পটভূমি
তারিখ হিসেবে ৭ মার্চ ঐতিহাসিকতার মর্যাদা একদিনেই হঠাৎ করে পায়নি। পেছনে তাকালে চোখে পড়বে বিস্তর এক শোষণ এবং পরাধীনতার গল্প, যে গল্পের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যেদিন বাংলাকে খণ্ডিত করে উপমহাদেশীয় রাজনীতির রথী-মহারথীগণ খেললেন ভাগ-বাটোয়ারার খেলা। দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ভারতকে ভাগ করে সৃষ্টি করা হল নতুন একটি দেশ-পাকিস্তান।
ধর্মের ভিত্তিতে করা এ বিভাজনে হাস্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হল। পূর্ব বাংলা থেকে কয়েক লাখ হিন্দু পরিবারকে শুধু তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে দেশত্যাগে বাধ্য করা হল। ভারত ১৯৫০ সালে গৃহীত তার সংবিধানে অসাম্প্রদায়িকতাকে প্রাধান্য দিলেও নবসৃষ্ট পাকিস্তান তা দেয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের নামকরণ করা হল ইসলামী-জমহুরিয়াহ-পাকিস্তান। পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে করা হল পূর্ব পাকিস্তান। এর মধ্যে ভাষা আন্দোলন হয়ে গেল। বাংলা পাকিস্তানের আরেকটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল আন্দোলনের চার বছর পর ১৯৫৬ সালে।
মূলত ভাষা আন্দোলনের পরেই বাঙালির বোধোদয় হয়। ধর্মের যে আফিম খাইয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সুজলা-সুফলা বাংলাকে শোষণ করে পশ্চিমে বড় বড় কারখানা-ইমারত গড়েছে, বাঙালিদের কাছে সে বৈষম্য চোখে পড়া শুরু হল। পশ্চিমা আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে বাংলার উন্নয়ন মন্থর গতি লাভ করল এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিটি মন্ত্রক ও দপ্তরে বাঙালিরা চরম বৈষম্যের শিকার হল। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বাঙালিদের শোষণ করা শুরু করল পশ্চিমারা। ক্ষোভ দানা বাধতে শুরু করল। শুরু হলো ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক বিক্ষোভ, অসহযোগিতা। ’৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে পেশ করলেন ‘বাঙালির মুক্তির সনদ – ঐতিহাসিক ৬ দফা’। পাকিস্তানের রাজনীতিকেরা সেটি ভালো চোখে দেখলেন না।
’৬৯ সালে শুরু হল স্বৈরাচারী আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন। পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণ সে আন্দোলনে সায় দিল এবং সরাসরি তাতে অংশগ্রহণ করল। আন্দোলন একপর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিল। তীব্র আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান শাহী গদি ছাড়তে বাধ্য হলেন। তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পর্দার আড়ালে চলে গেলেন। শুরু হল আরেক স্বৈরাচারের শাসনামল।
ইয়াহিয়া খান আন্দোলনের তীব্রতায় ঘাবড়ে গিয়ে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের দাবিটি মেনে নিলেন। পরের বছর ১৯৭০ সালে একসাথে দুই পাকিস্তানে ভোট গ্রহণের আশ্বাস দিলে আন্দোলনকারীরা কিছুটা শান্ত হয়। জাতীয় পরিষদের মোট আসন ৩১৩টি। পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা পশ্চিমের তুলনায় বেশি হওয়ায় আসন বণ্টনকালে পূর্ব পাকিস্তানে আসন রাখা হল ১৬২টি আর পশ্চিম পাকিস্তানে রাখা হল ১৩৮ টি (সংরক্ষিত নারী আসনগুলো বাদে)।
মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় দুই পাকিস্তানের বৃহৎ দুটি দলের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে সেটিই ছিল পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের ভেতর ১৬৭টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পশ্চিমের নেতা ও আমলাদের মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম হয় নির্বাচনের ফলাফল দেখে।
একদিকে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিক ও আমলারা বসে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা আঁকতে শুরু করে। ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন সিএমএলএ (চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর) ইয়াহিয়া খান। আওয়ামী লীগের নেতাবৃন্দও বুঝে যান সোজা আঙুলে ঘি উঠবার নয়। নির্বাচনের পরের বছর ’৭১ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এক সভা করেন এবং সকলে মিলে শপথ করেন যে সরকার গঠন করলে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে এবং জনগণের রায়কে সবার উর্ধ্বে মর্যাদা দেওয়া হবে। এভাবে, শেখ মুজিব ও তার দল সব ধরনের রাজনৈতিক চাপকে উপেক্ষা করে ৬ দফার প্রতি অটল থাকার ব্যবস্থা করে নেন।
পরবর্তী মাসের ১৩ তারিখ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হয় ৩ মার্চ। তার দু’দিন বাদে জেড এ ভুট্টো সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দেন, তিনি এবং তার দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবেন না, কারণ পূর্ব পাকিস্তানিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে দেশের জাতীয়তার ভারসাম্য নষ্ট হবে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা হুমকির সম্মুখীন হবে, এবং তীব্র অসন্তোষ দেখা দেবে পশ্চিম পাকিস্তানে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কথায় তার পদক্ষেপে পরিবর্তন আনা শুরু করলেন। ১ মার্চ বেতারে তিনি ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেন। পূর্ব পাকিস্তানে প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়। ‘তোমার আমার ঠিকানা– পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি স্লোগানে জনতা মুখর হওয়া শুরু করে, মিছিল করা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। সেদিনের সব মিছিল এসে মিলিত হয় ঢাকার পূর্বাণী হোটেল চত্বরে যেখানে আওয়ামী লীগের নেতারা বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে সরকার গঠন ও কর্মপন্থা প্রণয়ণের উদ্দেশ্যে বৈঠক করছিলেন।
ইয়াহিয়ার ভাষণের পরে শেখ মুজিব সংসদীয় বিষয় সমন্ধীয় বৈঠক স্থগিত রেখে সাংবাদিকদের ব্রিফ করা শুরু করেন। ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রমনা রেসকোর্স মাঠে সর্বস্তরীয় জনসভার ডাক দেন। রিপোর্টারদের কেউ কেউ জিগ্যেস করেন, ‘আপনি কি সেদিন একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন?’
উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, “অপেক্ষা করুন, আমার জনগণ আমার সঙ্গে আছে। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আমরা ভালোর আশা করছি তবে মন্দের জন্যেও প্রস্তুত আছি। বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াই চলবে। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য কোনো ত্যাগই বড় নয়।”
ভাষণ রেকর্ডিং, প্রচার ও অন্যান্য
সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিওটি রেকর্ড করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা আবুল খায়ের। তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে ফরিদপুর-৫ সংসদীয় আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন আবার একইসাথে ছিলেন পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক। ভাষণের অডিওটি রেকর্ড করেছিলেন এইচ. এন. খোন্দকার। পরে সেটি আবুল খায়েরের মালিকানাধীন রেকর্ড লেভেল ঢাকা আর্কাইভ করেছিল। আর্কাইভের পরে অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের এক কপি বঙ্গবন্ধুকে প্রদান করা হয় এবং এক কপি ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভারতের এইচএমভি রেকর্ড সেটি আর্কাইভ করে তিন হাজার অনুলিপি তৈরি করে। পরে সেগুলো বিশ্বজুড়ে বিতরণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি পাকিস্তান সরকার ৭ তারিখে প্রচারের অনুমতি দেয়নি। চাপের মুখে পড়ে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল একদিন পরে। দেশবাসী সেটি শুনেছিলেন পরেরদিন। মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাত এ ভাষণ। প্রতিটি বাঙালির রন্ধ্রে সংগ্রামের বহ্নি জ্বেলে দেয় এ ভাষণ। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এ ভাষণের রেকর্ড বাজিয়ে বাজিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করতেন। পৃথিবীর প্রতিটি সংগ্রামী, শাসিত-শোষিতের অনুপ্রেরণা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ।
‘নিউজউইক’ নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল তার ঐতিহাসিক ভাষণের কারণে। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল প্রকাশিত সংখ্যার প্রচ্ছদজুড়ে তারা বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপিয়ে লিড নিউজের শিরোনাম করে ‘Poet of Politics’। সেটির মাধ্যমেও ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিকতা লাভ করেছিল।
ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ভাষণটি মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার-এর অন্তর্ভুক্ত করে। ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় এবং এর তাৎপর্য বিশ্ববাসীও অনুধাবন করা শুরু করে। ৭ মার্চের ভাষণকে তুলনা করা হয় আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গের ভাষণের সাথে। কলেবর ও দর্শকশ্রোতার দিক দিয়ে ৭ মার্চের ভাষণটি গেটিসবার্গের ভাষণ থেকে বড়। গেটিসবার্গ ভাষণের থেকে এ ভাষণ যে জায়গাটিতে স্বাতন্ত্র্য সেটি হচ্ছে- এটি একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের নির্দেশনা হিসেবে প্রদান করা হয় এবং এ ভাষণ বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে জ্বলন্ত ধূমকেতুর ন্যায় অনন্য ও চিরঞ্জীব।
পরিশেষে, কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করি।
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে উঠিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা; কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি;
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।