কম্পিউটার যারা ব্যবহার করেন, তারা একবার হলেও ট্রোজান ভাইরাসের সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু ক’জন জানেন সেই বিখ্যাত ট্রোজান হর্সের গল্প? ট্রোজান যুদ্ধ, যেখানে গ্রিকদের হাতে পরাজিত হয় ট্রয় নগরী। হেলেনের সৌন্দর্য, হেক্টর এবং অ্যাকিলিসদের বীরত্ব, গ্রিকদের ধূর্ততা, দেব-দেবী সবকিছু মিলিয়ে ট্রোজান যুদ্ধের গল্প অবিশ্বাস্য মনে হলেও প্রায় ৩ হাজার বছর পরেও মানুষকে কৌতূহলী করে তোলে। তবে এখনো প্রশ্ন থেকে যায়, ট্রয় নগরী কি আসলেই এ পৃথিবীতে ছিল? নাকি তা শুধুই একটি গ্রিক শ্রুতিগল্প?
ট্রয় নগরী এবং ট্রোজান যুদ্ধের কথা আমরা জানতে পারি প্রাচীন গ্রিক লেখক হোমার এর অনবদ্য সৃষ্টি ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডেসি’ থেকে। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ খুঁজে পান প্রাচীন বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া সেই ট্রয় নগরী। বর্তমান তুরস্কের একপ্রান্তে অবস্থিত ‘হিসারলিক‘কে তৎকালীন ট্রয় নগরী বলে ধারণা করা হয়।
ব্রোঞ্জ যুগের এক প্রসিদ্ধ শহর ট্রয়। এজিয়ান সাগরের উপকূলে অবস্থিত এ শহর জড়িয়ে আছে মানব সভ্যতার সূচনা এবং বিস্তারের সঙ্গে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে গড়ে ওঠে এ নগরী। বর্তমান এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের তৎকালীন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রয়। ব্রোঞ্জ যুগে পশ্চিম এবং পূর্ব বিশ্বের ব্রোঞ্জের পরিবহনের পথ ছিল এটি। বাণিজ্যিক প্রসিদ্ধির সাথে সাথে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক এই নগরীও।
ট্রয় যখন উন্নতির শিখরে, চারদিকে তখন গ্রিকদের রাজত্ব। স্বাভাবিকভাবেই গ্রিকরা ট্রয় দখল করার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং এখান থেকে হোমারের গল্পের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম এক যুদ্ধের সঙ্গে। ইতিহাসে এই যুদ্ধ পরিচিত ট্রোজান যুদ্ধ নামে, যা স্থায়ী হয়েছিল দীর্ঘ দশ বছর।
হোমার তাঁর ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডেসি’ রচনা করেন বীর যোদ্ধা অ্যাকিলিস ও রাজা অ্যাগামেমনন এবং তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, ট্রোজান যুদ্ধ বাস্তব ঘটনা। হোমার এমন এক বংশ থেকে এসেছেন যারা গীতের মাধ্যমে ইতিহাস মনে রাখতেন। হোমার হয়তো তাদের একজন এবং তিনি তার গীতি গল্পকে প্রথম অক্ষরের মাধ্যমে তুলে ধরেন।
গল্পের শুরু হয় অ্যাকিলিসের পিতা মিরমিডোন্সএর রাজা পিলিয়াস এবং গ্রিক দেবী থেটিসের বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানে সকল দেবতাকে নিমন্ত্রণ করা হলেও ‘ইরিস’, দ্বন্দ্বের দেবীকে নিমন্ত্রণ করা হয় না। ইরিস তবুও অনুষ্ঠানে আসেন। তিনি একটি সোনালি আপেল সঙ্গে আনেন, যাতে লেখা ছিল “সবথেকে সুন্দরীর জন্য”। তিন দেবী হেরা, এথিনা এবং এফ্রোডাইটি আপেলটি দাবী করেন এবং জিউসকে বিচারক হবার আহবান জানান। কিন্তু জিউস অসম্মতি জানান এবং ট্রয়ের সুদর্শন রাজকুমার প্যারিসকে এ দায়িত্ব দেন। প্যারিস এফ্রোডাইটিকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এফ্রোডাইটি প্যারিসকে পৃথিবীর সুন্দরীতম রমণী দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দরী রমণী হেলেন ছিলেন অ্যাগামেমননের ভাই স্পার্টার মেনালাউসের স্ত্রী।
প্যারিস বাণিজ্যিক কাজে স্পার্টা ভ্রমণে যান এবং সেখান থেকে হেলেনের সঙ্গে পালিয়ে ট্রয়ে ফিরে আসেন৷ মেনালাউস তার স্ত্রী এবং গ্রিকদের সম্মান ফিরিয়ে আনতে তার ভাই মাইসিনির অ্যাগামেমননের সাহায্য প্রার্থনা করেন। অ্যাগামেমনন সহজে রাজী হয়ে যান, কেননা এর মাধ্যমে ট্রয়কে গ্রিক সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে জয় করার সম্ভাবনা ছিল।
অ্যাগামেমনন অন্যান্য গ্রিক রাজাদের একত্রিত করেন এবং প্রায় এক হাজার জাহাজ নিয়ে ট্রয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন। গ্রিকদের যাত্রাপথে বাধা হন দেবতা আর্টেমিস। সমুদ্রের বাতাস থেমে যায় আর্টেমিসের অভিশাপে। দেবতাকে খুশি করতে অ্যাগামেমনন তার নিজ কন্যা ইফিজিনিয়াকে হত্যা করেন উৎসর্গ হিসেবে। কেউ কেউ বলেন, ইফিজিনিয়ার সঙ্গে অ্যাকিলিসের বিয়ে হবার কথা ছিল। আর্টেমিস এতে তার অভিশাপ তুলে নেন এবং গ্রিক সৈন্যবাহিনী অ্যাগামেমননের নেতৃত্বে ট্রয়ে পৌঁছায়।
কিন্তু দীর্ঘ দশ বছরে তারা ট্রয়ের দেয়াল ভেদ করতে পারেনি। যুদ্ধের শেষ বছরে অ্যাগামেমনন এবং তৎকালীন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অ্যাকিলিসের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর ফলে অ্যাকিলিস যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এ সময় প্যাট্রোক্লাস অ্যাকিলিসের বর্ম পরে যুদ্ধে যান এবং হেক্টরের হাতে নিহত হন। প্যাট্রোক্লাস অ্যাকিলিসের নিকট গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। হোমার ইলিয়াডে তাদের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক তুলে ধরলেও প্লেটো এবং অন্যরা তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তুলে ধরেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অ্যাকিলিস হেক্টরের সাথে যুদ্ধের আহবান জানান এবং হেক্টর পরাজিত হন। অ্যাকিলিস হেক্টরের মৃত দেহ টেনে তাদের শিবিরে নিয়ে আসেন। তৎকালীন ট্রয়ের রাজা এবং হেক্টরের পিতা প্রিয়াম রাতের অন্ধকারে অ্যাকিলিসের সাথে একা সাক্ষাৎ করেন এবং তার সন্তানের দেহ ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানান। অ্যাকিলিস রাজি হন এবং ১১ দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন।
এর মধ্যে ওডেসিয়াস একটি কাঠের ঘোড়া তৈরির বুদ্ধি বের করেন। একটি বিরাট কাঠের ঘোড়া, যার ভেতরে গ্রিক সৈন্যরা অবস্থান নেন। ঘোড়াটি তীরে রেখে গ্রিকরা ফিরে যায়। ট্রোজানরা ভাবে ঘোড়াটি তাদের জন্য উপহার হিসেবে রেখে গিয়েছে গ্রিকরা। ট্রোজান সৈন্যরা তাদের দেয়াল ভেঞে ঘোড়াটিকে শহরে নিয়ে যায়। রাতে যখন তারা তাদের বিজয় উদযাপনে মত্ত থাকে তখন ঘোড়ার ভেতর থেকে গ্রিক সৈন্যরা বের হয়ে আসে এবং শহরের ফটক খুলে দেয় অন্যান্য গ্রিক সৈন্যদের প্রবেশের জন্য, যারা আসলে ফিরে না গিয়ে সমুদ্রে অপেক্ষারত ছিল। এভাবে তারা জয় করে ট্রয় নগরী। প্রিয়ামকে হত্যা করা হয়। হেক্টরের শিশু সন্তানকে ট্রয়ের দেয়াল থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলা হয়। অ্যাকিলিস নিহত হন প্যারিসের ছোড়া তীরে। এভাবে শেষ হয় দীর্ঘ দশ বছরের ট্রোজান যুদ্ধ।
যুদ্ধ শেষে গ্রিকদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন খুব একটা সহজ হয় না। দশ বছর সমুদ্রে ঘুরে হেলেনকে নিয়ে নিজ দেশে ফেরেন মেনালাউস। মেনালাউস হেলেনকে হত্যা করতে চাইলেও তার সৌন্দর্যের কাছে পরাজিত হন। অ্যাগামেমনন নিজ দেশে ফিরে প্রথম রাতেই নিহত হন তার স্ত্রীর প্রেমিকার দ্বারা।
মেনালাউসের মতোই দশ বছর ঘুরে দেশে ফেরেন ওডেসিয়াস।
হোমারের বর্ণিত এই গল্পের সত্যতা বর্তমান পৃথিবী জানে না। কিন্তু ট্রোজান যুদ্ধ এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, ইতিহাস বা শ্রুতিকথা যা-ই হোক না কেন, তা আজ মিলে মিশে একাকার। পরবর্তীতে অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজারের মতো মহারথীরাও অনুপ্রাণিত হয়েছেন এই ট্রোজান যুদ্ধ থেকে। অ্যালেক্সান্ডার যেমন নিজেকে মিলিয়েছেন গ্রিক বীর অ্যাকিলিসের সঙ্গে, তেমনি জুলিয়াস সিজার নিজেকে তুলনা করেছেন ট্রোজান বীর এনিয়াসের সঙ্গে।
ট্রোজান যুদ্ধের গুরুত্ব অনেক বেশি, কারণ এ যুদ্ধের মাধ্যমে মানব সভ্যতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। হোমারের ইলিয়াড এবং ওডেসির মাধ্যমে প্রথম গ্রিক সাহিত্য সৃষ্টি হয়। এ কারণে গ্রিক বর্ণমালার সূচনা হয় যা পরবর্তীতে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এ যুদ্ধ ধূর্ততা, বীরত্ব, দেশপ্রেম, ভালোবাসার মতো বিষয়কে প্রকটভাবে ফুটিয়ে তোলে। ৩,০০০ বছর পূর্বের এ যুদ্ধ হতে পারে বাস্তবতা অথবা শুধুই একজন লেখকের সৃষ্ট এক গল্প। যেটাই হোক না কেন, আজ তা আর বিবেচ্য নয়। মানব সভ্যতার সঙ্গে মিশে আছে ট্রয়।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘ইতিহাস’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/