এই সময়ের একজন ফাস্ট ফুড লাভার হয়ে থাকলে ‘পেস্ট্রি’ শব্দটি শুনলেই আপনার জিভে জল চলে আসার কথা। বর্তমানে গালে-মুখে কেকের পেস্ট্রি না মাখালে যেন জন্মদিন উদযাপন পূর্ণতা পায় না। ডায়েট করবে করবে করেও অনেকের করা হয় না শুধুই পেস্ট্রি-কেকের জন্য। রাস্তার পাশের ফাস্টফুডের দোকানের শোকেসে বর্ণিল পেস্ট্রি-কেক দেখে নিজেকে আটকানো দায়। তবে শুনতে কিছুটা অদ্ভুত হলেও সত্য, এই পেস্ট্রি নিয়েও দুটি দেশের মাঝে যুদ্ধ হয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, পেস্ট্রির দোকান নিয়ে।
স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর মেক্সিকোর সময় ভালো যাচ্ছিল না। সারাদেশে বিশৃঙ্খলা। দূর্নীতিতে নিমজ্জিত সব কিছু। সবাই ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় ব্যস্ত। একটি তথ্য দিলে সে সময়ের মেক্সিকোর রাজনৈতিক অস্থিরতা একটু হলেও আঁচ করা যাবে। স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী বিশ বছরে বিশবার প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হয় মেক্সিকোর!
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ম্যানুয়েল গোমেজ পেদ্রাজা আগের প্রেসিডেন্টদের করুণ পরিণতি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তাই নিজেকে ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী রাখার জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরই অংশ হিসেবে লরেঞ্জো ডি জাভালা নামের একজন গভর্নরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন।
কিন্তু লরেঞ্জো ডি জাভালা ছেড়ে কথা বলার মানুষ ছিলেন না। সেনাবাহিনীর একটি অংশের সমর্থনও তার পক্ষে ছিল। তাই গভর্নর থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর কালবিলম্ব না করে প্রেসিডেন্ট পেদ্রাজার বিপক্ষে বিদ্রোহ শুরু করেন। তার অনুগত সেনাবাহিনী ও প্রেসিডেন্টের সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়।
মেক্সিকো সিটির পাশেই একটি ছোট্ট শহর ট্যাকুবায়া। পুরো মেক্সিকো সিটি যখন কোলাহলে ভরপুর, বাতাসে বারুদের ভারী গন্ধ, শহরবাসীরা ভীতসন্ত্রস্ত, তখন এই শহরে যেন রাজ্যের নীরবতা। শহরের দিকে দেখলে বোঝার উপায় নেই মেক্সিকোতে আসলে কী চলছে।
মঁসিয়ে রেমোন্টেল। শান্তশিষ্ট ট্যাকুবায়া শহরের একজন ব্যবসায়ী। ট্যাকুবায়ার ফরাসি বাজারে তার দোকান আছে। সেখানে পেস্ট্রি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার বিক্রি হয়। বেশিরভাগই মিষ্টিজাতীয় খাবার। শহরে তার পরিচিতি ভালোই। কারণ তার দোকানের খাবারের বেশ সুনাম রয়েছে। শহরবাসী দেদারসে তার খাবার কেনে। খাবারের মান যেন ঠিক থাকে সেদিকে রেমোন্টেল বেশ সতর্ক থাকেন।
মেক্সিকো সিটিতে দুই বাহিনীর যে সংঘর্ষ, সেটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একদিন শোনা যায় ট্যাকুবায়া শহরেও গোলাগুলি শুরু হয়ে গিয়েছে। চিরশান্ত ট্যাকুবায়ার রাস্তায় দুই পক্ষের বিকট গোলাগুলির দৃশ্য একসময় খুবই সাধারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মঁসিয়ে রেমোন্টেলের দোকানটি ছিল রাস্তার সাথেই। ট্যাকুবায়ায় বিশৃঙ্খলা শুরু হওয়ার পর ভয়ে ভয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু একদিন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে বসলো।
প্রেসিডেন্টের সেনাবাহিনীর সদস্যরা হানা দিল রেমোন্টেলের দোকানে। দোকান কিংবা ব্যাংক লুট ততদিনে খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মেক্সিকোতে। প্রতিদিনই দোকান লুটের খবর পাওয়া যায়। ব্যবসায়ীরা পারতপক্ষে চেষ্টা করে দোকান না খোলার।
পেদ্রোজার মদ্যপ সৈন্যরা রেমোন্টেলের দোকানের সব লুট করে নিয়ে গেল।
হতভম্ব রেমোন্টেল কিছু বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। তিনি অবৈধ ব্যবসা করে কোটি কোটি পোসো আয় করা মানুষ ছিলেন না। মেক্সিকোতে যে মাদকের বাজার রমরমা, সে কথা নতুন করে বলতে হয় না। চাইলে তিনিও অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে লাখ লাখ পেসো কামাতে পারতেন। কিন্তু করেননি। তার একমাত্র সম্বল ছিল এই দোকানটি। সেটিও লুট হয়ে গেল সেনাবাহিনীর মদ্যপ সৈন্যদের হাতে।
দোকান লুটের শোকে প্রথমদিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গিয়েছিলেন মঁসিয়ে রেমোন্টেল। বুঝতে পারছিলেন না কী করা দরকার। একসময় তার মনে হল, সরকারের কাছে দোকান লুটের ক্ষতিপূরণ চাওয়া উচিত।
মেক্সিকো সরকারের দ্বারে বেশ কয়েকবার ঘুরলেন রেমোন্টেল, কিন্তু ফলাফল শূন্য। মেক্সিকো সরকার কোনোভাবেই কথা কানে নিচ্ছে না। দোকান লুটের ক্ষতিপূরণ না দেয়ার জন্য সরকারের যুক্তি– যেহেতু আমরা আমাদের ক্ষতিগ্রস্থ নাগরিকদেরই ক্ষতিপূরণ দিতে পারছি না, সেখানে তোমাকে কীভাবে দেই বলো? উল্লেখ্য, মঁসিয়ে রেমোন্টেল জাতে ফরাসি ছিলেন।
এবার রেমোন্টেলের মেজাজ গেল বিগড়ে। মেক্সিকো সরকারকে বলো তো লাভ হলো না, তাই এবার চললেন স্বয়ং ফ্রান্সের রাজার কাছে। ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ রেমোন্টেলের দুর্দশার কথা শুনে মুখ তুলে তাকালেন। তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো রাজার নির্দেশে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হলো, শুধু রেমোন্টেলই নয়, আরও অনেক ফরাসি ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে। রাজা এবার নড়েচড়ে বসলেন।
স্পেনের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ই ফ্রান্স মেক্সিকোকে ঋণ দিয়েছিল। যুদ্ধের সময় দেয়া ঋণ এবং অভ্যন্তরীণ গোলযোগে ফরাসি ব্যবসায়ীদের হারানো সম্পত্তি– দুটো একত্রে হিসাব করে মেক্সিকো সরকারের কাছে ছয় লাখ পেসো দাবি করা হয়। ছয় লাখ পেসোর দাবি মেক্সিকোর কাছে উত্থাপন করা হয় কূটনৈতিকভাবে।
তখন মেক্সিকোর অর্থনীতির যা অবস্থা তাতে ফ্রান্সের দাবি করা অর্থ পরিশোধ করা বেশ দুঃসাধ্য ছিল। তাই বারবার চাওয়া সত্ত্বেও মেক্সিকো অর্থ পরিশোধ করেনি। কূটনৈতিকভাবে দাবি করা অর্থ না পেয়ে ফ্রান্স বেশ অপমানিত বোধ করে।
ফ্রান্স দেখলো শান্তিপূর্ণ দাবি উত্থাপনে পাওনা আদায় করা যায়নি, তাই কঠোর পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়। অ্যাডমিরাল চার্লস বাউদিনেট নের্তৃত্বে একটি যুদ্ধজাহাজের বহর মেক্সিকান উপকূলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৮৪৮ সালের ১৬ই এপ্রিল মেক্সিকোর ভ্যারাক্রুজ বন্দরে এসে পৌঁছায় ফরাসি নৌবহর। ভ্যারাক্রুজ বন্দরে অবরোধ জারি করা হয়।
অবরোধ জারি করার পরও ফ্রান্স কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একে একে তাদের সকল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
নৌবহর পাঠিয়ে দেওয়ার প্রায় সাত মাস পর, ২৭ নভেম্বর ভারাক্রুজ বন্দরের স্যান হুয়ান ডি উলুয়া সেনা-দুর্গে বোমাবর্ষণ শুরু করে। এর ফলে মেক্সিকোও অনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দেয়।
ফ্রান্সের উন্নত নৌবাহিনীর সামনে মেক্সিকান বাহিনী কোনো পাত্তাই পাচ্ছিল না। কয়েকদিনের মধ্যেই পুরো ভ্যারাক্রুজ শহর দখল করে নেয় ফরাসিরা।
এবার দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে সান্তা অ্যানা নামক ব্যক্তির। মেক্সিকোর স্বাধীনতা যুদ্ধে সান্তা অ্যানা জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে টেক্সাস হারানোকে কেন্দ্র করে তিনি রাতারাতি নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হন। ভ্যারাক্রুজ বন্দর ফরাসিদের দখলে যাওয়ার পর তিনি মেক্সিকো সরকারের অনুমতি ছাড়াই ছোটখাট সেনাদল দাঁড় করিয়ে ফেলেন। নিজেই এর নের্তৃত্বের দায়ভার কাঁধে নেন।
ফরাসি বাহিনী সামনে যেখানে মেক্সিকান সেনাবাহিনীই দাঁড়াতে পারছিল না, সেখানে সান্তার অ্যানার ছোট সেনাদল কী করবে তা অনুমান করাই যায়। ফরাসিদের সামনে কিছুই করতে পারেনি তারা। তবে তার সেনাদল নির্ভীক চিত্তে লড়েছিল। এটিই মেক্সিকান জনগণকে আকর্ষণ করে।
ফরাসিদের সাথে যুদ্ধের একপর্যায়ে ছররার আঘাতে অশ্বারোহী জেনারেল সান্তা অ্যানার ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান। তার একটি পা মারাত্মক জখম হয়। ডাক্তাররা তার পা কেটে ফেলতে বাধ্য হন। পূর্ণ সামরিক মর্যাদার সাথে তার পা দাফন করা হয়।
মিডিয়ার কল্যাণে সান্তা অ্যানার পা হারানোর খবর জোরেশোরে প্রচার করা হয়। টেক্সাস ইস্যুতে তিনি ভিলেনে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু পা হারানোর ঘটনায় আবার জনগণের চোখে হিরো হয়ে যান তিনি। এমনকি অনেকে তাকে ‘পশ্চিমের নেপোলিয়ন’ আখ্যা দেন। যুদ্ধের সময়ে দাঁড় হওয়া ‘ইমেজ’কে কাজে লাগিয়ে তিনি মেক্সিকান রাজনীতিতে আবার প্রবেশ করেন এবং প্রেসিডেন্ট হন।
ভ্যারাক্রুজ বন্দর দখল হওয়ার পর মেক্সিকোর ভঙ্গুর অর্থনীতির আরও পতন ঘটে। এই বন্দর দিয়েই মেক্সিকোর প্রধান বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালিত হতো। ভ্যারাক্রুজ দখল হয়ে যাওয়ার পর সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও শুল্ক বাবদ দৈনিক হাজার হাজার পেসো হারাচ্ছিল মেক্সিকো সরকার।
উপায়ান্তর না দেখে মেক্সিকো এবার ব্রিটেনের দ্বারস্থ হয়। মেক্সিকো সরকারের অনুরোধে ব্রিটেন কূটনীতিক সমঝোতার চেষ্টা করে দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে। কাজ হয়। মেক্সিকো ফ্রান্সের দাবিকৃত অর্থ দিতে রাজি হয়। এছাড়াও মেক্সিকোতে যেসব ফরাসি নাগরিক ব্যবসা করতো তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার দাবিও মেনে নেয়।
যুদ্ধ শেষ হলো। ফরাসিরা ৯ মার্চ মেক্সিকো ত্যাগ করে। সাড়ে তিন মাসের যুদ্ধে খুব বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে বন্দরে কোনোপ্রকার বাণিজ্য না হওয়ায় মেক্সিকো সরকার বেশ বড় অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।
ফরাসিদের নৌশক্তি ব্রিটিশদের মতো না হলেও যে একদম ফেলে দেয়ার মতো নয়, এই যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বকে সেই বার্তা দেয় ফ্রান্স। ফরাসি নৌবাহিনীকে বীরের বেশে দেশে বরণ করে নেয়া হয়।
মজার ব্যাপার হলো, মেক্সিকো ছয় লাখ পেসো দিতে সম্মত হলেও শেষ পর্যন্ত পুরো অর্থ পরিশোধ করেনি। খুব অল্প পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করেছিল। ১৮৬১ সালে যখন দ্বিতীয়বার ফ্রান্স মেক্সিকোতে আক্রমণ করে, তখন এই পাওনা পেসো পরিশোধ না করাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়।
এই যে এত কিছু হয়ে গেল, সব কিন্তু সেই পেস্ট্রির দোকান লুটের জন্য!