“নূর ইসলাম- পোস্টারটা খুবই জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ, তাই আজ রাতেই ছাপার ব্যবস্থা কর। প্রেসকে বলবা কাগজের টাকা আজ রাতে দিবার পারুম না। আগামীকাল দুপুরের পর দিব। প্রেসকে আমার এই নোটটা দেখাবা। আপাতত ১০ হাজার পোস্টার ছাপ।”
– শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৭০ এ নির্বাচন তখন দরজায় কড়া নাড়ছে। পাকিস্তানীদের শোষণ আর বঞ্চনার শিকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য নির্বাচনী পোস্টারেই পশ্চিমা পাকিস্তানীদের বৈষম্যের চিত্র তুলে আনার প্রস্তাব দিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা দিয়েও পিছিয়ে পড়া বাঙালিদের অধিকার আদায় করা যায়নি। কিন্তু বাঙালিরা নিজেদের দাবি নিয়ে কতটা সচেতন তা আরো একবার বুঝিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছিলো পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে। দীর্ঘদিন ধরে বাঙালিদের উপর করে আসা সকল অবিচারের জবাব দিতেই ছয়দফা নিয়ে প্রচারণায় মাঠে নামলেন বাঙালির প্রতিনিধি শেখ মুজিব। পাকিস্তান পিপলস পার্টি তখন পশ্চিম পাকিস্তানে চালাচ্ছে বিপুল প্রচারণা। বিদেশী সাংবাদিকরা যখন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকে এই নির্বাচনের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলেন,”আপনি কতটি আসনে জয়ী হবার আশা করেন?” শেখ মুজিবুর রহমান আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিয়েছিলেন,”আমি অবাক হবো, যদি আমি দুটি আসনে হেরে যাই।” আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় ১৬৭টি আসনে।
কিন্তু একদিকে আওয়ামী লীগ যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো আসনে জিততে ব্যর্থ হয়, ঠিক তেমনি পাকিস্তান পিপলস পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে জিততে পারেনি একটি আসনেও। কিন্তু পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বেশ ভালোভাবে সুযোগটি লুফে নিলেন।
তিনি প্রচার করে বেড়ালেন শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের ম্যান্ডেট না নিয়ে কোনোক্রমেই সরকার গঠন করতে পারেন না। শেখ মুজিবের হাতে পাকিস্তানের ক্ষমতা চলে যাবে এই দৃশ্য দেখতে তিনি কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তখনও গদিতে বসে থাকা ইয়াহিয়া খানকে নিজের নির্বাচনী আসন লারকানায় আমন্ত্রণ জানালেন ভুট্টো। আর সেই আলোচনাতেই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার আভাস পেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নাকানি চুবানি খাওয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী,
“সত্তরের নির্বাচনের পরে বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকা গ্রহণের জন্য ভুট্টো কোনোক্রমেই প্রস্তুত ছিলেন না। তার মনোভাব দেখে ধারণা করা হচ্ছিলো শেখ মুজিবের সরকার গঠনের নায্য দাবী একমাত্র তখনই বাস্তবায়ন সম্ভব যদি, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যায়। লারকানাতে জেনারেল ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর এই আলোচনাতেই হয়তো পাকিস্তানের ভাঙ্গনের নীলনকশনার সূচনা হয়ে গিয়েছিলো। ” 1
তাহলে কী ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের শেষ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের ভবিষ্যতবাণীটাই একটু একটু করে ফলে যাচ্ছে? যিনি ভারত ছাড়ার সময় বলে গিয়েছিলেন,
“পূর্ব পাকিস্তান হয়তো এই শতাব্দীর এক চতুর্থাংশের মধ্যেই পাকিস্তান থেকে বিছিন্ন হয়ে যাবে।” 2
কিন্তু কী এমন হয়েছিলো, যার ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে বাঙালিরা নিজেদের জমানো ক্ষোভ ঢেলে দিয়েছিলো ব্যালট পেপারে?
দীর্ঘদিন ধরে দানা বাঁধছে ক্ষোভ
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের ফলে জন্ম নেওয়া দুটি দেশের একটি এই পাকিস্তান। দেশটির পশ্চিম অংশ রুক্ষ, শুষ্ক আর অনুর্বর। তবে সুদূর পূর্ব অংশটি নদী বিধৌত পৃথিবীর উর্বরতম এক অঞ্চল। পাট উৎপাদনে অদ্বিতীয় ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। আর প্রত্যাশিতভাবেই ভারতবর্ষ ভাগের পর অর্থনৈতিকভাবে বেশ এগিয়েই ছিলো পূর্বাংশ। ১৯৪৮ সালের হিসাব অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে কাপড়ের কল ছিল এগারোটি আর পশ্চিম পাকিস্তানে নয়টি। কিন্তু ১৯৭১ সাল নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানে কাপড়ের কল দাঁড়ায় ছাব্বিশটি আর পশ্চিমে দেড়শটি!
একদিকে যখন রাস্তাঘাট আর অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটছে অন্যদিকে তখন বাসা বাঁধছে অনাহার আর দারিদ্র্য। পূর্ববঙ্গের নিজস্ব শিল্পগুলো ক্রমান্বয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে বিনিয়োগের অভাবে। পূর্ব পাকিস্তানের যৎসামান্য শিল্প কারখানা যা ছিলো তার মালিক বেশিরভাগই পশ্চিম পাকিস্তানী। কোনো এক অদ্ভুত কারণে পূর্ব থেকে পশ্চিমে টাকা-পয়সা নিয়ে যেতে বাধা ছিলো না। কিন্তু পশ্চিম থেকে পূর্বে টাকা নেওয়ার সময়ই ছিলো যত সরকারী বিধি নিষেধ।
ইংরেজ থেকে পাকিস্তান, শুধুই কি প্রভু বদল?
১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের মনে দেশভাগের বিভীষিকা পর একপশলা শান্তি বিরাজ করছিলো। নতুন দেশ, হাজারো কর্মসংস্থান, নতুন স্বপ্ন, হাজারো স্বপ্ন। এসব প্রথম ধাক্কা খায় যখন সর্বক্ষেত্রে পশ্চিমের লোকদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছিলো। সামরিক ক্ষেত্রে চাকরী দেওয়ার বৈষম্যটা চোখে পড়ার মতো। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর শতকরা নব্বই জন পশ্চিম থেকে নেয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারী চাকরির পরিসংখ্যান দেখে যে কারো পিলে চমকে উঠবে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাত্র ১৬ শতাংশ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে সরকারী চাকরিতে। বাকি ৮৪ শতাংশই পশ্চিম থেকে। সেনাবাহিনীর ১৭ জন জেনারেলের মধ্যে বাঙালির সংখ্যাটা ১ জন। তাহলে প্রশ্ন জাগতেই পারে- বাঙালি কি সংখ্যায় কম ছিলো নাকি শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে ছিলো?
শিক্ষা, নেতৃত্ব কিংবা লোকবল কোথায় পিছিয়ে ছিলো বাঙালিরা?
পুরো পাকিস্তানের প্রায় ৫৬ শতাংশ মানুষের বসবাস ছিলো পূর্ব বাংলায়। এদের সবাই বাংলা ভাষাভাষী। নতুন দেশের রাষ্ট্রীয় কাজ কিংবা বই পুস্তকের ভাষার প্রশ্নেই প্রথম আঘাত আসে বাংলার উপর। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের পর মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা গেলেও বাঙালিকে কৌশলে পিছনে রাখতে কম তোড়জোড় হয়নি।
১৯৫৫-৬৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষা খাতে দুই পাকিস্তানের তুলনা করে দেখলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই সময়কালে পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ হয়েছে ২,০৮৪ মিলিয়ন রুপি সেখানে পূর্বাংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কপালে জুটেছে ৭৯৭ মিলিয়ন রুপি। বঞ্চনা আর সীমাবদ্ধতার পাহাড় সমান বাধা পাড়ি দিয়ে যারা শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরির আশায় বুক বাঁধতেন, তারাও দেখতেন অফিস-আদালত আর গুরুত্বপূর্ণ সব পদ যেন সরিয়ে রাখা হয়েছে পশ্চিমে।
নতুন দেশ পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রের লাগাম যখন পশ্চিমে তখন সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেও মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে বাঙালি যুবকদের। আর যারা সেই বাধাও অতিক্রম করেছেন তারা সেখানে শিকার হয়েছেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা ধরনের বৈষম্যের। নিজ দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে কর্মস্থলে অবন্ধুসুলভ পরিবেশে বার বার ছিটকে পড়েছে বাঙালিরা। ১৯৬২ সালের এক হিসেবানুযায়ী, পাকিস্তানের মন্ত্রণালয়গুলোর ৯৫৪ জন শীর্ষ কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ১১৯ জন।
উন্নয়ন নাকি বঞ্চনা?
১৯৭১ সালে সাংবাদিক চার্লস স্মিথ ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ নামক পত্রিকায় সাংবাদিক চার্লস স্মিথ পাকিস্তানের এই ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে’র জন্য অনেকটা সহানুভুতি নিয়েই লিখেছিলেন,
“পূর্ববঙ্গ যদি পৃথিবীর আটটি দরিদ্রতম দেশের মধ্যে একটি হয়, তবে তার কিছুটা কারণ এই যে, এটি পাকিস্তানের একটি অংশ”
পাকিস্তানের রপ্তানী আয়ের সিংহভাগই আসতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন ১৯৪৭-৭০ পর্যন্ত পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিলো ৫৪.৭%। কিন্তু পূর্বের মানুষের বিধি বাম। শুরু থেকেই নীতি নির্ধারণীতে বসে আছে পশ্চিমের লোকেরা। পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচির উন্নয়নের জন্যে ১৯৫৬ সালে বরাদ্দ ছিলো ৫৭০ কোটি রুপি। মোট সরকারি ব্যয়ের ছাপান্ন শতাংশই ছিলো রাজধানীর জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাড়া করে বেড়ানো পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিলো মোট সরকারি ব্যয়ের পাঁচ শতাংশ।
শেকল ভাঙ্গার গান
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জিতেও বাঙালিরা যখন সরকার গঠন করতে পারেনি, তখনই দানা বাঁধা ক্ষোভ পরিণত হয় জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ টিকে থাকবে কিনা এই নিয়েও ছিলো অনেকের মনে সন্দেহ। বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রের নেতা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা সবাই এই রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নিয়েই সন্দেহ করেছিলো।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তো একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে বলে গিয়েছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক এক তলাবিহীন ঝুড়ি’।
ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, সত্যিকার অর্থেই ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন ছিলো। দেশজুড়ে শত শত ভাঙ্গা ব্রিজ আর কালভার্ট। সড়ক আর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বিপন্ন। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো প্রায় এক কোটি শরণার্থী। তারাও স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসছিলো দলে দলে। মানুষের মুখে খাবার নেই, পরিধানের কাপড় নেই। স্বাধীনতার কয়েক দশকের মধ্যেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক শিল্পের বাজারে নিজেকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয় সহ প্রায় সব সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকেও এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় যেখানে ১,৫৩৮ মার্কিন ডলার, সেখানেপাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ১,৪৭০ ডলার। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু যেখানে ছিলো ৫০ বছরেরও কম, সেখানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। শিক্ষা, জিডিপি কিংবা ব্যবসা বাণিজ্যের আর্থ-সামাজিক সূচকগুলোতে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। শত বাধা আর প্রতিকূলতার মাঝেও বাংলাদেশের উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক এমনটাই প্রত্যাশা এ দেশের কোটি কোটি জনতার।
তথ্যসূত্র
- Owen Bennett-Jones (2003). Pakistan: Eye of the Storm. Yale University Press. Page:164
- Owen Bennett-Jones (2003). Pakistan: Eye of the Storm. Yale University Press. Page:159
ফিচার ইমেজ: dawn.com