বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকা যদি দেখা হয়, তাহলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের দেশগুলোর আধিপত্য খালি চোখেই বোঝা যাবে। সুইডেন এই অঞ্চলেরই এক বিখ্যাত দেশ। গ্লোবাল পিস ইনডেক্সের সমীক্ষা বলছে, এই পৃথিবীতে ১৬১টি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে সুইডেনের অবস্থান এগারোতম। এটি নিঃসন্দেহে সুইডিশ সরকার ও জনগণের জন্য বিশাল অর্জন। তবে ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, আজকের শান্তিপূর্ণ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে পুরো ষোড়শ শতাব্দীজুড়ে যুদ্ধ কিংবা সামরিক সংঘাতের মতো ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো কখনও আবার অনেকাংশে এই অঞ্চলের দেশগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে ড্যানিশ রাজতন্ত্রের আধিপত্য থেকে সুইডেনের স্বাধীনতা তেমনই একটি ঘটনা, যেটি আধুনিক সুইডেনের প্রতিষ্ঠার সূচনা এনে দিয়েছিল।
আধুনিক সুইডেনের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় গুস্তাভ ভাসাকে। বলা যায়, তার সামরিক পরিকল্পনা, যুদ্ধের সময় সাংগঠনিক দক্ষতা ও দেশের প্রতি অসামান্য ভালোবাসা মূলত সুইডেনকে ড্যানিশ রাজতন্ত্রের শেকল থেকে মুক্ত করেছিল। তিনি চাইলেই সুইডেনের অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্যান্য ব্যক্তির মতো ড্যানিশ আধিপত্য মেনে সুইডিশ সমাজে নিজের আভিজাত্য বজায় রেখে আরামে জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তার দেশে বাইরের কোনো শাসক শাসন করবে, এটা মেনে নেয়ার মতো মানসিকতা তার ছিল না। সুইডেনকে নিয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল, যেগুলো তিনি স্বাধীনতা অর্জনের পর পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তার নেওয়া পদক্ষেপগুলো নিয়ে বিশাল বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য তিনি যা করেছেন, সেগুলো তাকে সুইডেনের ইতিহাসে অমর করে রাখবে। তার নিজের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর দিকে যদি আলোকপাত করা যায়, তাহলে আধুনিক সুইডেনের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।
স্বাধীনতা অর্জনের আগে সুইডেন ছিল ঐতিহাসিক ‘কালমার ইউনিয়ন’ এর সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি দেশ। দেশটি শাসিত হতো তাদের নিজস্ব প্রশাসকের মাধ্যমে, যার নাম স্টেন স্টিউর। ইউনিয়নের প্রতিটি দেশকে মূলত আলাদাভাবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছিল ড্যানিশ রাজা ইউনিয়নের অনেক বিষয়ে তার নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দিচ্ছেন। এজন্য সুইডিশ প্রশাসক স্টেন স্টিউর বারংবার অসন্তোষ প্রকাশ করলেও আদতে কোনো লাভ হয়নি। তিনি ড্যানিশ রাজার একাধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সুইডেনের জন্য নিজের সাধ্যমতো প্রস্তাব তুলতেন। কিন্তু তাকে বারবার প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে। ড্যানিশ রাজা মনে করতেন, সুইডেনকে আলাদা হওয়ার অধিকার প্রদান করলে একসময় কালমার ইউনিয়নের আরেক দেশ নরওয়ে স্বাধীনতার দাবি তুলবে। শেষপর্যন্ত ইউনিয়ন ভেঙে যাবে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে ড্যানিশদের যে আধিপত্য, তা শেষ হয়ে যাবে। কেউ কি আর স্বেচ্ছায় নিজের একাধিপত্যের অবসান দেখতে চায়? এই চিন্তা থেকে ড্যানিশ রাজা প্রথম ক্রিস্টিয়ান বার বার স্টেন স্টিউরের স্বাধীনতার দাবি প্রত্যাখ্যান করছিলেন।
গুস্তাভ ভাসার জন্ম সুইডেনের অভিজাত পরিবারে, ১৪৯৬ সালে। তিনি সুইডেনের তৎকালীন প্রশাসক স্টেন স্টিউরকে মন থেকে সমর্থন করতেন। ব্রানকির্কার যুদ্ধ শেষের পর ড্যানিশ রাজা ও কালমার ইউনিয়নের কর্ণধার দ্বিতীয় ক্রিস্টিয়ান একটি আলোচনাসভার আয়োজন করলেন। এর কারণ হিসেবে রাজা বলেছিলেন- তিনি ও স্টেন স্টিউর একত্রে বসে সুইডেনের ভবিষ্যত নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। রাজার যেন সন্দেহের অবকাশ না থাকে, এজন্য ছ’জন সুইডিশ ব্যক্তিকে রাজার প্রতিনিধিদের কাছে ‘আমানতস্বরূপ’ স্টেন স্টিউর আগেই আলোচনাস্থলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নিজেদের দিক থেকে তারা শতভাগ সৎ আছেন– এটা বোঝাতেই মূলত ছয়জন ব্যক্তিকে পাঠানো হয়েছিল, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন গুস্তাভ ভাসা। বাস্তবে দেখা গেল- আলোচনার এই প্রস্তাব ছিল একটি ফাঁদ। বিনা কারণে আলোচনা ভেস্তে দিয়ে দোষ চাপানো হলো স্টেন স্টিউরের কাঁধে। যে ছয়জনকে পাঠানো হয়েছিল, তাদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হলো ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে।
বন্দীরা ভেবেছিলেন- হয়তো তাদের সাথে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল- তাদের সাথে অপ্রত্যাশিত কিছু তো হয়ইনি, বরং তাদের ড্যানিশ রাজা বেশ আদর-যত্ন করলেন। রাজার এই ব্যবহারে তারা এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে, তাদের মানসিকতা ও চিন্তায় রাতারাতি বিশাল পরিবর্তন চলে আসলো। ডেনিশ রাজা ও স্টেন স্টিউরের মধ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনার আগে তারা সবাই ছিলেন সুইডেনের স্বাধীনতার পক্ষে। কিন্তু রাজার হাতে বন্দী অবস্থায় তাদের এমনভাবে মস্তিষ্ক ধোলাই করা হলো, এবং রাজার আদর-যত্নে তারা এতটাই মুগ্ধ হলেন যে, প্রায় সবাই কালমার ইউনিয়নে সুইডেনের থেকে যাওয়ার পক্ষে মতামত প্রদান শুরু করলেন, মাতৃভূমির স্বাধীনতার কথা বেমালুম চেপে গেলেন। তবে এই ছয়জনের মধ্যে একজন তখনও সুইডেনের স্বাধীনতার দাবির প্রতি সমর্থন ধরে রেখেছিলেন– তিনি গুস্তাভ ভাসা। ড্যানিশ রাজার কাছে বাকিদের এমন বিকিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তরুণ গুস্তাভ চরম বিরক্ত হয়েছিলেন।
গুস্তাভকে বন্দী করে রাখা হয়ে কুখ্যাত ক্যালো কারাগারে। সেখান থেকে তিনি পালানোর পথ খুঁজছিলেন, কিন্তু কারারক্ষীদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় পালানোর চিন্তাভাবনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল না। অবশেষে তিনি সুযোগ পেলেন। রাখালের ছদ্মবেশ ধরে তিনি সফলভাবে কারাগার থেকে পালাতে সক্ষম হন, এবং বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে ‘লুবেক’ নামের এক শহরে ছদ্মবেশে থাকতে শুরু করেন। এই শহরে তার থাকতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি, কারণ শহরের মূল অধিবাসী ছিল উত্তর জার্মানির লোকেরা, যারা ব্যবসায়িক কারণে এই শহরে বসবাস করত, একজনের অনুপস্থিতিতে আরেকজন তার ব্যবসায়িক জিনিসপত্র পাহারা দিত। জার্মান ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যে চুক্তিতে বলা হয়- বিদেশে বাণিজ্যের সময় একজন জার্মান ব্যবসায়ী অবশ্যই আরেকজন জার্মান ব্যবসায়ীর অনুপস্থিতিতে তার ব্যবসার সমস্ত জিনিসপত্র রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে। গুস্তাভ ভাসার এই শহরে থাকতে কোনো ঝামেলা ছিল না, যেহেতু এই শহরের বেশিরভাগ অধিবাসী ডেনমার্কের স্বীকৃত নাগরিক ছিল না।
লুবেক শহরে থাকতেই গুস্তাভ ভাসা এমন কিছু খবর শুনতে পান, যেগুলো তাকে প্রচন্ড কষ্ট দেয়। তার কাছে খবর আসে- সদ্য সিংহাসনে বসা সুইডেনের ড্যানিশ রাজা দ্বিতীয় ক্রিস্টিয়ান সুইডেনে সৈন্যসামন্তসহ এসেছেন, এবং স্বাধীনতাকামী স্টেন স্টিউর নিহত হয়েছেন। তার মৃত্যুর পর ড্যানিশ রাজা নিজের পছন্দমতো এক ধর্মযাজককে ক্ষমতায় বসান। এই ধর্মযাজক ছিলেন ড্যানিশ রাজার ‘হাতের পুতুল’ ও তিনি কালমার ইউনিয়নে সুইডেনের থেকে যাওয়ার পক্ষে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আসলে রাজা দ্বিতীয় ক্রিস্টিয়ান সুইডেনের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য সে-রকমই একজনকে খুঁজছিলেন, যিনি একইসাথে শিক্ষিত ও অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হবেন, সুইডিশ সমাজের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে, এর পাশাপাশি ডেনিশ রাজার প্রতি সেখানে আনুগত্যও প্রকাশ করবে। ক্ষমতা লাভের পর সুইডেনের নতুন প্রশাসকের আশঙ্কা ছিল, হয়তো সুইডেনের অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা স্টেন স্টিউরকে সমর্থন করেন, তারা হয়তো ভবিষ্যতে তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেন।