পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে বলা হয় বিশ্বের সর্বকালের সেরা মেধাবী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রায় সব শাখায় তার ছিল সমান বিচরণ। উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার, প্যারাস্যুট, সাঁজোয়া যান, মেশিনগান, আধুনিক ঘড়ি, স্বয়ংক্রিয় রোবট, মোটরগাড়ি প্রভৃতি আবিষ্কৃত হওয়ার শতশত বছর আগেই দ্য ভিঞ্চি সেগুলোর কথা কল্পনা করে গেছেন এবং সেগুলোর বিভিন্ন খসড়া চিত্র অঙ্কন করেছেন। তবে দ্য ভিঞ্চির এসব স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের পেছনে যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল, তিনি হলেন দ্বাদশ শতকের বিজ্ঞানী ইসমাইল আল-জাজারি।
ইসমাইল আল-জাজারির পুরো নাম বদিউজ্জামান আবুল ইজ ইবনে ইসমাইল ইবনে আর-রাজাজ আল-জাজারি। তার জন্ম ১১৩৬ সালে তৎকালীন মেসোপটেমিয়ার জাজিরাত ইবনে উমার নামক এলাকায়। এলাকাটি সংক্ষেপে জাজিরা নামেও পরিচিত ছিল। তার নামের শেষ অংশ আল-জাজারি মূলত তার জন্মস্থান জাজিরাকেই নির্দেশ করে। আল-জাজারির শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। তবে পারিবারিকভাবেই তিনি প্রকৌশলবিদ্যা রপ্ত করেন এবং ১১৮১ সাল থেকে তিনি বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়ার দিয়ারবাকির রাজ্যের সুলতান নাসিরুদ্দিনের দরবারের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
আল-জাজারি ছিলেন সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বহুবিদ্যাবিশারদ। তিনি ছিলেন একাধারে একজন যন্ত্র প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, গণিতবিদ, শিল্পী ও দক্ষ কারিগর। তার আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ঘড়ি, দৃষ্টিনন্দন ঝর্ণা, হাত ধোয়ার যন্ত্র, পানি উত্তোলন যন্ত্র, সুরযন্ত্র, স্বয়ংক্রিয় ফটক ইত্যাদি। আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলোর মধ্যে কয়েকটি এতই উন্নত ছিল যে, সেগুলো যে আটশো বছর পূর্বে তৈরি, সেটি বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। তার নির্মিত দুর্গঘড়িকে অনেকে বিশ্বের প্রথম অ্যানালগ কম্পিউটার হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়াও তার আবিষ্কৃত রোবট জাতীয় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মধ্যে একটি ছিল অটোম্যাটেড ওয়েট্রেস। এটি ছিল নারীর অবয়ব বিশিষ্ট একটি যন্ত্র, যা নির্দেশ পাওয়ামাত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রথমে বালতিতে, এরপর সেখান থেকে গ্লাসে পানীয় ঢেলে এরপর নির্দিষ্ট পথ ধরে হেঁটে এসে তা পরিবেশন করতে পারত।
আল-জাজারির আবিষ্কারগুলোর বিবরণ পাওয়া যায় তার লেখা একটি বইয়ে, যার ইংরেজি নাম Book of Knowledge of Ingenious Mechanical Devices। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বইটিতে কর্যপ্রণালীর উপর ভিত্তি করে ৬টি বিভাগের অধীনে মোট ৫০টি যন্ত্রের বিবরণ দেওয়া আছে। বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি শুধু তত্ত্বীয় কোনো বই না। এতে বর্ণিত প্রতিটি যন্ত্র আল-জাজারি নিজে নির্মাণ করেছিলেন এবং বইটিতে তিনি যন্ত্রগুলোর জটিল কার্যপদ্ধতি, নির্মাণ কৌশল এবং বিভিন্ন অংশের বিবরণ চিত্র সহ লিপিবদ্ধ করেছেন। জাজারির বইটি তার সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং এর অনেকগুলো অনুলিপি তৈরি করা হয়েছিল।
আল-জাজারির বইটির প্রথম ভাগটি ঘড়ি সংক্রান্ত। এতে মোট ১০টি অধ্যায় আছে। এ অধ্যায়গুলোতে তিনি বিভিন্ন ধরনের ঘড়ি নির্মাণের বিবরণ দিয়েছেন। যেমন দুর্গঘড়ি, নৌকাঘড়ি, ময়ূরঘড়ি, মোমঘড়ি ইত্যাদি। তবে যে আবিষ্কারটির জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, সেটি হচ্ছে তার হস্তিঘড়ি বা এলিফ্যান্ট ক্লক। এটি মূলত বিশাকৃতির একটি যান্ত্রিক হাতির উপর অবস্থিত জলঘড়ি। জলঘড়ি (Water Clock)-এ পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোনো পাত্র কতটুকু পূর্ণ হয়েছে কিংবা তা থেকে কতটুকু পানি বেরিয়ে গেছে, তা পরিমাপের মাধ্যমে সময় মাপা হয়।
জলঘড়ি হচ্ছে সময় পরিমাপের সবচেয়ে প্রাচীন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি। ঠিক কবে এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল, তা নিশ্চতভাবে জানা না গেলেও খ্রিস্টপূর্ব ১,৬০০ অব্দে প্রাচীন ব্যবিলন এবং মিসরে এ ধরনের ঘড়ি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে চীন এবং ভারতসহ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও জলঘড়ির প্রচলন ছিল। কিছু কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, সর্বপ্রথম জলঘড়ির উৎপত্তি হয়েছিল চীনে খ্রিস্টপূর্ব ৪,০০০ অব্দে। তবে এই দাবির পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে পেণ্ডুলাম ঘড়ি আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জলঘড়িই ছিল সময় পরিমাপের সবচেয়ে নির্ভুল যন্ত্র।
ইসমাইল আল-জাজারির সময়টি ছিল ইসলামের স্বর্ণযুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় তখন মুসলমান বিজ্ঞানীদের ছিল অগাধ বিচরণ। স্বাভাবিকভাবেই এই বিজ্ঞানীদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারই ছিল তৎকালীন ইসলামিক সমাজের চাহিদা থেকে অণুপ্রাণিত। আল-জাজারিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি দামেস্কের মসজিদে পানির সংকট দূর করতে প্রথম জলশক্তি ও গিয়ার ব্যবহার করে পানি সরবরাহ পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় জানার জন্য মুসলিম সমাজে সঠিক সময় নির্ণয়ে সবসময়ই বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আল-জাজারির আগে থেকেই অবশ্য বিভিন্ন স্থানে মুসলমানরা সরল জলঘড়ি ব্যবহার করত। কিন্তু আল-জাজারি তার অসাধারণ জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে এই জলঘড়ির প্রযুক্তিকে অন্যতম উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রচলিত অন্যান্য জলঘড়ি থেকে তার এলিফ্যান্ট ক্লকটি অনেক দিক থেকেই ব্যতিক্রমধর্মী। ২২ ফুট (প্রায় সাড়ে ছয় মিটার) উচ্চতা বিশিষ্ট এই ঘড়িটি একটি বিশালাকৃতির কাঠের হাতির উপর অবস্থিত। হাতির পিঠের উপর একটি পাটাতন রাখা থাকে, যেখানে পেন্সিল হাতে একজন কেরাণী বসে থাকে। পাটাতনের চার কোনায় অবস্থিত চারটি স্তম্ভের উপর থাকে একটি দুর্গ সদৃশ কাঠামো। দুর্গের উপর থাকে একটি গম্বুজ, যার উপরে বসে থাকে একটি ফিনিক্স পাখি। দুর্গের সামনের বারান্দায় বসে থাকে আরেকজন ব্যক্তি, যার দুই পাশের জানালা দিয়ে মুখ বের করে রাখে দুটি বাজপাখি। দুর্গের নিচে এবং হাতির পিঠের উপরে মাঝামাঝি স্থানে থাকে দুটি ড্রাগনের মুখ বিশিষ্ট সর্প, যারা একটি অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরতে পারে। আর হাতির কাঁধের উপর বসে থাকে একজন মাহুত, যার এক হাতে থাকে একটি কুঠার, অন্য হাতে আছে একটি দণ্ড।
ঘড়িটির মূল কার্যপ্রণালী সম্পাদিত হয় হাতিটির পেটের অভ্যন্তরে। সেখানে একটি পানিপূর্ণ জলাধারের উপর একটি পাত্র রাখা থাকে। পাত্রটির নিচে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে, যার মধ্য দিয়ে পাত্রটিতে পানি প্রবেশ করতে থাকে, ফলে এটি ধীরে ধীরে পানিতে নিমজ্জিত হতে থাকে। ছিদ্রটির মাপ এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেন একবার সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হতে পাত্রটির সময় লাগে আধঘণ্টা। পাত্রটির সাথে হাতির পিঠে পাটাতনের উপর বসে থাকা কেরাণীর হাতের পেন্সিলটি একটি সুতা দ্বারা সংযুক্ত থাকে। ফলে পাত্রটি নিমজ্জিত হবার সময় তার টানে পেন্সিলসহ কেরাণীটি ঘুরতে থাকে এবং পেন্সিলটি পাটাতনের উপর অবস্থিত গোলাকার চাকতির উপর অঙ্কিত সংখ্যাগুলোর দিকে নির্দেশের মাধ্যমে আধঘন্টা সময়ের মধ্যে অতিক্রান্ত মিনিটগুলো নির্দেশ করতে থাকে।
পাত্রটি যখন সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়, তখন ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে। একাধিক সুতায় টান পড়ার কারণে ঘড়িটির একেবারে উপরে অবস্থিত একটি ধারক হেলে পড়ে এবং তাতে সংরক্ষিত অনেকগুলো বলের মধ্য থেকে একটি বল নিচের একটি পাখার উপর গড়িয়ে পড়ে। এরফলে পাখাটি এবং তার সাথে সংযুক্ত ফিনিক্স পাখিটি ঘুরতে শুরু করে এবং সুমধুর শব্দে জানান দিতে থাকে যে, আধঘণ্টা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।
এরপর বলটি একটি বাজপাখির ঠোঁটের মধ্য দিয়ে নিচে অবস্থিত একটি সাপের মুখের উপর গড়িয়ে পড়ে। বলের ভারে সাপটি যখন একটি অক্ষকে কেন্দ্র করে উল্টে পড়তে থাকে, তখন তার টানে নিমজ্জিত পাত্রটি পুনরায় খালি অবস্থায় পানির উপরে উঠে আসে। বলটি সাপের মুখ থেকে একটি দানিতে এসে পড়ে, ফলে মাহুতের হাতের কুঠার এবং দণ্ডটি উঠানামা করার মাধ্যমে প্রক্রিয়াটির একটি ধাপের সমাপ্তি নির্দেশ করে। বলের ভারমুক্ত হওয়া সাপটি পুনরায় নিজের অবস্থানে ফেরত যায় এবং সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি আবার নতুন করে শুরু হয়।
ঘড়িটিতে সময় নির্দেশ করার জন্য দুর্গের উপরের গম্বুজটির সম্মুখভাগে একটি অর্ধচন্দ্রাকার চাকতি রাখা থাকে। চাকতিটির উপর ঘণ্টার নির্দেশক সংখ্যাগুলো লিপিবদ্ধ করা থাকে। প্রতিটি সংখ্যার উপর থাকে একটি করে গোলাকার গর্ত। প্রথম আধঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম বলটি সরে যাওয়ার কারণে সংখ্যাটির উপর অবস্থিত গর্তটির রং অর্ধেক পরিবর্তিত হয়ে যায়। এক ঘন্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর দুটি বল সরে যাওয়ায় সম্পূর্ণ গর্তের রং পরিবর্তিত হয়ে যায়। এর ফলে বোঝা যায় যে, একঘন্টা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এভাবে দিনের যেকোনো সময় ঘড়িটির দিকে তাকিয়েই বোঝা যায় সূর্যাস্তের পর কতটুকু সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।
আল-জাজারির এই এলিফ্যান্ট ক্লকটি শুধু তার জটিল এবং নিখুঁত কার্যপ্রণালীর কারণেই বিখ্যাত না। এটি যে একইসাথে বিভিন্ন অংশের মাধ্যমে নানাবিধ সংস্কৃতিকে ধারণ করে, তার জন্যও সমানভাবে প্রশংসিত। ঘড়িটিতে ব্যবহৃত হাতিটি হচ্ছে ভারতীয়, এর উপর রাখা কার্পেটটি পারস্যের, ড্রাগন সদৃশ সাপ দুইটি চীনের, ফিনিক্স পাখিটি মিশরের এবং পাগড়ি পরা মাহুত ও কেরাণী আরবের। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে সর্বজনীন এবং বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে আহরিত জ্ঞানকে আপন করে নেওয়ার মাধ্যমেই যে উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব, আল-জাজারি হয়তো তার এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই ইঙ্গিতই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সময় পরিমাপের উদ্দেশ্যে তৈরি আল-জাজারির এ আবিষ্কারটি সময়ের পরিক্রমায় টিকে থাকতে পারেনি। তবে রয়ে গেছে তার লেখা বইটি, যেখানে ঘড়িটির বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে। বইটির বর্ণনা অনুযায়ী বিভিন্ন সময় ঘড়িটি পুনর্নির্মাণের চেষ্টাও করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো দুবাইয়ের ইবনে বতুতা মলের ভারতীয় অংশে অবস্থিত এলিফ্যান্ট ক্লক, যেটি হু্বহু আসল এলিফ্যান্ট ক্লকের মাপ এবং নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও ১০০১ ইনভেনশন্স কর্তৃক নির্মিত কয়েকটি অনুলিপিও আছে ঘড়িটির, যার একটি স্থান পেয়েছে লন্ডন সায়েন্স মিউজিয়ামে।
ফিচার ইমেজ- SABIT/ tirto.id