– দুর্গন্ধে ভরা দূষিত বাতাসই হচ্ছে মিয়াজমা। আর এই মিয়াজমা যখন আমরা আমাদের শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে নেই, তখন মিয়াজমা আমাদের শরীরে ঢুকে পড়ে আর আমরা কলেরার মতো রোগে আক্রান্ত হই…
– কিন্তু আমার মনে হয় কলেরার পেছনে অন্য কিছু রয়েছে।
– You know nothing, John Snow!
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়। শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়ায় বদলে যেতে শুরু করেছে ইউরোপের পশ্চিমভাগ, ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনও তার ব্যতিক্রম নয়। শহরের প্রতিটা কোনায় গড়ে উঠছে নতুন কারখানা, কাজের আশায় শহরে ভিড় জমাচ্ছে অন্যান্য এলাকা থেকে আসা লোকজন। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে শহরের আয়তনও বাড়াতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এরপরও জায়গা করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গ্রেটার লন্ডনের প্রতি একরে ৩০০ থেকে ৪০০ জন ঠেসেঠুসে নিজেদের মাথা গোঁজার মতো আশ্রয় করে নিয়েছে, যেখানে বর্তমানে ম্যানহ্যাটনের মতো আকাশচুম্বী অট্টালিকাপ্রধান এলাকাতেও প্রতি একরে ১০০ জনের বেশি থাকে না।
এই ঘন জনবসতির পাশাপাশি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব জনস্বাস্থ্যকে ঠেলে দিয়েছে আরো হুমকির মুখে। তাই ভিক্টোরিয়ান যুগের আস্তাবল আর রাস্তার সামনে পড়ে থাকা আবর্জনার স্তূপের গন্ধে ভারি হয়ে আসা লন্ডনের বাতাসই যে সকল রোগের মূল কারণ, এই ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল হতে সময় নেয়নি। শহরের এই অপরিচ্ছন্নতার সুযোগে নিয়মিত হানা দিতে থাকে প্লেগ, টাইফয়েডের মতো রোগ। শিল্পবিপ্লবের সময় বাণিজ্যের অবাধ প্রসারের সুযোগে ভারত থেকে আসা কলেরার জীবাণুও ঢুকে পড়লো লন্ডনে, শুরু হলো মহামারী। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিশাল জনবসতি লাশে পরিণত হওয়ার পেছনের কারণ কি শুধুই দুর্গন্ধযুক্ত ‘মিয়াজমা’ নাকি অন্য কিছু? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বের হলেন ড. জন স্নো।
কলেরার সাথে পরিচয়
১৮১৩ সাল। জেনারেল উইন্টারের কাছে পর্যুদস্ত নেপোলিয়নের গ্রান্দে আর্মি যখন মাথা হেঁট করে ফ্রান্সে ফিরে আসছে, সেই সময়েই জন্ম জন স্নোয়ের। তবে কোনো ধনী ঘরের সন্তান হয়ে নয়, ইয়র্কের এক কয়লা খনিতে কাজ করে কোনরকমে পেট চালানো বাবা-মায়ের ঘরে। শৈশব থেকেই অনুসন্ধিৎসু মন ছিল স্নোয়ের, সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন তার। ছেলের প্রশ্নবানে জর্জরিত মা সিদ্ধান্ত নিলেন স্নোয়ের হাত কয়লার কালিতে ময়লা করতে দেবেন না, তাই উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সামান্য কিছু জমিয়ে রাখা টাকা-পয়সা দিয়েই ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিলেন স্কুলে। স্কুলের পাট চুকানোর পর ১৪ বছর বয়সী স্নোকে নিউক্যাসলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো, উইলিয়াম হার্ডক্যাসল নামের এক ডাক্তারের শিষ্য হিসেবে ডাক্তারি শেখার জন্য। আর সে সময়েই স্নোকে মুখোমুখি হতে হলো তার জীবনের নেমেসিস কলেরার সাথে।
ভারত, রাশিয়া আর জার্মানির গ্রাম-শহর ফাঁকা করে দেওয়ার পর কলেরা যখন ইংল্যান্ডে হানা দিয়েছে, জন স্নোর বয়স তখন ১৮। লন্ডনের পর নিউক্যাসলেও যখন একের পর এক লোকজন মানুষ মারা যেতে শুরু করলো, হার্ডক্যাসল নিজেও আর একা পেরে উঠলেন না। শেষমেশ পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়লাখনি শ্রমিকদের এক বস্তিতে পাঠানো হলো স্নোকে, একা!
গুটিবসন্ত বা প্লেগের মতো প্রাণঘাতী না হলেও কলেরা তখন যথেষ্ট ভয়ঙ্কর। একদিনের মধ্যেই যেকোনো স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির ভেতর থেকে সমস্ত পানি শুষে নেওয়ার মতো ক্ষমতা রয়েছে কলেরা জীবাণুর, এবং তা কোনোরকম সংকেত ছাড়াই। এক সাধারণ দিনে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ পেট চেপে বসে পড়ার পর একাধারে শুরু হবে বমি আর ডায়রিয়া। দিনে ২০ লিটার পর্যন্ত পানি এভাবে শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর চামড়া ঝুলে পড়ে, তরল রক্ত হয়ে পড়ে জেলির মতো আঠালো। শরীর থেকে পানি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর একের পর এক অঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। শেষমেশ ব্যক্তি মারা পড়ে রোগের সরাসরি আক্রমণে নয়, বরং তার শরীর এত পরিমাণ পানি হারিয়েছে যে বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ প্লাজমাও তৈরি করতে পারে না।
কিন্তু চার বছর ধরে ডাক্তারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করা স্নো যত ধরনের চিকিৎসা ছিল, সব প্রয়োগ করেও কলেরা রোগীদের সুস্থ করতে ব্যর্থ হলেন। আফিম থেকে শুরু করে কঠিন ভেষজ, কোনোকিছু খাইয়েও কলেরা রোগীদের মৃত্যু থামানো যাচ্ছিল না। স্নো পানি খাইয়ে বাঁচানোর চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু খাওয়ানোর প্রথম কয়েক ঘণ্টা কিছুটা সুস্থ দেখালেও, কয়েক ঘণ্টা যাওয়ার পরেই রোগীরা লাশে পরিণত হতে থাকল। স্নো পানিশূন্যতা ঠিক করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তখনও মানুষ জানতো না যে ডায়রিয়ার ফলে শুধু পানি না, খণিজ লবণেরও শূন্যতা সৃষ্টি হয়। বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত তা অনাবিষ্কৃতই ছিল, আর এ কারণেই স্নো তার রোগীদেরকে বাঁচাতে পারছিলেন না।
যা-ই হোক, স্নো তার ডাক্তারি জীবনের সব পর্যবেক্ষণের নোট লিখে রাখতেন। তিনি খেয়াল করেছিলেন, কয়লা খনির ভেতরে শ্রমিকরা কলেরায় আক্রান্ত হতেন, যা গোরস্থান, নর্দমা কিংবা নোংরা ডোবা থেকে অনেক দূরে। যদি কলেরা মিয়াজমা থেকেই সৃষ্টি হতো, তবে এসব অঞ্চলের লোকেরাই বেশি কলেরায় আক্রান্ত হতো, বহুদূরে থাকা কয়লা খনির শ্রমিকরা নয়। ‘এর পেছনে অন্য কিছু রয়েছে, মিয়াজমা নয়। এমন কিছু যা সহজেই একজন থেকে আরেকজনের কাছে ছড়িয়ে পড়তে পারে,’ স্নোয়ের দাবি করা এই যুক্তিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ঊর্ধ্বতন ডাক্তাররা। আর তা-ই কলেরার আসল কারণ অজানাই থেকে গেল আরো বহুদিন পর্যন্ত।
জন স্নো আরো বেশ কয়েকজন ডাক্তারের শিষ্য হিসেবে কাজ করার পর লন্ডনে আসলেন মেডিসিন নিয়ে পড়ার জন্য। মাত্র এক বছরের মধ্যেই জেনারেল প্র্যাকটিশনারের লাইসেন্স পেয়ে গেলেন তিনি। এরপর একে একে অ্যাপোথেক্যারিসের (ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করা) লাইসেন্স, মেডিসিনের ওপর ব্যাচেলর আর ডক্টরেট ডিগ্রি আর শেষমেশ রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনসেও পড়ার সুযোগ পেলেন তিনি। যদিও তৎকালীন সময়ে ডাক্তারি করার জন্য এত ডিগ্রি প্রয়োজন হতো না। এই সময়েই স্নো অ্যানেস্থেশিয়া নিয়ে কাজ করা শুরু করলেন। স্নোয়ের আগে সার্জনরা কাপড়ে ক্লোরোফর্ম ঢেলে তা রোগীর মুখের উপর ফেলে রাখতেন, এবং কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর অপারেশন শুরু করতেন, অনেক সময় তাও ঠিকমতো কাজ করতো না। কিন্তু স্নো বিভিন্ন উপাদান একেকভাবে মিশিয়ে অ্যানেস্থেশিয়ার সবচেয়ে কার্যকরী ডোজ বের করে ফেললেন। তার অ্যানেস্থেশিয়া অন্যান্যদের চেয়ে এতটাই কার্যকরী ছিল যে, স্বয়ং রানী ভিক্টোরিয়াকেও দুবার অজ্ঞান করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় আক্রমণ
অ্যানেস্থেশিয়া নিয়ে কাজ করলেও স্নো তার বাল্যকালের আতঙ্ককে ভুলে যাননি। ৩৫ বছর বয়সী অভিজ্ঞ ডাক্তারে পরিণত হওয়া স্নো দ্বিতীয়বার কলেরার মুখোমুখি হলেন ১৮৪৮ সালে। এবার রাজধানী লন্ডনে। স্নো বুঝতে পেরেছিলেন কলেরা কোনো মিয়াজমার কারণে ছড়ায় না, এর পেছনে অন্য কিছু রয়েছে। এবার এটিই প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। ডাক্তারসমাজের কাছে পরিচিত হওয়ার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে লন্ডনের প্রথম কলেরা রোগীর ডাক্তারকে খুঁজে বের করলেন। জানতে পারলেন, জন হারল্যান্ড নামের এক নাবিকই প্রথম কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং হারল্যান্ডের মৃত্যুর ৮ দিন পরেই সেই একই বাসা ভাড়া নেওয়া আরেকজন কলেরায় আক্রান্ত হয়েছেন।
স্নো দুইএর সাথে দুই যোগ করে বুঝতে পারলেন, কলেরা মোটেও কোনো মিয়াজমাবাহিত রোগ নয়, বরং এটি এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির দেহে ছড়ায়। কিন্তু কীভাবে ছড়ায়? এটিই বের করা প্রয়োজন। লন্ডনের আনাচেকানাচে কলেরা রোগী ধরা পড়তে থাকলো। স্নোও রোগী আর ডাক্তারদের সাথে কথা বলে তথ্য জোগাড় করতে থাকলেন। জানতে পারলেন, ব্যথা শুরু হয় পেট থেকে। এখান থেকে ধারণা করলেন, রোগের কারণ সম্ভবত কোনো কিছু খাওয়া বা পান করা। যদি দূষিত বাতাসের মাধ্যমেই রোগের বিস্তার ঘটতো তবে নাক, গলা অথবা ফুসফুসেই ব্যথা শুরু হওয়ার কথা ছিল, তাই নয় কী?
তিনি আরো আন্দাজ করলেন কলেরার কারণে হওয়া ডায়রিয়া শুধু লক্ষণই নয়, বরং কলেরা ছড়ানোর আরেকটি মাধ্যমও বটে! ‘জীবাণু’ শব্দটি তখন সবেমাত্র ডাক্তারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। স্নোও আন্দাজ করলেন কলেরা কোনো জীবাণুর মাধ্যমে ছড়ায় আর তা সম্ভবত পানির মাধ্যমে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি একটি পরীক্ষাও করলেন। লন্ডনের রাস্তা ঘেঁটে দুটো নলকূপ বের করলেন যেখানে একটি নলকূপ খানিকটা উঁচু এবং রাস্তার আবর্জনার সাথে সংযোগ নেই, অন্যদিকে দ্বিতীয় নলকূপ কিছুটা নিচু অবস্থানে থাকায় আবর্জনা সব নলকূপের দিকে প্রবাহিত হয়। দুই নলকূপের পানি পান করা ব্যক্তিদের সাথে কলেরা রোগীদের তথ্য মিলিয়ে দেখতে পেলেন, দ্বিতীয় নলকূপ থেকে পান করা প্রায় সবাই কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে, অন্যদিকে প্রথম নলকূপ থেকে পান করা মাত্র একজনকে পাওয়া গেল যে কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে।
স্নো তার পরীক্ষার ফলাফল লিখে পুস্তিকা তৈরি করে পুরো লন্ডনজুড়ে ছড়িয়ে দিলেন যে কলেরা পানির মাধ্যমেই ছড়ায়। কিন্তু শুধু এই পরীক্ষার ফলাফল দেখে কেউ বিশ্বাস করতে চাইলো না, অন্যরাও স্নোয়ের এই দাবি এড়িয়ে গেল। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বোঝাতে ব্যর্থ স্নোর হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু রইল না, তবে তিনি হাল ছাড়লেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন এর শেষ দেখে ছাড়বার।
১৮৫৪ কলেরা মহামারী
১৮৫০ সালে স্নো আরো কয়েকজন ডাক্তার আর গবেষককে সাথে নিয়ে গঠন করলেন এপিডেমিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডন। বৈজ্ঞানিকভাবে রোগের কারণ অনুসন্ধান এবং প্রতিষেধক তৈরিসহ রোগ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন গবেষণা সংস্থা এটি। “কীভাবে রোগটি ছড়ায়? কীভাবেই বা রোগের জীবানূ বংশবিস্তার করে? কোন কোন জিনিসগুলোর কারণে রোগের মহামারী ঘটে? কীভাবে একে প্রতিরোধ করা যায়?” এগুলোই ছিল প্রতিষ্ঠানটির গবেষণার বিষয়। তাই যখন ১৮৫৪ সালে লন্ডনে আবারও কলেরা হানা দিল, স্নো এবার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামলেন যে, কলেরা পানির মাধ্যমেই ছড়ায় তা তিনি প্রমাণ করে ছাড়বেন।
কিন্তু স্নো যখন কলেরায় মৃত ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করলেন, তখন বুঝতে পারলেন এই তথ্যের মধ্যে কোনো ধারা নেই! হোক সে ধনী-গরীব, বৃদ্ধ-শিশু, নারী-পুরুষ কিংবা ভিন্ন এলাকার ব্যক্তি, বয়স-লিঙ্গ-অর্থনৈতিক বা সামাজিক প্রভাব বা অবস্থান, যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তিই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে! শহরের এক স্থানে কম, বা অন্য স্থানে বেশি, এ ধরনের কোনো প্যাটার্নই খুঁজে পেলেন না তিনি। লন্ডনের মানুষরাও ভাবতে শুরু করল এটি কোনো ঐশ্বরিক গজব কিংবা লটারির ভাগ্য পরীক্ষা। কিন্তু স্নো তা মানতে নারাজ, নিশ্চই এর মধ্যে কোনো প্যাটার্ন লুকিয়ে রয়েছে।
স্নো জানতেন যে কলেরা পানির মাধ্যমে ছড়ায়, নলকূপের পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলেন, কিন্তু ঊর্ধ্বতনদেরকে বোঝাতে হলে চাই এরচেয়েও বড় প্রমাণ। লন্ডনের প্রতিটি বাড়ির পানি সরবরাহের তথ্য পেতে তাই তিনি ছুটে গেলেন মিউনিসিপ্যাল রেকর্ড অফিসে, আর রেকর্ডের ভেতর থেকেই তিনি পেয়ে গেলেন তার মূল প্রমাণ!
লন্ডনের যে অংশে তিনি কাজ করতেন, সেই এলাকায় মাত্র দুটো কোম্পানি সকল বাড়ির পানি সরবরাহ করে। একটি হলো সাউথওয়ার্ক অ্যান্ড ভক্সহল (এসঅ্যান্ডভি) ওয়াটার কোম্পানি, অন্যটি ল্যাম্বেথ কোম্পানি। দুটো কোম্পানিই টেমস নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে, কিন্তু নদীর দুই অংশ থেকে, আর এখানেই মূল সমস্যা।
তৎকালীন লন্ডনে বাড়ির নিচে শুধু মলমূত্রভর্তি বিশেষ গর্তই ছিল না, বরং গর্তে যেন জমে না থাকে সেজন্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাও ছিল। আর এসব বর্জ্য সরাসরি চলে যেত টেমস নদীতে, যেখান থেকে খাবার পানি সরবরাহ করা হয়! এসঅ্যান্ডভি কোম্পানির পাইপ সেখান থেকেই পানি সংগ্রহ করে যেখানে বর্জ্য ফেলা হয়। অন্যদিকে ল্যাম্বেথ কোম্পানি কিছুদিন আগেই তাদের পাইপ সেখান থেকে সরিয়ে আরো দূরে নিয়ে গিয়েছে, যেখানে বর্জ্যের পরিমাণ কম। স্নো তার পরীক্ষা চালানোর মতো উপাদান পেয়ে গেলেন, লন্ডনের জনসংখ্যাকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করলেন তিনি। একভাগকে সরবরাহ করা হচ্ছে লন্ডনের বর্জ্য মিশ্রিত হওয়া পানি, যার মধ্যে কলেরা রোগীদের বর্জ্যও রয়েছে। অন্যভাগে এ ধরনের দূষিত পানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম।
স্নো প্রথমে ভেবেছিলেন তথ্য সংগ্রহ করা খুবই সহজ হবে। প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে শুনে নেবেন তার বাড়িতে কোন কোম্পানির পানি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু সংগ্রহ করতে গিয়েই ভুল ভাঙলো তার। ভাড়াটিয়াদের তো জানার কথাই নয়, এমনকি বাড়িওয়ালারাও বাড়ি বানানোর সময় কোন কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছিলেন, তা-ও মনে রাখেননি। স্নো আবারো হতাশ হয়ে পড়লেন। অবশেষে নতুন আরেক বুদ্ধি পেলেন, দুই কোম্পানির পানির রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা শুরু করলেন তিনি। দেখতে পেলেন, ল্যাম্বেথের তুলনায় এসঅ্যান্ডভি কোম্পানির পানিতে লবণের পরিমাণ ৪ গুণ বেশি!
এবার যেসব বাড়িতে কলেরা রোগী শণাক্ত হয়েছে, সেসব বাড়ির পানির সাথে দুই কোম্পানির পানির তুলনা করে বের করে ফেললেন কোন বাড়িতে কোন কোম্পানির পানি সরবরাহ করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল দেখে জন স্নো নিশ্চিত হলেন এবার নিশ্চই কর্মকর্তারা বিশ্বাস করবেন কলেরা পানির মাধ্যমেই ছড়ায়। কারণ ল্যাম্বেথ কোম্পানির পানি পান করা ৬ জনের মৃত্যুর বিপরীতে এসঅ্যান্ডভি কোম্পানির পানি পান করে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৮! স্নো হয়তো আরো কয়েক সপ্তাহ সময় পেলে আরো বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা চালাতে পারতেন, কিন্তু কলেরা আবার হানা দিল। গবেষণা করতে থাকলেও ডাক্তারি দায়িত্ব তো আর এড়িয়ে যেতে পারেন না। প্রথমে কলেরায় মৃত্যুর ছোটোখাট কিছু গুজব শুনলেও তিনি তেমন পাত্তা দিলেন না।
৪ সেপ্টেম্বর। সকালবেলা পত্রিকা খুলতেই স্নো দেখলেন পত্রিকায় বড় করে লেখা, “সন্ধ্যাবেলা যখন ঘোড়ার গাড়িতে করে কফিনগুলো নিতে আসা হলো, তখন এত লোকের লাশ ছিল যে ছাদে একটির উপর আরেকটি রেখেও জায়গা করা যাচ্ছিলো না! এমনকি গাড়ির ভেতরেও কফিন ঠেসে ঢুকাতে হয়েছিল। প্লেগের পর কখনো এত বাজে অবস্থা লন্ডন দেখেনি।“ স্নো তার গবেষণা মুলতবি রেখেই ছুটলেন সেই এলাকায়। এলাকার নাম, ‘ব্রড স্ট্রিট’।
ব্রড স্ট্রিট পাম্প
ব্রড স্ট্রিটের এ-মাথা থেকে ও-মাথা কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে। মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, আক্রান্তদের চিৎকার চিকন দেয়াল ভেদ করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসা জন স্নোয়ের কানে পৌঁছালো। বাড়ির দরজায় কড়া নেড়েও কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না, কয়েকটি বাড়ির কেউই বেঁচে নেই, আবার কলেরার ভয়ে সপরিবারে এলাকা ছেড়েছে অনেকেই। সময় যত গড়াচ্ছে, তার হাতে তথ্য জোগাড়ের সুযোগ ততই কমে আসছে। কলেরার মৃত লোকদের তথ্য জানার মতো আর একটিই জায়গা আছে তার সামনে, রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিস। দুপুর গড়াতেই স্নো অফিস থেকে কলেরায় মারা যাওয়া সবার ঠিকানা জোগাড় করে নিয়ে আসলেন, সরকারি তথ্যের সাথে নিজেও সরেজমিনে মিলিয়ে দেখবেন কোথায় কয়জন কলেরায় প্রাণ হারিয়েছে। রাস্তার দু’পাশে থাকা বাড়ির কড়া নেড়েও জবাব না পেয়ে স্নো ভাবতে থাকলেন কীভাবে এর সমাধান করা যায়। এবং তখনই রাস্তার মানচিত্র এঁকে মৃতের সংখ্যার প্যাটার্ন বোঝার আইডিয়া মাথায় আসলো তার। আর এটিই তাকে অমর করে রেখেছে ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের দুনিয়ায়।
ব্রড স্ট্রিটকে কেন্দ্র করে মানচিত্র এঁকে কলেরা রোগীদের সংখ্যা অনুযায়ী দাগ কাটতে থাকলেন স্নো। ধীরে ধীরে মানচিত্রে একটি প্যাটার্ন ফুটে উঠল। ব্রড স্ট্রিটের পাম্পকে কেন্দ্র করে কাছাকাছি দূরত্বে থাকা বাড়িগুলোতেই কলেরায় মৃতদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পাম্প থেকে যতদূরে বাড়ির অবস্থান, মৃতের হার তত কম। কিন্তু স্নো জানতেন, এটুকু দিয়ে মিয়াজমায় বিশ্বাসীদের সন্তুষ্ট করা যাবে না। ব্রড স্ট্রিটের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা আরো দুটো পাম্পের এলাকাও মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে হিসাব করলেন ব্রড স্ট্রিটের পাম্পের কাছাকাছি থাকা বাড়িগুলোতেই তুলনামূলকভাবে অন্য দুটো পাম্পের তুলনায় মৃতের হার বেশি।
স্নো আরো নিশ্ছিদ্র প্রমাণ খুঁজছিলেন। মানচিত্রে তাকাতেই সেই প্রমাণ দুটোও পেয়ে গেলেন তিনি। পোর্টল্যান্ড স্ট্রিটের মোড়ে থাকা বিশাল কারখানার ভেতরে ৫৩৫ জন কর্মচারী গাদাগাদি করে থাকে। হিসাব অনুযায়ী সেখানে ১০ গুণ লোক মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু অবাক করা বিষয়, কারখানার একজনও কলেরায় আক্রান্ত হয়নি! স্নো দৌড়ে গেলেন কারখানায় এবং তার কাঙ্ক্ষিত প্রমাণ পেয়ে গেলেন। কারখানার ভেতরেই নিজস্ব একটি পাম্প রয়েছে এবং তা গ্র্যান্ড জাংশন ওয়াটার ওয়ার্কস কোম্পানির। আগের গবেষণা থেকে স্নো আগেই জানতেন এই কোম্পানির পানি নিরাপদ। শেষ সূত্র জোড়া লাগাতে স্নো এবার ছুটলেন ব্রড স্ট্রিটের চোলাইখানায় এবং সেখানেও কলেরায় আক্রান্ত না হওয়ার কারণ পেয়ে গেলেন। চোলাইখানার কর্মচারীদের কেউই পানি পান করে না, পিপাসা মেটাতে তাদের একমাত্র পানীয় চোলাইখানায় উৎপাদিত বিয়ার!
স্নোয়ের সব প্রমাণ খাপে খাপে মিলে গেল, এবার শুধু স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদেরকে বোঝাতে পারলেই তার কাজ সফল। তবে স্নো আরো দু’দিন সময় নিলেন। এই দু’দিনে কলেরায় আক্রান্ত ব্যক্তি, মৃত ব্যক্তির পরিবারের লোক, চিকিৎসা দেওয়া ডাক্তার, সবার সাক্ষাৎকার নিলেন, সাথে তাদের বক্তব্যের সাথে নিজের পাওয়া তথ্যও মিলিয়ে নিলেন। সবকিছু শেষ করে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মিটিংয়ে তার সমস্ত প্রমাণ উপস্থাপন করলেন স্নো। স্নোয়ের অকাট্য প্রমাণ ভাঙতে না পেরে ব্রড স্ট্রিট পাম্পের হাতল খুলতে রাজি হলেন তারা। পরদিন সকালে ব্রড স্ট্রিট পাম্পের হাতল সরিয়ে ফেলা হলো।
হাতল সরিয়ে ফেলার ৪ দিনের মধ্যেই ব্রড স্ট্রিটে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসলো। লন্ডনের অন্যান্য এলাকাতেও কলেরার প্রাদুর্ভাব কমে আসলো। ব্রড স্ট্রিট পাম্পের হাতল আবার লাগানো হলো, মানুষের জীবনও স্বাভাবিক হয়ে আসলো। কলেরার কারণ অনুসন্ধান করতে বের করা হলো নতুন বোর্ড। মানুষের মধ্যেও জল্পনাকল্পনা শুরু হলো কেন এই মহামারী শুরু হয়েছিল। ঐশ্বরিক গজব থেকে শুরু করে গরীব মানুষের অনৈতিকতা, অনেক গালগল্প আর গুজব ছড়িয়ে পড়ল লন্ডনজুড়ে।
স্নোয়ের মতো আরো একজন এর কারণ খুঁজতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন, আর তিনি হলেন স্থানীয় পাদ্রী হেনরি হোয়াইটহেড। একের পর এক গুজবের ছিদ্র বের করতে থাকলেন তিনি, তিনি ভেবেছিলেন স্নোয়ের হাতল সমাধানও নিতান্তই কাকতালীয় কোনো ঘটনা। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ব্রড স্ট্রিটের পাম্প থেকে মানুষ পানি পান করে আসছে। আর এটি সরাসরি মাটির গভীর থেকে তোলা পানি, কোনো কোম্পানির সরবরাহ করা পানি নয়। এর আগে কখনোই কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি, তবে কেন ঐ সময়ে ওখানেই কলেরা ছড়িয়ে পড়লো?
হোয়াইটহেড তার স্থানীয় প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আরো গভীর অনুসন্ধান করতে লাগলেন। স্নোয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর তিনিও স্নোয়ের পর্যবেক্ষণে তেমন কোনো ত্রুটি খুঁজে পেলেন না। আবারো দুজন হাজির হলেন রেজিস্ট্রার অফিসে। ব্রড স্ট্রিটে মৃত্যুর রেকর্ড খুঁজে দেখা গেল লুইস পরিবারের এক বাচ্চা মেয়ে প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার কিছুদিন আগেই কলেরায় মারা গিয়েছিল। হোয়াইটহেড ছুটলেন বাচ্চার মায়ের সাথে কথা বলার জন্য। সারাহ লুইস জানালেন তার বাচ্চার ডায়াপার মলমূত্রের গর্তে ফেলে দিয়েছিলেন। হোয়াইটহেড কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে গর্ত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করলেন। পরীক্ষা করার পর দেখা গেল ঠিকভাবে না বানানো গর্ত ভেঙে গিয়ে মাত্র ২ মিটার দূরত্বে থাকা ব্রড স্ট্রিট পাম্পের সংযোগের সাথে মিশে গিয়েছিল! আর এভাবেই কলেরা মহামারীর মূল কারণ বের হয়ে আসলো।
এই আবিষ্কারের পর ইংল্যান্ডজুড়ে স্যানিটারি আন্দোলন শুরু হলো। লন্ডনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হলো। মলমূত্রের গর্ত সরিয়ে সেখানে বসানো হলো আধুনিক পাইপ, লন্ডনের প্রতিটি বাড়িকে এই নর্দমার পাইপের নেটওয়ার্কের ভেতর আনা হলো। লন্ডনের মাটির নিচের এই সুড়ঙ্গ বানাতে তখন প্রয়োজন হয়েছিল ৩১ কোটি ইট আর ১৩ হাজার মাইল পাইপ, যা পৃথিবীর পরিধির অর্ধেক!
১৮৫৪ সালের পর লন্ডনে কলেরা আর মাত্র একবার হানা দিতে পেরেছিল, তা-ও শহরের এমন জায়গায় যেখানে নর্দমা বসানোর কাজ শেষ হয়নি। সৌভাগ্যক্রমে সেবারের কলেরা থামানোর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, আর তিনি হলেন রেজিস্ট্রার অফিসের সেই ব্যক্তি যার কাছে নিয়মিত স্নো ছুটতেন সরকারি তথ্য খোঁজার জন্য। যা-ই হোক, এই নর্দমা ব্যবস্থার ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আধুনিক লন্ডন। আজ থেকে ১৫০ বছর আগে তৈরি করা সেই নর্দমাই এখনো লন্ডনের আবর্জনাকে সরিয়ে মানুষের চোখের আড়ালে কাজ করে যাচ্ছে। ইউরোপের অন্যান্য শহরে আধুনিক নর্দমা বসানোর জন্য শহরকে নতুন করে গড়তে হয়েছে, শিকাগোকে ১৪ ফুট উঁচু করতে হয়েছে স্রেফ শহরের নিচে নর্দমার পাইপ বসানোর জন্য। আর এই নর্দমার পাইপের ওপরেই গড়ে উঠেছে আধুনিক সভ্যতা।