুইডেন আলান্দ আক্রমণ করে এবং সুইডিশ ও সোভিয়েত রুশ সৈন্যরা লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। এসময় ফিনল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ চলছিল এবং ফিনল্যান্ডে কমিউনিজমবিরোধী ‘শ্বেত ফিন’ সরকার ও কমিউনিস্ট ‘লাল ফিন’ সরকার পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। শ্বেত ফিন সরকার আলান্দ দ্বীপপুঞ্জ থেকে সোভিয়েত রুশ সৈন্যদের বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে জার্মানির কাছে সহায়তা প্রার্থনা করে। সুইডেন আলান্দ আক্রমণ করার এক সপ্তাহ পর জার্মানি সুইডেনকে জানায় যে, জার্মান সৈন্যরা আলান্দ দখল করবে এবং সুইডিশ সৈন্যদের তাৎক্ষণিকভাবে দ্বীপপুঞ্জটি ত্যাগ করা উচিত।
শীঘ্রই জার্মানি আলান্দে আক্রমণ চালায় এবং দ্বীপটিতে অবস্থানরত সোভিয়েত রুশ সৈন্যদের পরাজিত ও বন্দি করে। জার্মানি ও সুইডেন একটি সমঝোতায় পৌঁছায় এবং দ্বীপটি প্রায় দুই মাস জার্মান–সুইডিশ যৌথ নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে। কিন্তু ১৯১৮ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে শ্বেত ফিন সরকারের প্রতিবাদের মুখে সুইডেন আলান্দ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।
এদিকে ১৯১৮ সালের মে মাসে সুইডেনের ওপর থেকে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণরূপে তুলে নেয়া হয়। এর ফলে সুইডেনের খাদ্য সঙ্কট পরিস্থিতিতে উন্নতি ঘটে। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ কেন্দ্রীয় শক্তি মিত্রশক্তির নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং এর মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। এভাবে শেষ পর্যন্ত সুইডেন কোনো পক্ষে যোগদান না করেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পার করতে সক্ষম হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সুইডেনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যুদ্ধ চলাকালে সুইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখলেও কার্যত তারা পুরোপুরি নিরপেক্ষ ছিল না এবং তাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল জার্মানির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতি। সুইডেন কেন্দ্রীয় শক্তিতে যোগ দেয়নি এবং এই যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়নি, কিন্তু তারা জার্মানিকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল সরবরাহ করেছে, জার্মানির অনুরোধ মোতাবেক নিজস্ব আঞ্চলিক সমুদ্রে মাইনক্ষেত্র স্থাপন করেছে, নিজস্ব সাইফার জার্মানিকে ব্যবহার করতে দিয়েছে এবং এমনকি জার্মান সৈন্যদের সঙ্গে মিলে আলান্দ দ্বীপপুঞ্জ যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অন্যদিকে, সুইডেন মিত্রশক্তির সঙ্গে বাণিজ্য করেছে এবং তারাও জার্মান ইউ–বোট আক্রমণাভিযানের শিকার হয়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সুইডেন মিত্রশক্তির চেয়ে কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিল। এমতাবস্থায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সুইডেনের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হবে, সেটিই স্বাভাবিক।