১৯৮৯ সালের ৫ জুন, উত্তপ্ত বেইজিং। বিক্ষোভের মুখে পড়েছে মাওবাদী চীন সরকার। কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা ছাত্র আন্দোলন রূপ নিয়েছে জাতীয় বিক্ষোভে। ক্রমেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। চীন সরকার শক্ত হাতে আন্দোলন দমন করার সিদ্ধান্ত নিলো।
যেই কথা সেই কাজ। সরকারের নির্দেশে মুহূর্তের মধ্যে সুসজ্জিত ট্যাংক বহর রওয়ানা দিলো তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের দিকে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করে সেনাবাহিনী। সফল অভিযান শেষ করে শূন্য বেইজিংয়ের রাজপথ টহল দিচ্ছিলো তারা। হঠাৎ পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ালো প্রথম ট্যাংক। সেটার পিছু পিছু বাকি ট্যাংকগুলোও থেমে গেল। একটি ট্যাংকও সামনে অগ্রসর হতে পারছে না। কারণ কী?
কারণ তাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে এক অকুতোভয় ছাত্র। কী সাংঘাতিক সাহস এই ছোকরার! যে ট্যাংক বাহিনীর ভয়ে শক্তিশালী সেনাদল পর্যন্ত থর থর করে কাঁপে, আজ এক নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্র কিনা তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে? সামনের ট্যাংক একটু পিছিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করলো। সাথে সাথে সেই ছাত্র জায়গা বদলে পুনরায় ট্যাংকের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। এখানেই ঘটনার শেষ নয়। সেই ছাত্র বিদ্রোহী নেতার মতো হাত দিয়ে ইশারা করলো পিছু হটে যেতে। ছাত্রের সাহস দেখে থ বনে গেলেন ট্যাংক কমান্ডার। মুগ্ধ হয়ে দেখলো সারা বিশ্ব। চীনা ছাত্ররা আজ জেগে উঠেছে। এক নতুন ইতিহাস রচনার নেশায় তারা আজ যুদ্ধে নেমেছে।
রোমন্থন করছিলাম ঐতিহাসিক তিয়েন আনমেন স্কোয়ার ছাত্র আন্দোলনের ঘটনা। সেই আন্দোলনের প্রতীক ‘ট্যাংক ম্যান’ খ্যাত সেই নাম না জানা ছাত্রের বীরত্বে সেদিন পৃথিবী দেখেছিল নতুন চীনকে। আমাদের আজকের আলোচনা সেই বিখ্যাত ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে।
তিয়েন আনমেন স্কোয়ার
তিয়েন আনমেন স্কয়ার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের প্রাণকেন্দ্র। শহরের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত এই চত্বরের উত্তরে তিয়েন আনমেন নামক একটি ফটক রয়েছে। তিয়েন আনমেন অর্থ ‘স্বর্গের দরজা’। এই ফটকের সাথে মিলিয়ে চত্বরের নামকরণ করা হয় তিয়েন আনমেন। চীনের বড় বড় ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন নিদর্শন এই চত্বরকে চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। নিদর্শনগুলোর মধ্যে মাও সেতুংয়ের সমাধিসৌধ, জাতীয় জাদুঘর, গ্রেট হল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
চীনের ইতিহাসে অনেক ছোট বড় আন্দোলনের স্মৃতি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এই চত্বর। কিন্তু সবধরনের আন্দোলনকে ছাপিয়ে ’৮৯ এর ছাত্র আন্দোলন দ্বারা তিয়েন আনমেন ইতিহাসের পাতায় স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে।
আন্দোলনের পটভূমি
১৯৭৬ সালে চীনের জনক মাও সেতুং মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর সাথে চীনা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূর্য অস্তমিত হয়। মাও সেতুং যে দর্শন নিয়ে চীনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। মৃত্যুর মাধ্যমে ব্যর্থতার দায় থেকে তার রেহাই হলেও চীনের আর্থ-সামাজিক কাঠামো তখন মৃতপ্রায়। দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অস্থিতিশীল অর্থনীতি, বেকারত্ব ইত্যাদির কারণে চীনে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। খাদ্যাভাবে মৃত্যু ঘটে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের।
চারিদিকে শুধু অভাব আর অভাব। এমন অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ১৯৮৬ এর দিকে চীন জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনে অংশ নেয় চীনের ছাত্রসমাজ।
মাওবিরোধী সংস্কারপন্থীদের আন্দোলনে প্রেরণা প্রদান করেন কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব হু ইয়াওবেং। ফলে ১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে তাকে দল থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে তুলে ধরা হয়, তিনি ১৯৮৬ সালে ছাত্রদের সরকারবিরোধী আন্দোলনে উস্কানি প্রদান করেন। তাকে দলের পক্ষ থেকে অপমান করা হয়। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। তাকে ঘিরে চীনে বড় আকারের সংস্কারপন্থী ছাত্র সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু সংস্কারপন্থীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো হু ইয়াওবেংয়ের মৃত্যু। ১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন হু। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নেতা হওয়ার পরেও সরকারপক্ষ থেকে হু-কে কোনো ধরনের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়নি। সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার থেকে তেমন ফলাও করে ঘোষণা করা হয়নি তার মৃত্যুসংবাদ।
এই আচরণের বিরুদ্ধে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে। বিভিন্ন দিক থেকে সরকারকে চাপ দিতে থাকে ছাত্ররা। ছাত্র নেতারা সরকারপক্ষের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলার জন্য গ্রেট হলে সমাবেশের আয়োজন করেন। কিন্তু সরকারপক্ষের কোনো নেতা ছাত্রদের সমাবেশে অংশ নেননি। ফলে ছাত্ররা ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু সরকার থেকে হু ইয়াওবেংকে সংবর্ধনা প্রদান করার দাবি মেনে নেওয়া হয়।
২২ এপ্রিল প্রায় ১ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয় হু ইয়াওবেংকে। এ দিন ছাত্ররা সরকারের নিকট তাদের আন্দোলনের দাবি-দাওয়া সম্বলিত একটি পিটিশন পেশ করে। কিন্তু নতুন মহাসচিব ঝাও ঝিয়াং ছাত্রদের পিটিশন আমলে নিলেন না। তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে উত্তর কোরিয়া চলে গেলেন। এই ঘটনায় ছাত্ররা চরমভাবে অপমানিত হয়। আন্দোলনের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিলেন ঝাও ঝিয়াং।
সরকারপক্ষ থেকে কোনোরূপ সাড়া না পেয়ে ছাত্ররা প্রতিবাদ শুরু করে। সরকারবিরোধী ব্যানার নিয়ে তারা জড়ো হতে থাকে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে। তিয়েন আনমেনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন।
আন্দোলনের শুরু
খুব অল্প সময়ের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো চীন জুড়ে। সাংহাই, নানজিং, যিয়ান, চাংসা, চেংদু সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে দেয়। তাদের সাথে যোগ দেয় সাধারণ জনগণ। কিন্তু নাছোড়বান্দা সরকার তখনও ছাত্রদের সাথে কোনো ধরনের আলোচনায় বসতে রাজি হননি। সরকারপক্ষের নেতা ডেং ঝিয়াওপিং এক বিবৃতিতে এই আন্দোলনকে অরাজক কর্মকাণ্ড হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি শক্ত হাতে আন্দোলন দমনের হুমকি পর্যন্ত দেন। তিনি চীনা পত্রিকা ‘পিপলস ডেইলি’ তে এ ব্যাপারে একটি সম্পাদকীয় পর্যন্ত প্রকাশ করেন।
এবার পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রায় ৫০ হাজার ছাত্র তিয়েন আনমেনে জড়ো হয় এবং সরকার পতনের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। ততদিনে ঝাও ঝিয়াং তার সফর শেষ করে চীনে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার ভুল সিদ্ধান্তের ফলেই আজ এই পরিস্থিতি। তিনি ছাত্রদের সাথে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করবেন বলে প্রস্তাব দেন।
কিন্তু চীনা প্রধানমন্ত্রী লি পেং এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে দেন। তিনি পিছু হটতে রাজি নন। তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে। ৪ মে এর মধ্যে আন্দোলন প্রায় ২৫০ শহরে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তিয়েন আনমেনে জড়ো হওয়া আন্দোলনকারীর সংখ্যাই ছিল ১ লাখের কিছু বেশি। বৈদেশিক সংবাদমাধ্যমে এই আন্দোলনকে ৪০ বছরের ইতিহাসে বৃহত্তম ছাত্র আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এরপর ছাত্ররা ১৩ মে একযোগে অনশন কর্মসূচি শুরু করে। ‘পিপলস ডেইলি’র সম্পাদকীয় বাতিল ঘোষণাসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মেনে না নিলে তারা অনশন ভাঙবে না। বিশ্লেষকদের মতে, অনশন বিক্ষোভের মাধ্যমে এই আন্দোলন বিশ্ববাসীর নিকট সমর্থন আদায় করে। ছাত্রদের এই পদক্ষেপ ছিল সময়োচিত।
ওদিকে ঝাও ঝিয়াং সরকারকে চাপ দিতে থাকেন। তিনি দ্রুত ছাত্রদের সাথে আলোচনায় বসে সমস্যা সমাধান করতে চান। তার এই প্রস্তাবনায় এবার চটে যায় চীন সরকার। পরদিন সরকারের মুখপাত্র ডেং ঝিয়াওপিং বেইজিংয়ে সামরিক শাসন জারি করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ঝাও ঝিয়াংকে কমিটি থেকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু ঝাও ঝিয়াং থেমে যাননি। তিনি অনশন কর্মসূচি ত্যাগ করার জন্য ছাত্রদের আহ্বান করেন।
সরকারপক্ষীয় নেতাদের মাঝে মতবিরোধ আর ছাত্রদের জোরালো আন্দোলনের মুখে চীন জুড়ে এক অস্থিতিশীল অবস্থার সূত্রপাত হয়।
মিখাইল গর্বাচেভের সফর
বিশ্ব পরাশক্তি সোভিয়েতের সাথে চীনের সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ১৬ মে চীন সফরে আসেন। নিয়মানুযায়ী রাষ্ট্রনেতাদের সংবর্ধনার জন্য তিয়েন আনমেন স্কয়ারে সম্মেলনের আয়োজন করেন চীন সরকার। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা তিয়েন আনমেন ছাড়তে নারাজ। ছাত্রদের দাবী অগ্রাহ্য করে গর্বাচেভের সফর নিয়ে সরকারের ব্যস্ততা ছাত্রদের পছন্দ হলো না। গর্বাচেভের সফর নিয়ে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ কম ছিল না। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সাংবাদিকরা গর্বাচেভের আগমন উপলক্ষ্যে চীনে আসেন। ফলে তিয়েন আনমেন নিয়ে ছাত্র এবং সরকারের মতবিরোধের কথা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা চীন সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন এবং নিন্দা প্রকাশ করেন।
শেষ পর্যন্ত ছাত্রদেরকে তিয়েন আনমেন থেকে সরাতে ব্যর্থ হয় সরকার। বাতিল হয়ে যায় গর্বাচেভের সংবর্ধনা। লজ্জায় পড়ে যায় চীন সরকার। ক্ষুদ্ধ হয়ে আন্দোলন শক্ত হাতে দমন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন প্রধানমন্ত্রী লি পেং।
বেইজিংয়ে সামরিক শাসন জারি
১৯ মে সকালে ঝিও ঝিয়াং তিয়েন আনমেনে ছাত্রদের সাথে কথা বলার জন্য উপস্থিত হন। কিন্তু তার এই উপস্থিতির কথা চীন সরকার জানতেন না। তিনি সেখানে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন, “Students, we came too late. We are sorry. You talk about us, criticize us, it is all necessary.”
ততক্ষণে হয়তো আসলেই দেরি হয়ে গেছে। স্বৈরাচারী সরকার ঝাও ঝিয়াংকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। তাকে গৃহবন্দী করা হয়। এরপর আর জনসম্মুখে কখনো দেখা যায়নি ঝিয়াংকে।
পরদিন বেইজিংয়ে সামরিক শাসন জারি করেন ডেং ঝিয়াওপিং। অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাসদস্যরা বেইজিংয়ের রাজপথে নেমে আসেন। কিন্তু সাধারণ নাগরিকরা বেইজিং প্রবেশের সকল রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে দেয়। ফলে সামরিক বাহিনীর বেইজিং প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
সামরিক শাসন জারি করায় ছাত্ররা ক্ষুদ্ধ হয়ে যায়। তারা গণতন্ত্রের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। বেইজিং পরিণত হয় বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্রে।
৩০ মে ললিত কলার ছাত্ররা ‘গণতন্ত্রের দেবী’ নামক একটি মূর্তি গড়ে তোলেন। তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে স্থাপন করা হয় মূর্তিটি। আন্দোলনের প্রতীকী হিসেবে মূর্তিটি প্রেরণার উৎস হয়ে উঠে।
বৈশ্বিক চাপের মুখে দিশেহারা চীন সরকার আর বসে থাকতে পারলেন না। প্রধানমন্ত্রী লি পেং যে করেই হোক আন্দোলন দমন করতে নির্দেশ প্রদান করেন সেনাপ্রধানকে।
ভারি অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে সেনাবাহিনী বেইজিং আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তিয়েন আনমেনের আকাশে তখন গণহত্যার আশঙ্কা উঁকি দিতে থাকে।
তিয়েন আনমেন হত্যাকাণ্ড
৩ জুন সকালের দিকে পিপলস লিবারেশন আর্মির ২৮ ডিভিশনের একটি ফৌজ ব্যারিকেড ভেঙে বেইজিংয়ে প্রবেশ করে। তাদের সাথে যোগ দেয় ২৭ ডিভিশন। সেনাবাহিনী ছাত্রদের উপর কাঁদুনে গ্যাস দিয়ে আক্রমণ করে। তাদের উপর অস্ত্র ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়।
কিন্তু সেনাবাহিনীর এই আক্রমণের ফলাফল ‘বুমেরাং’ হয়ে গেল। উল্টো হাজার হাজার সাধারণ জনতা ছাত্রদের সাথে যোগ দিয়ে সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করতে লাগলো। সেনাবহরে অগ্নিসংযোগ করে দেয় তারা। সেখানে কয়েকজন সেনাসদস্য জীবন্ত পুড়ে মৃত্যুবরণ করেন। জনগণের আক্রমণের মুখে পিছু হটে যায় সেনাবাহিনী।
ছাত্র নেতারা জানতেন, এই ঘটনার পরিণতি কী হতে পারে। সেনাসদস্যের মৃত্যু সরকার হালকাভাবে গ্রহণ করবেন না। অনেকেই আন্দোলন স্থগিত করতে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা নাকচ করে দেন নেতারা।
পরদিন বেইজিংয়ের রাজপথে গোলাবারুদ বোঝাই বহর নিয়ে আক্রমণ করে সেনাবাহিনী। ট্যাংক দিয়ে সাধারণ জনতার উপর গোলাবর্ষণ করা হয়। পদাতিক বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে থাকে। আন্দোলন দমনের চেয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাই যেন মুখ্য হয়ে ফুটে উঠেছিল সৈনিকদের অভিব্যক্তিতে।
নিরস্ত্র ছাত্রদের বুকের তাজা রক্তে সেদিন বেইজিংয়ের রাজপথ রঞ্জিত হয়ে যায়। কামানের গোলার আঘাতে ধ্বসে যায় আন্দোলনের প্রতীক ‘গণতন্ত্রের দেবী’। সারাদিন ধরে চললো এই পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ। তিয়েন আনমেন পরিণত হলো রক্তাক্ত প্রান্তরে।
৪ জুন সন্ধ্যার দিকে তিয়েন আনমেন স্কোয়ার সম্পূর্ণভাবে দখলে নিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। চীন সরকার এই অভিযানকে সফল ঘোষণা করেন এবং ন্যায়ের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করে বিবৃতি দেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে বিদ্রোহে নিহতদের সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য গোপন করা হয়।
কিন্তু চীনে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকরা তখন সেদিনের ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ, ছবি এবং লিখিত প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করে দেন। বিশ্বজুড়ে তীব্রনিন্দা জানানো হয় চীন সরকারের প্রতি।
সুপারহিরোর নাম ‘ট্যাংক ম্যান’
৫ জুনের ঘটনা। বেইজিংয়ের রাজপথ প্রায় শূন্য। আন্দোলনকারীরা তখন অনেকেই মৃত। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেছেন। ট্যাংক নিয়ে বেইজিংয়ের পথে টহল দিচ্ছিলো সেনাবাহিনী। তারা ভেবেছিলো আন্দোলন বুঝি শেষ। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল। বিশাল ট্যাংকের সামনে এসে রুখে দাঁড়ালেন এক অকুতোভয় ছাত্র। তিনি একাই লড়াই করবেন সরকারের বিরুদ্ধে। আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি।
তিনি অমিত তেজে আঙুল তুলে সতর্ক করেন ট্যাংক সেনাকে। তারপর অবাক করে দিয়ে তিনি ট্যাংকের উপর উঠে বসেন। সেখানে চালককে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে প্রশ্ন করেন,”তোমরা এখানে কেনো এসেছো? তোমরা আমাদের কষ্ট দেওয়া ব্যতীত আর কিছু করতে পারবে না”।
আশেপাশের সাধারণ জনগণ এই ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। তারা দ্রুত সেখানে পৌঁছে সেই সাহসী ছাত্রকে নিয়ে আড়ালে সরে পড়েন। এই পুরো ঘটনা দূর থেকে ভিডিও করেন এক সাংবাদিক। সেই সাহসী ছাত্রের নাম জানা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পুরো পৃথিবী তখন তাকে বরণ করে নিয়েছে ‘ট্যাংক ম্যান’ হিসেবে। রূপালী পর্দার সুপারহিরো যেন বাস্তবে জন্ম নিয়েছেন। ছাত্র আন্দোলনের জীবন্ত প্রতীক হয়ে যান তিনি।
আন্দোলন পরবর্তী ঘটনা
আন্দোলনের পর বেঁচে যাওয়া আন্দোলনকারী ছাত্রদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। আন্দোলনের সাথে জড়িত যে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়। যেসব সংবাদমাধ্যম আন্দোলন সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রকাশ করেছিল, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আজ পর্যন্ত চীন সরকারের পক্ষ থেকে সেদিনের আন্দোলন সম্পর্কে কোনো নথি প্রকাশ করা হয়নি। আন্দোলনে মোট কতজন নিহত হয়েছিলো, তার সঠিক হিসাবও প্রকাশ করেননি চীন সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে হতাহতের সংখ্যা বলা হয় মাত্র ২৪১। কিন্তু এই সংখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। রেড ক্রস এবং স্থানীয় হাসপাতালে লাশ গণনা করে ধারণা করা হয় মৃতের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার হতে পারে।
সরকার থেকে তিয়েন আনমেনের আন্দোলনকে ‘ট্যাবু’ ঘোষণা করা হয়। চীনে এই ঘটনা ‘৪ জুন ঘটনা’ নামে পরিচিত। এমনকি এই ঘটনা সম্পর্কিত যেকোনো ধরনের চীনা ওয়েবসাইট সরকারের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
তিয়েন আনমেনের ছাত্র আন্দোলন চীনের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। অস্ত্রের আঘাতে হয়তো সেদিনের আন্দোলন দমন করা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু আন্দোলনের চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। নাম না জানা হাজারো বিপ্লবীর বুকের রক্তে সিক্ত তিয়েন আনমেন স্কোয়ার শুধু চীনের প্রাণকেন্দ্র নয়, তা পরিণত হয়েছে গণজাগরণের রাজধানীতে।