ফরাসি-ইন্ডিয়ান লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। এ সময় ভূমধ্যসাগরে ব্রিটিশ এবং ফরাসি নৌবহরের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘাত চলছিল। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ আর আমেরিকার সাথে নৌপথ সচল রাখতে ভূমধ্যসাগর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ফ্রান্সের প্রধান ঘাঁটি ছিল তুঁলো (Toulon)। ইংল্যান্ডের শক্তিশালী অবস্থান ছিল মিনোর্কা দ্বীপের বন্দর ম্যাহন আর জিব্রাল্টারে। এখান থেকে ব্রিটিশরা ভূমধ্যসাগরে ফরাসি সামরিক-বেসামরিক সমস্ত জাহাজ চলাচল বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছিল। তাদের কাছে খবর পৌঁছে যে ফরাসিরা নৌপথে ইংল্যান্ডে আক্রমণের ছক করছে। ফলে অ্যাডমিরাল জন বিংকে দশটি জাহাজ দিয়ে পাঠানো হলো ভূমধ্যসাগরে ব্রিটিশ অবরোধ শক্তিশালী করতে।
সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের নৌযুদ্ধ
সাগরে লড়াই হয় মূলত ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে। ১৭৬২ সালে স্পেন ফ্রান্সের পক্ষে মাঠে নামলেও ততদিনে বহু দেরি হয়ে গেছে। স্থলের লড়াইয়ে সমানে সমানে সংঘর্ষ চললেও সাগরে দু-একটি ফরাসি সাফল্য ছাড়া ব্রিটিশ একাধিপত্য বিরাজ করছিল। পুরো যুদ্ধে ব্রিটিশরা যেখানে ৬৯টি নতুন জাহাজ নিজেদের বহরে যুক্ত করেছিল, সেখানে ফরাসিদের সংযোজন ছিল সাকুল্যে ৬টি জাহাজ। সাগরে প্রাধান্য বিস্তারের মাধ্যমে ইংল্যান্ড তিনটি কাজ করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রথমত, ফ্রান্সের চারদিকের জলপথে ব্রিটিশ জাহাজের উপস্থিতি তাদের উপর একপ্রকার অবরোধ জারি করে। দ্বিতীয়ত, ফরাসি নৌবাণিজ্য ব্যহত করে ব্রিটিশরা ফ্রান্সের অর্থনীতির চাকা স্থবির করে দেয় এবং ফরাসি বাণিজ্য জাহাজ দখল করে সেই মালামাল নিজেদের ভাণ্ডারে জমা করে। তৃতীয়ত, সাগরে ব্রিটিশ জাহাজের টহলে উপনিবেশে সেনা আর সরঞ্জাম পাঠাতে ফ্রান্সকে প্রচুর বেগ পেতে হয়।
ব্যাটল অফ মিনোর্কা
ম্যাহন বন্দরের নিরাপত্তায় মিনোর্কাতে নিয়োজিত ছিল আড়াই হাজার ব্রিটিশ সেনা। ফরাসিরা চাচ্ছিল এখান থেকে তাদের উৎখাত করতে। ফলে বারটি জাহাজ আর ১৫,০০০ সেনা নিয়ে অ্যাডমিরাল গ্যালিসোনিয়ের ১৭৫৬ সালের এপ্রিলে দ্বীপে পা রাখলেন। ব্রিটিশদের সাথে গোলাগুলি আরম্ভ হলে জিব্রাল্টার থেকে অ্যাডমিরাল বিং রওনা হলেন। এদিকে মিনোর্কাতে হামলার খবর লন্ডনে পৌঁছলে ১৭ মে ইংল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল।
এদিকে তেরটি জাহাজ নিয়ে ২০ মে অ্যাডমিরাল বিং মিনোর্কার সামনে এসে অবস্থান নেন। বিপরীতে থাকা ফরাসি জাহাজ অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে ছিল। বিং সরাসরি আক্রমণ করে বসেন। কিন্তু উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবে শত্রুদের তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারলেন না। উল্টো ফরাসি কামানের আঘাতে তার পাঁচটি জাহাজ বিধ্বস্ত হয়। পরিস্থিতি প্রতিকূল বিবেচনা করে বিং জিব্রাল্টারে ফেরত গেলেন। ২৮ তারিখ ম্যাহন বন্দর দখল করে নিল ফরাসিরা। যুদ্ধ শেষ হওয়া অবধি এই দ্বীপ ছিল ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে।
ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে অ্যাডমিরাল বিংয়ের বিচার হয়। তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং এক বছর পর পোর্টসমাউথে এক জাহাজের ডেকে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
রশফাঁ এবং সেন্ট মালোর হামলা
যে অল্প কিছু ক্ষেত্রে সাগরে ব্রিটিশরা ব্যর্থ হয়েছিল তার একটি হল রশফাঁ বন্দর, আরেকটি সেন্ট মালোতে হামলা চালাতে গিয়ে। ব্রিটিশরা ফরাসিদের আটলান্টিকে জাহাজ ভাসাতেই দিতে রাজি ছিল না, তাই তারা নানা দিকে অবরোধ জারি করেছিল। রশফাঁ আর সেন্ট মালো ছিল আটলান্টিকে ফরাসিদের প্রবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। তাই ব্রিটিশরা এখানে আক্রমণ চালায়।
প্রথম হামলা করা হয় রশফাঁতে। অ্যাডমিরাল এডওয়ার্ড হক ছিলেন নৌবহরের প্রধান। তার কাজ ছিল জেনারেল মরডান্টের অধীনস্থ স্থলবাহিনীকে তীরে নামিয়ে দেয়া এবং জলপথ থেকে ফরাসি অবস্থানে গোলাবর্ষণ। ১৭৫৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কুয়াশার মধ্যে নৌবহর রশফাঁর কাছে এসে পৌঁছে। কয়েকদিন পর তারা রশফাঁর নিকটবর্তী ডেক্স (Ile d’Aix) দখল করে নেয়। ব্রিটিশ কমান্ডারদের ইচ্ছা ছিল ডেক্সকে ঘাঁটি করে রশফাঁতে আক্রমণ করবার। এদিকে ফরাসিরা নাকের ডগাতে শত্রুসেনা দেখে হকচকিয়ে যায়। দ্রুত তারা দুর্গে অবস্থান নিল।
আবহাওয়া দ্রুত খারাপ হচ্ছিল, আবার পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল রশফাঁর দুর্গের পার্শ্ববর্তী সাগর অগভীর হওয়ায় অ্যাডমিরাল হকের পক্ষে ফরাসিদের উপরে গোলা চালানোর মতো কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব নয়। স্থলবাহিনীর কম্যান্ডারদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিল। অধিকাংশ আক্রমণের পক্ষে থাকলেও সর্বাধিনায়ক মরডান্ট অক্টোবরে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফিরে এলেন ইংল্যান্ডে। তাকেও বিংয়ের মতো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তবে তিনি বেকসুর খালাস পেয়ে যান। একই বছর লুইজবার্গ হামলাতেও ব্রিটিশ নৌবহর পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
১৭৫৮ সালের জুনে ব্রিটিশ সেনারা জাহাজ থেকে নৌকা দিয়ে ফ্রান্সের সেন্ট মালোর ভূখণ্ডে এসে নামে। তীরে থাকা ফরাসি কামান ব্রিটিশ জাহাজের গোলাবর্ষণে ধ্বংস হয়ে যায়। নিকটবর্তী শহর অবরোধের মতো যথেষ্ট শক্তিশালী না হলেও ব্রিটিশ সেনারা প্রায় সপ্তাহখানেক এখানে অবস্থান করে শতাধিক জাহাজ পুড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। ফরাসিদের বড় একটি দল এগিয়ে আসতে থাকলে তারা সেন্ট মালো ত্যাগ করল। সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়বার এখানে নামতে গেলে ব্রিটিশরা প্রবল ফরাসি প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় (Battle of St Cast)। জাহাজ থেকে কিছু সেনা নামতে না নামতেই ফরাসিরা হামলা করে এবং শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ নৌবহর পিছিয়ে যায়। এরপর থেকে ফরাসি উপকূলে ব্রিটিশ সেনা অবতরণের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়।
একই বছর অ্যাডমিরাল অসবোর্ন স্প্যানিশ জলসীমায় ফরাসিদের পরাস্ত করেন, যারা তুঁলো বন্দরের উপর অবরোধ প্রত্যাহারের চেষ্টা করেছিল। ফ্রান্সের বিস্কে উপকূলের কাছে অ্যাডমিরাল এডওয়ার্ড হকও নিউ ফ্রান্সের দিকে পাল তোলার সময় একটি ফরাসি বহরকে বিধ্বস্ত করেন। এসব কারণে ফরাসিরা তাদের প্রধান তিনটি বন্দর, তুঁলো, ব্রেস্ট আর ল্যু আভরে ছড়িয়ে থাকা তাদের নৌবাহিনীকে একসাথে করতে পারছিল না।
প্রধান নৌযুদ্ধ
সেভেন ইয়ার্স ওয়ারে সাগরপথে দুটি প্রধান লড়াই সংঘটিত হয়। একটি ব্যাটল অফ লাগোস (Battle of Lagos), অন্যটি ব্যাটল অফ কুইবেরন বে (Battle of Quiberon Bay)।
ব্যাটল অফ লাগোস
১৭৫৯ সালে ফ্রেঞ্চরা ব্রিটিশ অবরোধ ভেঙে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণের পরিকল্পনা ফাঁদে। সেনাবাহিনী সেই লক্ষ্যে প্রস্তুত ছিল। তাদের পরিবহনের কাজে তুঁলোতে ফরাসি জাহাজর দায়িত্ব নেন স্যাব্রান লা-ক্লু। খবর পেয়ে অ্যাডমিরাল বস্ক্যাওয়েন মে মাসে তুঁলোর সামনে এসে পাহারা বসালেন। কিন্তু রসদপত্রের জন্য মাসখানেক পর তাকে জিব্রাল্টারে ফিরে যেতে হয়। এই সুযোগে আগস্টের ৫ তারিখ লা-ক্লু ব্রেস্ট বন্দরে ফরাসি নৌবহরের সাথে যোগ দিতে বারটি জাহাজ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। জিব্রাল্টার অতিক্রম করার সময় ব্রিটিশরা তাদের দেখে ফেললে বস্ক্যাওয়েন ১৪টি জাহাজ নিয়ে পিছু ধাওয়া করে ১৮ তারিখ লা-ক্লুর নাগাল পেয়ে যান।
এদিকে আগস্টের ১৭ তারিখ রাতে লা-ক্লুর বহরের ৫টি জাহাজ মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সঙ্গীদের খুঁজে না পেয়ে তার কাডিজের দিকে চলে গেল। খর্বশক্তির দল নিয়ে বস্ক্যাওয়েনের সাথে লড়াইয়ের কোনো ইচ্ছা লা-ক্লুর ছিল না। উল্টো ব্রিটিশ জাহাজ দেখে তিনি মনে করেছিলেন তার হারিয়ে যাওয়া জাহাজগুলোই মনে হয় ফেরত আসছে। শীঘ্রই তার ভুল ভেঙে যায় এবং তিনি পালানোর কথা ভাবেন। কিন্তু বাতাস পড়ে গেলে এবং ব্রিটিশরা তাকে ঘিরে ফেলতে থাকলে তিনি বাধ্য হলেন গোলাবর্ষণের নির্দেশ দিতে। ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজ আঘাতপ্রাপ্ত হলেও তুমুল উদ্যমে বস্ক্যাওয়েন হামলা করে ফরাসিদের কাবু করে ফেলেন। তবে বাতাস পেয়ে ফরাসি জাহাজ পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। ব্রিটিশরা পরদিন তাড়া করে সবগুলোকেই ডুবিয়ে বা পুড়িয়ে দেয়। এই সংঘাতে বহু ফরাসি হতাহত হয় এবং তাদের অনেক জাহাজ নষ্ট হয়ে যায়, যা ফ্রান্সের নৌশক্তিকে হ্রাস করে।
ব্যাটল অফ কুইবেরন বে
কুইবেরন উপসাগরের যুদ্ধ সম্ভবত সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের চূড়ান্ত নৌযুদ্ধ। ১৭৫৯ সালে ব্রেস্ট বন্দরে পাঁচ মাস ধরে ব্রিটিশ বহর ফরাসি জাহাজ অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। ব্রিটিশ নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল এডওয়ার্ড হক, আর ফরাসি কমান্ডার কনফ্লাঁর। লা-ক্লুর মতো কনফ্লাঁরও দায়িত্ব ছিল ফ্রান্স থেকে একদল সেনা নিয়ে আয়ারল্যান্ডে অবতরণ করা। কিন্ত বন্দরের সামনে ব্রিটিশ জাহাজের জন্য তিনি তা পারছিলেন না। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঝড়ের মধ্যে ব্রিটিশরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ঝড় থামলে ব্রিটিশরা ফিরে আসবার আগেই কনফ্লাঁর নির্দেশে ফরাসিরা পাল তুলল।
অ্যাডমিরাল হক পিছু নিয়ে ২০ নভেম্বর তাদের ধরে ফেলেন। কনফ্লাঁ আশ্রয় নিলেন ব্রিটানির দক্ষিণে কুইবেরন উপসাগরে, যে এলাকা তার হাতের তালুর মতো চেনা। তখন সন্ধ্যার কাছাকাছি। উপসাগরের যেখানে-সেখানে পাথর বেয়াড়াভাবে মাথা জাগিয়ে রাখায় অন্ধকারে এখানে জাহাজ চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কনফ্লাঁ মনে করেছিলেন হক আক্রমণে বিরত থাকবেন। কিন্তু হক দুঃসাহসিক হামলা করে বসেন। তার নিজের দুটি জাহাজ পাথরে লেগে ডুবে যায়, কিন্তু তিনি মোটামুটি অন্ধকারের ভেতরেই কনফ্লাঁর সাতটি জাহাজ ধ্বংস করে দেন। কয়েকটি মাত্র জাহাজ পালাতে সক্ষম হয়। লাগোস আর কুইবেরন বে-র পর ফ্রান্স ইংল্যান্ডে হামলার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। এদিকে ইউরোপিয়ান থিয়েটারেও পাল্লা প্রুশিয়ার দিকে হেলে পড়লে ব্রিটেনের সাথে ফ্রান্সের শান্তি আলোচনা শুরু হয়।
উপমহাদেশের লড়াই
উপমহাদেশে সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের অংশ হিসেবে ব্রিটিশ-ফরাসি সংঘর্ষ পরিচিত তৃতীয় কর্ণাটক যুদ্ধ (Third Carnatic War) নামে।
সময়টা ১৭৫৬ সাল। ভারতে তখন দুর্বল মুঘল শাসন, আর বাংলার সিংহাসনে নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ব্রিটিশ এবং ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যস্ত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইতে। আমেরিকাতে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের বিবাদের খবর ততদিনে ভারতেও এসে পৌঁছেছে। যুদ্ধের আশঙ্কায় দুই পক্ষই তাদের প্রত্যেকটি ঘাঁটিতে সমরায়োজন করতে লাগল। সিরাজউদ্দৌলা শঙ্কিত বোধ করলেন। তার কাছে সংবাদ ছিল ব্রিটিশরা তাকে অপসারণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তিনি দুই পক্ষকেই সামরিক প্রস্তুতি বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। ফরাসিরা মেনে নিলেও ব্রিটিশরা নবাবের আদেশ উপেক্ষা করে। ফলে তিনি কলকাতাসহ বাংলাতে ব্রিটিশদের সমস্ত ঘাঁটি দখল করে নেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হেডকোয়ার্টার তখন মাদ্রাজ। সেখান থেকে রবার্ট ক্লাইভ নামে এক অফিসারের নেতৃত্বে বাংলাতে সেনা পাঠানো হলো। ক্লাইভ ৩০ ডিসেম্বর কলকাতা কব্জা করেন, এরপর দখল করেন হুগলী। এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের যুদ্ধ শুরুর সংবাদ তাদের কানে এলো।
এদিকে সিরাজউদ্দৌলা ক্লাইভকে শায়েস্তা করতে ১৭৫৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতা আক্রমণ করেন। সংঘর্ষে নবাবের ক্ষতি ছিল অনেক বেশি। ফলে তিনি সন্ধি করে নেন। ব্রিটিশদের সমস্ত ঘাঁটি ফিরিয়ে দেয়া হলো। ক্লাইভ এরপর চন্দনগরে ফরাসিদের ঘাঁটি অধিকার করেন। সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশদের ক্রমবর্ধমান শক্তিতে বিচলিত হয়ে ফরাসিদের সহায়তা চাইলেন। কিন্তু তার ঘরে তখন ঘনিয়ে উঠছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। তার প্রধান পরামর্শদাতা মীর জাফর ছিল এর হোতা। ক্লাইভ তার সাথে হাত মেলান।
পলাশির যুদ্ধ
২৩ জুন, ১৭৫৭।
চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য ক্লাইভ আর সিরাজউদ্দৌলা মুখোমুখি হলেন। ক্লাইভের সাথে তিন হাজারের কিছু বেশি সেনা। বিপরীতে নবাবের বাহিনীতে ফ্রেঞ্চ কন্টিনজেন্টসহ পঞ্চাশ হাজারের মতো সৈন্য। সকাল আটটায় ফরাসিরা কামান দেগে আক্রমণ শুরু করল। তিন ঘণ্টা পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণ চলে। এরপর বৃষ্টি আরম্ভ হলে নবাবের গোলাবারুদ ভিজে অকার্যকর হয়ে পড়ে। তিনি কয়েকবার সেনাদের হামলা করতে পাঠালেও ক্লাইভ প্রত্যেকবারেই তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। তিনি বাহিনীকে সুবিধাজনক একটি অবস্থানে নিয়ে যেতে যাইলেন, যেখান থেকে প্রবল হামলা চালিয়ে শত্রুদের খতম করে দেয়া যাবে। এই সময় নবাবের সৈন্যরা আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। ক্লাইভ উপলব্ধি করলেন তার দুই বাহুর দিকে আছে মীর জাফরের অনুগত সেনারা, এরা কোনো ঝামেলা করবে না। তিনি নিশ্চিন্তে নবাবের অনুগত সেনাদের উপর গুলি চালানোর আদেশ দেন। ব্রিটিশদের তীব্র আক্রমণে সিরাজউদ্দৌলার প্রতিরক্ষা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। বিকাল পাঁচটার মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। সিরাজউদ্দৌলা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে হত্যা করে।
চলমান ফরাসি-ব্রিটিশ সংঘাত
ফরাসি জেনারেল ল্যালি ১৭৫৮ সালের এপ্রিলে পণ্ডিচেরিতে অবতরণ করেন। মে-জুন মাসের মধ্যে তিনি ব্রিটিশ কুডালোর আর সেন্ট ডেভিড দুর্গ দখল করে নেন। ব্রিটিশরা মাদ্রাজে সেনা সমাবেশ করল। ৩ আগস্ট নাগাপত্তমের নৌযুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফরাসি বহর পণ্ডিচেরিতে আশ্রয় নেয়। এদিকে ল্যালি মাদ্রাজের আশেপাশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ডিসেম্বর থেকে সেন্ট জর্জ দুর্গ আর মাদ্রাজ শহর অবরোধ করলেন। ১৩-১৪ ডিসেম্বর মাদ্রাজের রাস্তায় সংঘর্ষের পর দুই পক্ষই যার যার অবস্থানে ফিরে যায়। কয়েক মাস অবরোধের পরেও ফরাসিরা কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এদিকে ব্রিটিশদের পক্ষে অতিরিক্ত সেনা সাগরপথে এসে পৌঁছে। ফলে ল্যালি ১৭৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পণ্ডিচেরি ফিরে যান।
ভান্দাভাসির যুদ্ধ
পণ্ডিচেরিতে ফরাসিদের মূল ঘাঁটির কাছেই এক দুর্গ। নিকটবর্তী শহরের নামানুসারে একে বলা হত ভান্দাভাসি দুর্গ। এখানে ২২ জুন, ১৭৬০ সালে সংঘটিত হয় ভারতে ফরাসি-ব্রিটিশ চূড়ান্ত মুখোমুখি সংঘাত (Battle of Wandiwash)। ফরাসিদের প্রধান কম্যান্ডার ল্যালি, আর ব্রিটিশ সেনাদের দায়িত্বে স্যার কুট। সাগরে ব্রিটিশ আধিপত্যের জেরে ল্যালি তখন নিঃসঙ্গ। সাগরে অ্যাডমিরাল দাশ্লিজের বহর ফেরত গেছে। লড়াই করবার প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জামের বড়ই অভাব। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাদের সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে প্রথমবারের মতো দাঁড়িয়েছিল উপমহাদেশীয় সৈনিকেরা।
সকাল সাতটার সময় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। দুই পক্ষের সেনারা একে অপরের উপর বন্দুক ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে গেল। একপর্যায়ে হাতাহাতি যুদ্ধ আরম্ভ হয়। প্রচুর সেনা হারিয়ে ফরাসিরাই প্রথম পিছু হটতে বাধ্য হয়। মরার উপর খাঁড়ার ঘা-র মতো ব্রিটিশ কামানের গোলায় ফরাসিদের বাম বাহুতে গোলাবারুদের স্তূপে আগুন লেগে যায়। ফলে ফরাসিদের সমরবিন্যাস ভেঙে পড়বার উপক্রম হয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ কমান্ডার দুই পাশ থেকে হামলা করে ফরাসিদের ঠেলে দেন তাদের মধ্যভাগের দিকে, যা তাদের ব্যূহকে চূড়ান্তভাবে বিশৃঙ্খল করে দেয়। দু-বাহু বিপর্যস্ত হয়ে গেলে বেলা দুটোর দিকে ফরাসিরা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। তাদের ৬০০ জন মারা যায় অথবা বন্দি হয়, ব্রিটিশদের ক্ষতি ছিল ২০০ সেনা। ফরাসি জেনারেল বুসি ব্রিটিশদের হাতে বন্দি হন। ল্যালি পণ্ডিচেরিতে ফিরে যান। এই লড়াইয়ের পর জেনারেল কুট পণ্ডিচেরির আশেপাশে সমস্ত ফরাসি ঘাঁটি দখল করে নেন।
পণ্ডিচেরি অবরোধ ও পতন
১৭৬০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্রিটিশরা পণ্ডিচেরি অবরোধ করে রাখে। স্থল এবং জলপথের যৌথ অবরোধে শহরের বাসিন্দাদের অবস্থা হয়ে পড়ে সঙ্গিন। তীব্র দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে অবশেষে ল্যালি শহর ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেন। এই অবরোধে বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। পণ্ডিচেরির পতনের মাধ্যমে উপমহাদেশে ফরাসি ক্ষমতার সর্বশেষ কেন্দ্রও ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। ল্যালিকে এজন্য চরম পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল। ফ্রান্সে ফিরে গেলে তাকে দেশদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়।