মানুষের জালিয়াতির ইতিহাসের শুরু সেই আদিকাল থেকেই। যখন থেকে সে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হয়েছে, তখন থেকে শুরু হয়েছে তার জালিয়াতির অভূতপূর্ব ইতিহাসও। পরিবারের জাল দলিল করা থেকে শুরু করে চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সাহিত্য, রাজনীতি- বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জালিয়াতির নানা ঘটনা ঘটেছে। এমনই এক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৩ সালে জার্মানির স্বৈরশাসক হিটলারের ডায়েরিকে কেন্দ্র করে। বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে বড় জালিয়াতির ঘটনা ছিল এটি।
তিরিশের দশক থেকে শুরু করে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জার্মানির ভাগ্যবিধাতা হিটলার সারা পৃথিবীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সে তার বক্তৃতার মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ ও সমাজতন্ত্র বিরোধিতা ছড়াতে চেয়েছিল। তার কাজকর্মের মধ্য দিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল সকলকে। জার্মানির সামরিক বাহিনীকে নতুন নতুন সব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে একটি সমগ্রতাবাদী ও ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল হিটলার।
বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে, লক্ষ লক্ষ লোককে নির্বিচারে হত্যা করেছিল সে। তাই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত রাষ্ট্রনায়কদের অন্যতম হয়ে আছে হিটলার।
স্বভাবতই, হিটলারের জীবনযাত্রা, তার চিন্তাভাবনা, এমনকি তার চরিত্রের নানা দিক নিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের মনে ছড়িয়ে আছে এক অদম্য কৌতূহল। এজন্য কোনো ব্যক্তিগত রোজনামচা বা ডায়েরি সে রেখে গিয়েছিল কিনা- তা নিয়ে গবেষণার অন্ত ছিল না।
অবশেষে ১৯৮৩ সালের ২২ এপ্রিল ঘটল সেই চমকপ্রদ ঘটনা। পশ্চিম জার্মানি থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘স্টার্ন’ এর একটি সম্পাদকীয়তে জানানো হয় যে, হিটলারের লেখা ৬২ খানা ডায়েরি তাদের এক সংবাদ প্রতিনিধি খুঁজে পেয়েছেন। ‘ইমিটেশন’ চামড়ায় মোড়া এই ডায়েরিগুলোতে হিটলার নাকি ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৪ বছরের রোজনামচা লিখে গেছে।
পত্রিকাটি আরো জানায় যে, তাদের ৫১ বছরের বয়স্ক সংবাদ প্রতিনিধি জার্ড হাইডম্যান ডায়েরিগুলো খুঁজে পেয়েছেন। কার কাছ থেকে তিনি এগুলো সংগ্রহ করেছেন, তা অবশ্য প্রকাশ করতে রাজি হননি হাইডম্যান। তবে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৫ সালের ২২ এপ্রিল ড্রেসডেন শহরের কাছে একটি বিমান ধ্বংস হয়। তার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেই নাকি ডায়েরিগুলো পাওয়া গিয়েছে। যে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে হিটলার আত্মহত্যা করেছিল, সেখান থেকে হিটলারের নিজস্ব লোকজন ও দামী জিনিসপত্র দশটি বিমানে করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ডায়েরিগুলো ঐ বিমানের ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে কাছেই একটি খড়ের গুদামে লুকিয়ে রাখা হয় বলে তথ্য দেন হাইডম্যান।
বলাই বাহুল্য, এই চমকপ্রদ খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা পৃথিবীর বুদ্ধিজীবী মহলে একটা দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক ও গবেষক মন্তব্য করেছিলেন, ‘এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা’! এ গবেষকদের অনেকেরই অভিমত ছিল যে, হিটলার যেখানে নিজের হাতে কিছু লিখতে একেবারেই পছন্দ করতো না, সেখানে তার লেখা ৬২ খানা ডায়েরি পাওয়া একেবারেই অসম্ভব!
তার একাধিক ব্যক্তিগত সহকারি ও কর্মচারী জানান যে, হিটলার নিজের হাতে দৈনন্দিন রোজনামচা লেখার মতো সময়ই পেত না। তাছাড়া হিটলার ছিল স্নায়ুরোগী। এ রোগে আক্রান্ত হবার পর থেকেই হিটলারের ডান হাত অনবরত কাঁপত। শুধু তাই নয়, ১৯৪৪ সালে তাকে মেরে ফেলার জন্য যে চেষ্টা হয়েছিল, তাতেও তার ঐ ডান হাতখানাই বেশ কিছুদিনের জন্য অকেজো হয়ে পড়েছিল।
‘স্টার্ন’ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ কিন্তু তাদের দাবিতে অটল রইল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সবগুলো ডায়েরি সংগ্রহ করার পর ধারাবাহিকভাবে সেগুলো প্রকাশ করা এবং তা থেকে বিশাল পরিমানের অর্থ সংগ্রহ করা। সে লক্ষ্যে তারা ডায়েরিগুলোর উপর ভিত্তি করে একটি বই প্রকাশ করে যার নাম ছিল ‘Plan 3’।
‘স্টার্ন’ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ তাদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য কয়েকজন ঐতিহাসিকের সাহায্য নেন। ট্রেভর রোপার, ডেভিড আরভিং, ওয়েইবার্গের মতো বিখ্যাত ঐতিহাসিকরাও রায় দিলেন যে, ডায়েরিগুলো খাঁটি বলেই তাদের অনুমান। এগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে দেয়ার জন্য ৩০ লক্ষ ডলার দর চাওয়া হয়।
‘সানডে টাইমস’ ৪ লক্ষ ডলার দিয়ে এ ডায়েরিগুলির আংশিক স্বত্ব কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে এগুলো নিয়ে সন্দেহ ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যেতে লাগল। অগত্যা ‘স্টার্ন’ কর্তৃপক্ষ ডায়েরিগুলির কিছু কিছু অংশ পশ্চিম জার্মানির সরকারি হেফাজতে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে রাজি হল। হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্টদের মাধ্যমে শুরু হয় বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ডায়েরি পরীক্ষা করা। ইতোমধ্যে ‘স্টার্ন’ পত্রিকায় ডায়েরিগুলোর প্রথম একটি কিস্তিও প্রকাশিত হয়ে যায়। কিন্তু তার পরের দিনই সেই চমকপ্রদ ডায়েরি আবিষ্কারের কাহিনী তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে।
বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর দেখা যায় যে, ১৯৬২ সালে ম্যাকস্ ডোমারাস নামে এক পূর্বতন নাৎসি কর্মকর্তা ‘হিটলারস স্পিচেস অ্যান্ড প্রোক্লেমেশন্স’ নামে যে বইখানা লিখেছিলেন, ঐ ডায়েরির একটি বড় অংশই সেই বই থেকে নেয়া। দেখা গেল, ডোমারাসের বইয়ে যেসব ভুলভ্রান্তি ছিল, ঐ ডায়েরিগুলোতেও আছে হুবুহু সেই একই ভুলভ্রান্তি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষার ফলে অন্যান্য হস্তাক্ষরের সঙ্গে ডায়েরিগুলির হস্তাক্ষরের ছাঁচে ও টানেও অনেক গড়মিল বেরিয়ে পড়ল।
রাসায়নিক পরীক্ষায় প্রমানিত হলো যে, এক ধরনের সুতো ও আঠা ঐ ডায়েরিগুলি বাধাঁই ও লেবেল আটকানোর কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। বাঁধাই ও লেবেলের কাজে এমন সুতো ও আঠা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে তৈরিই হত না। আরো দেখা যায়, ডায়েরির প্রথম ও শেষ খণ্ডগুলির মধ্যে ১৪ বছরের ব্যবধান থাকলেও, ৫২টি ডায়েরিই একই রকম পরিস্কার এবং প্রায় দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে খড়ের গুদামে পড়ে থাকা সত্ত্বেও একেবারে অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে, যা মোটেই সম্ভবপর নয়।
এছাড়াও হিটলারের মতো লোক এই ধরনের সস্তা ডায়েরি ব্যবহার করবে- এ ব্যাপারটিও একেবারে বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ সে খুব দামী, উঁচুমানের বাঁধানো বই পছন্দ করত। যে সমস্ত ঐতিহাসিক ও গবেষকদল প্রথমে ডায়েরিগুলিকে খাঁটি বলে রায় দিয়েছিলেন, তারাও এখন অনেকে স্বীকার করেন যে, তাদের ভুল হয়েছিল।
পশ্চিম জার্মানির তৎকালীন অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী ফ্রেডরিখ জিমারম্যান ঘোষণা করলেন যে, ঐ ডায়েরিগুলো আদৌ হিটলারের নিজের হাতের লেখা নয়। এগুলি লেখা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। এরপর সরকারি একাধিক কর্মকর্তাও সংশয়াতীতভাবে প্রমাণ করেন যে, এই ডায়েরিগুলো নিছক জালিয়াতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের দাবি জালিয়াতিটা করা হয়েছে ১৯৬৪ সালে।
এভাবে প্রমাণিত হয়, হিটলারের ডায়েরিগুলো ছিল ভুয়া। আর এজন্য স্টার্ন ম্যাগাজিনকে ৯ মিলিয়ন জার্মান মার্ক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এসবের মধ্য দিয়েই পরিসমাপ্তি ঘটে বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে বড় চমকপ্রদ জালিয়াতির ঘটনার।