লেখাটির শিরোনাম দেখে যে কারোরই ভ্রু কুঁচকে যাবার কথা। তবে আজকের লেখায় যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবগুলোই সত্যি। যে ছয়জন নারী সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে, তাদের সবাই দীর্ঘদিন ধরে স্বামীর নির্যাতন সহ্য করে শেষে এ পথ বেছে নিয়েছিলেন। কেউ আবার স্বামীর পরকীয়ার খবর জানতে পেরে তার প্রতি এতটা নিষ্ঠুর হয়েছিলেন।
১। মিশেল হৌক্স
১৯৯৫ সালের গ্রীষ্মের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের জ্যাকসন কাউন্টির বাসিন্দা মিশেল ও ড্যারিন হৌক্স দম্পতির মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বাড়িতে থেকে যান স্বামী ড্যারিন, চলে যান মিশেল।
সেই বছরেরই ২৮ আগস্ট রাতে মিশেল তাদের আগের বাসায় আসেন তার রেখে যাওয়া কিছু জিনিস নিয়ে যেতে। কিন্তু এসেই মাথা গরম হয়ে যায় তার। কারণ ড্যারিনকে আরেক নারীর সাথে দেখে ফেলেন তিনি। রাগের মাথায় সাবেক স্বামীকে এক হাতে স্ক্রু-ড্রাইভার আর অন্য হাতে কেচি দিয়ে আক্রমণ করতে যান মিশেল। সৌভাগ্যবশত ড্যারিন তাকে নিরস্ত্র করতে সক্ষম হন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সেই রাতের মতো বাসা ছেড়ে যান মিশেল।
পরদিন আবার তিনি আগের বাসায় আসলেন; তবে রাতে নয়, সন্ধ্যাবেলায়। ড্যারিন অফিস থেকে ফেরার আগেই তিনি বাসায় ঢুকে লুকিয়ে থাকলেন রান্নাঘরে। তারপর ড্যারিন ফিরে এসে রান্নাঘরের কাছে আসামাত্রই তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন মিশেল। প্রতিরোধ করতে ড্যারিন মিশেলের হাত আটকাতে চাইলেন। কিন্তু ততক্ষণে লাইটার জ্বালিয়ে মিশেল সেটি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সাবেক স্বামীর দিকে। সাথে সাথেই দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করে তার পুরো শরীর। এ ঘটনায় ড্যারিনের শরীরের প্রায় অর্ধেক পুড়ে গিয়েছিলো।
জানা যায়, যখন আগুনে জ্বলছিলো ড্যারিনের শরীর, তখন তিনি মিশেলকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি আমার সাথে কেন এমন করছো?” জবাবে রাগে ফুঁসতে থাকা মিশেল শুধু বলেছিলেন, “যদি আমি তোমাকে না পাই, তবে আর কেউই পাবে না!” হায়রে অদ্ভুত ভালোবাসা!
২। ম্যারি অ্যাটাহ
এবার একটু নাইজেরিয়া থেকে ঘুরে আসা যাক। ২০১২ সালের জুলাই মাসে নাইজেরিয়ার ইফুরান শহরে চমৎকার এক আবেগঘন সান্ধ্যকালীন মুহূর্ত পার করছিলেন ম্যারি অ্যাটাহ এবং তার স্বামী ডার্লিংটন অ্যাটাহ। এমন এক মুহূর্তেই বেজে ওঠে ডার্লিংটনের ফোন। আর এ ফোনই হয়ে ওঠে যত সর্বনাশের মূল।
ফোন কলের সূত্র ধরে ম্যারি বুঝতে পারেন যে, ফোনটি আসলে করেছেন ডার্লিংটনের উপপত্নী। সাথে সাথেই যেন মাথায় বিষ্ফোরণ ঘটে যায় ম্যারির। এক দৌড়ে রান্নাঘরে ছুটে যান তিনি, নিয়ে আসেন মরিচের গুঁড়া ও ছুরি। এসে প্রথমেই স্বামীর চোখে মরিচের গুঁড়া ছুঁড়ে মারেন তিনি। এরপর হাতে থাকা ছুরি সজোরে বসিয়ে দেন ডার্লিংটনের গলায়। এরপরেও রাগ কমে নি ম্যারির। রক্তাক্ত ডার্লিংটনের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন তিনি। এত আঘাত আর সইতে পারেন নি বেচারা ডার্লিংটন। হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
মনের জ্বালা যে ম্যারির মিটেছিলো, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তবে আইনের হাত থেকে তার মুক্তি মেলে নি। ২০১৬ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ম্যারির মৃত্যুদন্ড কার্যকরের রায় দেয় আদালত।
৩। রজনী নারায়ণ
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেইডে স্বামী সতীশ নারায়ণকে নিয়ে সুখের সংসার পেতেছিলেন রজনী নারায়ণ। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে যখন তিনি জানতে পারেন যে, সতীশ আসলে পরকীয়ায় লিপ্ত।
২৪ বছর ধরে ঘর করা নেভি ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর এহেন কাজকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন নি রজনী। তাই বিশ্বাসভঙ্গকারী স্বামীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে চাইলেন রজনী, তবে ‘একটু অন্যভাবে’।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা, ঘুমিয়ে ছিলেন সতীশ নারায়ণ। হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেলো প্রচন্ড উত্তাপে, টের পেলেন তার পুরুষাঙ্গে কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আসলে সতীশকে শিক্ষা দিতে স্ত্রী রজনীই করেছিলেন এ কাজটি। নিজেকে বাঁচাতে পাশে থাকা রজনীর ব্যবহৃত স্পিরিটের বোতলটি ছুঁড়ে ফেলে দেন তিনি। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়ে আগুন লেগে যায় সারা বাড়িতেই, শরীরের তিন-চতুর্থাংশ পুড়ে যায় সতীশের।
এ ঘটনার ২০ দিন পর পরলোকগমন করেন সতীশ নারায়ণ। অবশ্য স্বামীর এমন প্রস্থান চান নি রজনী নিজেও। পুরো ব্যাপারটির জন্য তিনি নিজেও ছিলেন অনুতপ্ত। তিনি শুধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমি শুধু ওর পুরুষাঙ্গটাই পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম! এমন কিছু হবে তা আমি কখনোই চাই নি!”
৪। মেরিলিন প্ল্যান্ট্জ
১৯৮৮ সালের ২৬ আগস্ট নাইট ডিউটি সেরে বাসায় ফিরলেন জিম প্ল্যান্ট্জ। কিন্তু এ ফেরাটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য। কারণ ঘরে ঢোকামাত্রই ১৮ বছর বয়সী দুটি ছেলে- ক্লিনটন ম্যাককিম্বলে ও উইলিয়াম ব্রাইসন তাকে বেসবল ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে আধমরা করে ছাড়লো। তারপর জিমের স্ত্রী মেরিলিনের নির্দেশে তারা জিমকে তারই পিক-আপ ভ্যানে করে ওক্লাহোমা সিটির একটু বাইরে নির্জন জায়গায় নিয়ে গেলো। তারপর এক গ্রাম্য রাস্তায় গাড়িটি থামিয়ে জিমকে ভেতরে রেখে বের হয়ে যায় ব্রাইসন ও ম্যাককিম্বলে। তারপর? তারপর গাড়িসহ পুড়িয়ে মারা হয় জিমকে। কিন্তু কেন এমন করা হবে?
এর পেছনে মূল কারণ ছিলো জিমের নামে করা ৩,০০,০০০ ডলারের জীবন বীমা। এছাড়া জিম তার স্ত্রী মেরিলিনের গায়ে প্রায়শই হাত তুলতেন। তাই এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাইছিলেন মেরিলিন। আবার ব্রাইসনের সাথে পরকীয়ার সম্পর্কও ছিলো তার। সব মিলিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ নিয়ে ব্রাইসনকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরুর আশায় ভয়াবহ এই খেলায় মেতে উঠেছিলেন মেরিলিন।
শেষ রক্ষা অবশ্য হয় নি কারোরই। পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনজনই। ম্যাককিম্বলে মেরিলিন ও ব্রাইসনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে তাকে প্রাণদন্ডের বদলে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়। বাকি দুজনকে দেয়া হয় প্রাণদণ্ড। প্রাণঘাতী ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে ২০০০ সালের জুনে ব্রাইসন এবং পরবর্তী বছরের মে মাসে মেরিলিনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
৫। কীরঞ্জিত আহ্লুওয়ালিয়া
১৯৭৯ সালের দিকে বিয়ে হয়েছিলো কীরঞ্জিত ও দীপকের। কিন্তু বিয়ের অল্প কিছুদিনের মাঝেই দীপকের মুখোশ খুলে যায়। নিয়মিতভাবেই স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে থাকেন তিনি। একটানা দশ বছর মুখ বুজে এ অত্যাচার সহ্য করে গেছেন কীরঞ্জিত। কিন্তু ১৯৮৯ সালে এসে যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় তার। তাই বাজার থেকে কিছু রাসায়নিক পদার্থ কিনে এনে একপ্রকার দাহ্য মিশ্রণ বানালেন তিনি। তারপর একদিন ঘুমন্ত অবস্থায় দীপকের গায়ে সেই মিশ্রণটি ছুঁড়ে দিয়ে সাথে সাথেই আগুন ধরিয়ে দেন কীরঞ্জিত। অল্প কিছুদিনের মাঝেই জীবনাবসান ঘটে দীপকের।
খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয় কীরঞ্জিতকে। তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় সুখবরটি কীরঞ্জিত পান ১৯৯২ সালে। সাউদাল ব্ল্যাক সিস্টার্স অর্গানাইজেশনের জোর প্রচেষ্টায় তার সাজা বাতিল করা হয়েছে। দশ বছর ধরে কীরঞ্জিতের উপর চলা অমানুষিক নির্যাতনের কথা বিবেচনা করেই শেষ পর্যন্ত আদালত এ সিদ্ধান্ত নেয়। তার উপর চালানো অত্যাচার থেকে শিক্ষা নিয়ে যুক্তরাজ্যে বাসা-বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের রক্ষার্থে প্রণীত আইনে সংশোধন আনা হয়। নিজের জীবনের ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে কীরঞ্জিত ‘সার্কেল অব লাইফ’ নামে একটি আত্মজীবনীও লিখেছিলেন।
৬। ফ্রান্সিন হিউঘ্স
১৯৭৭ সালের কথা। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও মাতাল স্বামী জেমস মিকি হিউঘ্স হাত তুলেছিলেন স্ত্রী ফ্রান্সিন হিউঘ্সের গায়ে। অনেক দিন ধরে এ নির্যাতন সহ্য করে আসছিলেন ফ্রান্সিন। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, এমনকি পুলিশও জানতো তার এমন নির্যাতিত হবার খবর। কিন্তু কেউই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি। বরং সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে যেন ফ্রান্সিনকে বোঝাতে চাইছিলেন- এটাই তোমার নিয়তি!
সেদিন তাই নিজের নিয়তিকে পরখ করে দেখতে চাইলেন ফ্রান্সিন। স্বামীর মার খেয়ে অন্যান্য দিনের মতো কাঁদতে বসে গেলেন না তিনি। বরং ছুটে গেলেন গ্যারেজে, ফিরে আসলেন গ্যাসোলিন নিয়ে। তার মাতাল স্বামী তখন বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন তাদের বিছানায়। সেখানেই গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন ফ্রান্সিন। তারপর বাচ্চাকে গাড়িতে করে নিয়ে সোজা ছুটে গেলেন পুলিশ স্টেশনে। সেখানে গিয়ে নিজের অপরাধের কথা খুলে বললেন তিনি!
অবশ্য শেষ পর্যন্ত ক্ষমা পেয়ে যান ফ্রান্সিন। তার উকিল আদালতকে বোঝাতে সক্ষম হন যে দীর্ঘদিন নির্যাতনের পর সেদিনের নির্যাতনে আর মাথা ঠিক ছিলো না ফ্রান্সিনের। তাই অমন কান্ডজ্ঞানহীন অবস্থায় খুনের ঘটনাটি ঘটিয়ে বসেন তিনি। ফ্রান্সিনের এ ঘটনাই পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব নারী গৃহ নির্যাতনের শিকার হন তাদের জন্য সেবার মান বাড়াতে ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।